আসসালামু আলাইকুম! যাকাত, ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের মধ্যে অন্যতম। এটা শুধু একটা আর্থিক সাহায্য নয়, বরং সমাজের অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার এক গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। কিন্তু যাকাত কাকে দেওয়া যাবে, এই নিয়ে আমাদের অনেকের মনেই প্রশ্ন থাকে। আজকের ব্লগ পোস্টে আমরা এই বিষয়টি নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা করব।
যাকাত ইসলামের একটি অত্যাবশ্যকীয় স্তম্ভ। এটি কেবল একটি আর্থিক সাহায্য নয়, বরং সমাজের অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যাকাত কাদের দেওয়া যাবে, এ নিয়ে আমাদের অনেকের মনেই বহু প্রশ্ন জাগে। আজকের ব্লগ পোস্টে, আমরা এ বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব যেন আপনার মনে থাকা সব দ্বিধা দূর হয়ে যায়।
যাকাত কাকে দেওয়া যাবে: একটি বিস্তারিত আলোচনা
যাকাত দেওয়ার উপযুক্ত কারা, তা আল্লাহ্ তা’আলা নিজেই কুরআনে বলে দিয়েছেন। সূরা তাওবার ৬০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ্ বলেন, “যাকাত হল কেবল ফকীর ও মিসকীনদের জন্য, এবং এতে নিয়োজিত কর্মচারীদের জন্য, এবং যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য, এবং ঋণ মুক্তির জন্য, এবং আল্লাহর পথে জেহাদকারীদের জন্য এবং মুসাফিরদের জন্য। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত; আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।” তাই, এই আটটি শ্রেণীভুক্ত ব্যক্তিরাই মূলত যাকাত পাওয়ার যোগ্য।
যাকাত বিতরণের নির্দিষ্ট কিছু নিয়মকানুন আছে। কুরআনের সূরা তাওবার ৬০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা নিজেই যাকাত বিতরণের খাতগুলো উল্লেখ করেছেন। এই আয়াত অনুযায়ী, আট শ্রেণির মানুষ যাকাত পাওয়ার যোগ্য:
- ফকির (অত্যন্ত অভাবগ্রস্থ)
- মিসকীন (দরিদ্র)
- যাকাত আদায় ও বিতরণে নিযুক্ত কর্মচারী
- ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে এমন ব্যক্তি
- দাসমুক্তি অথবা ঋণগ্রস্থ ব্যক্তি
- আল্লাহর পথে জিহাদে অংশগ্রহণকারী
- মুসাফির (ভ্রমণকারী)
এবার চলুন, এই শ্রেণীগুলো সম্পর্কে একটু বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
১. ফকীর: অভাবের চরমসীমায় থাকা মানুষ
ফকীর বলতে সেই সব লোকদের বোঝায়, যাদের সামান্য কিছু সম্পদ থাকলেও তা তাদের জীবন ধারণের জন্য যথেষ্ট নয়। তাদের জীবন চলে ধার-দেনা করে অথবা অন্যের সাহায্যের উপর নির্ভর করে। হয়তো তাদের এমন সামান্য কিছু আয় আছে যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।
ফকির বলতে সেই ব্যক্তিদের বোঝানো হয়, যাদের জীবন ধারণের জন্য সামান্য কিছু সম্পদ থাকলেও তা যথেষ্ট নয়। তারা ধার-দেনা করে বা অন্যের সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল।
২. মিসকীন: দরিদ্র কিন্তু আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন
মিসকীন অনেকটা ফকীরের মতোই, তবে তাদের কষ্টটা একটু ভিন্ন। তারা হয়তো মানুষের কাছে হাত পাততে পারেন না, কিন্তু তাদেরও অভাব অনটন লেগেই থাকে। তাদের দৈনন্দিন জীবন চালাতে হিমশিম খেতে হয়। এই শ্রেণির মানুষের আত্মসম্মানবোধ প্রবল।
মিসকিন অনেকটা ফকিরের মতোই, তবে তাদের কষ্ট একটু ভিন্ন। তারা হয়তো মানুষের কাছে হাত পাততে পারেন না, কিন্তু অভাব-অনটন তাদের নিত্যসঙ্গী। তাদের দৈনন্দিন জীবন চালাতে কষ্ট হয়।
৩. যাকাত আদায় ও বিতরণে নিযুক্ত কর্মচারী
যাকাত শুধু সংগ্রহ করলেই তো হবে না, তা সঠিকভাবে বিতরণও করতে হবে। আর এই কাজের জন্য কিছু লোক নিয়োজিত থাকেন। তাদের বেতন বা পারিশ্রমিক যাকাতের তহবিল থেকেই দেওয়া যায়।
যাকাত সংগ্রহ ও বিতরণের জন্য কিছু লোক নিয়োজিত থাকেন। তাদের বেতন বা পারিশ্রমিক যাকাতের তহবিল থেকে দেওয়া যায়।
৪. যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় (ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট)
নতুন কেউ ইসলামে আকৃষ্ট হলে অথবা ইসলামের প্রতি আগ্রহ দেখালে, তাদের সাহায্য করার জন্য যাকাতের অর্থ ব্যবহার করা যায়। এর মাধ্যমে তাদের মনে ইসলামের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হতে পারে।
নতুন কেউ ইসলামে আকৃষ্ট হলে অথবা ইসলামের প্রতি আগ্রহ দেখালে, তাদের সাহায্য করার জন্য যাকাতের অর্থ ব্যবহার করা যায়। এর মাধ্যমে তাদের মনে ইসলামের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হতে পারে।
৫. দাসমুক্তি অথবা ঋণগ্রস্থ ব্যক্তি
ইসলাম দাসপ্রথাকে সমর্থন করে না। তাই, কোনো দাস যদি মুক্তি পেতে চায়, তাহলে তাকে মুক্ত করার জন্য যাকাতের টাকা ব্যবহার করা যায়। এছাড়া, কেউ যদি ঋণের দায়ে জর্জরিত হয়ে থাকে, তাহলে তাকে ঋণমুক্ত করার জন্য যাকাতের অর্থ দেওয়া যায়।
ইসলাম দাসত্ব সমর্থন করে না। তাই, কোনও দাস মুক্তি পেতে চাইলে, তাকে মুক্ত করার জন্য যাকাতের টাকা ব্যবহার করা যায়। এছাড়া, কেউ যদি ঋণে জর্জরিত হয়ে থাকে, তাকে ঋণমুক্ত করার জন্য যাকাতের অর্থ দেওয়া যায়।
৬. আল্লাহর পথে জিহাদে অংশগ্রহণকারী
এখানে জিহাদ বলতে শুধুমাত্র সশস্ত্র যুদ্ধ বোঝায় না, বরং ইসলামের প্রচার ও প্রসারের জন্য যেকোনো বৈধ effort-কে বোঝায়। যারা আল্লাহর পথে কাজ করছেন, তাদের সাহায্য করার জন্য যাকাতের অর্থ ব্যবহার করা যায়।
এখানে জিহাদ বলতে শুধু সশস্ত্র যুদ্ধ বোঝায় না, বরং ইসলামের প্রচার ও প্রসারের জন্য যেকোনো বৈধ প্রচেষ্টাকে বোঝায়। যারা আল্লাহর পথে কাজ করছেন, তাদের সাহায্য করার জন্য যাকাতের অর্থ ব্যবহার করা যায়।
৭. মুসাফির (ভ্রমণকারী)
কোনো মুসাফির যদি ভ্রমণকালে আর্থিক সংকটে পড়েন, তাহলে তাকে যাকাতের অর্থ দিয়ে সাহায্য করা যায়। তবে শর্ত হলো, তার নিজ এলাকায় যথেষ্ট সম্পদ থাকতে হবে।
কোনও মুসাফির যদি ভ্রমণকালে আর্থিক সংকটে পড়েন, তাহলে তাকে যাকাতের অর্থ দিয়ে সাহায্য করা যায়। তবে শর্ত হলো, তার নিজ এলাকায় যথেষ্ট সম্পদ থাকতে হবে।
যাকাত বিতরণের ক্ষেত্রে কিছু জরুরি বিষয়
-
নিকটাত্মীয়দের প্রাধান্য: যাকাত দেওয়ার ক্ষেত্রে গরীব আত্মীয়-স্বজনকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। তবে নিজের স্ত্রী, সন্তান বা বাবা-মাকে যাকাত দেওয়া যায় না।
-
সঠিক নিয়ত: যাকাত দেওয়ার সময় অবশ্যই মনে নিয়ত থাকতে হবে যে আপনি যাকাত দিচ্ছেন। লোক দেখানোর জন্য দান করলে তা যাকাত হিসেবে গণ্য হবে না।
-
যাকাত দেওয়ার পরিমাণ: আপনার সম্পদের ২.৫% যাকাত হিসেবে দিতে হয়।
-
একবারে দেওয়া ভালো: সম্ভব হলে পুরো যাকাতের অর্থ একবারে দেওয়াই ভালো, যাতে recipient-এর প্রয়োজন মেটাতে সুবিধা হয়।
-
অমুসলিমকে যাকাত: যাকাতের টাকা অমুসলিমদের দেওয়া যায় না। যাকাত শুধুমাত্র মুসলিম দরিদ্রদের হক।
যাকাত বিষয়ক কিছু সাধারণ প্রশ্ন (FAQ)
যাকাত নিয়ে আমাদের মনে আরও অনেক প্রশ্ন ঘোরাফেরা করে। তাই, নিচে কয়েকটি সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
যাকাত কি শুধু রমজান মাসেই দিতে হয়?
আসলে, যাকাত দেওয়ার জন্য রমজান মাস নির্দিষ্ট নয়। তবে রমজান মাসে ইবাদতের সওয়াব অনেক বেশি, তাই অনেকে এই মাসে যাকাত দিতে পছন্দ করেন। আপনার সম্পদ নেসাব পরিমাণ হলে, বছরপূর্তি হওয়ার পর আপনি যখন খুশি যাকাত দিতে পারেন।
যাকাত দেওয়ার জন্য রমজান মাস নির্দিষ্ট নয়। তবে রমজান মাসে ইবাদতের সওয়াব বেশি হওয়ায় অনেকে এই মাসে যাকাত দিতে পছন্দ করেন। আপনার সম্পদ নেসাব পরিমাণ হলে, বছর পূর্তি হওয়ার পর আপনি যখন খুশি যাকাত দিতে পারেন।
যাকাতের টাকা দিয়ে কি মসজিদ বা মাদ্রাসা নির্মাণ করা যায়?
যাকাতের টাকা সরাসরি মসজিদ বা মাদ্রাসা নির্মাণের কাজে ব্যবহার করা যায় না। তবে, যদি কোনো গরীব ছাত্র মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে বা কোনো গরীব শিক্ষক সেখানে চাকরি করেন, তাহলে তাদের যাকাতের টাকা দিয়ে সাহায্য করা যেতে পারে।
যাকাতের টাকা সরাসরি মসজিদ বা মাদ্রাসা নির্মাণের কাজে ব্যবহার করা যায় না। তবে, যদি কোনও গরিব ছাত্র মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে বা কোনও গরিব শিক্ষক সেখানে চাকরি করেন, তাহলে তাদের যাকাতের টাকা দিয়ে সাহায্য করা যেতে পারে।
কাকে যাকাত দেওয়া যাবে না?
-
বাবা, মা, দাদা, দাদী, নানা, নানী, ছেলে, মেয়ে, নাতি, নাতনী এদেরকে যাকাত দেওয়া যায় না। কারণ শরীয়তে এদের ভরণপোষণ করা যাকাতদাতার ওপর আবশ্যক।
-
অমুসলিমদের যাকাত দেওয়া যায় না।
-
ধনী ব্যক্তিকে যাকাত দেওয়া যায় না।
- শারীরিকভাবে সক্ষম ব্যক্তিকে যাকাত দেওয়া যায় না।
যাকাত কিভাবে হিসাব করতে হয়?
যাকাত হিসাব করার নিয়ম হলো আপনার কাছে থাকা সোনা, রুপা, নগদ টাকা, ব্যবসার পণ্য এবং বিনিয়োগের মূল্য যোগ করে সেখান থেকে ঋণ বাদ দিন। যদি এই পরিমাণ ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী নির্ধারিত “নেসাব”-এর সমান বা তার বেশি হয়, তাহলে আপনাকে মোট সম্পদের ২.৫% যাকাত দিতে হবে।
এখানে একটি টেবিল দেওয়া হলো, যেখানে যাকাত হিসাব করার পদ্ধতি উল্লেখ করা হলো:
সম্পদের প্রকার | পরিমাণ | মূল্য (approx.) |
---|---|---|
সোনা | ২০ গ্রাম | ১,৮০,০০০ টাকা |
রুপা | ১০০ গ্রাম | ৭০,০০০ টাকা |
নগদ টাকা | – | ৫০,০০০ টাকা |
ব্যবসার পণ্য | – | ২,০০,০০০ টাকা |
মোট সম্পদ | ৫,০০,০০০ টাকা | |
ঋণ | ১,০০,০০০ টাকা | |
যাকাত দেওয়ার যোগ্য সম্পদ | ৪,০০,০০০ টাকা | |
যাকাতের পরিমাণ (২.৫%) | ১০,০০০ টাকা |
যাকাত দেওয়ার নিয়ম কি?
যাকাত দেওয়ার সময় কিছু বিষয় খেয়াল রাখা জরুরি। প্রথমত, যিনি যাকাত নিচ্ছেন তিনি যেন অবশ্যই যাকাত পাওয়ার যোগ্য হন। দ্বিতীয়ত, যাকাত দেওয়ার সময় কোনো রকম খোঁটা দেওয়া বা খারাপ ব্যবহার করা উচিত না। তৃতীয়ত, গোপনে যাকাত দেওয়া উত্তম, যাতে recipient-এর সম্মান বজায় থাকে।
যাকাত বিতরণের সময় কিছু বিষয়ে খেয়াল রাখা জরুরি। প্রথমত, যিনি যাকাত নিচ্ছেন, তিনি যেন অবশ্যই যাকাত পাওয়ার যোগ্য হন। দ্বিতীয়ত, যাকাত দেওয়ার সময় কোনও রকম খোঁটা দেওয়া বা খারাপ ব্যবহার করা উচিত নয়। তৃতীয়ত, গোপনে যাকাত দেওয়া উত্তম, যাতে গ্রহীতার সম্মান বজায় থাকে।
আধুনিক জীবনে যাকাতের গুরুত্ব
যাকাত শুধু একটি ধর্মীয় কর্তব্য নয়, এটি একটি শক্তিশালী সামাজিক ও অর্থনৈতিক হাতিয়ার। সঠিকভাবে যাকাত বিতরণ করা গেলে সমাজের দরিদ্রতা দূর করা সম্ভব। তাই, আসুন আমরা সবাই সঠিক নিয়ম মেনে যাকাত দেই এবং একটি সুন্দর সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি।
যাকাত কেবল একটি ধর্মীয় কর্তব্য নয়, এটি একটি শক্তিশালী সামাজিক ও অর্থনৈতিক হাতিয়ার। সঠিকভাবে যাকাত বিতরণ করা গেলে সমাজের দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব। তাই, আসুন আমরা সবাই সঠিক নিয়ম মেনে যাকাত দেই এবং একটি সুন্দর সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি।
মনে রাখবেন, আপনার দেওয়া সামান্য যাকাতের অর্থ হয়তো কারো জীবন বদলে দিতে পারে।
আশা করি, আজকের ব্লগ পোস্টটি থেকে আপনি যাকাত কাকে দেওয়া যাবে, সেই সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছেন। যদি আপনার মনে আরও কোনো প্রশ্ন থাকে, তাহলে কমেন্ট বক্সে জানাতে পারেন। ধন্যবাদ!
যদি এই লেখাটি আপনার ভালো লাগে, তবে অবশ্যই আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করবেন। আপনার একটি শেয়ার হয়তো অনেকের উপকারে আসতে পারে।