আমাদের দেশে বিনিয়োগের জগতে, “বোনাস শেয়ার” কথাটা প্রায়ই শোনা যায়। কিন্তু বোনাস শেয়ার আসলে কী, কেন কোম্পানিগুলো এটা দেয়, আর একজন বিনিয়োগকারী হিসেবে আপনারই বা কী লাভ—এসব নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন থাকে। আজকের ব্লগ পোস্টে আমরা এই বোনাস শেয়ারের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো সহজ ভাষায় আলোচনা করব। যাতে আপনি এই ব্যাপারে একটা স্পষ্ট ধারণা পান।
বোনাস শেয়ার: সহজ ভাষায় বুঝুন
সহজ কথায় বোনাস শেয়ার হল, কোনো কোম্পানির পক্ষ থেকে তাদের পুরনো শেয়ারহোল্ডারদের বিনামূল্যে দেওয়া অতিরিক্ত শেয়ার। কোম্পানি যখন ভালো লাভ করে, কিন্তু সেই মুহূর্তে নগদ টাকা দিতে না চায়, তখন এই বোনাস শেয়ার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এটা অনেকটা “ফাও” পাওয়ার মতো, কিন্তু এর পেছনে কোম্পানির কিছু হিসাব-নিকাশ থাকে।
বোনাস শেয়ার কেন দেওয়া হয়?
কোম্পানিগুলো সাধারণত তিনটি প্রধান কারণে বোনাস শেয়ার দিয়ে থাকে:
-
রিজার্ভ ক্যাশ ব্যবহার: কোম্পানির কাছে অনেক সময় ধরে জমানো টাকা (রিজার্ভ ক্যাশ) থাকে। এই টাকা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার একটা উপায় হল বোনাস শেয়ার।
-
শেয়ারের মূল্য কমানো: অনেক সময় শেয়ারের দাম খুব বেড়ে গেলে ছোট বিনিয়োগকারীদের জন্য কেনা কঠিন হয়ে পড়ে। বোনাস শেয়ার দিলে শেয়ারের সংখ্যা বাড়ে, তাই দাম কিছুটা কমে আসে।
-
বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ানো: বোনাস শেয়ার দেওয়া মানে কোম্পানি ভালো করছে এবং ভবিষ্যতে আরও ভালো করবে—এমন একটা ইতিবাচক বার্তা বিনিয়োগকারীদের কাছে পৌঁছানো।
বোনাস শেয়ার কিভাবে কাজ করে?
ধরা যাক, আপনার কাছে কোনো কোম্পানির ১০০টি শেয়ার আছে। কোম্পানি ১:২ অনুপাতে বোনাস শেয়ার ঘোষণা করল। এর মানে হল, আপনার প্রতিটি দুটি শেয়ারের জন্য আপনি একটি করে বোনাস শেয়ার পাবেন। তাহলে আপনার কাছে অতিরিক্ত ৫০টি (১০০ / ২ = ৫০) শেয়ার যোগ হবে। এখন আপনার মোট শেয়ারের সংখ্যা দাঁড়াবে ১৫০টি। তবে এখানে একটা বিষয় মনে রাখতে হবে বোনাস শেয়ার দেওয়ার পরে আপনার শেয়ারের দাম কিন্তু আনুপাতিক হারে কমে যাবে।
বোনাস শেয়ার পাওয়ার যোগ্যতা
বোনাস শেয়ার পাওয়ার জন্য আপনাকে কোম্পানির একজন রেজিস্টার্ড শেয়ারহোল্ডার হতে হবে। অর্থাৎ, বোনাস শেয়ার ঘোষণার আগে আপনার নামে শেয়ার থাকতে হবে। কোম্পানি সাধারণত একটা “রেকর্ড ডেট” ঘোষণা করে। এই তারিখের মধ্যে যাদের ডিমেট অ্যাকাউন্টে শেয়ার থাকবে, তারাই বোনাস শেয়ার পাওয়ার যোগ্য হবেন।
বোনাস শেয়ারের সুবিধা এবং অসুবিধা
বোনাস শেয়ার পাওয়ার কিছু সুবিধা আছে, আবার কিছু দিকে খেয়াল রাখতে হয়। চলুন, সেগুলো দেখে নেওয়া যাক:
সুবিধা
- বিনামূল্যে অতিরিক্ত শেয়ার: কোনো খরচ ছাড়াই আপনি অতিরিক্ত শেয়ার পাচ্ছেন।
- ভবিষ্যতে বেশি ডিভিডেন্ড: আপনার কাছে এখন বেশি শেয়ার, তাই ভবিষ্যতে কোম্পানি ডিভিডেন্ড দিলে আপনি বেশি টাকা পাবেন।
- শেয়ারের দাম বাড়লে লাভ: বোনাস শেয়ার পাওয়ার পরে যদি শেয়ারের দাম বাড়ে, তাহলে আপনার লাভের পরিমাণও বাড়বে।
অসুবিধা
-
শেয়ারের দাম কমে যাওয়া: বোনাস শেয়ার দেওয়ার পরে সাধারণত শেয়ারের দাম কমে যায়। কারণ, একই কোম্পানির শেয়ারের সংখ্যা বেড়ে যায়।
-
কর (Tax): বোনাস শেয়ার বিক্রি করার সময় আপনাকে ক্যাপিটাল গেইনস ট্যাক্স দিতে হতে পারে।
বোনাস শেয়ার সংক্রান্ত কিছু সাধারণ প্রশ্ন (FAQ)
এখানে বোনাস শেয়ার নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হল, যা বিনিয়োগকারীদের মনে প্রায়ই আসে:
বোনাস শেয়ার কি সবসময় লাভজনক?
সব সময় নয়। এটা নির্ভর করে কোম্পানির ভবিষ্যৎ কেমন, তার ওপর। যদি কোম্পানি ভালো করতে থাকে, তাহলে বোনাস শেয়ার লাভজনক হতে পারে।
বোনাস শেয়ার পাওয়ার পরে কি শেয়ার বিক্রি করে দেওয়া উচিত?
এটা আপনার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে। যদি মনে হয় কোম্পানির ভবিষ্যৎ ভালো, তাহলে শেয়ার ধরে রাখতে পারেন।
কোম্পানি কিভাবে বোনাস শেয়ার ঘোষণা করে?
কোম্পানি তাদের বোর্ড মিটিংয়ে বোনাস শেয়ার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং স্টক এক্সচেঞ্জে ঘোষণা করে।
বোনাস শেয়ার পেতে কি কোনো আবেদন করতে হয়?
না, এর জন্য কোনো আবেদন করতে হয় না। আপনি যদি যোগ্য হন, তাহলে অটোমেটিকভাবে আপনার ডিমেট অ্যাকাউন্টে বোনাস শেয়ার জমা হবে।
বোনাস শেয়ার এবং স্টক স্প্লিটের মধ্যে পার্থক্য কী?
দুটোই শেয়ারের সংখ্যা বাড়ায়, কিন্তু বোনাস শেয়ার বিনামূল্যে দেওয়া হয়, আর স্টক স্প্লিটে শেয়ারের দাম আনুপাতিক হারে কমে যায়। কিন্তু আপনার কাছে থাকা শেয়ারের সংখ্যা বাড়ে।
বোনাস শেয়ারের হিসাব-নিকাশ: একটা উদাহরণ
ধরুন, ‘আমান টেক্সটাইল’ নামের একটি কোম্পানি ১:১ অনুপাতে বোনাস শেয়ার ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ, যাদের কাছে একটি শেয়ার আছে, তারা আরও একটি করে বোনাস শেয়ার পাবেন।
আপনার কাছে এই কোম্পানির ৫০০টি শেয়ার আছে। বোনাস শেয়ার পাওয়ার পরে আপনার শেয়ারের সংখ্যা হবে ১০০০টি (৫০০ + ৫০০)।
আগে যদি প্রতিটি শেয়ারের দাম ২০০ টাকা করে থাকত, তাহলে বোনাস শেয়ার দেওয়ার পরে দাম কমে প্রায় ১০০ টাকা হয়ে যাবে। কিন্তু আপনার মোট বিনিয়োগের মূল্য একই থাকবে (আগে ৫০০ x ২০০ = ১,০০,০০০ টাকা ছিল, এখন ১০০০ x ১০০ = ১,০০,০০০ টাকা)।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বোনাস শেয়ার
বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে অনেক কোম্পানি নিয়মিতভাবে বোনাস শেয়ার দিয়ে থাকে। বিনিয়োগ করার আগে কোম্পানির আর্থিক অবস্থা, লাভের ইতিহাস এবং বোনাস শেয়ার দেওয়ার কারণগুলো ভালোভাবে জেনে নেওয়া উচিত।
বোনাস শেয়ার ঘোষণার প্রভাব
যখন কোনো কোম্পানি বোনাস শেয়ার ঘোষণা করে, তখন সাধারণত বাজারে একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। বিনিয়োগকারীরা মনে করেন যে কোম্পানি লাভজনক এবং তাদের ভবিষ্যৎ ভালো। এর ফলে অনেক সময় শেয়ারের দামও বেড়ে যায়।
বোনাস শেয়ার: দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের সুযোগ
বোনাস শেয়ার দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের জন্য একটা ভালো সুযোগ হতে পারে। যদি আপনি ভালো কোম্পানির শেয়ার কিনে দীর্ঘ সময় ধরে রাখতে পারেন, তাহলে বোনাস শেয়ারের মাধ্যমে আপনার লাভের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।
সিদ্ধান্ত
বোনাস শেয়ার বিনিয়োগের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটা যেমন আপনার পোর্টফোলিও বাড়াতে সাহায্য করে, তেমনই কোম্পানির আর্থিক অবস্থার একটা ধারণা দেয়। তাই, বোনাস শেয়ার সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে বুঝে বিনিয়োগ করুন, আর আপনার বিনিয়োগকে আরও শক্তিশালী করুন।
আশা করি, এই ব্লগ পোস্টটি আপনাকে বোনাস শেয়ার সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা দিতে পেরেছে। যদি আপনার আরও কিছু জানার থাকে, তবে কমেন্ট করে জানাতে পারেন। হ্যাপি ইনভেস্টিং!