আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন আপনারা? ধরুন, সারাদিন খেলার পর আপনার শরীরটা একটু কেমন যেন লাগছে, তাই না? মন চাইছে ঝট করে ফ্রেশ হয়ে নিতে। ঠিক তেমনি, আমাদের আত্মাকেও পরিশুদ্ধ করার একটা উপায় আছে। আর সেই উপায়টাই হল ওযু। কিন্তু, ওযু আসলে কী? কেন এটা এত গুরুত্বপূর্ণ? চলুন, আজ আমরা এই বিষয়ে বিস্তারিত জেনে নিই।
ওযু: পবিত্রতার চাবিকাঠি
ওযু শুধু হাত-মুখ ধোয়ার নাম নয়, এটা ইবাদতের প্রস্তুতি। নামাযের আগে যেমন শরীর ও মনকে পরিচ্ছন্ন করা জরুরি, তেমনই ওযু আমাদের সেই সুযোগ করে দেয়।
ওযু কাকে বলে?
ইসলামিক শরিয়তের পরিভাষায়, নামায বা অন্য কোনো ইবাদত করার পূর্বে পবিত্র হওয়ার উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট নিয়মে শরীরের কিছু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ধৌত করাকে ওযু বলা হয়। এটি একটি শারীরিক ও আত্মিক পরিচ্ছন্নতার প্রক্রিয়া।
ওযুর গুরুত্ব
ওযু শুধু একটি নিয়ম নয়, এর অনেক গুরুত্ব রয়েছে। নিচে কয়েকটি উল্লেখ করা হলো:
- পবিত্রতা: ওযু শরীর ও মনকে পবিত্র করে।
- ইবাদতের প্রস্তুতি: এটি নামাযের মতো ইবাদতের জন্য একটি পূর্বশর্ত।
- আল্লাহর সন্তুষ্টি: ওযুর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়।
- গুনাহ মাফ: নিয়মিত ওযু করলে ছোটখাটো গুনাহ মাফ হয়ে যায়।
ওযুর ফরজ কয়টি ও কি কি?
ওযুর ফরজ মানে হলো অত্যাবশ্যকীয় কাজ। এগুলো বাদ গেলে ওযু শুদ্ধ হবে না। ওযুর ৪টি ফরজ রয়েছে। আসুন, সেগুলো জেনে নিই:
-
সমস্ত মুখমণ্ডল ধোয়া: কপাল থেকে থুতনি পর্যন্ত এবং এক কানের লতি থেকে অন্য কানের লতি পর্যন্ত ভালোভাবে ধুতে হবে।
-
দুই হাতের কনুই পর্যন্ত ধোয়া: দুই হাতের আঙুলের অগ্রভাগ থেকে শুরু করে কনুই পর্যন্ত ভালোভাবে ধুতে হবে।
-
মাথার এক চতুর্থাংশ মাসেহ করা: মাথার সামনের দিক থেকে শুরু করে পেছনের দিকে চুলের ওপর হাত বুলানোকে মাসেহ বলা হয়।
- দুই পায়ের টাখনু পর্যন্ত ধোয়া: পায়ের আঙুলের অগ্রভাগ থেকে শুরু করে টাখনু পর্যন্ত ভালোভাবে ধুতে হবে।
ওযুর সঠিক নিয়ম
ওযু করার একটা সুন্দর নিয়ম আছে, যা অনুসরণ করলে ওযুটা সঠিকভাবে আদায় হয়। চলুন, সেই নিয়মটা জেনে নিই:
-
নিয়ত করা: মনে মনে ওযু করার সংকল্প করা। মুখে বলা জরুরি নয়, তবে “আমি পবিত্রতা অর্জনের জন্য ওযু করছি” এমন নিয়ত করা ভালো।
-
বিসমিল্লাহ বলা: ওযু শুরু করার আগে “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” বলা।
-
দুই হাতের কব্জি পর্যন্ত ধোয়া: প্রথমে দুই হাতের কব্জি পর্যন্ত তিনবার ধোয়া। আঙুলগুলোর মধ্যে ভালোভাবে খেয়াল করে ধুতে হবে।
-
কুলি করা: তিনবার ভালোভাবে কুলি করা। মুখের ভেতরের অংশ ভালোভাবে পরিষ্কার করা।
-
নাকে পানি দেওয়া ও পরিষ্কার করা: তিনবার নাকে পানি দেওয়া এবং বাঁ হাতের ছোট আঙুল দিয়ে নাক পরিষ্কার করা।
-
সমস্ত মুখমণ্ডল ধোয়া: কপাল থেকে থুতনি পর্যন্ত এবং এক কানের লতি থেকে অন্য কানের লতি পর্যন্ত তিনবার ধোয়া।
-
ডান হাত কনুই পর্যন্ত ধোয়া: প্রথমে ডান হাত এবং পরে বাম হাত আঙুলের অগ্রভাগ থেকে কনুই পর্যন্ত তিনবার ধোয়া।
-
মাথা মাসেহ করা: প্রথমে দুই হাত ভিজিয়ে মাথার সামনের দিক থেকে পেছনের দিকে একবার মাসেহ করা।
-
কান মাসেহ করা: শাহাদাত আঙুল দিয়ে কানের ভেতর এবং বুড়ো আঙুল দিয়ে কানের পেছনের অংশ মাসেহ করা।
-
ঘাড় মাসেহ করা: মাথার পেছনের দিক থেকে শুরু করে ঘাড়ের ওপর দিয়ে হাত বুলানো। তবে ঘাড় মাসেহ করা নিয়ে মতভেদ আছে।
-
ডান পা টাখনু পর্যন্ত ধোয়া: প্রথমে ডান পা এবং পরে বাম পা আঙুলের অগ্রভাগ থেকে টাখনু পর্যন্ত তিনবার ধোয়া। পায়ের আঙুলগুলোর মধ্যে ভালোভাবে পানি পৌঁছানো জরুরি।
-
দোয়া পড়া: ওযু শেষে একটি বিশেষ দোয়া পড়া সুন্নত।
- “আশহাদু আল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারীকা লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসুলুহু।”
ওযুর সুন্নাতসমূহ
ফরজগুলোর পাশাপাশি কিছু সুন্নাত কাজও আছে, যা ওযুকে আরও সুন্দর করে তোলে। নিচে কয়েকটি সুন্নাত উল্লেখ করা হলো:
- বিসমিল্লাহ বলা।
- মিসওয়াক করা।
- ডান দিক থেকে শুরু করা।
- তিনবার করে অঙ্গ ধৌত করা।
- এক অঙ্গ শুকানোর আগে অন্য অঙ্গ ধৌত করা।
- অযুর দোয়া পড়া।
ওযু ভঙ্গের কারণ
কিছু কারণে ওযু ভেঙে যায়। তাই, ওযু করার পর এই বিষয়গুলো খেয়াল রাখা জরুরি। নিচে কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা হলো:
- পায়খানা বা প্রস্রাব করা।
- বায়ু ত্যাগ করা।
- শরীর থেকে রক্ত, পুঁজ বা পানি বের হওয়া।
- মুখ ভরে বমি করা।
- ঘুমিয়ে যাওয়া (হেলান দিয়ে বা কাত হয়ে ঘুমালে)।
- পাগল বা অচেতন হয়ে যাওয়া।
- নামাযের মধ্যে শব্দ করে হাসা।
ওযু অবস্থায় যা করা নিষেধ
ওযু অবস্থায় কিছু কাজ করা নিষেধ। সেগুলো হলো:
- অপবিত্র কথা বলা।
- গান শোনা বা অশ্লীল কিছু দেখা।
- অন্যের ক্ষতি হয় এমন কাজ করা।
- ঝগড়া করা বা গালি দেওয়া।
তায়াম্মুম কি? কখন তায়াম্মুম করতে হয়?
তায়াম্মুম হলো পানি না পাওয়া গেলে বা পানি ব্যবহারে অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে পবিত্র মাটি দিয়ে ওযুর পরিবর্তে পবিত্রতা অর্জনের একটি ইসলামিক পদ্ধতি।
তায়াম্মুম করার নিয়ম
-
প্রথমে মনে মনে নিয়ত করতে হবে যে, আমি নামায আদায়ের জন্য তায়াম্মুম করছি।
-
এরপর দুই হাতের তালু পবিত্র মাটির ওপর মারতে হবে।
-
তারপর সেই হাত দিয়ে মুখমণ্ডল মাসেহ করতে হবে।
- আবারও দুই হাতের তালু মাটির ওপর মেরে ডান হাতের পিঠ বাম হাত দিয়ে এবং বাম হাতের পিঠ ডান হাত দিয়ে মাসেহ করতে হবে।
ওযু সম্পর্কিত কিছু জরুরি প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ)
এখানে ওযু নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও তার উত্তর দেওয়া হলো, যা আপনাদের কাজে লাগতে পারে:
প্রশ্ন: ওযু করার সময় যদি কোনো অঙ্গ ধুতে ভুলে যাই, তাহলে কী করব?
উত্তর: যদি ওযু করার সময় কোনো অঙ্গ ধুতে ভুলে যান এবং তা মনে পড়ার সাথে সাথেই ধুয়ে নেন, তাহলে আপনার ওযু হয়ে যাবে। তবে যদি অনেক পরে মনে পড়ে, তাহলে আবার নতুন করে ওযু করতে হবে।
প্রশ্ন: মোজা পরা অবস্থায় মাসেহ করার নিয়ম কি?
উত্তর: মোজা পরা অবস্থায় মাসেহ করাকে “মোজা মাসেহ” বলা হয়। এর কিছু নিয়ম আছে। যেমন –
- মোজাটি ওযু অবস্থায় পরতে হবে।
- মোজা দিয়ে পায়ের টাখনু ঢাকা থাকতে হবে।
- travelling এ থাকলে ৩ দিন ৩ রাত পর্যন্ত মোজা মাসেহ করা যায়।
প্রশ্ন: মহিলারা কিভাবে ওযু করবেন?
উত্তর: মহিলাদের ও পুরুষের ওযুর নিয়ম একই। কোনো ভিন্নতা নেই।
প্রশ্ন: অজু করার সময় কি দোয়া পড়া আবশ্যক?
উত্তর: অজু করার সময় দোয়া পড়া আবশ্যক নয়, তবে এটি একটি সুন্নাত।
প্রশ্ন: ভাঙ্গা হাত বা পায়ে কিভাবে অজু করতে হয়?
উত্তর: ভাঙ্গা হাত বা পায়ে যদি পানি লাগানোর কারণে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তবে সেই স্থান মাসেহ করতে হবে অথবা তায়াম্মুম করতে হবে।
প্রশ্ন: অজু করার পর নখ কাটলে কি অজু ভেঙ্গে যায়?
উত্তর: না, অজু করার পর নখ কাটলে অজু ভাঙ্গে না।
প্রশ্ন: মেকাপ করা অবস্থায় অজু করা যাবে কি?
উত্তর: মেকাপ যদি পানি প্রবেশে বাধা দেয়, তাহলে অজু হবে না। তাই, অজু করার আগে মেকাপ তুলে ফেলতে হবে।
প্রশ্ন: অজু ছাড়া কুরআন স্পর্শ করা যাবে কি?
উত্তর: না, অজু ছাড়া কুরআন স্পর্শ করা যায় না। কুরআন স্পর্শ করার পূর্বে অবশ্যই অজু করে নিতে হবে।
প্রশ্ন: তায়াম্মুমের জন্য কি মাটি শর্ত?
উত্তর: তায়াম্মুমের জন্য মাটি অথবা মাটি জাতীয় জিনিস, যেমন পাথর, বালি ইত্যাদি ব্যবহার করা যায়।
প্রশ্ন: অজুর ফজিলত কি?
উত্তর: অজুর ফজিলত অনেক। নিয়মিত অজু করলে গুনাহ মাফ হয়, মর্যাদা বৃদ্ধি পায় এবং চেহারা উজ্জ্বল হয়।
ওযু ও বিজ্ঞান
আধুনিক বিজ্ঞানও ওযুর উপকারিতা স্বীকার করে। নিয়মিত ওযু করলে শরীর পরিষ্কার থাকে এবং অনেক রোগ-জীবাণু থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এটি আমাদের ত্বক এবং স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী।
ওযুর সামাজিক প্রভাব
ওযু শুধু ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা নয়, এটি সমাজের ওপরও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। যখন একজন ব্যক্তি ওযু করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে, তখন সে অন্যকেও পরিচ্ছন্ন থাকতে উৎসাহিত করে।
শেষ কথা
ওযু শুধু একটি ইবাদত নয়, এটি আমাদের জীবনকে সুন্দর ও পবিত্র করার একটি উপায়। তাই, আসুন আমরা সবাই সঠিকভাবে ওযু করি এবং নিজেদের জীবনকে সুন্দর করি।
আশা করি, এই ব্লগ পোস্টটি আপনাদের ওযু সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিতে পেরেছে। যদি কোনো প্রশ্ন থাকে, তবে কমেন্ট করে জানাতে পারেন। আল্লাহ হাফেজ।