শুরুতেই একটা প্রশ্ন করি, ধরুন কালবৈশাখীর রাতে ঘুমিয়ে আছেন, হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখলেন আপনার ঘরে হাঁটু জল! কেমন লাগবে? নিশ্চয়ই ভয় পাবেন, তাই না? এই যে জল বেড়ে আপনার ঘর-বাড়ি ডুবিয়ে দিলো, অনেকটা জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো, এটাই কিন্তু বন্যা। ছোটবেলায় আমরা রচনাও লিখেছি বন্যা নিয়ে। কিন্তু আজ আমরা class 5 এর উপযোগী করে বন্যা (বন্যা কাকে বলে class 5) নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
বন্যা কী? (What is Flood?)
সহজ ভাষায় বন্যা হলো নদীর জল বেড়ে গিয়ে লোকালয়ে ঢুকে পড়া। যখন অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে নদীর জল ধারণ ক্ষমতা ছাড়িয়ে যায়, তখন সেই জল आसपासের নিচু এলাকাগুলোতে ছড়িয়ে পরে। এতে ঘর-বাড়ি, রাস্তাঘাট, ফসলের জমি सब ডুবে যায়। বন্যার আরেক নাম হলো দুর্ভোগ!
বন্যা কেন হয়? (Reasons of Flood)
বন্যা হওয়ার অনেক কারণ আছে, তার মধ্যে কিছু প্রধান কারণ নিচে আলোচনা করা হলো:
- অতিরিক্ত বৃষ্টি: একটানা অনেক দিন ধরে যদি প্রচুর বৃষ্টি হয়, তখন নদীর জল বেড়ে গিয়ে বন্যা হতে পারে।
- নদীর নাব্যতা কমে যাওয়া: নদীর নাব্যতা কমে গেলে নদীর জল ধারণ ক্ষমতা কমে যায়। ফলে অল্প বৃষ্টিতেই নদীর জল উপচে বন্যা হতে পারে।
- বাঁধ ভেঙে যাওয়া: নদীর পাড়ে দেওয়া বাঁধ যদি দুর্বল হয়ে ভেঙে যায়, তাহলে বন্যার জল লোকালয়ে ঢুকে পড়ে।
- ভূমিকম্প: শক্তিশালী ভূমিকম্পের কারণে ভূমি ধসে নদীর গতিপথ বদলে গেলে বন্যা হতে পারে।
- বরফ গলা: পার্বত্য এলাকায় বরফ গলে নদীর জলের স্তর বেড়ে গেলে বন্যার সৃষ্টি হতে পারে।
বন্যার প্রকারভেদ (Types of Flood)
বন্যা বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। নিচে কয়েকটি প্রধান বন্যার প্রকারভেদ আলোচনা করা হলো:
- ** flash flood ( আকস্মিক বন্যা ):** খুব অল্প সময়ে, সাধারণত কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এই বন্যা হয়। ভারী বৃষ্টির কারণে পাহাড়ি অঞ্চলে এই ধরনের বন্যা বেশি দেখা যায়।
- River Flood (নদী বন্যা): যখন নদীর জল বিপদসীমার উপর দিয়ে বয়ে যায় এবং आसपासের এলাকা প্লাবিত করে, তখন তাকে নদী বন্যা বলে।
- Coastal Flood (উপকূলীয় বন্যা): ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস অথবা সমুদ্রের জল বেড়ে গেলে উপকূলীয় অঞ্চলে এই বন্যা হয়।
- Urban Flood (শহর বন্যা): শহরের অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং জল নিষ্কাশনের ব্যবস্থা দুর্বল হলে অল্প বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়, যা শহর বন্যার রূপ নেয়।
বন্যার কারণগুলো বিস্তারিত (Causes of Floods in Details)
আসুন, বন্যার কারণগুলো একটু গভীরে গিয়ে আলোচনা করি:
অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত (Excessive Rainfall)
অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত বন্যার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম। যখন কোনো অঞ্চলে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি বৃষ্টিপাত হয়, তখন নদীর জল দ্রুত বেড়ে যায় এবং বন্যা দেখা দেয়।
- উদাহরণস্বরূপ, ভারতের চেরাপুঞ্জি এবং মৌসিনরাম বিশ্বের অন্যতম বৃষ্টিবহুল এলাকা। এখানে অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে প্রায়ই বন্যা হয়। আমাদের দেশেও বর্ষাকালে অনেক এলাকায় অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে বন্যা দেখা যায়।
নদীর নাব্যতা হ্রাস (Reduction of River Navigability)
নদীর নাব্যতা কমে গেলে নদীর জল ধারণ ক্ষমতা কমে যায়। এর ফলে অল্প বৃষ্টিতেই নদীর জল উপচে বন্যা হতে পারে।
- নদীর নাব্যতা কমার প্রধান কারণ হলো পলি জমা। প্রতি বছর বর্ষাকালে নদীর সাথে প্রচুর পলি আসে। এই পলি নদীর তলদেশে জমা হয়ে নদীর গভীরতা কমিয়ে দেয়। এছাড়া, নদীর পাড় ভাঙনের কারণেও নদীর নাব্যতা কমে যায়।
বাঁধ ভেঙে যাওয়া (Dam Break)
নদীর পাড়ে দেওয়া বাঁধ বন্যার হাত থেকে এলাকাকে রক্ষা করে। কিন্তু কোনো কারণে যদি এই বাঁধ ভেঙে যায়, তাহলে মুহূর্তের মধ্যে বন্যার জল লোকালয়ে প্রবেশ করে ব্যাপক ক্ষতি করতে পারে।
- দুর্বল নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণের অভাব অথবা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাঁধ ভেঙে যেতে পারে।
ভূমিকম্প (Earthquake)
শক্তিশালী ভূমিকম্পের কারণে ভূমি ধসে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হতে পারে। এর ফলে নদীর জল নতুন পথে প্রবাহিত হয়ে বন্যা সৃষ্টি করতে পারে।
- ২০১৫ সালের নেপালের ভূমিকম্পের কারণে অনেক নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল, যার ফলে বেশ কিছু এলাকায় বন্যা দেখা দেয়।
বরফ গলা (Melting of Ice)
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে। এর ফলে পার্বত্য অঞ্চলের বরফ দ্রুত গলছে। এই বরফ গলা জল নদীর মাধ্যমে লোকালয়ে এসে বন্যার সৃষ্টি করতে পারে।
- হিমালয় পর্বতমালার বরফ গলার কারণে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে প্রায়ই বন্যা দেখা যায়।
বন্যার ফলে কী কী ক্ষতি হয়? (Damages Caused by Floods)
বন্যা আমাদের জীবনে অনেক ক্ষতি ডেকে আনে। কিছু প্রধান ক্ষতি নিচে উল্লেখ করা হলো:
- জীবনের ক্ষতি: বন্যায় বহু মানুষের জীবনহানি ঘটে। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধরা বন্যার পানিতে ডুবে মারা যায়।
- ঘর-বাড়ির ক্ষতি: বন্যার পানিতে ঘর-বাড়ি ডুবে গিয়ে নষ্ট হয়ে যায়। অনেক মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে।
- ফসলের ক্ষতি: বন্যার পানিতে ফসলের জমি ডুবে গিয়ে ফসল নষ্ট হয়ে যায়। এতে খাদ্য সংকট দেখা দেয়।
- রাস্তাঘাটের ক্ষতি: রাস্তাঘাট ডুবে গিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পরে।
- রোগবালাই: বন্যার পরে বিভিন্ন ধরনের রোগ যেমন ডায়রিয়া, কলেরা, টাইফয়েড ইত্যাদি ছড়িয়ে পরে।
বন্যা থেকে বাঁচার উপায় (Ways to Prevent Flood)
বন্যা একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, তবে কিছু পদক্ষেপ নিলে এর ক্ষতি কমানো যায়। নিচে কিছু উপায় আলোচনা করা হলো:
- বাঁধ নির্মাণ ও মেরামত: নদীর পাড়ে মজবুত বাঁধ নির্মাণ করতে হবে এবং নিয়মিত বাঁধের মেরামত করতে হবে।
- নদী খনন: নিয়মিত নদী খনন করে নদীর নাব্যতা বাড়াতে হবে ,যাতে নদীর জল ধারণ ক্ষমতা বাড়ে।
- জলাধার তৈরি: বন্যার অতিরিক্ত জল সংরক্ষণের জন্য জলাধার তৈরি করতে হবে।
- বনায়ন: নদীর পাড়ে ও পাহাড়ের ঢালে গাছ লাগাতে হবে। গাছপালা মাটিকে ধরে রাখে ফলে ভূমিধস কম হয়।
- সচেতনতা বৃদ্ধি: বন্যা সম্পর্কে लोगों को সচেতন করতে হবে এবং দুর্যোগের সময় কি করতে হবে, তা জানাতে হবে।
বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্র (Flood Forecasting Center)
বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্র বন্যার পূর্বাভাস দিয়ে থাকে। এই কেন্দ্রের মাধ্যমে বন্যার পূর্বাভাস পেলে আগে থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া যায় এবং জানমালের ক্ষতি কমানো যায়।
- বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্র নদীর জল level পর্যবেক্ষণ করে এবং তথ্যের বিশ্লেষণ করে বন্যার সম্ভাবনা সম্পর্কে জানায়।
class 5 এর শিক্ষার্থীদের জন্য বন্যার সংজ্ঞা (Flood Definition for Class 5 Students)
বন্যা হলো যখন অনেক বেশি বৃষ্টি হওয়ার কারণে নদীর জল বেড়ে গিয়ে রাস্তাঘাট, ঘর-বাড়ি, স্কুল, খেলার মাঠ সবকিছু ডুবিয়ে দেয়। বন্যার সময় চারদিকে শুধু জল আর জল দেখা যায়।
বন্যা নিয়ে কিছু মজার তথ্য (Some Fun Facts About Floods)
- সবচেয়ে বড় বন্যা হয়েছিল চীনে, ১৯৩১ সালে। এতে প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল।
- বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ২০% এলাকা বন্যার শিকার হয়।
- বন্যার পানিতে মাছেরা রাস্তাঘাটে চলে আসে এবং অনেক মানুষ সেই মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে।
বন্যা পরিস্থিতির জরুরি মুহূর্ত করণীয় (What to do in critical moments for flood situation)
বন্যা পরিস্থিতিতে জীবন বাঁচাতে কিছু জরুরি পদক্ষেপ নিতে হয়। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা করা হলো:
- তাৎক্ষণিক আশ্রয়: বন্যা শুরু হলে দ্রুত নিরাপদ উঁচু স্থানে আশ্রয় নিতে হবে। নিকটবর্তী আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে না পারলে বহুতল ভবনের ছাদে বা উঁচু জায়গায় অবস্থান করতে হবে।
- ত্রাণ সামগ্রী সংগ্রহ: শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ জল, ঔষধপত্র, টর্চলাইট এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সাথে রাখুন। শিশুদের জন্য বিশেষ খাবার এবং ডায়াপার সংগ্রহ করুন।
- যোগাযোগ রক্ষা: মোবাইল ফোন চার্জ করে রাখুন এবং নিকটাত্মীয় ও জরুরি হেল্পলাইন নম্বরের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখুন।
- পানিবাহিত রোগ প্রতিরোধ: বন্যার জল দূষিত হতে পারে, তাই জল ফুটিয়ে পান করুন এবং খাবার আগে অবশ্যই হাত ধুয়ে নিন।
- সর্পদংশন থেকে সাবধান: বন্যার সময় সাপেরা শুকনো জায়গায় আশ্রয় নেয়। তাই হাঁটাচলার সময় সতর্ক থাকুন এবং লম্বা লাঠি ব্যবহার করুন।
- বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন: বিদ্যুতের খুঁটি বা তার থেকে দূরে থাকুন। প্রয়োজনে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করার জন্য কর্তৃপক্ষকে খবর দিন।
- আশ্রয়কেন্দ্রে সহযোগিতা: আশ্রয়কেন্দ্রে অন্যদের সাথে মিলেমিশে থাকুন এবং স্বেচ্ছাসেবকদের কাজে সহযোগিতা করুন।
বন্যা মোকাবিলায় সরকারের পদক্ষেপ (Government initiatives facing flood)
* বন্যাপ্রবণ এলাকাগুলোতে আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে, যেখানে বন্যার সময় মানুষ নিরাপদে থাকতে পারে।
* সরকার নিয়মিতভাবে বন্যাদুর্গতদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করে। শুকনো খাবার, জল, ঔষধ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করা হয়।
* বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য আলাদা তহবিল গঠন করা হয়েছে, যা দুর্যোগকালীন সময়ে দ্রুত সাহায্য পাঠানোর কাজে ব্যবহৃত হয়।
* বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্র আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বন্যার পূর্বাভাস দেওয়ার কাজ করে, যা মানুষকে আগে থেকেই সতর্ক করে।
* সরকার ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাঘাট, সেতু এবং অন্যান্য অবকাঠামো দ্রুত মেরামতের ব্যবস্থা নেয়, যাতে যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখা যায়।
কিছু জরুরি প্রশ্নোত্তর (Some Important FAQs):
-
বন্যা কাকে বলে class 5 এর জন্য সহজ উত্তর কী?
- সহজ উত্তর হলো, যখন অনেক বৃষ্টির কারণে নদীর জল বেড়ে গিয়ে লোকালয়ে ঢুকে পরে, তখন তাকে বন্যা বলে।
-
বন্যা কেন হয়?
- অতিরিক্ত বৃষ্টি, নদীর নাব্যতা কমে যাওয়া, বাঁধ ভেঙে যাওয়া ইত্যাদি কারণে বন্যা হয়।
-
বন্যা থেকে বাঁচার উপায় কি?
- বাঁধ নির্মাণ, নদী খনন, বনায়ন এবং সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বন্যা থেকে বাঁচা যায়।
-
বন্যার সময় কোথায় আশ্রয় নিতে হয়?
- বন্যার সময় নিরাপদ উঁচু স্থানে অথবা আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিতে হয়।
-
বন্যার পরে কি কি রোগ হতে পারে?
- বন্যার পরে ডায়রিয়া, কলেরা, টাইফয়েড ইত্যাদি রোগ হতে পারে।
উপসংহার (Conclusion)
বন্যা আমাদের দেশের একটি নিয়মিত দুর্যোগ। তবে সঠিক পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নেওয়ার মাধ্যমে আমরা বন্যার ক্ষতি কমাতে পারি। বন্যা সম্পর্কে জানা এবং এর থেকে বাঁচার উপায়গুলো অনুসরণ করে আমরা নিজেদের এবং আমাদের সমাজকে সুরক্ষিত রাখতে পারি। মনে রাখবেন, আপনার একটু সচেতনতাই পারে অনেক জীবন বাঁচাতে। আপনার এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা বা কোনো প্রশ্ন থাকলে নিচে কমেন্ট করে জানাতে পারেন। সবাই মিলে সচেতন হলেই আমরা এই দুর্যোগ মোকাবেলা করতে পারব।