আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন সবাই? আমরা সবাই কম বেশি ফেরেশতাদের (মালায়েক) সম্পর্কে জানি। কিন্তু ফেরেশতা আসলে কী, তাদের কাজ কী, তারা দেখতে কেমন – এসব নিয়ে আমাদের মনে অনেক প্রশ্ন জাগে। আজকের ব্লগ পোস্টে আমরা ফেরেশতাদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করব। একদম সহজ ভাষায়, যেন আপনার মনে আর কোনো প্রশ্ন না থাকে!
ফেরেশতা: এক ঝলকে
ফেরেশতা মানে কী, তা জানার আগে চলুন, সংক্ষেপে কিছু তথ্য জেনে নেই:
- ফেরেশতারা নূরের তৈরি।
- তারা আল্লাহর আদেশে সবকিছু করেন।
- তাদের সংখ্যা অগণিত।
- তারা পানাহার করেন না এবং ঘুমান না।
ফেরেশতা কাকে বলে? (Firishta kake bole)
ফেরেশতা (ফারিশতা) শব্দটি মূলত আরবি “মালাক” (مَلَك) শব্দের বহুবচন। মালাক মানে হলো বার্তাবাহক। ইসলামে, ফেরেশতারা হলেন আল্লাহর বিশেষ সৃষ্টি, যারা নূরের (আলো) তৈরি এবং আল্লাহর আদেশ পালনে সর্বদা নিয়োজিত। তারা আল্লাহর বার্তাবাহক হিসেবে কাজ করেন এবং বিভিন্ন কাজে আল্লাহকে সাহায্য করেন।
ফেরেশতাদের নিজস্ব কোনো ইচ্ছা নেই। তারা সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর ইচ্ছার অনুগত। তারা সবসময় আল্লাহর তাসবীহ ( praises) ও ইবাদতে মগ্ন থাকেন।
ফেরেশতাদের সৃষ্টি: নূরের ঝলক
ফেরেশতারা নূরের তৈরি, যা তাদের মানুষের থেকে আলাদা করেছে। আমরা মাটি থেকে তৈরি, আর জিন জাতি আগুনের তৈরি। ফেরেশতাদের এই নূরের তৈরি হওয়ার কারণে তারা মানুষের চোখে অদৃশ্য থাকতে পারে।
নূরের বৈশিষ্ট্য
- পবিত্র: নূর সবসময় পবিত্র এবং আলোকময়। ফেরেশতারাও তেমনি পবিত্র ও নিষ্পাপ।
- দ্রুতগামী: আলোর গতি অনেক বেশি। ফেরেশতারাও আল্লাহর আদেশ দ্রুত পালন করতে পারেন।
- রূপ পরিবর্তন: নূর বিভিন্ন রূপে দেখা দিতে পারে। তেমনি ফেরেশতারাও আল্লাহর ইচ্ছায় রূপ পরিবর্তন করতে পারেন।
ফেরেশতাদের কাজ: আল্লাহর ইচ্ছাপূরণ
ফেরেশতাদের প্রধান কাজ হলো আল্লাহর আদেশ পালন করা। আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন ফেরেশতাকে বিভিন্ন কাজের দায়িত্ব দিয়েছেন। তাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিচে উল্লেখ করা হলো:
আল্লাহর প্রশংসা ও তাসবীহ পাঠ
ফেরেশতারা সবসময় আল্লাহর প্রশংসায় মগ্ন থাকেন। তারা কখনো ক্লান্ত হন না বা বিরতি নেন না।
বার্তা বহন
ফেরেশতাদের অন্যতম প্রধান কাজ হলো নবী ও রাসূলদের কাছে আল্লাহর বাণী পৌঁছে দেওয়া। হযরত জিবরাঈল (আ.) এই কাজের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত।
মানুষের কাজকর্ম লিপিবদ্ধ করা
প্রত্যেক মানুষের সাথে দুজন করে ফেরেশতা থাকেন, যারা তাদের ভালো ও খারাপ কাজগুলো লিপিবদ্ধ করেন। এই ফেরেশতাদেরকে কিরামান কাতিবিন বলা হয়।
প্রাকৃতিক কাজে নিয়োজিত
কিছু ফেরেশতা বৃষ্টি, বাতাস, মেঘ ইত্যাদি প্রাকৃতিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত আছেন।
জান্নাত ও জাহান্নামের তত্ত্বাবধান
জান্নাতের তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত ফেরেশতাদের প্রধান হলেন রিদওয়ান (আ.) এবং জাহান্নামের তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত ফেরেশতাদের প্রধান হলেন মালিক (আ.)।
প্রধান ফেরেশতাগণ ও তাদের দায়িত্ব
ইসলামে কয়েকজন প্রধান ফেরেশতার কথা উল্লেখ আছে, যারা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তাদের কয়েকজনের সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হলো:
হযরত জিবরাঈল (আ.)
তিনি ওহী (আল্লাহর বাণী) নিয়ে নবী-রাসূলদের কাছে আসতেন। তিনি সবচেয়ে সম্মানিত ফেরেশতাদের মধ্যে অন্যতম।
হযরত মীকাঈল (আ.)
তিনি বৃষ্টি ও খাদ্য বিতরণের দায়িত্বে নিয়োজিত।
হযরত ইসরাফীল (আ.)
তিনি শিঙ্গায় ফুঁক দেবেন, যা কেয়ামতের শুরু ঘোষণা করবে।
হযরত আজরাঈল (আ.)
তিনি মানুষের রুহ (প্রাণ) কবজ করেন, অর্থাৎ মানুষের মৃত্যু ঘটান।
নিচে একটি টেবিলে প্রধান ৪ ফেরেশতার নাম ও তাদের কাজ সংক্ষেপে দেওয়া হলো:
ফেরেশতার নাম | দায়িত্ব |
---|---|
জিবরাঈল (আ.) | ওহী নিয়ে আসা |
মীকাঈল (আ.) | বৃষ্টি ও খাদ্য বিতরণ |
ইসরাফীল (আ.) | শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়া |
আজরাঈল (আ.) | রুহ কবজ করা (মৃত্যু ঘটানো) |
ফেরেশতাদের প্রতি বিশ্বাস কেন জরুরি?
ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের মধ্যে ফেরেশতাদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা অন্যতম। এর কিছু কারণ নিচে উল্লেখ করা হলো:
- এটি আল্লাহর প্রতি ঈমানের অংশ।
- ফেরেশতারা আল্লাহর আদেশ পালন করেন, তাই তাদের প্রতি বিশ্বাস আল্লাহর আনুগত্যের শিক্ষা দেয়।
- তারা সবসময় মানুষের ভালো চান, তাই তাদের প্রতি বিশ্বাস মানুষকে সৎ পথে চলতে উৎসাহিত করে।
ফেরেশতা ও মানুষ: কিছু পার্থক্য
ফেরেশতা এবং মানুষের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। নিচে কয়েকটি পার্থক্য উল্লেখ করা হলো:
বৈশিষ্ট্য | ফেরেশতা | মানুষ |
---|---|---|
সৃষ্টি | নূরের তৈরি | মাটির তৈরি |
খাদ্য ও পানীয় | প্রয়োজন নেই | প্রয়োজন আছে |
পাপ ও পূণ্য | নিষ্পাপ, শুধু আল্লাহর আদেশ পালন করেন | ভালো-মন্দ উভয় কাজ করার ক্ষমতা আছে |
অদৃশ্যতা | সাধারণত মানুষের চোখে অদৃশ্য | দৃশ্যমান |
লিঙ্গ | তাদের কোনো লিঙ্গ নেই (পুরুষ বা মহিলা নয়) | পুরুষ ও মহিলা উভয় লিঙ্গ রয়েছে |
ফেরেশতাদের সম্পর্কে কিছু ভুল ধারণা
আমাদের সমাজে ফেরেশতাদের নিয়ে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। যেমন:
- অনেকে মনে করেন, ফেরেশতারা শুধু ভালো কাজ করেন, খারাপ কাজ করেন না। আসলে, ফেরেশতাদের কোনো কাজ ভালো বা খারাপ নয়; তারা শুধু আল্লাহর আদেশ পালন করেন।
- কেউ কেউ মনে করেন, ফেরেশতাদের ডানা আছে এবং তারা উড়তে পারেন। কোরআন ও হাদিসে ফেরেশতাদের ডানা থাকার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু তা আক্ষরিক অর্থে নাও হতে পারে। এটি তাদের দ্রুত চলাচলের প্রতীক হতে পারে।
- আবার অনেকে মনে করেন, ফেরেশতারা মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করেন। আসলে, ভাগ্য নির্ধারণের মালিক একমাত্র আল্লাহ। ফেরেশতারা শুধু তা লিপিবদ্ধ করেন। মানুষের ভালো-মন্দ কাজের ফল আল্লাহই দেন।
কোরআন ও হাদিসে ফেরেশতা
কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে এবং অসংখ্য হাদিসে ফেরেশতাদের সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। সূরা বাকারার ২৮৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, “রাসূল বিশ্বাস করেন সেই বিষয়ের উপর যা তাঁর রবের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে এবং মুমিনগণও। তাদের প্রত্যেকে বিশ্বাস করে আল্লাহর উপর, তাঁর ফেরেশতাদের উপর, তাঁর কিতাবসমূহের উপর এবং তাঁর রাসূলগণের উপর।”
হাদিসে আছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “ফেরেশতাদেরকে নূরের তৈরি করা হয়েছে, আর জিনদেরকে আগুনের শিখা থেকে তৈরি করা হয়েছে এবং আদমকে (আ.) মাটি থেকে তৈরি করা হয়েছে।” (সহীহ মুসলিম, ২৯৯৬)
এসব আয়াত ও হাদিস থেকে আমরা ফেরেশতাদের অস্তিত্ব, তাদের কাজ এবং তাদের প্রতি বিশ্বাসের গুরুত্ব জানতে পারি।
দৈনন্দিন জীবনে ফেরেশতাদের প্রভাব
ফেরেশতাদের প্রতি বিশ্বাসের আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অনেক ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। নিচে কয়েকটি উল্লেখ করা হলো:
- সৎ পথে চলতে উৎসাহিত করে: যখন আমরা জানি যে ফেরেশতারা আমাদের কাজকর্ম লিপিবদ্ধ করছেন, তখন আমরা খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করি।
- আল্লাহর প্রতি আনুগত্য বাড়ায়: ফেরেশতারা সবসময় আল্লাহর আদেশ পালন করেন, তাই তাদের দেখে আমরাও আল্লাহর প্রতি অনুগত হতে উৎসাহিত হই।
- মানসিক শান্তি এনে দেয়: যখন কোনো বিপদ আসে, তখন আমরা জানি যে আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন এবং ফেরেশতারা আমাদের সাহায্য করছেন, এতে আমাদের মনে শান্তি আসে।
ফেরেশতা নিয়ে কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ):
এখানে ফেরেশতাদের সম্পর্কে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
ফেরেশতারা কি খায়?
উত্তর: না, ফেরেশতারা খান না এবং পান করেন না। তাদের খাদ্য ও পানীয়ের প্রয়োজন নেই।
ফেরেশতারা কি ঘুমায়?
উত্তর: না, ফেরেশতারা ঘুমান না। তারা সবসময় আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন থাকেন।
সবচেয়ে শক্তিশালী ফেরেশতা কে?
উত্তর: যদিও সকল ফেরেশতাই আল্লাহর ইচ্ছায় শক্তিশালী, হযরত জিবরাঈল (আ.) কে সবচেয়ে সম্মানিত এবং শক্তিশালী ফেরেশতাদের মধ্যে গণ্য করা হয়।
মহিলা ফেরেশতা আছে কি?
উত্তর: ইসলামে ফেরেশতাদের কোনো লিঙ্গ নেই। তারা পুরুষ বা মহিলা কোনোটিই নন।
ফেরেশতারা কিভাবে মানুষের সাহায্য করেন?
উত্তর: ফেরেশতারা বিভিন্নভাবে মানুষের সাহায্য করেন। তারা মুমিনদের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেন, বিপদ থেকে রক্ষা করেন এবং ভালো কাজের জন্য উৎসাহিত করেন।
ফেরেশতাদের সংখ্যা কত?
উত্তর: ফেরেশতাদের সংখ্যা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। তবে কোরআন ও হাদিসে তাদের বিশাল সংখ্যক হওয়ার কথা বলা হয়েছে।
ফেরেশতারা কি ভবিষ্যৎ জানেন?
উত্তর: ফেরেশতারা গায়েব (অদৃশ্য) জানেন না। তারা কেবল সেইটুকুই জানেন যা আল্লাহ তাদের জানান।
ফেরেশতাদের প্রতি বিশ্বাস না করলে কি হয়?
উত্তর: ফেরেশতাদের প্রতি বিশ্বাস ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের অংশ। এটি অস্বীকার করলে ঈমান থাকে না।
আমরা কিভাবে ফেরেশতাদের প্রতি সম্মান জানাতে পারি?
উত্তর: ফেরেশতাদের প্রতি সম্মান জানানোর উপায় হলো আল্লাহর আদেশ পালন করা এবং সৎ পথে চলা।
“কিরামান কাতিবিন” কারা?
উত্তর: “কিরামান কাতিবিন” হলেন সেই ফেরেশতাগণ যারা মানুষের ভালো ও খারাপ কাজ লিপিবদ্ধ করেন।
“আজরাইল” নামের কোনো ফেরেশতা আছেন?
উত্তর: হ্যাঁ, আজরাইল (আ.) একজন ফেরেশতা, যিনি মানুষের রুহ কবজ করার দায়িত্বে নিয়োজিত।
ফেরেশতাদের সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য
- ফেরেশতাদের মধ্যে কেউ কেউ বিশেষ দোয়া করেন।
- কিছু ফেরেশতা শহীদদের রুহের সাথে থাকেন।
- ফেরেশতারা মুমিনদের ভালোবাসেন এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
উপসংহার
ফেরেশতারা আল্লাহর এক বিশেষ সৃষ্টি। তাদের প্রতি বিশ্বাস রাখা আমাদের ঈমানের অংশ। আশা করি, আজকের আলোচনা থেকে ফেরেশতাদের সম্পর্কে আপনার অনেক অজানা প্রশ্নের উত্তর পেয়েছেন। ফেরেশতাদের সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন করে, তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এবং আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে আমরা আমাদের জীবনকে সুন্দর করতে পারি।
যদি ফেরেশতাদের সম্পর্কে আরও কিছু জানতে চান, তাহলে কমেন্ট বক্সে জিজ্ঞাসা করতে পারেন। আর এই ব্লগ পোস্টটি ভালো লাগলে, বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না। আপনার একটি শেয়ার হয়তো অনেকের মনে থাকা প্রশ্নের উত্তর দিতে সাহায্য করবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক পথে চলার তৌফিক দান করুন। আমিন।