আচ্ছালামু আলাইকুম! কেমন আছেন সবাই? বাংলা ব্যাকরণের এক মজার বিষয় নিয়ে আজ আমরা কথা বলব। সেটা হল বাক্য। বাক্য ছাড়া কি আর মনের ভাব প্রকাশ করা যায়? একদমই না! তাই, বাক্য কী, কত প্রকার, আর উদাহরণগুলো কী কী – এসব জানতে পারলে আমাদের বাংলা ভাষার ব্যবহার আরও সুন্দর হবে, তাই না? চলুন, শুরু করা যাক!
বাক্য কাকে বলে? (Sentence Kake Bole)
সহজ ভাষায় যদি বলি, কয়েকটি শব্দ পাশাপাশি বসে যখন একটি সম্পূর্ণ মনের ভাব প্রকাশ করে, তখন তাকে বাক্য বলে। শুধু শব্দ থাকলেই হবে না, সেগুলোর একটা অর্থ থাকতে হবে এবং একটা সম্পর্ক থাকতে হবে। ধরুন, আমি বললাম “ভাত খাই”। এটা একটা বাক্য, কারণ এটা দিয়ে আমি কী করতে চাইছি সেটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।
আবার, যদি বলি “আমি খাই ভাত”, তাহলে শুনতে একটু অন্যরকম লাগছে, তাই না? যদিও এর একটা মানে আছে, কিন্তু বাক্যের গঠনটা ঠিক নেই। সুন্দর ও সঠিক বাক্য হতে হলে শব্দগুলোকে একটা নির্দিষ্ট অর্ডারে সাজাতে হয়।
বাক্যের প্রকারভেদ (Bakker Prokarved)
বাক্য প্রধানত তিন প্রকার:
- গঠন অনুসারে বাক্য (গঠন অনুযায়ী)
- অর্থ অনুসারে বাক্য (অর্থ অনুযায়ী)
- বাচ্য অনুসারে বাক্য (বাচ্য অনুযায়ী)
গঠন অনুসারে বাক্য (গঠন অনুযায়ী)
গঠন অনুসারে বাক্যকে আবার তিন ভাগে ভাগ করা যায়:
- সরল বাক্য বা সাধারণ বাক্য (Simple Sentence)
- জটিল বাক্য বা মিশ্র বাক্য (Complex Sentence)
- যৌগিক বাক্য (Compound Sentence)
সরল বাক্য বা সাধারণ বাক্য (Simple Sentence)
যে বাক্যে একটি মাত্র কর্তা (Subject) এবং একটি মাত্র সমাপিকা ক্রিয়া (Finite Verb) থাকে, তাকে সরল বাক্য বলে।
- উদাহরণ: “বৃষ্টি পড়ছে।” এখানে ‘বৃষ্টি’ হল কর্তা এবং ‘পড়ছে’ হল সমাপিকা ক্রিয়া।
- আমি ভাত খাই।
- সে স্কুলে যায়।
জটিল বাক্য বা মিশ্র বাক্য (Complex Sentence)
যে বাক্যে একটি প্রধান খণ্ডবাক্য (Principal Clause) এবং এক বা একাধিক আশ্রিত খণ্ডবাক্য (Subordinate Clause) থাকে, তাকে জটিল বাক্য বলে। আশ্রিত খণ্ডবাক্যগুলো প্রধান খণ্ডবাক্যের উপর নির্ভরশীল।
- উদাহরণ: “যদি তুমি আসো, তবে আমি যাব।” এখানে “যদি তুমি আসো” আশ্রিত খণ্ডবাক্য এবং “আমি যাব” প্রধান খণ্ডবাক্য।
- যে পরিশ্রম করে, সে সাফল্য লাভ করে।
- যখন বিপদ আসে, তখন সবাই ভয় পায়।
যৌগিক বাক্য (Compound Sentence)
দুই বা ততোধিক সরল বাক্য বা জটিল বাক্য যখন কোনো সংযোজক অব্যয় (Coordinating Conjunction) দ্বারা যুক্ত হয়ে একটি সম্পূর্ণ বাক্য গঠন করে, তখন তাকে যৌগিক বাক্য বলে।
- উদাহরণ: “সে গান গাইল এবং আমি নাচলাম।” এখানে “এবং” সংযোজক অব্যয়।
- তিনি ধনী, কিন্তু কৃপণ।
- তুমি কাজটি করতে পারো অথবা তাকে ডেকে নিতে পারো।
অর্থ অনুসারে বাক্য (অর্থ অনুযায়ী)
অর্থ অনুসারে বাক্যকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়:
- বিবৃতিমূলক বাক্য (Assertive/Declarative Sentence)
- অনুজ্ঞাসূচক বাক্য (Imperative Sentence)
- প্রশ্নবোধক বাক্য (Interrogative Sentence)
- বিস্ময়সূচক বাক্য (Exclamatory Sentence)
- ইচ্ছাসূচক বাক্য (Optative Sentence)
বিবৃতিমূলক বাক্য (Assertive/Declarative Sentence)
যে বাক্য দ্বারা কোনো সাধারণ ঘটনা, মতামত বা বিবৃতি প্রকাশ করা হয়, তাকে বিবৃতিমূলক বাক্য বলে।
- উদাহরণ: “সূর্য পূর্ব দিকে ওঠে।”
- আমি আজ সিনেমা দেখতে যাব।
- বাংলাদেশ একটি সুন্দর দেশ।
বিবৃতিমূলক বাক্য আবার দুই প্রকার:
- ইতিবাচক বাক্য (Affirmative Sentence): হ্যাঁ-বোধক বাক্য। যেমন: আমি যাব।
- নেতিবাচক বাক্য (Negative Sentence): না-বোধক বাক্য। যেমন: আমি যাব না।
অনুজ্ঞাসূচক বাক্য (Imperative Sentence)
যে বাক্য দ্বারা আদেশ, উপদেশ, অনুরোধ, নিষেধ ইত্যাদি প্রকাশ করা হয়, তাকে অনুজ্ঞাসূচক বাক্য বলে।
- উদাহরণ: “দয়া করে এখানে বসুন।”
- সবাই মনোযোগ দিয়ে শোনো।
- মিথ্যা কথা বলো না।
প্রশ্নবোধক বাক্য (Interrogative Sentence)
যে বাক্য দ্বারা কোনো প্রশ্ন করা হয়, তাকে প্রশ্নবোধক বাক্য বলে।
- উদাহরণ: “তোমার নাম কী?”
- তুমি কোথায় যাচ্ছো?
- আজ কি বৃষ্টি হবে?
বিস্ময়সূচক বাক্য (Exclamatory Sentence)
যে বাক্য দ্বারা আনন্দ, দুঃখ, ঘৃণা, বিস্ময় ইত্যাদি আবেগ প্রকাশ করা হয়, তাকে বিস্ময়সূচক বাক্য বলে।
- উদাহরণ: “কী সুন্দর দৃশ্য!”
- আহ! কী শান্তি!
- ছিঃ! তুমি এটা কী করে করলে?
ইচ্ছাসূচক বাক্য (Optative Sentence)
যে বাক্য দ্বারা কোনো ইচ্ছা, প্রার্থনা বা আশীর্বাদ প্রকাশ করা হয়, তাকে ইচ্ছাসূচক বাক্য বলে।
- উদাহরণ: “তোমার মঙ্গল হোক।”
- ঈশ্বর তোমার সহায় হোন।
- আমি যদি পাখি হতে পারতাম!
বাচ্য অনুসারে বাক্য (বাচ্য অনুযায়ী)
বাচ্য অনুসারে বাক্য তিন প্রকারঃ
- কর্তৃবাচ্য (Active Voice)
- কর্মবাচ্য (Passive Voice)
- ভাববাচ্য (Quasi-Passive Voice)
কর্তৃবাচ্য (Active Voice)
যে বাক্যে কর্তা প্রধান রূপে প্রতীয়মান হয় এবং কর্তার কাজকেই মুখ্যভাবে বোঝানো হয়, তাকে কর্তৃবাচ্য বলে।
- উদাহরণ: “আমি ভাত খাই।”
- ছেলেরা ফুটবল খেলছে।
- মা গান গাইছেন।
কর্মবাচ্য (Passive Voice)
যে বাক্যে কর্ম প্রধান রূপে প্রতীয়মান হয় এবং কর্মের কাজকেই মুখ্যভাবে বোঝানো হয়, তাকে কর্মবাচ্য বলে।
- উদাহরণ: “আমার দ্বারা ভাত খাওয়া হয়।”
- শিক্ষক কর্তৃক পুরষ্কার বিতরণ করা হল।
- পুলিশ কর্তৃক চোর ধৃত হয়েছে।
ভাববাচ্য (Quasi-Passive Voice)
যে বাক্যে কর্তা বা কর্মের প্রাধান্য না থেকে ক্রিয়ার ভাবের প্রাধান্য থাকে, তাকে ভাববাচ্য বলে।
- উদাহরণ: “আমাকে যেতে হবে।”
- আজ আমার শরীরটা ভালো লাগছে না।
- তোমাকে কাজটি করতে হবে।
কিছু অতিরিক্ত তথ্য যা আপনার কাজে লাগবে
- একটি সার্থক বাক্যের তিনটি গুণ থাকা আবশ্যক: আকাঙ্ক্ষা, আসক্তি ও যোগ্যতা।
- আকাঙ্ক্ষা (Expectancy): বাক্যের অর্থ সম্পূর্ণরূপে বোঝার জন্য অন্য পদের শোনার যে আগ্রহ থাকে।
- আসক্তি (Proximity): বাক্যের পদগুলো অর্থসঙ্গতি রক্ষার জন্য সুবিন্যস্তভাবে বসানো।
- যোগ্যতা (Fitness): বাক্যের অন্তর্গত পদগুলোর মধ্যে অর্থ ও ভাবের সঙ্গতি।
বাক্য নিয়ে কিছু মজার উদাহরণ
- “বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, নদে এলো বান।” – এটা একটা সরল বাক্য, যা প্রকৃতির ছবি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলে।
- “যতই পড়িবে, ততই শিখিবে।” – এটা একটা জটিল বাক্য, যা শিক্ষার গুরুত্ব বোঝায়।
- “তিনি সৎ, তাই সবাই তাঁকে সম্মান করে।” – এটা যৌগিক বাক্য, যা সততার প্রতি সম্মান দেখায়।
আসুন, আরও কিছু উদাহরণ দেখি:
বাক্যের প্রকার | উদাহরণ | ব্যাখ্যা |
---|---|---|
সরল বাক্য | পাখি উড়ে যায়। | এখানে একটি কর্তা (পাখি) এবং একটি সমাপিকা ক্রিয়া (উড়ে যায়) রয়েছে। |
জটিল বাক্য | যদি তুমি আসো, তবে আমি যাব। | এখানে “যদি তুমি আসো” আশ্রিত খণ্ডবাক্য এবং “আমি যাব” প্রধান খণ্ডবাক্য। |
যৌগিক বাক্য | সে গান গাইল এবং আমি নাচলাম। | এখানে “এবং” সংযোজক অব্যয় দ্বারা দুটি সরল বাক্য যুক্ত হয়েছে। |
প্রশ্নবোধক | তোমার বাড়ি কোথায়? | এই বাক্যটি একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করছে। |
বিস্ময়সূচক | কী দারুণ দৃশ্য! | এই বাক্যটি বিস্ময় প্রকাশ করছে। |
অনুজ্ঞাসূচক | দয়া করে দরজাটি বন্ধ করুন। | এই বাক্যটি একটি অনুরোধ জানাচ্ছে। |
ইচ্ছাসূচক | তুমি জীবনে অনেক বড় হও। | এই বাক্যটি একটি ইচ্ছা বা আশীর্বাদ প্রকাশ করছে। |
কর্তৃবাচ্য | শিশুরা ফুটবল খেলছে। | এখানে কর্তাই প্রধান এবং তার কাজ (ফুটবল খেলা) মুখ্য। |
কর্মবাচ্য | শিক্ষকদের দ্বারা ছাত্রদের পুরস্কৃত করা হল। | এখানে কর্ম (ছাত্রদের পুরস্কৃত করা) প্রধান। |
ভাববাচ্য | আমাকে যেতে হবে। | এখানে কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর চেয়ে ক্রিয়ার ভাবটাই প্রধান। |
বাক্য নিয়ে কিছু সাধারণ ভুল যা আমরা করি
আমরা প্রায়ই কথা বলার সময় বা লেখার সময় কিছু ভুল করে থাকি। যেমন:
- পদের ভুল স্থান: “আমি কালকে যাব বাড়ি” না বলে বলা উচিত “আমি কাল বাড়ি যাব”।
- অপ্রয়োজনীয় শব্দ ব্যবহার: “তিনি একজন ভালো মানুষ ছিলেন” না বলে শুধু “তিনি ভালো মানুষ ছিলেন” বলাই যথেষ্ট।
- লিঙ্গ এবং বচনের ভুল: “ছাত্রীরাটি গান গাইছে” না বলে বলা উচিত “ছাত্রীরা গান গাইছে”।
এই ছোটখাটো ভুলগুলোর দিকে খেয়াল রাখলে আমাদের ভাষার ব্যবহার আরও সুন্দর হবে।
বাক্য পরিবর্তন
এক ধরনের বাক্যকে অন্য ধরনের বাক্যে পরিবর্তন করা যায়। যেমন:
- সরল থেকে জটিল: “তিনি সাঁতার কাটেন” (সরল) থেকে “যে তিনি, সে সাঁতার কাটেন” (জটিল)।
- বিবৃতিমূলক থেকে প্রশ্নবোধক: “তিনি ভালো আছেন” (বিবৃতিমূলক) থেকে “তিনি কি ভালো আছেন?” (প্রশ্নবোধক)।
এই পরিবর্তনগুলো বাক্যকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে এবং মনের ভাব প্রকাশের ভিন্নতা আনে।
sentence কাকে বলে – নিয়ে কিছু প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ)
এখানে কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর দেওয়া হল যা বাক্য সম্পর্কে আপনার ধারণা আরও স্পষ্ট করবে:
- প্রশ্ন: একটি বাক্যে কয়টি অংশ থাকে?
উত্তর: একটি বাক্যে সাধারণত দুটি অংশ থাকে – উদ্দেশ্য (Subject) এবং বিধেয় (Predicate)। - প্রশ্ন: বাক্যের যোগ্যতা বলতে কী বোঝায়?
উত্তর: বাক্যের যোগ্যতা বলতে বোঝায় বাক্যের শব্দগুলোর মধ্যে অর্থ ও ভাবের সঙ্গতি। - প্রশ্ন: জটিল বাক্য চেনার সহজ উপায় কী?
উত্তর: জটিল বাক্যে সাধারণত “যদি”, “তবে”, “যে”, “সে”, “যখন”, “তখন” ইত্যাদি শব্দ থাকে। - প্রশ্ন: ভাববাচ্যের উদাহরণ দিন।
উত্তর: আমাকে কাজটি করতে হবে। - প্রশ্ন: সার্থক বাক্যের কয়টি গুণ থাকা আবশ্যক?
উত্তর: সার্থক বাক্যের তিনটি গুণ থাকা আবশ্যক: আকাঙ্ক্ষা, আসক্তি ও যোগ্যতা।
উপসংহার
তাহলে, আজকে আমরা বাক্য কাকে বলে, কত প্রকার ও কি কি, এবং উদাহরণসহ বিস্তারিত জানলাম। বাংলা ব্যাকরণের এই অংশটি ভালোভাবে বুঝতে পারলে আমাদের ভাষায় কথা বলা এবং লেখার দক্ষতা অনেক বাড়বে। বাক্য আমাদের মনের ভাব প্রকাশ করার প্রধান মাধ্যম। তাই, এর সঠিক ব্যবহার জানা খুবই জরুরি।
কেমন লাগলো আজকের আলোচনা? কোনো প্রশ্ন থাকলে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন। আর হ্যাঁ, এই ব্লগটি শেয়ার করতে ভুলবেন না! ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন। আল্লাহ হাফেজ!