আজ আমরা জানব: অমরা কী, কেন জরুরী এবং এর যত খুঁটিনাটি!
আচ্ছা, কখনো কি ভেবেছেন, একটি ছোট্ট শিশু মায়ের গর্ভে কীভাবে সুরক্ষিত থাকে, কীভাবে সে বেড়ে ওঠে? এর পেছনে যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, সেটি হল অমরা। অনেকে একে গর্ভফুল বা প্ল্যাসেন্টাও বলে থাকেন। আজকের ব্লগ পোস্টে আমরা অমরা (Placenta) নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। তাহলে চলুন, শুরু করা যাক!
অমরা কী? (What is Placenta?)
অমরা বা গর্ভফুল হলো মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থায় জরায়ুর মধ্যে গঠিত একটি অস্থায়ী অঙ্গ। এটি মায়ের শরীর থেকে ভ্রূণের (fetus) মধ্যে অক্সিজেন ও পুষ্টি সরবরাহ করে এবং ভ্রূণের শরীর থেকে বর্জ্য পদার্থ মায়ের শরীরে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। সহজ ভাষায়, অমরা হলো মা ও শিশুর মধ্যে একটি সংযোগ স্থাপনকারী মাধ্যম।
অমরার গঠন (Structure of Placenta):
অমরা দেখতে অনেকটা চ্যাপ্টা, গোলাকার ডিস্কের মতো। গর্ভাবস্থার শুরুতে এটি তৈরি হতে শুরু করে এবং প্রসবের সময় শিশু জন্মের পরেই এটি জরায়ু থেকে বেরিয়ে আসে। অমরার দুটি দিক থাকে:
- মaternal side (মাতৃ দিক): এই দিকটি জরায়ুর প্রাচীরের সাথে লেগে থাকে এবং মায়ের রক্তনালী থেকে রক্ত গ্রহণ করে।
- Fetal side (ভ্রূণ দিক): এই দিকটি ভ্রূণের দিকে মুখ করে থাকে এবং এর সাথে আম্বিলিক্যাল কর্ড (umbilical cord) বা নাভিরজ্জু যুক্ত থাকে। এই নাভিরজ্জুর মাধ্যমেই ভ্রূণ পর্যন্ত অক্সিজেন ও পুষ্টি পৌঁছায়।
অমরার কাজ (Functions of Placenta):
অমরার প্রধান কাজগুলো হলো:
- পুষ্টি সরবরাহ (Nutrient Supply): অমরা মায়ের রক্ত থেকে গ্লুকোজ, অ্যামিনো অ্যাসিড, ভিটামিন, মিনারেল ইত্যাদি পুষ্টি উপাদান ভ্রূণের শরীরে পৌঁছে দেয়।
- অক্সিজেন সরবরাহ (Oxygen Supply): মায়ের রক্ত থেকে অক্সিজেন নিয়ে ভ্রূণকে সরবরাহ করে। ভ্রূণ এই অক্সিজেন ব্যবহার করে শ্বাসকার্য চালায়।
- বর্জ্য অপসারণ (Waste Removal): ভ্রূণের শরীরে তৈরি হওয়া কার্বন ডাই অক্সাইড, ইউরিয়া-সহ অন্যান্য বর্জ্য পদার্থ মায়ের রক্তে ফেরত পাঠায়, যা মায়ের শরীর থেকে বেরিয়ে যায়।
- হরমোন উৎপাদন (Hormone Production): অমরা গর্ভাবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় কিছু হরমোন তৈরি করে, যেমন – হিউম্যান কোরিওনিক গোনাডোট্রফিন (hCG), প্রোজেস্টেরন (progesterone) এবং ইস্ট্রোজেন (estrogen)। এই হরমোনগুলো গর্ভাবস্থার বিভিন্ন পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- রোগ প্রতিরোধ (Protection): অমরা মায়ের শরীর থেকে কিছু রোগ প্রতিরোধক অ্যান্টিবডি ভ্রূণের শরীরে সরবরাহ করে, যা জন্মের পরে কয়েক মাস পর্যন্ত শিশুকে বিভিন্ন রোগ থেকে রক্ষা করে।
গর্ভাবস্থায় অমরার অবস্থান (Placenta Position during Pregnancy):
গর্ভাবস্থায় জরায়ুর মধ্যে অমরার অবস্থান বিভিন্ন হতে পারে। সাধারণত, এটি জরায়ুর উপরের দিকে বা পাশের দিকে লেগে থাকে। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে এটি জরায়ুর নিচের দিকেও থাকতে পারে, যা ‘প্লাসেন্টা প্রিভিয়া’ (Placenta Previa) নামে পরিচিত। প্লাসেন্টা প্রিভিয়া একটি জটিল অবস্থা এবং এর জন্য বিশেষ চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।
অমরা সংক্রান্ত জটিলতা (Placenta Related Complications):
অমরা সংক্রান্ত কিছু জটিলতা গর্ভাবস্থায় দেখা যেতে পারে। এর মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য জটিলতা নিচে উল্লেখ করা হলো:
- প্লাসেন্টা প্রিভিয়া (Placenta Previa): যখন অমরা জরায়ুমুখের খুব কাছে অথবা জরায়ুমুখ সম্পূর্ণভাবে ঢেকে রাখে, তখন তাকে প্লাসেন্টা প্রিভিয়া বলে। এর কারণে গর্ভাবস্থায় রক্তপাত হতে পারে এবং সিজারিয়ান অপারেশনের প্রয়োজন হতে পারে।
- প্ল্যাসেন্টাল অ্যাবরাপশন (Placental Abruption): এই ক্ষেত্রে অমরা সময়ের আগে জরায়ু থেকে আলগা হয়ে যায়। এর ফলে ভ্রূণের অক্সিজেন ও পুষ্টি সরবরাহ কমে যেতে পারে এবং মায়ের রক্তপাত হতে পারে। এটি একটি জরুরি অবস্থা এবং দ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজন।
- প্লাসেন্টা অ্যাক্রিটা (Placenta Accreta): এই অবস্থায় অমরা জরায়ুর প্রাচীরের গভীরে প্রবেশ করে এবং প্রসবের পরে আলাদা হতে সমস্যা হয়। এর কারণে অতিরিক্ত রক্তপাত হতে পারে এবং জরায়ু অপসারণের প্রয়োজন হতে পারে।
- প্লাসেন্টাল ইনসাফিসিয়েন্সি (Placental Insufficiency): যখন অমরা ভ্রূণের চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত অক্সিজেন ও পুষ্টি সরবরাহ করতে পারে না, তখন প্লাসেন্টাল ইনসাফিসিয়েন্সি দেখা দেয়। এর ফলে ভ্রূণের বৃদ্ধি কমে যেতে পারে এবং অন্যান্য জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।
অমরা নিয়ে কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা (Frequently Asked Questions – FAQs):
আপনার মনে অমরা নিয়ে অনেক প্রশ্ন আসতে পারে, তাই নিচে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
-
প্রশ্ন: অমরা কি শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণ করতে পারে?
উত্তর: না, অমরার মাধ্যমে শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণ করা যায় না। শিশুর লিঙ্গ নির্ধারিত হয় নিষেক (fertilization) এর সময়, যখন ডিম্বাণু ও শুক্রাণু মিলিত হয়। -
প্রশ্ন: অমরার অবস্থান পরিবর্তন হতে পারে কি?
উত্তর: গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে অমরার অবস্থান নিচে থাকলে, জরায়ু বড় হওয়ার সাথে সাথে এর অবস্থান উপরে সরে যেতে পারে। তবে প্লাসেন্টা প্রিভিয়ার ক্ষেত্রে এটি সবসময় উপরে সরে নাও যেতে পারে। -
প্রশ্ন: অমরা কি খাওয়া যায়?
উত্তর: কিছু সংস্কৃতিতে প্রসবের পর অমরা খাওয়ার প্রচলন আছে, তবে এর স্বাস্থ্য উপকারিতা নিয়ে তেমন কোনো scientific প্রমাণ নেই। চিকিৎসকরা সাধারণত এটি খাওয়ার পরামর্শ দেন না, কারণ এতে সংক্রমণ হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
-
প্রশ্ন: গর্ভাবস্থায় অমরার স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য কী করা উচিত?
উত্তর: গর্ভাবস্থায় নিজের স্বাস্থ্য ভালো রাখা, সঠিক খাবার খাওয়া, নিয়মিত বিশ্রাম নেওয়া এবং ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলা অমরার স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য জরুরি। ধূমপান ও মদ্যপান থেকে সম্পূর্ণভাবে দূরে থাকুন। -
প্রশ্ন: অমরা কি মায়ের শরীরের অংশ?
উত্তর: অমরা মায়ের শরীরের অংশ নয়, এটি গর্ভাবস্থায় তৈরি হওয়া একটি অস্থায়ী অঙ্গ। -
প্রশ্ন: অমরার ওজন কত হতে পারে?
উত্তর: সাধারণত, একটি সুস্থ অমরার ওজন ৫০০ গ্রাম থেকে ১ কেজি পর্যন্ত হতে পারে।
-
প্রশ্ন: “অমরা ভক্ষণ” বা “Placentophagy” কী? এটা কি নিরাপদ?
উত্তর: “Placentophagy” মানে প্রসবের পর অমরা খাওয়া। কিছু সংস্কৃতিতে এটা প্রচলিত, কিন্তু এর স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে। সংক্রমণ বা দূষণের সম্ভাবনা থাকে। তাই, চিকিৎসকরা সাধারণত এটা নিরুৎসাহিত করেন। -
প্রশ্ন: অমরার কার্যকারিতা কমে গেলে কি হতে পারে?
উত্তর: অমরার কার্যকারিতা কমে গেলে গর্ভের শিশু পর্যাপ্ত পুষ্টি ও অক্সিজেন পাবে না। এর ফলে বাচ্চার বৃদ্ধি কম হতে পারে, সময়ের আগে প্রসবের ঝুঁকি বাড়তে পারে, এমনকি মৃত শিশুর জন্মও হতে পারে। -
প্রশ্ন: প্রসবের পর অমরা কতক্ষণ পর শরীর থেকে বের হয়?
উত্তর: সাধারণত, শিশু জন্মের ৫ থেকে ৩০ মিনিটের মধ্যে অমরা জরায়ু থেকে প্রাকৃতিকভাবে বের হয়ে যায়।
অমরা পরীক্ষা (Placenta Examination):
প্রসবের পর চিকিৎসক বা ধাত্রী (midwife) অমরা পরীক্ষা করেন। এই পরীক্ষার উদ্দেশ্য হলো:
- অমরাটি সম্পূর্ণভাবে বের হয়েছে কিনা, তা নিশ্চিত করা।
- অমরার মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা আছে কিনা, তা দেখা।
- অমরার আকার, গঠন এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলো মূল্যায়ন করা।
- কোনো রক্তনালী ছিঁড়ে গেছে কিনা, তা পরীক্ষা করা।
অমরার স্বাস্থ্য এবং গর্ভাবস্থার সম্পর্ক (Relationship between Placenta Health and Pregnancy):
অমরার স্বাস্থ্য গর্ভাবস্থার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি সুস্থ অমরা ভ্রূণের সঠিক বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য অপরিহার্য। অমরার কোনো সমস্যা হলে, তা ভ্রূণের স্বাস্থ্য এবং মায়ের শরীরেও জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। তাই গর্ভাবস্থায় নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো এবং ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলা উচিত।
অমরার বিকল্প (Alternatives of Placenta):
অমরার কোনো বিকল্প নেই। এটি একটি বিশেষ অঙ্গ, যা শুধুমাত্র গর্ভাবস্থাতেই তৈরি হয় এবং ভ্রূণের জীবন রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বর্তমানে, কিছু প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃত্রিম অমরা তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে, তবে এটি এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে আছে।
অমরার ভবিষ্যৎ গবেষণা (Future Research on Placenta):
অমরা নিয়ে গবেষণা ভবিষ্যতে গর্ভাবস্থার জটিলতাগুলো আরও ভালোভাবে বুঝতে এবং সমাধান করতে সাহায্য করতে পারে। বিজ্ঞানীরা অমরার গঠন, কার্যকারিতা এবং রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা নিয়ে আরও গভীর অনুসন্ধান চালাচ্ছেন। এর মাধ্যমে গর্ভাবস্থায় সুস্থ থাকতে নতুন নতুন উপায় খুঁজে বের করা সম্ভব হবে।
গর্ভাবস্থায় সুস্থ থাকতে কিছু টিপস (Tips for Staying Healthy during Pregnancy):
গর্ভাবস্থায় সুস্থ থাকার জন্য নিচে কিছু টিপস দেওয়া হলো:
- সুষম খাবার গ্রহণ করুন: প্রচুর ফল, সবজি, প্রোটিন এবং শস্য আপনার খাদ্য তালিকায় যোগ করুন।
- পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন: প্রতিদিন কমপক্ষে ৮ ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন।
- নিয়মিত ব্যায়াম করুন: হালকা ব্যায়াম, যেমন – হাঁটা গর্ভাবস্থার জন্য ভালো।
- ধূমপান ও মদ্যপান পরিহার করুন: এগুলো ভ্রূণের জন্য ক্ষতিকর।
- ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলুন: নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান এবং ডাক্তারের দেওয়া সব উপদেশ অনুসরণ করুন।
অমরা আমাদের জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা হয়তো আমরা অনেকেই জানি না। একটি সুস্থ শিশুর জন্ম দেওয়ার পেছনে এর অবদান অনেক। তাই গর্ভাবস্থায় নিজের শরীরের প্রতি যত্ন নিন, ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলুন, এবং সুস্থ থাকুন।