আচ্ছালামু আলাইকুম, কেমন আছেন সবাই? ভাবছেন তো, হঠাৎ করে বিজ্ঞান ক্লাস শুরু করলাম নাকি? আসলে, বিজ্ঞান কিন্তু আমাদের জীবনেরই একটা অংশ। আর আজকে আমরা বিজ্ঞানের তেমনই একটা মজার বিষয় নিয়ে আলোচনা করব – ভর সংখ্যা (Mass Number)। শুনে কঠিন মনে হলেও, বুঝিয়ে বললে দেখবেন এটা আসলে ডাল-ভাত!
ভর সংখ্যা কী, এটা কেন এত জরুরি, আর এটা কীভাবে বের করতে হয় – এই সবকিছু নিয়েই আজকের আলোচনা। তাই, খাতা-কলম (নাহ্, সিরিয়াস হওয়ার দরকার নেই!) নিয়ে তৈরি হয়ে যান, আর আমার সাথে ডুব দিন পরমাণুর গভীরে!
ভর সংখ্যা: পরমাণুর পরিচয়পত্র
ভর সংখ্যা (Mass Number) হলো কোনো পরমাণুর নিউক্লিয়াসে থাকা প্রোটন (proton) ও নিউট্রনের (neutron) মোট সংখ্যা। সহজ ভাষায় বললে, একটা পরমাণুর কেন্দ্রে যতগুলো প্রোটন আর নিউট্রন থাকে, সেই সংখ্যা যোগ করলেই আমরা ভর সংখ্যা পেয়ে যাই।
ভর সংখ্যাকে সাধারণত ‘A’ অক্ষর দিয়ে প্রকাশ করা হয়।
তাহলে, একটা উদাহরণ দেওয়া যাক? ধরুন, কার্বনের (Carbon) ভর সংখ্যা ১২। এর মানে হলো কার্বনের নিউক্লিয়াসে ৬টা প্রোটন আর ৬টা নিউট্রন আছে। (৬ + ৬ = ১২)
ভর সংখ্যা কেন গুরুত্বপূর্ণ?
ভর সংখ্যা অনেক কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। নিচে কয়েকটি কারণ আলোচনা করা হলো:
-
পরমাণুর পরিচিতি: ভর সংখ্যা একটা পরমাণুকে ভালোভাবে চিনতে সাহায্য করে। একই মৌলের ভিন্ন ভরসংখ্যার পরমাণুগুলোকে আইসোটোপ (Isotope) বলা হয়।
-
পরমাণুর গঠন বোঝা: ভর সংখ্যা থেকে আমরা জানতে পারি একটা পরমাণুর নিউক্লিয়াসে কয়টা প্রোটন ও নিউট্রন আছে।
-
নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া: নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া বোঝার জন্য ভর সংখ্যা একটি জরুরি বিষয়।
ভর সংখ্যা, পারমাণবিক সংখ্যা, আর আইসোটোপ: একটু জট পাকানো, একটু খোলাসা করা
ভর সংখ্যা (Mass Number) নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আরও দুটো বিষয় চলে আসে – পারমাণবিক সংখ্যা (Atomic Number) ও আইসোটোপ (Isotope)। এই তিনটে জিনিস গুলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাই একটু ভালো করে বুঝিয়ে বলা যাক।
পারমাণবিক সংখ্যা (Atomic Number)
পারমাণবিক সংখ্যা হলো কোনো মৌলের পরমাণুর নিউক্লিয়াসে থাকা প্রোটনের সংখ্যা। এটাকে ‘Z’ অক্ষর দিয়ে প্রকাশ করা হয়। একটা মৌলের পারমাণবিক সংখ্যাই বলে দেয় যে সেটা আসলে কোন মৌল। যেমন, সব কার্বন পরমাণুর পারমাণবিক সংখ্যা ৬। এর মানে, কার্বনের নিউক্লিয়াসে সবসময় ৬টা প্রোটন থাকবে।
আইসোটোপ (Isotope)
একই মৌলের পরমাণুগুলোর মধ্যে নিউট্রনের সংখ্যা ভিন্ন হতে পারে। যাদের নিউট্রন সংখ্যা ভিন্ন, তাদেরকে একে অপরের আইসোটোপ বলে। আইসোটোপগুলোর পারমাণবিক সংখ্যা একই থাকে, কিন্তু ভর সংখ্যা ভিন্ন হয়।
উদাহরণস্বরূপ, কার্বনের তিনটি আইসোটোপ আছে: কার্বন-১২ (12C), কার্বন-১৩ (13C), এবং কার্বন-১৪ (14C)। এদের সবার মধ্যেই ৬টা করে প্রোটন আছে, কিন্তু নিউট্রনের সংখ্যা ভিন্ন। কার্বন-১২ এ ৬টা নিউট্রন, কার্বন-১৩ এ ৭টা নিউট্রন, আর কার্বন-১৪ এ ৮টা নিউট্রন আছে।
নিচের টেবিলটি দেখলে ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হবে:
আইসোটোপ | প্রোটন সংখ্যা | নিউট্রন সংখ্যা | ভর সংখ্যা |
---|---|---|---|
কার্বন-১২ | ৬ | ৬ | ১২ |
কার্বন-১৩ | ৬ | ৭ | ১৩ |
কার্বন-১৪ | ৬ | ৮ | ১৪ |
ভর সংখ্যা, পারমাণবিক সংখ্যা, ও আইসোটোপের মধ্যে সম্পর্ক
এই তিনটি বিষয়ের মধ্যে একটা সুন্দর সম্পর্ক আছে। সেটা হলো:
- ভর সংখ্যা (A) = পারমাণবিক সংখ্যা (Z) + নিউট্রন সংখ্যা (N)
এই সূত্র ব্যবহার করে, যদি আমরা ভর সংখ্যা আর পারমাণবিক সংখ্যা জানি, তাহলে নিউট্রন সংখ্যা বের করতে পারব।
ভর সংখ্যা কীভাবে বের করতে হয়?
ভর সংখ্যা বের করাটা খুবই সোজা। আগেই বলেছি, এটা হলো নিউক্লিয়াসে থাকা প্রোটন ও নিউট্রনের মোট সংখ্যা। তাহলে, ভর সংখ্যা বের করার নিয়ম হলো:
- পরমাণুর প্রোটন সংখ্যা জানুন।
- পরমাণুর নিউট্রন সংখ্যা জানুন।
- প্রোটন সংখ্যা ও নিউট্রন সংখ্যা যোগ করুন।
যোগফলই হলো ভর সংখ্যা।
উদাহরণ: অক্সিজেনের (Oxygen) একটি পরমাণুর নিউক্লিয়াসে ৮টি প্রোটন এবং ৮টি নিউট্রন আছে। তাহলে এর ভর সংখ্যা কত?
উত্তর: ৮ (প্রোটন) + ৮ (নিউট্রন) = ১৬। সুতরাং, অক্সিজেনের ভর সংখ্যা হলো ১৬।
ভর সংখ্যা বের করার কিছু উদাহরণ
-
সোডিয়াম (Sodium) এর একটি পরমাণুতে ১১টি প্রোটন ও ১২টি নিউট্রন আছে। এর ভর সংখ্যা কত?
উত্তর: ১১ + ১২ = ২৩। সোডিয়ামের ভর সংখ্যা ২৩। -
অ্যালুমিনিয়াম (Aluminium) এর একটি পরমাণুতে ১৩টি প্রোটন ও ১৪টি নিউট্রন আছে। এর ভর সংখ্যা কত?
উত্তর: ১৩ + ১৪ = ২৭। অ্যালুমিনিয়ামের ভর সংখ্যা ২৭। -
ইউরেনিয়াম-২৩৫ (Uranium-235) আইসোটোপটিতে ৯২টি প্রোটন আছে। এর নিউট্রন সংখ্যা কত?
উত্তর: যেহেতু ভর সংখ্যা ২৩৫ এবং প্রোটন সংখ্যা ৯২, তাই নিউট্রন সংখ্যা = ২৩৫ - ৯২ = ১৪৩।
ভর সংখ্যা: কিছু মজার তথ্য
- ভর সংখ্যা সবসময় একটি পূর্ণ সংখ্যা হয়, ভগ্নাংশ হয় না। কারণ, প্রোটন বা নিউট্রন তো আর অর্ধেক হতে পারে না, তাই না?
- ভর সংখ্যাকে প্রায়ই মৌলের প্রতীকের উপরে বাম দিকে লেখা হয়। যেমন, 12C হলো কার্বন-১২ আইসোটোপের প্রতীক।
- প্রোটন ও নিউট্রনের ভর প্রায় সমান। তাই, ভর সংখ্যা পরমাণুর ভরের মোটামুটি একটা ধারণা দেয়। তবে, নিখুঁত ভর বের করতে গেলে আরও কিছু হিসাব-নিকাশ করতে হয় ,যেটা তোমরা বড় হলে শিখবে।
ভর সংখ্যা নিয়ে কিছু প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ)
ভর সংখ্যা নিয়ে তোমাদের মনে নিশ্চয়ই কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। নিচে তেমনই কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও তার উত্তর দেওয়া হলো:
-
প্রশ্ন: ভর সংখ্যা কি কোনো মৌলের বৈশিষ্ট্য?
উত্তর: না, ভর সংখ্যা কোনো মৌলের বৈশিষ্ট্য নয়। কারণ, একই মৌলের বিভিন্ন আইসোটোপের ভর সংখ্যা ভিন্ন হতে পারে। পারমাণবিক সংখ্যা (প্রোটন সংখ্যা) হলো কোনো মৌলের বৈশিষ্ট্য।
-
প্রশ্ন: ভর সংখ্যা কি পরিবর্তন হতে পারে?
উত্তর: হ্যাঁ, ভর সংখ্যা পরিবর্তন হতে পারে। নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার (Nuclear reaction) সময় পরমাণুর নিউক্লিয়াসে প্রোটন বা নিউট্রনের সংখ্যা পরিবর্তিত হলে ভর সংখ্যাও বদলে যায়।
-
প্রশ্ন: ভর সংখ্যা ও পারমাণবিক ভরের মধ্যে পার্থক্য কী? (পারমাণবিক ভর কি?)
**উত্তর:** ভর সংখ্যা হলো নিউক্লিয়াসে থাকা প্রোটন ও নিউট্রনের মোট সংখ্যা। আর পারমাণবিক ভর (Atomic mass) হলো একটি পরমাণুর প্রকৃত ভর। পারমাণবিক ভরকে সাধারণত ডাল্টনে (Dalton বা amu - atomic mass unit) প্রকাশ করা হয়। প্রোটন ও নিউট্রনের ভর ১ ডাল্টনের কাছাকাছি হলেও, এদের ভরের সামান্য পার্থক্য আছে। এছাড়াও, পরমাণুতে ইলেকট্রনের ভরও যুক্ত হয়। তাই, ভর সংখ্যা ও পারমাণবিক ভর এক নয়, তবে এরা কাছাকাছি মানের হয়।
-
প্রশ্ন: ভর সংখ্যা জানার গুরুত্ব কি?
উত্তর: ভর সংখ্যা থেকে আমরা একটা পরমাণুর গঠন সম্পর্কে জানতে পারি। এছাড়াও, আইসোটোপ সনাক্তকরণ, নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া বোঝা, এবং তেজস্ক্রিয় ডেটিং (Radioactive dating) এর মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভর সংখ্যা খুব দরকারি।
-
প্রশ্ন: আইসোটোপের ভর সংখ্যা কীভাবে আলাদা হয়?
উত্তর: আইসোটোপগুলোর প্রোটন সংখ্যা একই থাকে, কিন্তু নিউট্রন সংখ্যা ভিন্ন হওয়ার কারণে তাদের ভর সংখ্যা আলাদা হয়।
ভর সংখ্যা, আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর, এবং মোলার ভর
ভর সংখ্যা বোঝার পরে, আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর (Relative atomic mass) এবং মোলার ভর (Molar mass) সম্পর্কে একটু ধারণা নেওয়া যাক। এই বিষয়গুলো রসায়ন (Chemistry) বোঝার জন্য খুবই জরুরি।
আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর (Relative Atomic Mass)
আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর হলো কোনো মৌলের একটি পরমাণুর গড় ভর, যা কার্বন-১২ (12C) আইসোটোপের ভরের ১/১২ অংশের সাথে তুলনা করে প্রকাশ করা হয়। যেহেতু বেশিরভাগ মৌলের একাধিক আইসোটোপ প্রকৃতিতে পাওয়া যায়, তাই আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর হলো তাদের প্রাচুর্য (Abundance) অনুসারে হিসাব করা গড় ভর।
আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর বের করার নিয়ম:
- প্রকৃতিতে মৌলের প্রতিটি আইসোটোপের ভর এবং প্রাচুর্য নির্ণয় করুন।
- প্রতিটি আইসোটোপের ভরকে তার প্রাচুর্য দিয়ে গুণ করুন।
- গুণফলগুলোকে যোগ করুন।
উদাহরণ: ক্লোরিনের দুটি আইসোটোপ রয়েছে: ক্লোরিন-৩৫ (35Cl) এবং ক্লোরিন-৩৭ (37Cl)। প্রকৃতিতে এদের প্রাচুর্য যথাক্রমে ৭৫.৭৭% এবং ২৪.২৩%।
আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর = (৩৫ × ৭৫.৭৭/১০০) + (৩৭ × ২৪.২৩/১০০) = ৩৫.৪৫ amu (প্রায়)
মোলার ভর (Molar Mass)
মোলার ভর হলো কোনো পদার্থের এক মোলের ভর, যা গ্রাম/মোল (g/mol) এককে প্রকাশ করা হয়। মোলার ভর সংখ্যাগতভাবে আপেক্ষিক পারমাণবিক ভরের সমান, তবে এর একক ভিন্ন।
উদাহরণ: কার্বনের আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর ১২ amu, তাই কার্বনের মোলার ভর হলো ১২ গ্রাম/মোল।
মোলার ভর ব্যবহার করে আমরা কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ায় (Chemical reaction) কতটুকু পদার্থ প্রয়োজন, তা হিসাব করতে পারি।
ভর সংখ্যা: বাস্তব জীবনে প্রয়োগ
ভর সংখ্যা শুধু বইয়ের পাতায় আটকে থাকা কোনো বিষয় নয়। আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও এর অনেক প্রয়োগ আছে। নিচে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো:
-
তেজস্ক্রিয় ডেটিং (Radioactive Dating): কার্বন-১৪ (14C) আইসোটোপ ব্যবহার করে পুরনো প্রত্নতত্ত্বিক বস্তু বা জীবাশ্মের বয়স নির্ণয় করা হয়। 14C এর ভর সংখ্যা ১৪, যা একে সাধারণ কার্বন-১২ থেকে আলাদা করে।
-
চিকিৎসা বিজ্ঞান: তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ ব্যবহার করে ক্যান্সার নির্ণয় ও চিকিৎসা করা হয়। যেমন, আয়োডিন-১৩১ (131I) থাইরয়েড গ্রন্থির রোগ নির্ণয়ে ব্যবহৃত হয়।
-
নিউক্লিয়ার শক্তি: ইউরেনিয়াম-২৩৫ (235U) নিউক্লিয়ার চুল্লিতে (Nuclear reactor) ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।
- কৃষি: ফসলের ফলন বাড়াতে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ ব্যবহার করা হয়।
উপসংহার
ভর সংখ্যা (Mass Number) আপাতদৃষ্টিতে কঠিন মনে হলেও, এটা আসলে পরমাণুর একটা গুরুত্বপূর্ণ পরিচয়পত্র। এটা আমাদের পরমাণুর গঠন, আইসোটোপ, এবং নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া বুঝতে সাহায্য করে। শুধু তাই নয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর অনেক প্রয়োগ রয়েছে।
আশা করি, আজকের আলোচনা থেকে ভর সংখ্যা সম্পর্কে তোমাদের ধারণা স্পষ্ট হয়েছে। বিজ্ঞানকে ভয় না পেয়ে, বরং মজা করে শিখতে থাকো। আর কোনো প্রশ্ন থাকলে, অবশ্যই কমেন্ট করে জানাও!
তাহলে, আজকের মতো বিদায়। ভালো থেকো সবাই! আল্লাহ হাফেজ।