অসহযোগ আন্দোলন কাকে বলে? অসহযোগ আন্দোলনের ইতিহাস, তাৎপর্য এবং প্রভাব
আজ আমরা কথা বলব ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় নিয়ে – অসহযোগ আন্দোলন। এই আন্দোলন শুধু একটি রাজনৈতিক পদক্ষেপ ছিল না, এটি ছিল ব্রিটিশ শাসনের ভিত নাড়িয়ে দেওয়ার এক শক্তিশালী প্রয়াস। আসুন, আমরা এই আন্দোলনের গভীরে প্রবেশ করি এবং জানার চেষ্টা করি অসহযোগ আন্দোলন আসলে কী, কেন এটি শুরু হয়েছিল, এর ফলাফল কী ছিল এবং আজকের দিনে এর তাৎপর্য কতটুকু।
অসহযোগ আন্দোলন: স্বাধীনতা সংগ্রামের বাঁক পরিবর্তন
১৯২০ সাল। ভারতীয় রাজনীতি তখন টালমাটাল। একদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কা, অন্যদিকে ব্রিটিশ সরকারের দমন-পীড়ন। ঠিক সেই সময়েই মহাত্মা গান্ধী এক নতুন আন্দোলনের ডাক দিলেন – অসহযোগ আন্দোলন। এই আন্দোলনের মূলমন্ত্র ছিল অহিংসা ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে ব্রিটিশ সরকারকে অচল করে দেওয়া।
অসহযোগ আন্দোলনের সংজ্ঞা: কী ছিল এই আন্দোলন?
অসহযোগ আন্দোলন (Non-Cooperation Movement) হল একটি প্রতিবাদ কৌশল। এর মাধ্যমে কোনো দেশের জনগণ শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে অসহযোগিতা করে। অসহযোগিতার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল – সরকারি কাজকর্ম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আদালত এবং অন্যান্য ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান বর্জন করা। এর উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ সরকারকে নতি স্বীকার করতে বাধ্য করা এবং স্বরাজ প্রতিষ্ঠা করা।
অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমি: কেন এই আন্দোলনের জন্ম?
অসহযোগ আন্দোলনের প্রেক্ষাপট কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সমন্বয়ে গঠিত। নিচে কয়েকটি প্রধান কারণ আলোচনা করা হলো:
-
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব: প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভারতীয়দের সমর্থন আদায়ের জন্য ব্রিটিশ সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে যুদ্ধের পর ভারতীয়দের জন্য সুযোগ সুবিধা বাড়ানো হবে, কিন্তু যুদ্ধ শেষে তারা সেই প্রতিশ্রুতি রাখেনি। এতে ভারতীয়দের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়।
-
রাওলাট আইন (Rowlatt Act): ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ সরকার রাওলাট আইন জারি করে। এই আইনের মাধ্যমে সরকার বিনা বিচারে যে কাউকে গ্রেফতার করতে পারত। এই আইনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয়।
-
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড (Jallianwala Bagh Massacre): ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে নিরস্ত্র ভারতীয়দের উপর নির্বিচারে গুলি চালায় ব্রিটিশ সেনারা। এই ঘটনায় শত শত মানুষ নিহত হন। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড ভারতীয়দের মধ্যে চরম ক্ষোভের জন্ম দেয়।
- খেলাফত আন্দোলন (Khilafat Movement): খেলাফত আন্দোলন ছিল মূলত তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের খলিফার পদ রক্ষার জন্য ভারতীয় মুসলমানদের আন্দোলন। গান্ধীজি এই আন্দোলনে সমর্থন দেন এবং হিন্দু-মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন।
অসহযোগ আন্দোলনের উদ্দেশ্য: কী চেয়েছিল ভারত?
অসহযোগ আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল তিনটি:
- স্বরাজ প্রতিষ্ঠা: ভারতের জন্য স্ব-শাসন বা স্বরাজ অর্জন করাই ছিল এই আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য।
- রাওলাট আইনের প্রত্যাহার: কুখ্যাত রাওলাট আইন বাতিল করার দাবি জানানো হয়।
- জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের বিচার: এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি দাবি করা হয়।
অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি: কিভাবে কাজ করা হয়েছিল?
অসহযোগ আন্দোলনকে সফল করার জন্য বেশ কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল:
- সরকারি খেতাব বর্জন: ভারতীয়দের ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত খেতাব (যেমন রায়বাহাদুর, খান বাহাদুর) ত্যাগ করতে বলা হয়।
- সরকারি চাকরি ত্যাগ: সরকারি চাকরি থেকে ইস্তফা দেওয়ার জন্য জনগণকে উৎসাহিত করা হয়।
- আইনসভা বর্জন: আইনসভার সদস্যপদ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
- স্কুল-কলেজ বর্জন: সরকারি স্কুল ও কলেজ বর্জন করে জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়।
- বিদেশী দ্রব্য বর্জন: বিদেশী পণ্য, বিশেষত কাপড় বর্জন করে দেশীয় পণ্য ব্যবহারের উপর জোর দেওয়া হয়।
- কর দেওয়া বন্ধ: ব্রিটিশ সরকারকে কোনোরকম ট্যাক্স দেওয়া বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
অসহযোগ আন্দোলনের পর্যায়: কিভাবে আন্দোলন এগিয়েছিল?
অসহযোগ আন্দোলন মূলত দুটি পর্যায়ে সংগঠিত হয়েছিল:
- প্রথম পর্যায় (১৯২০-১৯২২): এই পর্যায়ে আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল শান্তিপূর্ণ অসহযোগিতার মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করা। এই সময়কালে স্কুল-কলেজ, আদালত, সরকারি চাকরি এবং বিদেশি দ্রব্য বর্জন করা হয়।
- দ্বিতীয় পর্যায়: এই পর্যায়ে গান্ধীজি আইন অমান্য আন্দোলনের উপর জোর দেন।
অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা
অসহযোগ আন্দোলনে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁরা শুধু আন্দোলনে অংশগ্রহণই করেননি, বরং নেতৃত্বও দিয়েছিলেন। অনেক নারী তাদের গয়না ও মূল্যবান সম্পদ দান করে আন্দোলনে সাহায্য করেন। সরোজিনী নাইডু, কমলা নেহেরু, বাসন্তী দেবী প্রমুখ নারী নেত্রী এই আন্দোলনে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
অসহযোগ আন্দোলনের ফলাফল ও প্রভাব
অসহযোগ আন্দোলন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল আলোচনা করা হলো:
- রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি: এই আন্দোলনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায়।
- জাতীয়তাবাদের উন্মেষ: অসহযোগ আন্দোলন ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদের চেতনাকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।
- হিন্দু-মুসলিম ঐক্য: এই আন্দোলনে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ একসঙ্গে অংশগ্রহণ করে।
- গান্ধীজির নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা: এই আন্দোলনের মাধ্যমে গান্ধীজি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রধান নেত হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হন।
অসহযোগ আন্দোলন কেন ব্যর্থ হয়?
১৯২২ সালে চৌরিচৌরায় সহিংস ঘটনার কারণে গান্ধীজি এই আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন। কিন্তু এর কিছু কারণ ছিল:
- সহিংসতা: আন্দোলনের শুরুতে অহিংস থাকার কথা থাকলেও, অনেক স্থানে সহিংস ঘটনা ঘটে।
- নেতৃত্বের অভাব: কিছু অঞ্চলে যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে আন্দোলন দুর্বল হয়ে পরে।
- ব্রিটিশ সরকারের দমননীতি: ব্রিটিশ সরকার কঠোর হাতে আন্দোলন দমন করে।
অসহযোগ আন্দোলনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
অসহযোগ আন্দোলন ব্যর্থ হলেও এর গুরুত্ব আজও অনেক।
- গণআন্দোলন: এই আন্দোলনের মাধ্যমে গান্ধীজি প্রথম একটি গণআন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হন।
- স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেরণা: এই আন্দোলন পরবর্তীকালের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে।
- ব্রিটিশ শাসনের দুর্বলতা প্রকাশ: এই আন্দোলন প্রমাণ করে যে ভারতীয়রা ঐক্যবদ্ধভাবে ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা করতে সক্ষম।
অসহযোগ আন্দোলন ও মহাত্মা গান্ধী
মহাত্মা গান্ধী ছিলেন অসহযোগ আন্দোলনের প্রাণপুরুষ। তাঁর নেতৃত্বেই এই আন্দোলন সারা ভারতে ছড়িয়ে পরে। গান্ধীজির অহিংসার দর্শন এবং সত্যাগ্রহের পথ এই আন্দোলনকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে।
অসহযোগ আন্দোলনের সমালোচনা
অসহযোগ আন্দোলনের কিছু সমালোচনাও রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, গান্ধীজি হঠাৎ করে আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেওয়ায় অনেক কর্মী হতাশ হয়েছিলেন। এছাড়া, এই আন্দোলনের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বলেও অনেকে মনে করেন।
অসহযোগ আন্দোলন: কিছু প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ)
এই অংশে আমরা অসহযোগ আন্দোলন নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেব:
-
অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব কে উত্থাপন করেন?
গান্ধীজি স্বয়ং এই আন্দোলনের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। -
অসহযোগ আন্দোলনের সময় ভাইসরয় কে ছিলেন?
অসহযোগ আন্দোলনের সময় ভারতের ভাইসরয় ছিলেন লর্ড চেমসফোর্ড। -
অসহযোগ আন্দোলনের ব্যর্থতার প্রধান কারণ কী ছিল?
চৌরিচৌরায় সহিংস ঘটনার কারণে গান্ধীজি এই আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন, যা ছিল এর প্রধান কারণ।
-
চৌরিচৌরার ঘটনাটি কী ছিল?
১৯২২ সালে উত্তর প্রদেশের চৌরিচৌরায় একদল উত্তেজিত জনতা একটি পুলিশ স্টেশনে আগুন ধরিয়ে দেয়, जिसमें ২২ জন পুলিশ কর্মী নিহত হন। -
অসহযোগ আন্দোলনের মূল ভিত্তি কী ছিল?
অহিংসা ও শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ ছিল এই আন্দোলনের মূল ভিত্তি। -
অসহযোগ আন্দোলনের স্লোগান কি ছিল?
এই আন্দোলনের কোনো নির্দিষ্ট স্লোগান ছিল না, তবে "স্বরাজ" এবং "ব্রিটিশ বর্জন" মূল সুর ছিল।
অসহযোগ আন্দোলনের শিক্ষা
অসহযোগ আন্দোলন আমাদের অনেক শিক্ষা দেয়। এটি শেখায় যে ঐক্যবদ্ধভাবে শান্তিপূর্ণ উপায়ে যেকোনো Oppression-এর বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব। এই আন্দোলন প্রমাণ করে যে জনগণের সম্মিলিত শক্তি যেকোনো স্বৈরশাসকের চেয়ে শক্তিশালী।
অসহযোগ আন্দোলনের উপর লেখা কিছু বই
অসহযোগ আন্দোলন নিয়ে অনেক মূল্যবান বই লেখা হয়েছে। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বইয়ের নাম নিচে দেওয়া হলো:
- Gandhi Before India by Ramachandra Guha
- The Story of My Experiments with Truth by M.K. Gandhi
- An Autobiography or The Story of My Experiments with Truth by Mahatma Gandhi
অসহযোগ আন্দোলন : আজকের প্রাসঙ্গিকতা
আজও অসহযোগ আন্দোলনের গুরুত্ব কমেনি। যেকোনো অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করার ক্ষেত্রে এটি আজও অনুপ্রেরণা জোগায়। এই আন্দোলনের শিক্ষা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে সাহস, সংকল্প ও একতা দিয়ে যেকোনো কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব।
উপসংহার
অসহযোগ আন্দোলন ছিল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। এই আন্দোলন প্রমাণ করে যে সাধারণ মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে যেকোনো শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে। আজকের দিনেও এই আন্দোলনের শিক্ষা আমাদের পথ দেখায় – অন্যায়কে রুখে দাঁড়াতে, ন্যায়ের পক্ষে কথা বলতে। এই আন্দোলনের চেতনাকে বুকে ধারণ করে আমরা যেন একটি সুন্দর ও справедливое সমাজ গড়তে পারি, সেই চেষ্টাই করতে হবে।
যদি এই বিষয়ে আপনার কোনো প্রশ্ন থাকে, তাহলে কমেন্ট করে জানাতে পারেন। আপনার মতামত আমাদের কাছে মূল্যবান।