আচ্ছা, বিদ্যুতের দুনিয়ায় ডুব দিতে প্রস্তুত তো? ধরুন, আপনি একটা নদীর ধারে দাঁড়িয়ে আছেন। নদীর স্রোত যেমন জলের পরিমাণ আর পথের ওপর নির্ভর করে, তেমনই কোনো তারের মধ্যে দিয়ে বিদ্যুৎ কতটা সহজে যাবে, সেটা নির্ভর করে তারের উপাদানের ওপর। আর এইখানেই আসে আপেক্ষিক রোধের (Specific Resistance) ধারণা!
আপেক্ষিক রোধ: বিদ্যুতের পথের বাধা
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, আপেক্ষিক রোধ হলো কোনো পরিবাহী (conductor) পদার্থের একক দৈর্ঘ্য এবং একক প্রস্থচ্ছেদের (cross-sectional area) একটি তারের রোধ। মানে, তারটি যদি ১ মিটার লম্বা হয় এবং তার প্রস্থচ্ছেদের ক্ষেত্রফল ১ বর্গমিটার হয়, তাহলে সেই তারের রোধই হল ঐ পদার্থের আপেক্ষিক রোধ। একে রোধাঙ্ক (Resistivity) ও বলা হয়। ব্যাপারটা একটু কঠিন লাগছে, তাই তো? একটা উদাহরণ দিলে সহজ হবে।
ধরুন, আপনার কাছে দুটো তার আছে – একটা তামা (copper) দিয়ে তৈরি, আরেকটা লোহা (iron) দিয়ে। দুটো তারেরই দৈর্ঘ্য আর প্রস্থচ্ছেদ সমান। কিন্তু আপনি দেখবেন তামার তারের মধ্যে দিয়ে কারেন্ট খুব সহজে যাচ্ছে, কারণ তামার আপেক্ষিক রোধ লোহার চেয়ে কম। তার মানে, তামা বিদ্যুৎ পরিবহনে লোহার চেয়ে ভালো।
আপেক্ষিক রোধের সংজ্ঞা (Definition of Specific Resistance)
কোনো নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় একক দৈর্ঘ্য এবং একক প্রস্থচ্ছেদের ক্ষেত্রফলবিশিষ্ট কোনো পরিবাহীর রোধকে ঐ পরিবাহীর উপাদানের আপেক্ষিক রোধ বা রোধাঙ্ক বলে।
আপেক্ষিক রোধের একক (Unit of Specific Resistance)
আপেক্ষিক রোধের একক হলো ওহম-মিটার (Ohm-meter) বা Ω⋅m।
আপেক্ষিক রোধকে প্রভাবিত করার বিষয়গুলো (Factors Affecting Specific Resistance)
আপেক্ষিক রোধ কিন্তু সব সময় একই থাকে না। কিছু জিনিস আছে, যেগুলো এর মান পরিবর্তন করতে পারে। নিচে সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা হলো:
উপাদান (Material)
পরিবাহীর উপাদানই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিভিন্ন পদার্থের আপেক্ষিক রোধ বিভিন্ন হয়। যেমন, রূপার (silver) আপেক্ষিক রোধ সবচেয়ে কম, তাই এটি সবচেয়ে ভালো বিদ্যুৎ পরিবাহী।
তাপমাত্রা (Temperature)
সাধারণত, তাপমাত্রা বাড়লে পরিবাহীর আপেক্ষিক রোধ বাড়ে। কারণ তাপমাত্রা বাড়লে পরিবাহীর মধ্যে থাকা পরমাণুগুলোর কম্পন বেড়ে যায়, ফলে ইলেকট্রনের চলাচলে বাধা সৃষ্টি হয়।
ভেজাল (Impurities)
কোনো পরিবাহীতে ভেজাল মেশানো হলে তার আপেক্ষিক রোধ বেড়ে যায়। ভেজাল মেশানোর ফলে পরিবাহীর মধ্যে ইলেকট্রনের স্বাভাবিক গতিপথে বাধা সৃষ্টি হয়।
রোধ এবং আপেক্ষিক রোধের মধ্যে পার্থক্য (Difference Between Resistance and Specific Resistance)
অনেকেই রোধ (Resistance) আর আপেক্ষিক রোধের (Specific Resistance) মধ্যে গুলিয়ে ফেলেন। এদের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য আছে। চলুন, সেগুলো জেনে নেওয়া যাক:
বৈশিষ্ট্য | রোধ (Resistance) | আপেক্ষিক রোধ (Specific Resistance) |
---|---|---|
সংজ্ঞা | কোনো পরিবাহীর তড়িৎ প্রবাহে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা। | একক দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থচ্ছেদের পরিবাহীর রোধ। |
নির্ভরশীলতা | দৈর্ঘ্য, প্রস্থচ্ছেদ এবং উপাদানের উপর নির্ভরশীল। | শুধুমাত্র উপাদানের উপর নির্ভরশীল। |
একক | ওহম (Ohm) বা Ω | ওহম-মিটার (Ohm-meter) বা Ω⋅m |
পরিমাপ | রোধ সরাসরি পরিমাপ করা যায়। | আপেক্ষিক রোধ পরিমাপের জন্য রোধ, দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থচ্ছেদ জানতে হয়। |
বিভিন্ন পদার্থের আপেক্ষিক রোধ (Specific Resistance of Different Materials)
বিভিন্ন পদার্থের আপেক্ষিক রোধ বিভিন্ন হয়ে থাকে। নিচে কয়েকটি পরিচিত পদার্থের আপেক্ষিক রোধের মান দেওয়া হলো:
পদার্থ | আপেক্ষিক রোধ (Ω⋅m) |
---|---|
রূপা (Silver) | 1.59 x 10⁻⁸ |
তামা (Copper) | 1.68 x 10⁻⁸ |
সোনা (Gold) | 2.44 x 10⁻⁸ |
অ্যালুমিনিয়াম (Aluminum) | 2.82 x 10⁻⁸ |
লোহা (Iron) | 9.71 x 10⁻⁸ |
টাংস্টেন (Tungsten) | 5.60 x 10⁻⁸ |
কার্বন (Carbon) | 3.5 x 10⁻⁵ |
জার্মেনিয়াম (Germanium) | 0.46 |
সিলিকন (Silicon) | 640 |
কাচ (Glass) | 10¹⁰ – 10¹⁴ |
রাবার (Rubber) | 10¹³ – 10¹⁶ |
আপেক্ষিক রোধের ব্যবহার (Applications of Specific Resistance)
আপেক্ষিক রোধের ধারণা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অনেক কাজে লাগে। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার উল্লেখ করা হলো:
- বৈদ্যুতিক তার (Electrical wires): বিদ্যুৎ পরিবহনের জন্য ভালো পরিবাহী তার তৈরি করতে আপেক্ষিক রোধের জ্ঞান অপরিহার্য।
- হিটিং এলিমেন্ট (Heating elements): বৈদ্যুতিক হিটার, ইস্ত্রি ইত্যাদিতে যে গরম করার কয়েল ব্যবহার করা হয়, তা উচ্চ আপেক্ষিক রোধ সম্পন্ন পদার্থ দিয়ে তৈরি করা হয়।
- রেজিস্টর (Resistors): ইলেকট্রনিক সার্কিটে কারেন্ট নিয়ন্ত্রণ করার জন্য রেজিস্টর ব্যবহার করা হয়, যা নির্দিষ্ট আপেক্ষিক রোধের পদার্থ দিয়ে তৈরি।
- সেন্সর (Sensors): কিছু সেন্সর আছে, যেগুলোর রোধ তাপমাত্রার সাথে পরিবর্তিত হয়। এই ধরনের সেন্সর তৈরিতে আপেক্ষিক রোধের ধারণা কাজে লাগে।
- থার্মিস্টর (Thermistors): থার্মিস্টর হলো এক ধরনের রেজিস্টর, যার রোধ তাপমাত্রার ওপর খুব সংবেদনশীল। এগুলো তৈরিতে অর্ধপরিবাহী (semiconductor) পদার্থের আপেক্ষিক রোধ ব্যবহার করা হয়।
আপেক্ষিক রোধ সম্পর্কিত কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর (FAQs About Specific Resistance)
আপেক্ষিক রোধ নিয়ে অনেকের মনে কিছু প্রশ্ন থাকে। নিচে কয়েকটি সাধারণ প্রশ্ন ও তার উত্তর দেওয়া হলো:
আপেক্ষিক রোধ তাপমাত্রা বাড়লে কেন বাড়ে?
তাপমাত্রা বাড়লে পরিবাহীর পরমাণুগুলোর কম্পন বাড়ে, যার ফলে ইলেকট্রনের চলাচলে বাধা সৃষ্টি হয়। এই কারণে আপেক্ষিক রোধ বৃদ্ধি পায়।
পরিবাহীর দৈর্ঘ্য বাড়লে কি আপেক্ষিক রোধ বাড়ে?
না, পরিবাহীর দৈর্ঘ্য বাড়লে রোধ বাড়ে, আপেক্ষিক রোধ নয়। আপেক্ষিক রোধ শুধুমাত্র উপাদানের বৈশিষ্ট্য।
সুপার কন্ডাক্টর (Superconductor) কি?
সুপার কন্ডাক্টর হলো এমন একটি পদার্থ, যা একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রার নিচে কোনো রকম রোধ ছাড়াই বিদ্যুৎ পরিবহন করতে পারে। এদের আপেক্ষিক রোধ শূন্যের কাছাকাছি।
অর্ধপরিবাহী (Semiconductor) কি?
অর্ধপরিবাহী হলো সেই সব পদার্থ, যাদের পরিবাহিতা পরিবাহী এবং অন্তরকের মাঝামাঝি। এদের আপেক্ষিক রোধ তাপমাত্রা এবং ভেজালের ওপর নির্ভর করে।
আপেক্ষিক রোধ কিভাবে পরিমাপ করা হয়?
আপেক্ষিক রোধ পরিমাপ করার জন্য প্রথমে পরিবাহীর রোধ (Resistance), দৈর্ঘ্য (Length) এবং প্রস্থচ্ছেদের ক্ষেত্রফল (Cross-sectional area) পরিমাপ করতে হয়। তারপর নিম্নলিখিত সূত্র ব্যবহার করে আপেক্ষিক রোধ বের করা হয়:
আপেক্ষিক রোধ (ρ) = (রোধ × ক্ষেত্রফল) / দৈর্ঘ্য
ρ = (R × A) / L
এখানে,
R = রোধ (Resistance)
A = প্রস্থচ্ছেদের ক্ষেত্রফল (Cross-sectional area)
L = দৈর্ঘ্য (Length)
রোধ এবং আপেক্ষিক রোধের মধ্যে সম্পর্ক কি?
রোধ এবং আপেক্ষিক রোধ একটি সরল সম্পর্ক দ্বারা জড়িত। কোনো পরিবাহীর রোধ তার দৈর্ঘ্যের সাথে সরাসরি সমানুপাতিক এবং প্রস্থচ্ছেদের ক্ষেত্রফলের সাথে ব্যস্তানুপাতিক। আপেক্ষিক রোধ হলো এই সমানুপাতিক ধ্রুবক।
R = ρ (L/A)
এখানে,
R = রোধ
ρ = আপেক্ষিক রোধ
L = দৈর্ঘ্য
A = প্রস্থচ্ছেদের ক্ষেত্রফল
দৈনন্দিন জীবনে আপেক্ষিক রোধের উদাহরণ কি কি?
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আপেক্ষিক রোধের অনেক উদাহরণ রয়েছে। নিচে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো:
- বৈদ্যুতিক তার: তামা বা অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি তার ব্যবহার করা হয়, কারণ এদের আপেক্ষিক রোধ কম এবং এরা ভালো বিদ্যুৎ পরিবাহী।
- হিটিং এলিমেন্ট: বৈদ্যুতিক হিটার এবং ইস্ত্রিতে নাইক্রোম তার ব্যবহার করা হয়, কারণ এর আপেক্ষিক রোধ বেশি এবং এটি গরম হয়ে আলো দেয়।
- ফিউজ তার: ফিউজ তার টিন এবং সীসার সংকর ধাতু দিয়ে তৈরি করা হয়, কারণ এর আপেক্ষিক রোধ বেশি এবং এটি সহজেই গলে গিয়ে বৈদ্যুতিক সার্কিট রক্ষা করে।
- লাইট বাল্ব: লাইট বাল্বের ফিলামেন্ট টাংস্টেন দিয়ে তৈরি করা হয়, কারণ এর আপেক্ষিক রোধ বেশি এবং এটি উত্তপ্ত হয়ে আলো দেয়।
উপসংহার
তাহলে, আপেক্ষিক রোধ যে বিদ্যুতের দুনিয়ায় কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন। এটা শুধু একটা সংজ্ঞা নয়, বরং এর ওপর নির্ভর করে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অনেক কিছু। বৈদ্যুতিক তার থেকে শুরু করে হিটিং এলিমেন্ট, সবকিছুতেই আপেক্ষিক রোধের ধারণা কাজে লাগে। তাই, এই বিষয়ে ভালোভাবে জানা আমাদের জন্য খুবই দরকারি।
আশা করি, আপেক্ষিক রোধ নিয়ে আপনার মনে আর কোনো প্রশ্ন নেই। যদি থাকে, তাহলে কমেন্ট করে জানাতে পারেন! আর হ্যাঁ, এই লেখাটি ভালো লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না। কে জানে, হয়তো আপনার একটা শেয়ার অনেকের কাজে লাগবে!