আজ আমরা রসায়ন এর এক মজার বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। বিষয়টির নাম শুনে হয়তো একটু কঠিন মনে হতে পারে, কিন্তু আমি কথা দিচ্ছি, এই ব্লগটি পড়ার পর “যোজনী” আপনার কাছে একদম জলের মতো সোজা হয়ে যাবে! তাহলে চলুন, আর দেরি না করে শুরু করা যাক।
যোজনী কী? (What is Valency?)
যোজনী (Valency) হলো কোনো মৌলের (Element) অন্য মৌলের সাথে যুক্ত হওয়ার ক্ষমতা। সহজ ভাষায়, একটি মৌলের কয়টি হাত আছে, যা দিয়ে সে অন্য মৌলের সাথে bonding তৈরি করতে পারে, সেটাই হলো তার যোজনী। এই “হাত” গুলো আসলে ইলেকট্রন (Electron), যা অন্য পরমাণুর (Atom) সাথে শেয়ার (Share) করে বা আদান-প্রদান (Exchange) করে যৌগ (Compound) গঠন করে।
মনে করুন, আপনার দুটি হাত আছে। আপনি একই সময়ে অন্য দুজনের হাত ধরতে পারবেন। এক্ষেত্রে আপনার “যোজনী” হলো ২। রসায়নের মৌলগুলোরও এরকম “হাত” থাকে, যা তাদের যোজনী নির্ধারণ করে।
যোজনীর ইতিহাস (History of Valency)
যোজনীর ধারণা উনিশ শতকে (19th century) বিকাশ লাভ করে, যখন বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন যে পরমাণুগুলো নির্দিষ্ট অনুপাতে (Specific Ratio) যুক্ত হয়ে যৌগ গঠন করে। আর্চিবাল্ড স্কট কুপার (Archibald Scott Couper) এবং অগাস্ট কেকুলে (August Kekulé) এর মতো রসায়নবিদরা এই ধারণার প্রাথমিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
যোজনী কিভাবে কাজ করে? (How does Valency work?)
যোজনী বোঝার জন্য, প্রথমে আমাদের জানতে হবে যোজ্যতা ইলেকট্রন (Valence Electron) কী।
যোজ্যতা ইলেকট্রন (Valence Electron)
যোজ্যতা ইলেকট্রন হলো কোনো পরমাণুর সবচেয়ে বাইরের শক্তিস্তরে (Outermost energy level) থাকা ইলেকট্রন। এই ইলেকট্রনগুলোই রাসায়নিক বন্ধন (Chemical bond) তৈরিতে অংশ নেয়।
উদাহরণস্বরূপ, সোডিয়ামের (Sodium) (Na) ইলেকট্রন বিন্যাস হলো 2, 8, 1। এর সর্বশেষ শক্তিস্তরে ১টি ইলেকট্রন আছে। তাই সোডিয়ামের যোজ্যতা ইলেকট্রন হলো ১।
কিভাবে যোজনী নির্ধারিত হয়?
যোজনী সাধারণত কোনো মৌলের যোজ্যতা ইলেকট্রনের সংখ্যার উপর নির্ভর করে। কিছু ক্ষেত্রে, পরমাণু স্থিতিশীলতা অর্জনের জন্য ইলেকট্রন গ্রহণ (Accept) করে বা ত্যাগ (Donate) করে।
-
ধাতু (Metal): ধাতুগুলো সাধারণত ইলেকট্রন ত্যাগ করে ধনাত্মক আয়ন (Positive ion) তৈরি করে। এদের যোজনী হলো তারা যতগুলো ইলেকট্রন ত্যাগ করে সেই সংখ্যা। যেমন, সোডিয়াম ১টি ইলেকট্রন ত্যাগ করে Na+ আয়ন তৈরি করে, তাই এর যোজনী ১।
-
অ-ধাতু (Non-metal): অধাতুগুলো সাধারণত ইলেকট্রন গ্রহণ করে ঋণাত্মক আয়ন (Negative ion) তৈরি করে। এদের যোজনী হলো তারা যতগুলো ইলেকট্রন গ্রহণ করে সেই সংখ্যা। যেমন, ক্লোরিন (Chlorine) ১টি ইলেকট্রন গ্রহণ করে Cl- আয়ন তৈরি করে, তাই এর যোজনী ১।
যোজনীর প্রকারভেদ (Types of Valency)
যোজনী প্রধানত দুই প্রকার:
-
ধণাত্মক যোজনী (Positive valency): যখন কোনো পরমাণু ইলেকট্রন ত্যাগ করে ক্যাটায়ন (Cation) এ পরিণত হয়, তখন তাকে ধনাত্মক যোজনী বলে।
- উদাহরণ: সোডিয়াম (Na) একটি ইলেকট্রন ত্যাগ করে Na⁺ এ পরিণত হয়। এখানে সোডিয়ামের যোজনী +১।
-
ঋণাত্মক যোজনী (Negative valency): যখন কোনো পরমাণু ইলেকট্রন গ্রহণ করে অ্যানায়ন (Anion) এ পরিণত হয়, তখন তাকে ঋণাত্মক যোজনী বলে।
- উদাহরণ: ক্লোরিন (Cl) একটি ইলেকট্রন গ্রহণ করে Cl⁻ এ পরিণত হয়। এখানে ক্লোরিনের যোজনী -১।
যোজনী এবং রাসায়নিক সূত্র (Valency and Chemical Formula)
যোজনী রাসায়নিক সূত্র (Chemical formula) লেখার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাসায়নিক সূত্র হলো কোনো যৌগের মধ্যে থাকা পরমাণুগুলোর সংখ্যার অনুপাত (Ratio)।
ক্রিস-ক্রস পদ্ধতি (Criss-cross method)
ক্রিস-ক্রস পদ্ধতি ব্যবহার করে সহজেই রাসায়নিক সূত্র লেখা যায়। এই পদ্ধতিতে, দুটি মৌলের যোজনী পরস্পর পরিবর্তন করে অন্য মৌলের পরমাণু সংখ্যা হিসেবে লেখা হয়।
উদাহরণস্বরূপ, অ্যালুমিনিয়াম (Al) এবং অক্সিজেন (O) এর সমন্বয়ে গঠিত যৌগের রাসায়নিক সূত্র নির্ণয় করা যাক।
- অ্যালুমিনিয়ামের যোজনী: ৩
- অক্সিজেনের যোজনী: ২
এখন, ক্রিস-ক্রস পদ্ধতি অনুযায়ী, অ্যালুমিনিয়ামের পরমাণু সংখ্যা হবে ২ এবং অক্সিজেনের পরমাণু সংখ্যা হবে ৩। সুতরাং, যৌগটির রাসায়নিক সূত্র হবে Al₂O₃।
মৌল (Element) | যোজনী (Valency) |
---|---|
অ্যালুমিনিয়াম (Al) | ৩ |
অক্সিজেন (O) | ২ |
এই টেবিলটি ক্রিস-ক্রস পদ্ধতিতে রাসায়নিক সূত্র লেখার প্রক্রিয়াটিকে আরও স্পষ্ট করে।
সাধারণ কিছু মৌলের যোজনী (Valency of some common elements)
এখানে কয়েকটি সাধারণ মৌলের যোজনী উল্লেখ করা হলো:
মৌল (Element) | প্রতীক (Symbol) | যোজনী (Valency) |
---|---|---|
হাইড্রোজেন (Hydrogen) | H | ১ |
অক্সিজেন (Oxygen) | O | ২ |
সোডিয়াম (Sodium) | Na | ১ |
ম্যাগনেসিয়াম (Magnesium) | Mg | ২ |
অ্যালুমিনিয়াম (Aluminum) | Al | ৩ |
ক্লোরিন (Chlorine) | Cl | ১ |
পটাশিয়াম (Potassium) | K | ১ |
ক্যালসিয়াম (Calcium) | Ca | ২ |
এই তালিকাটি আপনাকে বিভিন্ন রাসায়নিক যৌগ গঠনে যোজনীর ব্যবহার বুঝতে সাহায্য করবে।
পরিবর্তনশীল যোজনী (Variable Valency)
কিছু মৌলের একাধিক যোজনী থাকতে পারে। এদেরকে পরিবর্তনশীল যোজনী বলে। এর কারণ হলো, তারা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন সংখ্যক ইলেকট্রন শেয়ার বা আদান-প্রদান করতে পারে।
পরিবর্তনশীল যোজনীর উদাহরণ (Examples of variable valency)
-
আয়রন (Iron): আয়রনের দুটি যোজনী দেখা যায়: ২ এবং ৩। তাই আয়রন (II) ক্লোরাইড (FeCl₂) এবং আয়রন (III) ক্লোরাইড (FeCl₃) নামে দুটি যৌগ গঠন করতে পারে।
-
কপার (Copper): কপারেরও দুটি যোজনী আছে: ১ এবং ২। কপার (I) অক্সাইড (Cu₂O) এবং কপার (II) অক্সাইড (CuO) এর উদাহরণ।
পরিবর্তনশীল যোজনীর কারণ (Reasons for variable valency)
পরিবর্তনশীল যোজনীর প্রধান কারণ হলো পরমাণুর ইলেকট্রন বিন্যাসের জটিলতা। কিছু মৌলের ক্ষেত্রে, ভেতরের শক্তিস্তরের ইলেকট্রনও রাসায়নিক বন্ধন তৈরিতে অংশ নিতে পারে, যার ফলে একাধিক যোজনী দেখা যায়।
জটিল যৌগের যোজনী (Valency of Complex compounds)
জটিল যৌগের (Complex compounds) ক্ষেত্রে যোজনী নির্ণয় করা একটু কঠিন। এই ক্ষেত্রে, কেন্দ্রীয় পরমাণুর (Central atom) সাথে কয়টি লিগ্যান্ড (Ligand) যুক্ত আছে এবং লিগ্যান্ডগুলোর চার্জের (Charge) উপর নির্ভর করে যোজনী হিসাব করা হয়। জটিল যৌগের নামকরণ IUPAC (International Union of Pure and Applied Chemistry) এর নিয়ম অনুযায়ী করা হয়।
যোজনী মনে রাখার সহজ উপায় (Easy ways to remember valency)
যোজনী মনে রাখার জন্য কিছু সহজ উপায় নিচে দেওয়া হলো:
-
পর্যায় সারণি (Periodic Table): পর্যায় সারণির গ্রুপ (Group) নম্বর অনুযায়ী মৌলের যোজনী মনে রাখা যায়। সাধারণত, একই গ্রুপের মৌলগুলোর যোজনী একই হয়।
-
অনুশীলন (Practice): বিভিন্ন যৌগের রাসায়নিক সূত্র লেখার মাধ্যমে যোজনী মনে রাখা সহজ হয়। যত বেশি অনুশীলন করা হবে, তত সহজে যোজনী মনে থাকবে।
-
চার্ট তৈরি (Create chart): একটি চার্ট তৈরি করে সেখানে মৌলের নাম ও যোজনী লিখে দেওয়ালে লাগিয়ে দিন। প্রতিদিন দেখলে ধীরে ধীরে সব মনে হয়ে যাবে।
যোজনীর গুরুত্ব (Importance of valency)
রসায়নে যোজনীর গুরুত্ব অপরিসীম। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উল্লেখ করা হলো:
-
যৌগের গঠন (Structure of compounds): কোনো যৌগের গঠন কেমন হবে, তা যোজনীর ওপর নির্ভর করে।
-
রাসায়নিক বিক্রিয়া (Chemical reactions): রাসায়নিক বিক্রিয়া কিভাবে ঘটবে এবং কী উৎপন্ন হবে, তা যোজনীর মাধ্যমে বোঝা যায়।
-
নতুন যৌগ তৈরি (Formation of new compounds): নতুন যৌগ তৈরি করার জন্য কোন মৌল কত পরিমাণে লাগবে, তা যোজনী দিয়ে হিসাব করা হয়।
দৈনন্দিন জীবনে যোজনীর ব্যবহার (Uses of valency in daily life)
যোজনীর ধারণা শুধু রসায়ন পরীক্ষাগারেই সীমাবদ্ধ নয়, আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও এর অনেক ব্যবহার রয়েছে।
-
ঔষধ শিল্প (Pharmaceutical industry): বিভিন্ন ঔষধ তৈরির সময় সঠিক পরিমাণে উপাদান মেশানোর জন্য যোজনীর জ্ঞান থাকা জরুরি।
-
কৃষি (Agriculture): জমিতে সার ব্যবহারের ক্ষেত্রে, কোন সারে কী উপাদান আছে এবং তার পরিমাণ কত হওয়া উচিত, তা যোজনীর সাহায্যে নির্ধারণ করা হয়।
-
পরিষ্কারক দ্রব্য (Cleaning products): ডিটারজেন্ট (Detergent) এবং অন্যান্য পরিষ্কারক দ্রব্য তৈরিতে যোজনীর ধারণা কাজে লাগে।
যোজনী নিয়ে কিছু মজার তথ্য (Fun facts about valency)
-
হাইড্রোজেনের যোজনী ১ হলেও, এটি একাধিক পরমাণুর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে।
-
কিছু মৌল, যেমন কার্বন (Carbon), একাধিক যোজনী প্রদর্শন করে এবং জটিল জৈব যৌগ (Organic compound) গঠনে অংশ নেয়।
-
নোবেল গ্যাসগুলো (Noble gases), যেমন হিলিয়াম (Helium), নিয়ন (Neon), আর্গন (Argon) সাধারণত রাসায়নিকভাবে নিষ্ক্রিয় (Inert) থাকে, কারণ এদের যোজ্যতা স্তর (Valence shell) সম্পূর্ণরূপে ইলেকট্রন দ্বারা পূর্ণ থাকে।
সচরাচর জিজ্ঞাস্য (Frequently Asked Questions – FAQs)
এখানে যোজনী সম্পর্কিত কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
-
যোজনী ও যোজকতার মধ্যে পার্থক্য কী? (What is the difference between valency and valence?)
যোজনী হলো একটি মৌলের অন্য মৌলের সাথে যুক্ত হওয়ার ক্ষমতা। অন্যদিকে, যোজ্যতা হলো কোনো মৌলের সর্বশেষ শক্তিস্তরের ইলেকট্রন সংখ্যা, যা রাসায়নিক বন্ধন তৈরিতে অংশ নেয়। যদিও শব্দ দুটি প্রায়শই বিনিময়যোগ্যভাবে ব্যবহৃত হয়, তাদের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। যোজনী হলো একটি সংখ্যা যা বোঝায় একটি পরমাণু কয়টি বন্ধন গঠন করতে পারে, যেখানে যোজ্যতা ইলেকট্রন হলো সেই ইলেকট্রন যা বন্ধন গঠনে ব্যবহৃত হয়।
-
যৌগমূলক এর যোজনী কিভাবে নির্ণয় করব? (How to determine the valency of a radical?)
যৌগমূলকের যোজনী হলো এর ওপরের চার্জ সংখ্যা। যেমন, সালফেট (SO₄²⁻) এর যোজনী ২, কারণ এর চার্জ হলো 2-।
-
যোজনী কি ভগ্নাংশ হতে পারে? (Can valency be a fraction?)
সাধারণত, যোজনী পূর্ণ সংখ্যা (Whole number) হয়। তবে কিছু জটিল যৌগের ক্ষেত্রে ভগ্নাংশ যোজনী দেখা যেতে পারে, কিন্তু সেটি মূলত গড় যোজনী (Average valency)।
-
যোজনী কিভাবে রাসায়নিক বিক্রিয়া বুঝতে সাহায্য করে? (How does valency help in understanding chemical reactions?)
যোজনী আমাদের জানতে সাহায্য করে যে একটি মৌল অন্য মৌলের সাথে কিভাবে যুক্ত হবে এবং কয়টি পরমাণু একত্রিত হয়ে একটি যৌগ গঠন করবে। এটি রাসায়নিক সমীকরণ (Chemical Equation) লিখতে এবং বিক্রিয়াটি সঠিকভাবে বুঝতে সহায়ক। -
যোজনী এবং জারণ সংখ্যা (Oxidation number) কি একই? (Are valency and oxidation number the same?)
না, যোজনী এবং জারণ সংখ্যা দুটি ভিন্ন ধারণা। যোজনী হলো একটি পরমাণুর বন্ধন গঠনের ক্ষমতা, যেখানে জারণ সংখ্যা হলো কোনো যৌগে একটি পরমাণুর চার্জ, যদি ধরে নেওয়া হয় যে যৌগটি আয়নিক বন্ধন দ্বারা গঠিত। জারণ সংখ্যা ধনাত্মক, ঋণাত্মক বা শূন্য হতে পারে, কিন্তু যোজনী সাধারণত একটি ধনাত্মক পূর্ণসংখ্যা।
উপসংহার (Conclusion)
আশা করি, “যোজনী কাকে বলে” এই বিষয়ে আপনার মনে আর কোনো প্রশ্ন নেই। যোজনী রসায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা, যা আমাদের যৌগ গঠন এবং রাসায়নিক বিক্রিয়া বুঝতে সাহায্য করে। নিয়মিত অনুশীলন এবং সঠিক ধারণার মাধ্যমে আপনি সহজেই এই বিষয়টি আয়ত্ত করতে পারবেন।
যদি এই ব্লগটি আপনার ভালো লেগে থাকে, তাহলে অবশ্যই বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন এবং নিচে কমেন্ট করে জানান আপনার আর কী কী বিষয়ে জানতে আগ্রহী। রসায়নের আরও মজার বিষয় নিয়ে খুব শীঘ্রই আমরা আবার হাজির হবো! টিল দেন, ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।