কোরমা রেসিপি
আচ্ছা, কোরমা শুনলেই জিভে জল আসে, তাই না? বিয়েবাড়ি থেকে শুরু করে যেকোনো অনুষ্ঠানে, কোরমা যেন এক অপরিহার্য পদ। কিন্তু সব কোরমা কি এক রকম হয়? একদমই না! একেক জনের হাতের কোরমার স্বাদ একেক রকম। আজ আমি আপনাদের সাথে শেয়ার করব আমার নিজের স্পেশাল কোরমা রেসিপি, যা একবার খেলে আপনি বারবার বানাতে চাইবেন।
কোরমা: স্বাদের এক রাজত্ব
কোরমা শুধু একটি রান্না নয়, এটি একটি ঐতিহ্য। মুঘলদের হাত ধরে আসা এই পদটি এখন আমাদের সংস্কৃতির অংশ। হালকা মিষ্টি আর মশলার এক অপূর্ব মিশ্রণ, যা যেকোনো অনুষ্ঠানে এক নতুন মাত্রা যোগ করে।
কোরমার প্রকারভেদ
কোরমা বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যেমন:
- চিকেন কোরমা
- মাটন কোরমা
- বিফ কোরমা
- সবজির কোরমা
তবে আজ আমরা আলোচনা করব শাহী চিকেন কোরমা নিয়ে, যা সহজেই তৈরি করা যায় এবং স্বাদে অতুলনীয়।
শাহী চিকেন কোরমা: রেসিপি
শাহী চিকেন কোরমা তৈরি করতে কী কী লাগবে, চলুন দেখে নেওয়া যাক:
উপকরণ
- চিকেন: ১ কেজি (মাঝারি সাইজের টুকরা)
- পেঁয়াজ কুচি: ২ কাপ
- আদা বাটা: ২ টেবিল চামচ
- রসুন বাটা: ১ টেবিল চামচ
- টক দই: ১ কাপ
- কাজু বাদাম বাটা: ২ টেবিল চামচ
- পোস্ত দানা বাটা: ১ টেবিল চামচ
- পেস্তা বাদাম কুচি: ১ টেবিল চামচ
- জাফরান: ১ চিমটি (গরম দুধে ভেজানো)
- এলাচ: ৪-৫টি
- দারুচিনি: ২-৩টি
- লবঙ্গ: ৪-৫টি
- তেজপাতা: ২টি
- সর্ষের তেল: ৪ টেবিল চামচ
- ঘি: ১ টেবিল চামচ
- চিনি: ১ চা চামচ (ইচ্ছা অনুযায়ী)
- নুন: স্বাদমতো
- লাল লঙ্কার গুঁড়ো: ১ চা চামচ (ইচ্ছা অনুযায়ী)
- ধনে গুঁড়ো: ১ চা চামচ
- গরম মশলা গুঁড়ো: ১/২ চা চামচ
- কেওড়া জল: ১ চা চামচ
প্রস্তুত প্রণালী
- প্রথমে চিকেনের টুকরোগুলোকে ভালো করে ধুয়ে নিন। তারপর তাতে আদা বাটা, রসুন বাটা, টক দই, নুন ও সামান্য লাল লঙ্কার গুঁড়ো দিয়ে ম্যারিনেট করে অন্তত ৩০ মিনিটের জন্য রেখে দিন।
- একটি পাত্রে সর্ষের তেল ও ঘি গরম করুন। তাতে এলাচ, দারুচিনি, লবঙ্গ ও তেজপাতা দিয়ে কিছুক্ষণ ভেজে নিন।
- পেঁয়াজ কুচি যোগ করে হালকা সোনালী হওয়া পর্যন্ত ভাজুন।
- ম্যারিনেট করা চিকেন যোগ করে মাঝারি আঁচে ভালোভাবে কষিয়ে নিন, যতক্ষণ না তেল উপরে ভেসে আসে।
- কাজু বাদাম বাটা, পোস্ত দানা বাটা, ধনে গুঁড়ো, লাল লঙ্কার গুঁড়ো এবং গরম মশলা গুঁড়ো দিয়ে আরও কিছুক্ষণ কষান।
- পরিমাণ মতো গরম জল যোগ করে ঢাকনা দিয়ে দিন এবং ২০-২৫ মিনিট রান্না করুন, যতক্ষণ না চিকেন সেদ্ধ হয়ে যায়।
- জাফরান ভেজানো দুধ, পেস্তা বাদাম কুচি এবং কেওড়া জল যোগ করে আরও ৫ মিনিট রান্না করুন।
- চিনি ও নুন স্বাদমতো যোগ করুন।
- গরম ভাত, পোলাও বা পরোটার সাথে পরিবেশন করুন শাহী চিকেন কোরমা।
কোরমা রান্নার কিছু টিপস ও ট্রিকস
কোরমা রান্না করার সময় কিছু জিনিস মনে রাখলে স্বাদ আরও বাড়ানো যায়:
- মাংস ম্যারিনেট করার সময় টক দইয়ের ব্যবহার মাংসকে নরম করে এবং মশলার স্বাদ ভালোভাবে ঢোকাতে সাহায্য করে।
- পেঁয়াজ বেরেস্তা করে ব্যবহার করলে কোরমার স্বাদ আরও বাড়ে।
- যদি গ্রেভি ঘন করতে চান, তবে আরও কিছুটা কাজু বাদাম বাটা যোগ করতে পারেন।
- কোরমাতে মিষ্টি স্বাদ পছন্দ না করলে চিনি বাদ দিতে পারেন।
- সব সময় অল্প আঁচে রান্না করলে মাংস ভালোভাবে সেদ্ধ হয় এবং মশলার সুগন্ধ বজায় থাকে।
কোরমা রান্নার সময় সাধারণ ভুলগুলো
কোরমা রান্নার সময় কিছু ভুল হতে পারে, যা এড়িয়ে যাওয়া উচিত:
- অতিরিক্ত মশলা ব্যবহার করা: অতিরিক্ত মশলা ব্যবহার করলে কোরমার আসল স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়।
- কম আঁচে রান্না না করা: কম আঁচে রান্না না করলে মাংস ভালোভাবে সেদ্ধ হয় না।
- টক দইয়ের পরিমাণ বেশি দেওয়া: টক দইয়ের পরিমাণ বেশি হলে কোরমা টক হয়ে যেতে পারে।
কোরমা: স্বাস্থ্য ও পুষ্টিগুণ
কোরমা শুধু স্বাদের দিক থেকেই সেরা নয়, এর কিছু স্বাস্থ্য উপকারিতাও রয়েছে।
কোরমার পুষ্টি উপাদান
কোরমাতে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, ভিটামিন ও মিনারেল থাকে। এটি শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ করে।
উপাদান | পরিমাণ (১০০ গ্রাম) |
---|---|
ক্যালোরি | প্রায় ২৫০-৩০০ |
প্রোটিন | ২০-২৫ গ্রাম |
ফ্যাট | ১৫-২০ গ্রাম |
কার্বোহাইড্রেট | ৫-১০ গ্রাম |
ক্যালসিয়াম | প্রায় ৫০-৭০ মিগ্রা |
আয়রন | প্রায় ১-২ মিগ্রা |
কোরমার স্বাস্থ্য উপকারিতা
- প্রোটিনের উৎস: কোরমা প্রোটিনের একটি ভালো উৎস, যা শরীরের মাংসপেশি গঠনে সাহায্য করে।
- ভিটামিন ও মিনারেল: এটি ভিটামিন বি, ক্যালসিয়াম ও আয়রনের একটি উৎস, যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
- হাড়ের স্বাস্থ্য: ক্যালসিয়াম হাড়ের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে।
কোরমা পরিবেশন
কোরমা পরিবেশনের সময় কিছু বিষয় মনে রাখলে খাবারের স্বাদ আরও বাড়ানো যায়।
কোরমার সাথে কী পরিবেশন করবেন?
কোরমা সাধারণত পোলাও, সাদা ভাত, নান বা পরোটার সাথে পরিবেশন করা হয়। এছাড়াও রায়তা ও সালাদ যোগ করলে খাবারের স্বাদ আরও বেড়ে যায়।
পরিবেশনের টিপস
- গরম গরম পরিবেশন করুন, যাতে স্বাদ ও গন্ধ বজায় থাকে।
- পরিবেশনের আগে উপরে পেস্তা বাদাম কুচি ও জাফরান দিয়ে সাজিয়ে দিন।
- পাশে রায়তা বা সালাদ পরিবেশন করুন, যা খাবারের স্বাদকে ব্যালেন্স করবে।
কোরমা রেসিপি নিয়ে কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ)
কোরমা নিয়ে আপনাদের মনে কিছু প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক। তাই নিচে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
কোরমা কি শুধু বিয়েবাড়িতেই ভালো লাগে?
মোটেই না! কোরমা যে কোনো অনুষ্ঠানে বা দাওয়াতে পরিবেশন করা যায়। এটি একটি ক্লাসিক পদ, যা সব অনুষ্ঠানেই মানানসই।
কোরমা তৈরিতে কি বেশি সময় লাগে?
উপকরণ হাতের কাছে থাকলে কোরমা তৈরি করতে খুব বেশি সময় লাগে না। প্রস্তুতি এবং রান্না মিলিয়ে প্রায় এক ঘণ্টা সময় লাগে।
কোরমা কি স্বাস্থ্যকর?
কোরমাতে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন থাকে এবং এটি শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও মিনারেলের উৎস। তবে, যেহেতু এটি মশলাযুক্ত খাবার, তাই পরিমিত পরিমাণে খাওয়া ভালো।
কোরমা কতদিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়?
কোরমা সাধারণত ২-৩ দিন পর্যন্ত ফ্রিজে সংরক্ষণ করা যায়। তবে, টাটকা কোরমা খাওয়াই ভালো, যাতে স্বাদ ও গন্ধ বজায় থাকে।
কোরমা রান্নার জন্য কোন তেল ভালো?
কোরমা রান্নার জন্য সর্ষের তেল এবং ঘিয়ের মিশ্রণ ব্যবহার করা ভালো। এতে কোরমার স্বাদ আরও বাড়ে।
কোরমা কি নিরামিষ হতে পারে?
হ্যাঁ, সবজি দিয়ে কোরমা তৈরি করা যায়। সেক্ষেত্রে মাংসের পরিবর্তে ফুলকপি, গাজর, পটল, আলু ইত্যাদি সবজি ব্যবহার করতে পারেন।
কোরমা রান্নার সময় দই ব্যবহার না করলে কি হবে?
দই কোরমার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। এটি মাংসকে নরম করে এবং মশলার স্বাদ ভালোভাবে মিশিয়ে দেয়। দই ব্যবহার না করলে কোরমার স্বাদ তেমন ভালো হবে না।
কোরমাতে কি চিনি দেওয়া জরুরি?
কোরমাতে সামান্য চিনি দেওয়া হয় স্বাদের ব্যালেন্সের জন্য। তবে, আপনি যদি মিষ্টি স্বাদ পছন্দ না করেন, তবে চিনি বাদ দিতে পারেন।
কোরমা রান্নার সময় কি কোনো বিশেষ মশলা ব্যবহার করা হয়?
কোরমা রান্নার সময় সাধারণত এলাচ, দারুচিনি, লবঙ্গ এবং তেজপাতা ব্যবহার করা হয়। এছাড়া, কাজু বাদাম বাটা এবং পোস্ত দানা বাটা কোরমার স্বাদ বাড়াতে সাহায্য করে।
কোরমা এবং রেজালা মধ্যে পার্থক্য কি?
কোরমা এবং রেজালা দুটোই মুঘলাই রান্না তবে এদের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। কোরমা সাধারণত হালকা মিষ্টি হয় এবং এতে বাদাম ও দুগ্ধজাতীয় উপকরণ ব্যবহার করা হয়। অন্যদিকে, রেজালাতে টক দই ও অন্যান্য মশলার ব্যবহার বেশি থাকে, যা এটিকে একটু ভিন্ন স্বাদ দেয়।
উপসংহার
কোরমা নিঃসন্দেহে একটি অসাধারণ খাবার, যা যেকোনো অনুষ্ঠানে আনন্দ যোগ করে। আমি চেষ্টা করেছি সহজভাবে কোরমা রেসিপিটি আপনাদের সামনে তুলে ধরতে। আশা করি, এই রেসিপিটি অনুসরণ করে আপনিও খুব সহজে শাহী চিকেন কোরমা তৈরি করতে পারবেন এবং পরিবারের সবাইকে খাওয়াতে পারবেন। তাহলে আর দেরি কেন, আজই তৈরি করে ফেলুন আর জানান কেমন হলো! আর হ্যাঁ, আপনার স্পেশাল কোরমা রেসিপি থাকলে আমাদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না।