আচ্ছা, বাচ্চা কিভাবে হয়, এই প্রশ্নটা নিশ্চয়ই ছোটবেলায় অনেকের মনে উঁকি দিয়েছে! আর বড় হয়ে সেই প্রশ্নের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশের উত্তর হলো নিষেক। “নিষেক কাকে বলে” – এই প্রশ্নটা শুনতে একটু জটিল মনে হলেও, এর ভেতরের গল্পটা কিন্তু বেশ মজার। চলেন, আজকের ব্লগ পোস্টে আমরা নিষেকের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো সহজভাবে জেনে নেই।
নিষেক: জীবনের শুরুটা যেখানে
নিষেক (Fertilization) হলো সেই প্রক্রিয়া, যেখানে একটি শুক্রাণু (sperm) একটি ডিম্বাণুর (ovum) সাথে মিলিত হয় এবং একটি নতুন কোষ তৈরি করে, যাকে জাইগোট (zygote) বলা হয়। এই জাইগোট পরবর্তীতে বিভাজিত হয়ে ভ্রূণ (embryo) এবং তারপর ধীরে ধীরে একটি পূর্ণাঙ্গ শিশুতে পরিণত হয়। অনেকটা যেন একটা নতুন গল্পের শুরু, যেখানে দুটি চরিত্র মিলেমিশে একটি নতুন অধ্যায় তৈরি করে।
নিষেকের সংজ্ঞা
সহজ ভাষায়, নিষেক হলো স্ত্রী জননকোষ (ডিম্বাণু) এবং পুরুষ জননকোষ (শুক্রাণু) এর মিলন প্রক্রিয়া। এই মিলনের ফলে নতুন জীবনের সূচনা হয়।
নিষেকের প্রকারভেদ: কোথায় এবং কিভাবে
নিষেক প্রধানত দুই প্রকার:
- বহিঃনিষেক (External Fertilization)
- অন্তঃনিষেক (Internal Fertilization)
বহিঃনিষেক (External Fertilization)
বহিঃনিষেক প্রক্রিয়ায় স্ত্রী ও পুরুষ জননকোষ উভয়েই স্ত্রী দেহের বাইরে মিলিত হয়। সাধারণত জলজ প্রাণীদের মধ্যে এই প্রক্রিয়া দেখা যায়।
বহিঃনিষেক কিভাবে ঘটে?
মাছ এবং উভচর প্রাণীরা সাধারণত এই পদ্ধতিতে বংশবৃদ্ধি করে। স্ত্রী মাছ বা ব্যাঙ ডিম পাড়ে এবং পুরুষ মাছ বা ব্যাঙ সেই ডিমের উপর শুক্রাণু নিঃসরণ করে। ডিম ও শুক্রাণু পানির মধ্যে মিলিত হয়ে জাইগোট গঠন করে। এখানে সাফল্যের হার কম থাকে, কারণ অনেক ডিম নষ্ট হয়ে যায় অথবা অন্য প্রাণীর খাদ্য হয়ে যায়।
অন্তঃনিষেক (Internal Fertilization)
অন্তঃনিষেক প্রক্রিয়ায় শুক্রাণু স্ত্রী দেহের ভেতরে প্রবেশ করে ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করে। স্থলজ প্রাণীদের মধ্যে এই প্রক্রিয়া দেখা যায়।
অন্তঃনিষেক কিভাবে ঘটে?
স্তন্যপায়ী প্রাণী, সরীসৃপ এবং পাখিরা এই পদ্ধতিতে বংশবৃদ্ধি করে। পুরুষ প্রাণী তার শুক্রাণু স্ত্রী প্রাণীর প্রজননতন্ত্রে প্রবেশ করায়। শুক্রাণু ডিম্বাণুর সাথে মিলিত হয়ে জাইগোট গঠন করে। এখানে নিষেকের সাফল্যের হার বেশি, কারণ ডিম্বাণু সুরক্ষিত থাকে।
এই প্রক্রিয়াটি কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়:
- শুক্রাণুর প্রবেশ: মিলনকালে পুরুষ সঙ্গী নারীর যোনিপথে শুক্রাণু নিঃসরণ করে। এই শুক্রাণুগুলো জরায়ু এবং ফ্যালোপিয়ান টিউবের দিকে সাঁতরে যায়।
- ডিম্বাণুর সাথে মিলন: যদি ফ্যালোপিয়ান টিউবে ডিম্বাণু উপস্থিত থাকে, তাহলে একটি শুক্রাণু ডিম্বাণুর মধ্যে প্রবেশ করে। ডিম্বাণুর প্রাচীর ভেদ করার জন্য শুক্রাণুকে বেশ বেগ পেতে হয়।
- জাইগোট গঠন: শুক্রাণু ডিম্বাণুর সাথে মিলিত হওয়ার সাথে সাথেই ডিম্বাণুর চারপাশে একটি শক্ত প্রাচীর তৈরি হয়, যা অন্য কোনো শুক্রাণুকে প্রবেশ করতে বাধা দেয়। এরপর শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর নিউক্লিয়াস মিলিত হয়ে জাইগোট গঠন করে।
মানবদেহে নিষেক: একটু গভীরে
মানুষের ক্ষেত্রে নিষেক একটি জটিল প্রক্রিয়া। এটি সাধারণত নারীর ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু নিঃসরণের পর ফ্যালোপিয়ান টিউবে (Fallopian tube) ঘটে।
ডিম্বাণু এবং শুক্রাণুর যাত্রা
ডিম্বাণু ডিম্বাশয় থেকে নিঃসৃত হওয়ার পর ফ্যালোপিয়ান টিউবের দিকে অগ্রসর হয়। শুক্রাণু যোনিপথ দিয়ে জরায়ু হয়ে ফ্যালোপিয়ান টিউবে পৌঁছায়।
নিষেক প্রক্রিয়া
ফ্যালোপিয়ান টিউবে ডিম্বাণু এবং শুক্রাণুর মিলন ঘটে। একটি শুক্রাণু ডিম্বাণুর মধ্যে প্রবেশ করে এবং তাদের নিউক্লিয়াস মিলিত হয়ে জাইগোট গঠন করে।
জাইগোট থেকে ভ্রূণ
জাইগোট এরপর বিভাজিত হতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে ভ্রূণে পরিণত হয়। এই ভ্রূণ জরায়ুতে স্থানান্তরিত হয় এবং সেখানে বড় হতে থাকে।
নিষেকের গুরুত্ব
নিষেক কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? এর উত্তর হলো, নিষেক ছাড়া নতুন জীবনের সূচনা হতে পারে না। এটি বংশগতির ধারা অক্ষুণ্ণ রাখে এবং প্রজাতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখে।
- নতুন জীবনের সূচনা: নিষেক একটি নতুন জীবের জন্ম দেয়।
- বংশগতির ধারা: এটি માતા-પિતા থেকে সন্তানের মধ্যে বৈশিষ্ট্য স্থানান্তর করে।
- প্রজাতির ধারাবাহিকতা: নিষেক প্রজাতির অস্তিত্ব রক্ষা করে।
নিষেক নিয়ে কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ)
এখানে নিষেক নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন এবং তাদের উত্তর দেওয়া হলো:
-
নিষেক কোথায় ঘটে?
উত্তর: মানুষের ক্ষেত্রে নিষেক সাধারণত ফ্যালোপিয়ান টিউবে ঘটে।
-
শুক্রাণু কতক্ষণ পর্যন্ত জীবিত থাকতে পারে?
উত্তর: নারীর প্রজননতন্ত্রে শুক্রাণু প্রায় ৫ দিন পর্যন্ত জীবিত থাকতে পারে।
-
ডিম্বাণু কতক্ষণ পর্যন্ত জীবিত থাকতে পারে?
উত্তর: ডিম্বাণু নিষিক্ত হওয়ার জন্য প্রায় ১২-২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত জীবিত থাকে।
-
নিষেক না হলে কি হয়?
উত্তর: নিষেক না হলে ডিম্বাণু নষ্ট হয়ে যায় এবং রজঃস্রাবের মাধ্যমে শরীর থেকে বেরিয়ে যায়।
-
ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন (IVF) কি?
উত্তর: IVF হলো একটি কৃত্রিম প্রজনন প্রক্রিয়া, যেখানে ডিম্বাণু এবং শুক্রাণুকে শরীরের বাইরে নিষিক্ত করা হয় এবং পরে ভ্রূণকে জরায়ুতে স্থাপন করা হয়।
বন্ধ্যাত্ব ও নিষেকের সমস্যা: কিছু কথা
অনেক দম্পতি বিভিন্ন কারণে সন্তান ধারণে সমস্যা অনুভব করেন। এর মধ্যে নিষেকের সমস্যা একটি বড় কারণ। অনিয়মিত মাসিক, ডিম্বাণু বা শুক্রাণুর গুণগত মান খারাপ হওয়া, ফ্যালোপিয়ান টিউবে বাধা ইত্যাদি কারণে নিষেক প্রক্রিয়া ব্যাহত হতে পারে।
বন্ধ্যাত্বের কারণ
- ডিম্বাণু উৎপাদনে সমস্যা
- শুক্রাণুর সংখ্যা কম বা দুর্বল
- ফ্যালোপিয়ান টিউবে বাধা
- জরায়ুর সমস্যা
- হরমোনের ভারসাম্যহীনতা
চিকিৎসা
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে বন্ধ্যাত্বের অনেক সমাধান রয়েছে। জীবনযাত্রার পরিবর্তন, ওষুধ, সার্জারি এবং辅助生殖 প্রযুক্তি (Assisted Reproductive Technology – ART) এর মাধ্যমে অনেক দম্পতি সন্তান লাভ করতে পারেন। IVF (In Vitro Fertilization) হলো ART-এর একটি উদাহরণ, যেখানে শরীরের বাইরে ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর মিলন ঘটানো হয়। এছাড়া IUI (Intrauterine Insemination), ICSI (Intracytoplasmic Sperm Injection)-এর মতো আধুনিক পদ্ধতিও বেশ জনপ্রিয়।
চিকিৎসা পদ্ধতি | বিবরণ | সাফল্যের হার |
---|---|---|
IVF | ডিম্বাণু ও শুক্রাণুকে শরীরের বাইরে নিষিক্ত করে ভ্রূণ তৈরি করা হয়, তারপর ভ্রূণকে জরায়ুতে স্থাপন করা হয়। | বয়স ও অন্যান্য স্বাস্থ্য পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে, সাধারণত ৩০-৫০% |
IUI | শুক্রাণুকে সরাসরি জরায়ুতে প্রবেশ করানো হয়, যাতে ডিম্বাণুর সাথে মিলিত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। | প্রতি সাইকেলে ১০-২০% |
ICSI | একটি শুক্রাণুকে সরাসরি ডিম্বাণুর মধ্যে প্রবেশ করানো হয়। এটি সাধারণত দুর্বল শুক্রাণুর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। | IVF-এর মতোই, বয়স ও স্বাস্থ্যের ওপর নির্ভরশীল |
নিষেকের ভবিষ্যৎ: নতুন দিগন্ত
বিজ্ঞানীরা নিষেকের প্রক্রিয়াকে আরও উন্নত করার জন্য প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছেন। ভবিষ্যতে হয়তো এমন প্রযুক্তি আসবে, যা বন্ধ্যাত্বের সমস্যাকে সম্পূর্ণভাবে দূর করতে পারবে। জিনোম এডিটিং (Genome editing) এবং অন্যান্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সুস্থ এবং স্বাভাবিক সন্তান জন্ম দেওয়া সম্ভব হবে।
উপসংহার
নিষেক হলো জীবনের প্রথম ধাপ, নতুন সৃষ্টির শুরু। এই জটিল এবং সুন্দর প্রক্রিয়াটি আমাদের বুঝিয়ে দেয় যে জীবন কত মূল্যবান। “নিষেক কাকে বলে” – এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার মাধ্যমে আমরা জীবনের অনেক গভীরে প্রবেশ করতে পারি। যদি আপনার নিষেক বা বন্ধ্যাত্ব নিয়ে কোনো প্রশ্ন থাকে, তবে অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। সুস্থ থাকুন, সুন্দর থাকুন!