পোলাওয়ের সুবাসে ম ম করছে আপনার রান্নাঘর, ভাবতেই জিভে জল আসছে? পোলাও এমন একটা খাবার, যা একইসাথে রাজকীয় আবার ঘরোয়া। বিয়েবাড়ি থেকে শুরু করে যেকোনো অনুষ্ঠানে পোলাওয়ের কদর থাকে সবসময়। আর ছুটির দিনে নিজের হাতে সুস্বাদু পোলাও রান্না করে পরিবারের সবাইকে খাওয়ালে মনটা ভরে যায়, তাই না?
পোলাও রান্না করাটা কঠিন কিছু নয়, শুধু দরকার সঠিক রেসিপি আর কিছু টিপস। আমি আজ আপনাদের সাথে শেয়ার করব পারফেক্ট পোলাও রান্নার রেসিপি, যা অনুসরণ করে আপনিও হয়ে উঠতে পারেন পোলাও রান্নায় এক্সপার্ট! তাহলে চলুন, শুরু করা যাক!
পারফেক্ট পোলাও রান্নার উপকরণ
পোলাও রান্নার আগে হাতের কাছে সব উপকরণ গুছিয়ে নিলে রান্নাটা সহজ হয়ে যায়। তাহলে দেখে নিন কি কি লাগবে:
- বাসমতী চাল – ২ কাপ (ভালো মানের বাসমতী চাল পোলাওয়ের স্বাদ বাড়ায়)
- পেঁয়াজ কুচি – ১/২ কাপ
- আদা বাটা – ১ টেবিল চামচ
- রসুন বাটা – ১ চা চামচ
- পেঁয়াজ বেরেস্তা – ১/২ কাপ (সাজানোর জন্য)
- গরম মশলা (এলাচ, দারুচিনি, লবঙ্গ) – কয়েকটি
- কাঁচা মরিচ – ৪-৫টি (স্বাদ অনুযায়ী)
- ঘি – ২ টেবিল চামচ (ঘি পোলাওয়ের স্বাদ ও সুগন্ধ দুটোই বাড়ায়)
- সাদা তেল – ১ টেবিল চামচ
- নুন – স্বাদমতো
- চিনি – ১/২ চা চামচ (ইচ্ছা অনুযায়ী)
- গরম জল – ৪ কাপ (চালের দ্বিগুণ)
- কেওড়া জল – ১ চা চামচ (ইচ্ছা অনুযায়ী, তবে দিলে সুন্দর একটা ফ্লেভার আসে)
- জাফরান – সামান্য (দুধে ভেজানো, এটা পোলাওয়ের রং সুন্দর করে)
পোলাও রান্নার সহজ পদ্ধতি
এবার আসি কিভাবে সহজে পারফেক্ট পোলাও রান্না করবেন সেই বিষয়ে। আমি নিজে যেভাবে রান্না করি, সেটাই আপনাদের সাথে শেয়ার করছি:
চাল ধোয়া ও প্রস্তুতি
- প্রথমে বাসমতী চাল ভালো করে ২-৩ বার ধুয়ে নিন। এতে চালের অতিরিক্ত স্টার্চ দূর হয়ে যায় এবং পোলাও ঝরঝরে হয়।
- ধুয়ে নেওয়া চাল ৩০ মিনিটের জন্য ঠান্ডা পানিতে ভিজিয়ে রাখুন। এতে চালগুলো নরম হবে এবং রান্না করার সময় সহজে ভেঙে যাবে না।
মশলা তৈরি ও চাল ভাজা
- একটি পাত্রে ঘি ও তেল গরম করুন। ঘিয়ের সুগন্ধ ছড়ালে পেঁয়াজ কুচি দিন এবং হালকা সোনালী হওয়া পর্যন্ত ভাজুন।
- পেঁয়াজ ভাজা হয়ে গেলে আদা বাটা ও রসুন বাটা দিয়ে কিছুক্ষণ ভাজুন, যতক্ষণ না কাঁচা গন্ধ চলে যায়।
- গরম মশলা ও কাঁচামরিচ দিয়ে একটু নেড়ে ভিজিয়ে রাখা চাল দিন। চালগুলো হালকা করে ভাজুন, যতক্ষণ না সেগুলো একটু শুকনো হয়ে আসে। চাল ভাজলে পোলাও ঝরঝরে হয়।
জল ও অন্যান্য উপকরণ মেশানো
- গরম জল, নুন ও চিনি দিয়ে ভালো করে মিশিয়ে নিন। জলের পরিমাণটা সঠিক হওয়া খুব জরুরি। সাধারণত, চালের দ্বিগুণ জল ব্যবহার করা হয়।
- যখন জল ফুটে উঠবে, তখন আঁচ কমিয়ে দিন এবং পাত্রটি ঢেকে দিন।
দমে রান্না
- পোলাও ২০-২৫ মিনিটের জন্য দমে রান্না করুন। মাঝে মাঝে ঢাকনা খুলে আলতো হাতে নেড়ে দিন, যাতে পোলাও নিচে লেগে না যায়।
- যখন দেখবেন জল শুকিয়ে গেছে এবং চাল সেদ্ধ হয়ে নরম হয়েছে, তখন কেওড়া জল ও জাফরান মেশানো দুধ দিয়ে দিন।
- আরও ৫-১০ মিনিটের জন্য দমে রাখুন। এরপর চুলা বন্ধ করে দিন এবং পোলাও পরিবেশনের জন্য প্রস্তুত।
পরিবেশন
- পোলাও পরিবেশনের আগে পেঁয়াজ বেরেস্তা দিয়ে সাজিয়ে দিন।
- গরম গরম সুস্বাদু পোলাও মাংস, ডিম অথবা সবজির সাথে পরিবেশন করুন।
পোলাও রান্নার কিছু দরকারি টিপস
পোলাও রান্না করার সময় কিছু জিনিস মনে রাখলে আপনার পোলাও হবে পারফেক্ট:
- সব সময় ভালো মানের বাসমতী চাল ব্যবহার করুন।
- চাল ধোয়ার পরে অন্তত ৩০ মিনিট ভিজিয়ে রাখুন।
- ঘি ব্যবহার করলে পোলাওয়ের স্বাদ এবং সুগন্ধ দুটোই বাড়ে।
- গরম জল ব্যবহার করলে পোলাও তাড়াতাড়ি সেদ্ধ হয়।
- দমে রান্না করার সময় খেয়াল রাখুন, যাতে পোলাও নিচে লেগে না যায়।
- পরিবেশনের আগে পেঁয়াজ বেরেস্তা দিয়ে সাজিয়ে দিন, এতে দেখতে সুন্দর লাগবে।
পোলাওয়ের স্বাদ বাড়াতে কিছু অতিরিক্ত উপকরণ
পোলাওয়ের স্বাদ আরও একটু বাড়াতে চান? তাহলে কিছু অতিরিক্ত উপকরণ যোগ করতে পারেন:
- কিসমিস ও বাদাম: চাল ভাজার সময় কিসমিস ও বাদাম যোগ করলে পোলাওয়ের স্বাদ বেড়ে যায়।
- সবজি: গাজর, মটরশুঁটি, ফুলকপি বা আপনার পছন্দের সবজি যোগ করে পোলাওকে আরও পুষ্টিকর করতে পারেন।
- মাংস: চিকেন বা মাটন কিমা যোগ করে পোলাওকে আরও সুস্বাদু করতে পারেন।
বিভিন্ন ধরনের পোলাও রেসিপি
পোলাও তো অনেক রকমের হয়, তাই না? আপনাদের জন্য কয়েকটা জনপ্রিয় পোলাওয়ের রেসিপি নিচে দেওয়া হলো:
চিকেন পোলাও
চিকেন পোলাওয়ের জন্য প্রথমে চিকেন মেরিনেট করে ভেজে নিতে হয়। এরপর চালের সাথে চিকেন মিশিয়ে রান্না করতে হয়।
উপকরণ:
- বাসমতী চাল – ২ কাপ
- চিকেন – ২৫০ গ্রাম (ছোট টুকরা করা)
- পেঁয়াজ কুচি – ১/২ কাপ
- আদা বাটা – ১ টেবিল চামচ
- রসুন বাটা – ১ চা চামচ
- গরম মশলা – পরিমাণ মতো
- কাঁচা মরিচ – ৪-৫টি
- ঘি – ২ টেবিল চামচ
- সাদা তেল – ১ টেবিল চামচ
- নুন – স্বাদমতো
- চিনি – ১/২ চা চামচ
- গরম জল – ৪ কাপ
- পেঁয়াজ বেরেস্তা – সাজানোর জন্য
প্রণালী:
- প্রথমে চিকেন টুকরাগুলো আদা, রসুন, নুন ও হলুদ দিয়ে মেখে ৩০ মিনিটের জন্য রেখে দিন।
- এরপর একটি পাত্রে তেল গরম করে চিকেনগুলো হালকা করে ভেজে তুলে নিন।
- ওই পাত্রে পেঁয়াজ কুচি দিয়ে সোনালী করে ভেজে আদা, রসুন বাটা ও গরম মশলা দিয়ে কিছুক্ষণ কষান।
- এবার চাল দিয়ে কিছুক্ষণ ভেজে গরম জল, নুন ও চিনি দিয়ে মিশিয়ে নিন।
- চিকেনগুলো চালের সাথে মিশিয়ে ঢাকনা দিয়ে ২০-২৫ মিনিটের জন্য দমে রান্না করুন।
- পেঁয়াজ বেরেস্তা দিয়ে সাজিয়ে গরম গরম পরিবেশন করুন।
ডিম পোলাও
ডিম পোলাও খুব সহজে তৈরি করা যায় এবং এটি বাচ্চাদের খুব পছন্দের।
উপকরণ:
- বাসমতী চাল – ২ কাপ
- ডিম – ২টি (ফেটিয়ে নেওয়া)
- পেঁয়াজ কুচি – ১/২ কাপ
- আদা বাটা – ১ টেবিল চামচ
- রসুন বাটা – ১ চা চামচ
- গরম মশলা – পরিমাণ মতো
- কাঁচা মরিচ – ৪-৫টি
- ঘি – ২ টেবিল চামচ
- সাদা তেল – ১ টেবিল চামচ
- নুন – স্বাদমতো
- চিনি – ১/২ চা চামচ
- গরম জল – ৪ কাপ
- পেঁয়াজ বেরেস্তা – সাজানোর জন্য
প্রণালী:
- ডিমের সাথে সামান্য নুন মিশিয়ে ফেটিয়ে নিন।
- একটি পাত্রে তেল গরম করে ডিমের ভুজিয়া তৈরি করে তুলে নিন।
- ওই পাত্রে পেঁয়াজ কুচি সোনালী করে ভেজে আদা, রসুন বাটা ও গরম মশলা দিয়ে কিছুক্ষণ কষান।
- চাল দিয়ে কিছুক্ষণ ভেজে গরম জল, নুন ও চিনি দিয়ে মিশিয়ে নিন।
- ডিমের ভুজিয়া চালের সাথে মিশিয়ে ঢাকনা দিয়ে ২০-২৫ মিনিটের জন্য দমে রান্না করুন।
- পেঁয়াজ বেরেস্তা দিয়ে সাজিয়ে গরম গরম পরিবেশন করুন।
সবজি পোলাও
যারা একটু স্বাস্থ্য সচেতন, তাদের জন্য সবজি পোলাও একটি দারুণ বিকল্প।
উপকরণ:
- বাসমতী চাল – ২ কাপ
- গাজর কুচি – ১/২ কাপ
- মটরশুঁটি – ১/২ কাপ
- ফুলকপি – ১/২ কাপ (ছোট টুকরা করা)
- পেঁয়াজ কুচি – ১/২ কাপ
- আদা বাটা – ১ টেবিল চামচ
- রসুন বাটা – ১ চা চামচ
- গরম মশলা – পরিমাণ মতো
- কাঁচা মরিচ – ৪-৫টি
- ঘি – ২ টেবিল চামচ
- সাদা তেল – ১ টেবিল চামচ
- নুন – স্বাদমতো
- চিনি – ১/২ চা চামচ
- গরম জল – ৪ কাপ
- পেঁয়াজ বেরেস্তা – সাজানোর জন্য
প্রণালী:
- একটি পাত্রে তেল গরম করে পেঁয়াজ কুচি সোনালী করে ভেজে আদা, রসুন বাটা ও গরম মশলা দিয়ে কিছুক্ষণ কষান।
- গাজর, মটরশুঁটি ও ফুলকপি দিয়ে কিছুক্ষণ ভেজে নিন।
- চাল দিয়ে কিছুক্ষণ ভেজে গরম জল, নুন ও চিনি দিয়ে মিশিয়ে নিন।
- ঢাকনা দিয়ে ২০-২৫ মিনিটের জন্য দমে রান্না করুন।
- পেঁয়াজ বেরেস্তা দিয়ে সাজিয়ে গরম গরম পরিবেশন করুন।
পোলাও নিয়ে কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ)
পোলাও নিয়ে অনেকের মনে কিছু প্রশ্ন থাকে। আমি চেষ্টা করব সেগুলোর উত্তর দিতে:
পোলাও কেন ঝরঝরে হয় না?
পোলাও ঝরঝরে না হওয়ার প্রধান কারণ হলো চালের পরিমাণ অনুযায়ী জলের সঠিক অনুপাত না রাখা। এছাড়া, চাল ভালোভাবে না ভাজলেও পোলাও ঝরঝরে হয় না।
পোলাও রান্নার জন্য কোন চাল ভালো?
পোলাও রান্নার জন্য বাসমতী চাল সবচেয়ে ভালো। এই চাল লম্বা এবং এতে সুগন্ধ থাকে, যা পোলাওয়ের স্বাদ বাড়ায়।
পোলাও কি প্রেশার কুকারে রান্না করা যায়?
হ্যাঁ, প্রেশার কুকারেও পোলাও রান্না করা যায়। তবে এতে জলের পরিমাণ কমিয়ে দিতে হবে এবং কম আঁচে রান্না করতে হবে।
পোলাওয়ের সাথে কি কি পরিবেশন করা যায়?
পোলাওয়ের সাথে মাংস, ডিম, সবজি, রায়তা, বোরহানি ইত্যাদি পরিবেশন করা যায়।
পোলাও কতক্ষণ পর্যন্ত ভালো থাকে?
পোলাও সাধারণত ৪-৬ ঘণ্টা পর্যন্ত ভালো থাকে। তবে ফ্রিজে রাখলে ১-২ দিন পর্যন্ত ভালো থাকে।
পোলাও এর জন্য কি বাসমতি চাল ব্যবহার করা আবশ্যিক?
যদিও বাসমতি চাল পোলাওয়ের জন্য সেরা, আপনি চিনিগুঁড়া বা কালিজিরা চালও ব্যবহার করতে পারেন। সেক্ষেত্রে জলের পরিমাণ একটু কমিয়ে দিতে হবে।
পোলাও এ কি জাফরান ব্যবহার না করলে চলে?
জাফরান পোলাওয়ের স্বাদ ও রং বাড়াতে সাহায্য করে, তবে এটা আবশ্যিক নয়। জাফরান না থাকলে আপনি সামান্য হলুদ ব্যবহার করতে পারেন।
পোলাও রান্নার সময় কি কি ভুল করা উচিত না?
পোলাও রান্নার সময় চাল না ধুয়ে ব্যবহার করা, জলের পরিমাণ বেশি দেওয়া, এবং দমে রান্না না করা – এই ভুলগুলো এড়িয়ে যাওয়া উচিত।
পোলাও এর স্বাদ বাড়াতে আর কি দেওয়া যায়?
পোলাও এর স্বাদ বাড়াতে গোলাপ জল, কেওড়া জল, বা সামান্য মাখন ব্যবহার করতে পারেন।
পোলাও এবং বিরিয়ানির মধ্যে পার্থক্য কি?
পোলাও এবং বিরিয়ানির মধ্যে প্রধান পার্থক্য হলো রান্নার পদ্ধতি এবং মশলার ব্যবহার। পোলাও সাধারণত হালকা মশলা দিয়ে রান্না করা হয়, যেখানে বিরিয়ানিতে ভারী মশলা এবং মাংস ব্যবহার করা হয়।
শেষ কথা
তাহলে, এই ছিল পোলাও রান্নার A to Z। আমি চেষ্টা করেছি সব কিছু সহজভাবে বুঝিয়ে বলতে, যাতে আপনি খুব সহজে বাড়িতেই পারফেক্ট পোলাও রান্না করতে পারেন। পোলাওয়ের রেসিপি নিয়ে আপনার কোনো প্রশ্ন থাকলে বা কোনো নতুন টিপস জানা থাকলে, অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন। আর হ্যাঁ, পোলাও রান্না করে কেমন হলো, সেটা জানাতে ভুলবেন না! শুভকামনা!