সরিষা ইলিশ রেসিপি: জিভে জল আনা স্বাদে বাঙালি ভোজ!
ইলিশ! নামটা শুনলেই জিভে জল এসে যায়, তাই না? আর যদি হয় সরিষা ইলিশ, তাহলে তো কথাই নেই! সরিষা বাটা আর কাঁচা লঙ্কার ঝাঁঝে ইলিশের স্বাদ যেন আরও কয়েকগুণ বেড়ে যায়। গরম ভাতের সাথে সরিষা ইলিশ হলে আর কিছুই লাগে না। আজ আমরা আলোচনা করব কিভাবে খুব সহজে এবং পারফেক্ট স্বাদে সরিষা ইলিশ রান্না করা যায়। তাহলে চলুন, দেরি না করে শুরু করা যাক!
সরিষা ইলিশের প্রস্তুতি: উপকরণ ও প্রনালী
সরিষা ইলিশ রান্না করার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো হাতের কাছে গুছিয়ে নিলে রান্নার কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়। আসুন, প্রথমে উপকরণগুলো দেখে নেওয়া যাক:
উপকরণ:
- ইলিশ মাছ: ৬ টুকরা (২৫০-৩০০ গ্রাম)
- সরিষা বাটা: ২ টেবিল চামচ (কালো ও সাদা সরিষা মিশিয়ে)
- পেঁয়াজ কুচি: ১টি (বড়)
- কাঁচা লঙ্কা: ৪-৫টি (স্বাদ অনুযায়ী)
- সরিষার তেল: ৪ টেবিল চামচ
- হলুদ গুঁড়া: ১ চা চামচ
- মরিচ গুঁড়া: ১/২ চা চামচ (ইচ্ছা অনুযায়ী)
- লবণ: স্বাদমতো
- কালো জিরা: ১/২ চা চামচ
- পানি: পরিমাণ মতো
- ধনে পাতা কুচি: ১ টেবিল চামচ (সাজানোর জন্য)
প্রস্তুত প্রণালী:
- মাছ তৈরি: প্রথমে ইলিশ মাছের টুকরাগুলো ভালো করে ধুয়ে নিন। মাছের গায়ে সামান্য লবণ ও হলুদ মাখিয়ে ১০ মিনিটের জন্য রেখে দিন।
- সরিষা বাটা তৈরি: কালো ও সাদা সরিষা একসাথে মিশিয়ে মিহি করে বেটে নিন। সরিষা বাটার সময় সামান্য লবণ ও কাঁচালঙ্কা দিয়ে বাটলে তেতো ভাব কমে যায়।
- পেঁয়াজ ও কাঁচালঙ্কা: পেঁয়াজ কুচি করে কেটে নিন। কাঁচালঙ্কাগুলো ফালি করে কেটে রাখুন।
- মসলার প্রস্তুতি: একটি পাত্রে সরিষা বাটা, হলুদ গুঁড়া, মরিচ গুঁড়া (যদি ব্যবহার করেন) এবং লবণ মিশিয়ে সামান্য পানি দিয়ে একটি মসলার পেস্ট তৈরি করুন।
সরিষা ইলিশ রান্নার পদ্ধতি
এবার আসি রান্নার মূল পর্বে। নিচে ধাপে ধাপে সরিষা ইলিশ রান্নার পদ্ধতি আলোচনা করা হলো:
ধাপ ১: কড়াইয়ের প্রস্তুতি
- একটি কড়াই বা প্যানে সরিষার তেল গরম করুন। সরিষার তেল গরম হয়ে ধোঁয়া উঠলে কালো জিরা দিয়ে দিন। কালো জিরা ফুটে সুগন্ধ ছড়ালে পেঁয়াজ কুচি দিয়ে হালকা বাদামি করে ভেজে নিন।
ধাপ ২: মসলা কষানো
- পেঁয়াজ ভাজা হয়ে গেলে আগে থেকে তৈরি করে রাখা মসলার পেস্টটি দিয়ে দিন। মাঝারি আঁচে মসলা ভালোভাবে কষিয়ে নিন। মসলা কষানোর সময় খেয়াল রাখবেন যেন পুড়ে না যায়। প্রয়োজনে সামান্য পানি যোগ করতে পারেন।
ধাপ ৩: মাছ যোগ করা
- মসলা কষানো হয়ে গেলে মাছের টুকরাগুলো মসলার উপর বিছিয়ে দিন। মাছের উপর ফালি করে রাখা কাঁচালঙ্কাগুলো ছড়িয়ে দিন।
ধাপ ৪: ঝোল দেওয়া
- মাছগুলো সামান্য কষানোর পর পরিমাণ মতো পানি দিন। খুব বেশি পানি দেবেন না, মাখা মাখা ঝোল হলেই ভালো লাগে। লবণ চেখে দেখে প্রয়োজন অনুযায়ী যোগ করুন।
ধাপ ৫: ঢেকে রান্না করা
- এবার কড়াইটি ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দিন এবং মাঝারি আঁচে ১৫-২০ মিনিট রান্না করুন। মাঝে মাঝে ঢাকনা তুলে আলতো হাতে মাছগুলো একটু নেড়ে দিন, যাতে নিচে লেগে না যায়।
ধাপ ৬: পরিবেশন
- ঝোল ঘন হয়ে এলে এবং মাছ সেদ্ধ হয়ে নরম হলে চুলা বন্ধ করে দিন। উপরে ধনে পাতা কুচি ছড়িয়ে দিন। গরম ভাত বা পোলাওয়ের সাথে পরিবেশন করুন সুস্বাদু সরিষা ইলিশ।
সরিষা ইলিশ রান্নার কিছু টিপস ও ট্রিকস
সরিষা ইলিশ রান্না করার সময় কিছু ছোটখাটো বিষয় মনে রাখলে স্বাদ আরও বেড়ে যায়। নিচে কয়েকটি টিপস দেওয়া হলো:
সরিষা বাটার সঠিক নিয়ম
সরিষা বাটার সময় সামান্য লবণ ও কাঁচালঙ্কা ব্যবহার করলে সরিষার তেতো ভাব কমে যায়। এছাড়া, সরিষা কিছুক্ষণ ভিজিয়ে রাখলে মিহি বাটা পাওয়া যায়।
সরিষার তেল ব্যবহার
সরিষা ইলিশের আসল স্বাদ পেতে সরিষার তেল ব্যবহার করা আবশ্যক। অন্য তেল ব্যবহার করলে সেই স্বাদ পাওয়া যায় না।
মাছের গুণগত মান
ভালো মানের ইলিশ মাছ ব্যবহার করলে রান্নার স্বাদ বহুগুণ বেড়ে যায়। টাটকা ইলিশ ব্যবহার করার চেষ্টা করুন।
কাঁচালঙ্কার ব্যবহার
কাঁচালঙ্কা ফালি করে দিলে ঝোল এবং মাছ উভয়েই সুন্দর একটা ফ্লেভার আসে। যারা বেশি ঝাল পছন্দ করেন, তারা লঙ্কার পরিমাণ বাড়াতে পারেন।
সরিষা ইলিশের পুষ্টিগুণ
সরিষা ইলিশ শুধু স্বাদের দিক থেকেই সেরা নয়, এর অনেক পুষ্টিগুণও রয়েছে। ইলিশ মাছে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে, যা হৃদরোগের জন্য খুবই উপকারী। এছাড়া, সরিষায় রয়েছে ভিটামিন ও মিনারেলস যা শরীরের জন্য প্রয়োজনীয়। নিচে এর কিছু পুষ্টিগুণ উল্লেখ করা হলো:
- ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড: হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় এবং মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বাড়ায়।
- ভিটামিন ডি: হাড় মজবুত করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
- প্রোটিন: শরীরের কোষ গঠনে সাহায্য করে এবং শক্তি যোগায়।
- আয়রন: রক্তস্বল্পতা দূর করে এবং শরীরের ক্লান্তি কমায়।
সরিষা ইলিশের বিভিন্ন প্রকারভেদ
সরিষা ইলিশ বিভিন্নভাবে রান্না করা যায়। কিছু জনপ্রিয় প্রকারভেদ নিচে উল্লেখ করা হলো:
ভাবা সরিষা ইলিশ
এই পদ্ধতিতে মাছ ভাপে রান্না করা হয়। এতে মাছের স্বাদ এবং পুষ্টিগুণ অক্ষুণ্ণ থাকে।
দই সরিষা ইলিশ
টক দই ব্যবহার করে এই রান্নাটি করা হয়। দইয়ের কারণে এটিতে একটি ভিন্ন স্বাদ আসে।
নারিকেল সরিষা ইলিশ
নারিকেলের দুধ ব্যবহার করে এই রান্নাটি করা হয়। এটিতে মিষ্টি এবং ক্রিমি একটা ভাব থাকে।
সচরাচর জিজ্ঞাস্য (FAQ)
সরিষা ইলিশ নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন এবং তার উত্তর নিচে দেওয়া হলো:
সরিষা ইলিশের জন্য কোন সরিষা ভালো? কালো না সাদা?
সরিষা ইলিশের জন্য কালো ও সাদা সরিষা মিশিয়ে ব্যবহার করাই ভালো। এতে স্বাদ এবং গন্ধের একটা ব্যালেন্স থাকে। শুধু কালো সরিষা ব্যবহার করলে তেতো লাগতে পারে।
সরিষা বাটার সময় কি মেশানো উচিত?
সরিষা বাটার সময় সামান্য লবণ ও কাঁচালঙ্কা মেশানো উচিত। এতে সরিষার তেতো ভাব কমে যায়।
সরিষা ইলিশ কি স্বাস্থ্যকর?
হ্যাঁ, সরিষা ইলিশ স্বাস্থ্যকর। ইলিশ মাছে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড এবং সরিষায় ভিটামিন ও মিনারেলস থাকে যা শরীরের জন্য খুবই উপকারী।
সরিষা ইলিশের সাথে কি পরিবেশন করা যায়?
সরিষা ইলিশ গরম ভাত বা পোলাওয়ের সাথে পরিবেশন করা যায়। এছাড়া, এটি আলু ভর্তা বা অন্য কোনো সবজির সাথেও পরিবেশন করা যেতে পারে।
সরিষা ইলিশ কত দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়?
সরিষা ইলিশ রান্না করার পর সাধারণ তাপমাত্রায় একদিন পর্যন্ত ভালো থাকে। তবে, ফ্রিজে রাখলে ২-৩ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।
সরিষা ইলিশের ঝোল ঘন করার উপায় কি?
সরিষা ইলিশের ঝোল ঘন করার জন্য রান্নার সময় অল্প আঁচে বেশি সময় ধরে রান্না করতে পারেন। এছাড়া, সামান্য চালের গুঁড়া বা বেসন ব্যবহার করেও ঝোল ঘন করা যায়।
সরিষা ইলিশে পেঁয়াজ ব্যবহার না করলে কি স্বাদ পরিবর্তন হয়?
পেঁয়াজ ব্যবহার না করলে স্বাদে কিছুটা পার্থক্য হয়, তবে এটি আপনার ব্যক্তিগত পছন্দের উপর নির্ভর করে। পেঁয়াজ ছাড়া রান্না করলে সরিষার আসল স্বাদটা বেশি পাওয়া যায়।
সরিষা ইলিশে টমেটো ব্যবহার করা যায়?
অনেকে সরিষা ইলিশে সামান্য টমেটো ব্যবহার করেন, এতে একটু টকটক ভাব আসে। তবে এটি পুরোপুরি ঐচ্ছিক।
সরিষা ইলিশ রান্নার জন্য কি ধরনের পাত্র ব্যবহার করা ভালো?
সরিষা ইলিশ রান্নার জন্য কড়াই বা প্যান ব্যবহার করা ভালো। মাটির পাত্র ব্যবহার করলে স্বাদ আরও ভালো হয়।
সরিষা ইলিশে চিনি দেওয়া যায়?
সরিষা ইলিশে সামান্য চিনি দিলে স্বাদের ব্যালেন্স আসে, তবে এটা বাধ্যতামূলক নয়। যারা একটু মিষ্টি স্বাদ পছন্দ করেন, তারা সামান্য চিনি দিতে পারেন।
উপসংহার
সরিষা ইলিশ নিঃসন্দেহে একটি অসাধারণ এবং মুখরোচক খাবার। সঠিক উপকরণ ও পদ্ধতি অনুসরণ করে আপনিও খুব সহজে এই পদটি রান্না করতে পারেন। এই রেসিপিটি অনুসরণ করে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন হলো, তা আমাদের জানাতে ভুলবেন না। আর হ্যাঁ, আপনার বন্ধুদের সাথে এই রেসিপিটি শেয়ার করতে পারেন, যাতে তারাও এই সুস্বাদু খাবারটি উপভোগ করতে পারে। শুভ রান্না!