আচ্ছা, কখনো কি এমন হয়েছে, ইস্ত্রি করতে গিয়ে লোহার শরীরটা গরম হয়ে জামাকাপড়ের ভাঁজ সোজা করে দিচ্ছে, আর তুমি ভাবছ – “ব্যাপারটা কী?” অথবা, চার্জে বসানো ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখছ, বিদ্যুতের তার ছাড়াই কেমন তরতর করে ব্যাটারি বাড়ছে? এই সবকিছুর পেছনেই আছে “আবেশ” (Induction)। ভয় নেই, জটিল মনে হলেও, ব্যাপারটা কিন্তু দারুণ মজার! তাহলে চলুন, আজকের ব্লগ পোস্টে আমরা জেনে নিই আবেশ আসলে কী, এর পেছনের বিজ্ঞানটাই বা কী, আর দৈনন্দিন জীবনেই বা এর কতরকম ব্যবহার রয়েছে।
আবেশ (Induction) কী?
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, আবেশ হল এমন একটা প্রক্রিয়া যেখানে কোনো পরিবাহীর (conductor) চারপাশে পরিবর্তনশীল চৌম্বক ক্ষেত্র (magnetic field) তৈরি হলে সেই পরিবাহীতে ভোল্টেজ (voltage) বা তড়িৎচালক বল (electromotive force) উৎপন্ন হয়। অনেকটা যেন অদৃশ্য একটা শক্তি, যা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বিদ্যুতের ঢেউ তোলে!
আবেশের পেছনের বিজ্ঞান: একটু গভীরে ঢুঁ মারা যাক
আবেশের মূল ভিত্তি হলো বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডে (Michael Faraday)-এর আবিষ্কার করা “ফ্যারাডের আবেশের সূত্র” (Faraday’s Law of Induction)। এই সূত্র অনুযায়ী, কোনো বদ্ধ বর্তনীর (closed circuit) মধ্যে দিয়ে অতিক্রান্ত চৌম্বক ফ্লাক্সের (magnetic flux) পরিবর্তনের হার ওই বর্তনীতে আবিষ্ট তড়িৎচালক বলের সমানুপাতিক।
মানেটা একটু খোলসা করে বলা যাক। ধরুন, একটা কুণ্ডলী (coil) আছে, আর তার কাছে একটা চুম্বক (magnet) নড়াচড়া করছে। চুম্বকটা নড়াচড়া করার ফলে কুণ্ডলীর চারপাশে চৌম্বক ক্ষেত্রের পরিবর্তন হচ্ছে। আর এই পরিবর্তনের কারণেই কুণ্ডলীতে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হচ্ছে! যত দ্রুত চুম্বক নড়াচড়া করবে, তত বেশি বিদ্যুৎ উৎপন্ন হবে। অনেকটা যেন ঢিল ছুড়লে পুকুরে ঢেউ ওঠার মতো ব্যপার।
চৌম্বক ফ্লাক্স (Magnetic Flux): অদৃশ্য এক জাল
এবার প্রশ্ন হলো, এই চৌম্বক ফ্লাক্সটা কী জিনিস? চৌম্বক ফ্লাক্স হলো কোনো তলের (surface) মধ্যে দিয়ে কতগুলি চৌম্বক বলরেখা (magnetic field lines) লম্বভাবে অতিক্রম করছে তার পরিমাপ। এই বলরেখাগুলো আসলে চুম্বকের চারপাশের সেই অদৃশ্য জাল, যা অন্য বস্তুকে আকর্ষণ বা বিকর্ষণ করে।
আবেশ কত প্রকার ও কী কী?
আবেশ মূলত দুই প্রকার:
- স্বকীয় আবেশ (Self-induction): কোনো কুণ্ডলীতে (coil) বিদ্যুতের প্রবাহ (current) পরিবর্তিত হলে, সেই পরিবর্তনের কারণে কুণ্ডলীতেই একটি ভোল্টেজ (voltage) উৎপন্ন হয়। এটা অনেকটা নিজের পায়ে কুড়োল মারার মতো! কুণ্ডলীর নিজের পরিবর্তনের ফলেই সে নিজেই প্রভাবিত হচ্ছে।
- পারস্পরিক আবেশ (Mutual induction): যখন দুটি কুণ্ডলী খুব কাছাকাছি থাকে এবং একটি কুণ্ডলীর বিদ্যুতের প্রবাহের পরিবর্তন অন্য কুণ্ডলীকে প্রভাবিত করে তাতে ভোল্টেজ তৈরি করে, তখন তাকে পারস্পরিক আবেশ বলে। এক্ষেত্রে, একটি কুণ্ডলী প্রাইমারি কুণ্ডলী (primary coil) এবং অন্যটি সেকেন্ডারি কুণ্ডলী (secondary coil) হিসেবে কাজ করে। ট্রান্সফরমার (transformer) এই নীতির ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়।
স্বকীয় আবেশ: নিজের ভেতরেই খেলা
ধরুন, একটা তারের কুণ্ডলীর মধ্যে দিয়ে কারেন্ট যাচ্ছে। কারেন্ট চলাচলের ফলে কুণ্ডলীর চারপাশে একটা চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি হবে। এখন যদি কোনো কারণে কারেন্টের মান কমে যায় বা বেড়ে যায়, তাহলে চৌম্বক ক্ষেত্রেরও পরিবর্তন হবে। এই পরিবর্তনের ফলে কুণ্ডলীতে একটা ভোল্টেজ তৈরি হবে, যা কারেন্টের পরিবর্তনকে বাধা দেবে। অনেকটা যেন কুণ্ডলীটি নিজের স্থিতাবস্থা (stability) বজায় রাখতে চাইছে।
পারস্পরিক আবেশ: একে অপরের পরিপূরক
দুটি কুণ্ডলী পাশাপাশি রাখা হল। প্রথম কুণ্ডলীতে কারেন্ট প্রবাহিত করলে, তার চারপাশে একটি চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি হয়। এই চৌম্বক ক্ষেত্রটি দ্বিতীয় কুণ্ডলীকেও প্রভাবিত করে, যার ফলে দ্বিতীয় কুণ্ডলীতেও একটি ভোল্টেজ উৎপন্ন হয়, এমনকি দ্বিতীয় কুণ্ডলীতে সরাসরি কোনো সংযোগ না থাকা সত্ত্বেও। ট্রান্সফরমার এই নীতির ওপর ভিত্তি করেই কাজ করে। প্রথম কুণ্ডলীকে বলা হয় প্রাইমারি কুণ্ডলী, আর দ্বিতীয় কুণ্ডলীকে বলা হয় সেকেন্ডারি কুণ্ডলী।
দৈনন্দিন জীবনে আবেশের ব্যবহার
আবেশ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নানাভাবে জড়িয়ে আছে। নিচে কয়েকটি প্রধান ব্যবহার উল্লেখ করা হলো:
- ট্রান্সফরমার (Transformer): ট্রান্সফরমারের মূল কাজ হলো ভোল্টেজ কমানো বা বাড়ানো। এটি পারস্পরিক আবেশের নীতিতে কাজ করে। আমাদের বাসা-বাড়িতে যে বিদ্যুৎ আসে, তা ট্রান্সফরমারের মাধ্যমেই কমিয়ে আনা হয়।
- ইনডাকশন কুকার (Induction Cooker): ইন্ডাকশন কুকারে সরাসরি পাত্র গরম করা হয়, কোনো উত্তাপক উপাদান (heating element) ব্যবহার করা হয় না। এটিও আবেশের একটি চমৎকার উদাহরণ। কুকারের নিচে থাকা কয়েলের মধ্যে দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হলে একটি চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি হয়, যা পাত্রকে উত্তপ্ত করে।
- ওয়্যারলেস চার্জিং (Wireless Charging): তারবিহীন চার্জিংয়ের ক্ষেত্রেও আবেশের ব্যবহার দেখা যায়। চার্জিং প্যাড এবং ডিভাইসের মধ্যে থাকা কুণ্ডলীগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আবেশের মাধ্যমে বিদ্যুৎ শক্তি স্থানান্তরিত হয়।
- বৈদ্যুতিক জেনারেটর (Electric Generator): জেনারেটরের মাধ্যমে যান্ত্রিক শক্তিকে (mechanical energy) বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তরিত করা হয়। এখানেও চৌম্বক ক্ষেত্রের পরিবর্তন ঘটিয়ে আবেশের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হয়।
- মেটাল ডিটেক্টর (Metal Detector): মেটাল ডিটেক্টরগুলোতেও আবেশের নীতি ব্যবহার করা হয়। মাটির নিচে বা অন্য কোনো জায়গায় লুকানো ধাতব বস্তুকে খুঁজে বের করতে এটি কাজে লাগে।
একটা টেবিলের মাধ্যমে দেখি কোথায় কী ব্যবহার
ব্যবহারক্ষেত্র | আবেশের প্রকার | মূল কার্যকারিতা |
---|---|---|
ট্রান্সফরমার | পারস্পরিক আবেশ | ভোল্টেজ পরিবর্তন (বাড়ানো বা কমানো) |
ইন্ডাকশন কুকার | স্বকীয় আবেশ | সরাসরি পাত্র গরম করা |
ওয়্যারলেস চার্জিং | পারস্পরিক আবেশ | তারবিহীনভাবে বিদ্যুৎ শক্তি স্থানান্তর |
জেনারেটর | স্বকীয় আবেশ | যান্ত্রিক শক্তিকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তর |
মেটাল ডিটেক্টর | স্বকীয় আবেশ | ধাতব বস্তু সনাক্তকরণ |
আবেশ সম্পর্কিত কিছু সাধারণ প্রশ্ন (FAQ)
আবেশ নিয়ে অনেকের মনে কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খায়। এখানে তেমনই কিছু প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
আবেশ এবং ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ইন্ডাকশন (electromagnetic ইnduction) কি একই জিনিস?
হ্যাঁ, আবেশ এবং ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ইন্ডাকশন একই জিনিস। “আবেশ” শব্দটা ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ইন্ডাকশনের সংক্ষিপ্ত রূপ।
আবেশ কিসের উপর নির্ভর করে?
আবেশ বেশ কয়েকটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে, যেমন:
- কুণ্ডলীর পাকসংখ্যা (number of turns in the coil)
- চৌম্বক ক্ষেত্রের তীব্রতা (strength of the magnetic field)
- চৌম্বক ক্ষেত্রের পরিবর্তনের হার (rate of change of magnetic field)
- কুণ্ডলীর আকার ও আকৃতি (size and shape of the coil)
আবেশের একক (unit) কি?
আবেশের একক হলো হেনরি (Henry), সংক্ষেপে H। বিজ্ঞানী জোসেফ হেনরির (Joseph Henry) নামানুসারে এই এককের নামকরণ করা হয়েছে।
আদর্শ ট্রান্সফরমার (ideal transformer) কী?
আদর্শ ট্রান্সফরমার হলো এমন একটি ট্রান্সফরমার যাতে কোনো শক্তি অপচয় (energy loss) হয় না। অর্থাৎ, প্রাইমারি কুণ্ডলীতে যে পরিমাণ শক্তি দেওয়া হয়, সেকেন্ডারি কুণ্ডলী থেকে ঠিক সেই পরিমাণ শক্তি পাওয়া যায়। বাস্তবে অবশ্য এমন ট্রান্সফরমার পাওয়া যায় না, কারণ কিছু না কিছু শক্তি তাপ (heat) আকারে অপচয় হবেই।
আবেশের সুবিধা এবং অসুবিধাগুলো কী কী?
আবেশের সুবিধা:
- বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি নির্ভরযোগ্য উপায়।
- ট্রান্সফরমারের মাধ্যমে ভোল্টেজ পরিবর্তন করা যায়।
- ওয়্যারলেস চার্জিংয়ের সুবিধা পাওয়া যায়।
- ইন্ডাকশন কুকার ব্যবহারের মাধ্যমে দ্রুত এবং নিরাপদে রান্না করা যায়।
আবেশের অসুবিধা:
- কিছু ক্ষেত্রে শক্তি অপচয়ের সম্ভাবনা থাকে।
- উচ্চ ভোল্টেজের ক্ষেত্রে বিপজ্জনক হতে পারে।
- মেটাল ডিটেক্টরের কার্যকারিতা মাটির ধরনের উপর নির্ভরশীল।
আবেশ: আধুনিক জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি
আবেশ আমাদের চারপাশের প্রযুক্তির একটি অপরিহার্য অংশ। এই প্রক্রিয়াটিকে কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন উদ্ভাবন করে চলেছেন, যা আমাদের জীবনকে আরও সহজ ও উন্নত করছে। তাই, আবেশের মূল ধারণাগুলো জানা থাকলে আপনিও এই প্রযুক্তির marvels-গুলো আরও ভালোভাবে বুঝতে পারবেন।
তাহলে, আজ এই পর্যন্তই। আবেশ নিয়ে আপনার যদি কোনো প্রশ্ন থাকে, তবে নিচে কমেন্ট করে জানাতে পারেন। আর যদি এই লেখাটি ভালো লেগে থাকে, তবে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না!