ধরুন, আপনি কোনো দোকানে গিয়েছেন কিছু জিনিস কিনতে। দাম শুনে আপনার মনে প্রশ্ন জাগল, “আচ্ছা, এই জিনিসগুলোর দাম সবচেয়ে কম কত হতে পারতো?” ঠিক এই ভাবনাটাই কিন্তু লঘিষ্ঠ সাধারণ গুণিতক (Least Common Multiple) বা লসাগু-এর ধারণার জন্ম দেয়। গণিতের এই মজার বিষয়টি আসলে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অনেক কাজে লাগে। চলুন, লঘিষ্ঠ গণন বা লসাগু কী, কেন দরকার, এবং কীভাবে বের করতে হয়, সেই সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে আসা যাক!
লঘিষ্ঠ সাধারণ গুণিতক (লসাগু) কী?
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, দুই বা ততোধিক সংখ্যার মধ্যে সবচেয়ে ছোট কোন সংখ্যাটি তাদের প্রত্যেকের দ্বারা নিঃশেষে বিভাজ্য, সেটাই হলো লঘিষ্ঠ সাধারণ গুণিতক বা লসাগু। “লঘিষ্ঠ” মানে সবচেয়ে ছোট, “সাধারণ” মানে যা সবার মধ্যে আছে, আর “গুণিতক” মানে কোনো সংখ্যাকে পূর্ণ সংখ্যা দিয়ে গুণ করে যে সংখ্যাগুলো পাওয়া যায়।
বিষয়টি আরও একটু পরিষ্কার করা যাক। ধরুন, আপনার কাছে ৬ এবং ৮ এই দুটি সংখ্যা আছে।
- ৬-এর গুণিতকগুলো হলো: ৬, ১২, ১৮, ২৪, ৩০, ৩৬, ৪৮, …
- ৮-এর গুণিতকগুলো হলো: ৮, ১৬, ২৪, ৩২, ৪০, ৪৮, …
এখানে দেখা যাচ্ছে, ২৪ এবং ৪৮ উভয় সংখ্যা ৬ এবং ৮ এর গুণিতক। কিন্তু ২৪ হলো সবচেয়ে ছোট সংখ্যা যা ৬ এবং ৮ উভয় সংখ্যা দিয়েই ভাগ করা যায়। সুতরাং, ৬ এবং ৮-এর লসাগু হলো ২৪।
লসাগু কেন প্রয়োজন?
লসাগু শুধু একটি গাণিতিক ধারণা নয়, বরং এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানেও কাজে লাগে। নিচে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো:
- সময় এবং সূচি: ধরুন, দুটি বাস একটি বাসস্ট্যান্ড থেকে বিভিন্ন সময়ে ছাড়ে। একটি বাস প্রতি ২০ মিনিটে এবং অন্যটি প্রতি ৩০ মিনিটে ছাড়ে। কখন তারা আবার একসাথে ছাড়বে, সেটা বের করতে লসাগু ব্যবহার করা যেতে পারে। ২০ এবং ৩০-এর লসাগু ৬০। তার মানে ৬০ মিনিট পর বাস দুটি আবার একসাথে ছাড়বে।
- ভগ্নাংশের যোগ-বিয়োগ: ভগ্নাংশের যোগ বা বিয়োগ করার সময় হরগুলোর লসাগু বের করে সাধারণ হর তৈরি করতে হয়। এটি হিসাব সহজ করে তোলে।
- দৈনন্দিন সমস্যা সমাধান: বিভিন্ন জিনিসের পরিমাণ নির্ধারণ, পরিকল্পনা করা, বা কোনো কাজের সময়সূচি তৈরি করতে লসাগু ব্যবহার করা যেতে পারে।
লসাগু নির্ণয়ের পদ্ধতি
লসাগু বের করার কয়েকটি জনপ্রিয় পদ্ধতি রয়েছে। নিচে তাদের কয়েকটি আলোচনা করা হলো:
মৌলিক উৎপাদকের সাহায্যে লসাগু
এই পদ্ধতিতে, প্রথমে সংখ্যাগুলোকে মৌলিক উৎপাদকে বিশ্লেষণ করা হয়। এরপর প্রতিটি মৌলিক উৎপাদকের সর্বোচ্চ ঘাত (power) নিয়ে গুণ করা হয়।
উদাহরণ: ১২ এবং ১৮-এর লসাগু নির্ণয় করুন।
- ১২ = ২ x ২ x ৩ = ২২ x ৩
- ১৮ = ২ x ৩ x ৩ = ২ x ৩২
এখানে, ২-এর সর্বোচ্চ ঘাত হলো ২২ এবং ৩-এর সর্বোচ্চ ঘাত হলো ৩২।
সুতরাং, লসাগু = ২২ x ৩২ = ৪ x ৯ = ৩৬
ইউক্লিডীয় পদ্ধতি বা ভাগ প্রক্রিয়ার সাহায্যে লসাগু
এই পদ্ধতিতে, সংখ্যাগুলোকে পর্যায়ক্রমে ভাগ করে যতক্ষণ না ভাগফল ১ হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত প্রক্রিয়াটি চালানো হয়।
উদাহরণ: ১৬ এবং ২৪-এর লসাগু নির্ণয় করুন।
- ১৬ এবং ২৪-কে প্রথমে ২ দিয়ে ভাগ করুন। ভাগফল হবে ৮ এবং ১২।
- আবার ৮ এবং ১২-কে ২ দিয়ে ভাগ করুন। ভাগফল হবে ৪ এবং ৬।
- আবার ৪ এবং ৬-কে ২ দিয়ে ভাগ করুন। ভাগফল হবে ২ এবং ৩।
- এখন ২ এবং ৩ কে আর কোনো সাধারণ সংখ্যা দিয়ে ভাগ করা যায় না।
সুতরাং, লসাগু = ২ x ২ x ২ x ২ x ৩ = ৪৮
সাধারণ গুণিতক পদ্ধতি
এই পদ্ধতিতে সংখ্যাগুলোর কয়েকটি গুণিতক লিখে তাদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট সাধারণ গুণিতকটি খুঁজে বের করা হয়।
উদাহরণ: ৪ এবং ৬ এর লসাগু নির্ণয় করুন।
- ৪ এর গুণিতক: ৪, ৮, ১২, ১৬, ২০, ২৪,…
- ৬ এর গুণিতক: ৬, ১২, ১৮, ২৪, ৩০,…
এখানে ১২ হলো ৪ এবং ৬ এর মধ্যে সবচেয়ে ছোট সাধারণ গুণিতক। সুতরাং, ৪ এবং ৬ এর লসাগু ১২।
লসাগু এবং গসাগু-এর মধ্যে পার্থক্য
লসাগু (LCM) এবং গসাগু (HCF) – এই দুটি বিষয় প্রায়ই গুলিয়ে ফেলা হয়। এদের মধ্যে মূল পার্থক্য হলো:
বৈশিষ্ট্য | লসাগু (LCM) | গসাগু (HCF) |
---|---|---|
সংজ্ঞা | এটি সেই ক্ষুদ্রতম সংখ্যা যা দুটি বা তার বেশি সংখ্যা দ্বারা সম্পূর্ণরূপে বিভাজ্য। | এটি সেই বৃহত্তম সংখ্যা যা দুটি বা তার বেশি সংখ্যাকে সম্পূর্ণরূপে ভাগ করতে পারে। |
অর্থ | লঘিষ্ঠ সাধারণ গুণিতক (Least Common Multiple) | গরিষ্ঠ সাধারণ উৎপাদক/গুণনীয়ক(Highest Common Factor) |
উদাহরণ | ৪ এবং ৬ এর লসাগু ১২ (কারণ ১২ হলো সবচেয়ে ছোট সংখ্যা যা ৪ এবং ৬ উভয় দিয়েই নিঃশেষে বিভাজ্য)। | ৪ এবং ৬ এর গসাগু ২ (কারণ ২ হলো সবচেয়ে বড় সংখ্যা যা ৪ এবং ৬ দুটোকেই নিঃশেষে ভাগ করতে পারে)। |
ব্যবহার | ভগ্নাংশের যোগ-বিয়োগ, সময় এবং দূরত্বের হিসাব, ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। | কোনো জিনিস সমান ভাগে ভাগ করা, ক্ষেত্রফল নির্ণয় করা, ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। |
বাস্তব জীবনে লসাগুর ব্যবহার: কিছু উদাহরণ
- ঘড়ির কাঁটা: একটি ঘড়িতে ঘণ্টার কাঁটা প্রতি ১২ ঘন্টায় একবার ঘোরে এবং মিনিটের কাঁটা প্রতি ঘন্টায় একবার ঘোরে। কখন দুটি কাঁটা আবার একসাথে মিলিত হবে? উত্তর হলো ১২ ঘন্টা পর, যা ১২ এবং ১ এর লসাগু।
- টাইলস বসানো: আপনি একটি rectangular মেঝেতে টাইলস বসাতে চান। টাইলসের আকার এমন হতে হবে, যা দৈর্ঘ্যে এবং প্রস্থে উভয় দিকেই সমানভাবে মিলে যায়। টাইলসের সঠিক আকার বের করতে লসাগু ব্যবহার করা যেতে পারে। ধরুন, মেঝের দৈর্ঘ্য ১২ ফুট এবং প্রস্থ ১৮ ফুট। তাহলে টাইলসের এক দিকের মাপ ৬ ফুট হতে হবে (১২ এবং ১৮ এর গ.সা.গু), যা পুরো মেঝেতে সুন্দরভাবে বসানো যাবে।
-
**উৎসবের পরিকল্পনা:** ধরুন, কোনো একটি সংস্থা প্রতি বছর বিশেষ দিনে গরিবদের মধ্যে খাবার বিতরণের আয়োজন করে। এ বছর তারা ঠিক করেছে, প্রতি ১২ জন শিশুর জন্য একটি প্যাকেট বিস্কুট এবং প্রতি ১৫ জন শিশুর জন্য একটি প্যাকেট কেক দেবে। এখন, যদি তারা প্রত্যেক শিশুকে বিস্কুট এবং কেক দুটোই দিতে চায়, তাহলে কমপক্ষে কতজন শিশুকে তারা খাবার দেবে? এখানে ১২ এবং ১৫-এর লসাগু বের করতে হবে, যা হলো ৬০। সুতরাং, কমপক্ষে ৬০ জন শিশুকে বিস্কুট এবং কেক দুটোই দিতে হবে।
লসাগু সংক্রান্ত কিছু প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)
আপনার মনে লসাগু নিয়ে কিছু প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। নিচে কয়েকটি সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
-
লসাগু নির্ণয়ের গুরুত্ব কী?
- লসাগু আমাদের বাস্তব জীবনের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে সাহায্য করে, যেমন সময় বের করা, ভগ্নাংশের হিসাব করা, এবং পরিকল্পনা তৈরি করা।
-
ভগ্নাংশের যোগ-বিয়োগের ক্ষেত্রে লসাগুর ব্যবহার কী?
- ভগ্নাংশের হরগুলো ভিন্ন হলে, তাদের লসাগু বের করে একটি সাধারণ হর তৈরি করা হয়। এতে যোগ বা বিয়োগ করা সহজ হয়।
-
দুটি সংখ্যার গুণফল কি তাদের লসাগু এবং গসাগু-এর গুণফলের সমান?
* হ্যাঁ, দুটি সংখ্যার গুণফল তাদের লসাগু (LCM) এবং গসাগু (HCF)-এর গুণফলের সমান। এই সম্পর্কটি শুধুমাত্র দুটি সংখ্যার জন্য প্রযোজ্য।
-
লসাগু নির্ণয়ের সবচেয়ে সহজ উপায় কী?
- মৌলিক উৎপাদকের সাহায্যে লসাগু নির্ণয় করা সাধারণত সবচেয়ে সহজ উপায়। তবে, সংখ্যা ছোট হলে সাধারণ গুণিতক পদ্ধতিও ব্যবহার করা যেতে পারে।
-
শূন্যের লসাগু কী?
- শূন্যের কোনো লসাগু নেই, কারণ শূন্যকে কোনো সংখ্যা দিয়ে গুণ করলে গুণফল সবসময় শূন্য হয়।
-
ভগ্নাংশের লসাগু কিভাবে নির্ণয় করতে হয়?
* ভগ্নাংশের লসাগু নির্ণয় করার নিয়ম হল: লবগুলোর লসাগু বের করতে হবে এবং হরগুলোর গসাগু বের করতে হবে। তারপর, লবের লসাগুকে হরের গসাগু দিয়ে ভাগ করতে হবে।
* উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনার কাছে দুটি ভগ্নাংশ থাকে, ২/৩ এবং ৪/৫, তাহলে এদের লসাগু হবে:
* লবগুলোর লসাগু (২ এবং ৪ এর লসাগু) = ৪
* হরগুলোর গসাগু (৩ এবং ৫ এর গসাগু) = ১
* সুতরাং, লসাগু = ৪/১ = ৪
-
তিনটি সংখ্যার লসাগু কিভাবে বের করে?
-
তিনটি সংখ্যার লসাগু বের করার জন্য প্রথমে যেকোনো দুটি সংখ্যার লসাগু বের করতে হবে। তারপর, ওই লসাগু এবং তৃতীয় সংখ্যাটির লসাগু বের করতে হবে।
-
উদাহরণস্বরূপ, যদি আপনার কাছে তিনটি সংখ্যা থাকে, ৪, ৬ এবং ৮, তাহলে:
- প্রথমে ৪ এবং ৬ এর লসাগু বের করুন, যা হল ১২।
- তারপর ১২ এবং ৮ এর লসাগু বের করুন, যা হল ২৪।
- সুতরাং, ৪, ৬ এবং ৮ এর লসাগু হল ২৪।
-
-
লসাগু এর সূত্র কি?
-
লসাগু (LCM) বের করার জন্য সরাসরি কোনো একটি সূত্র নেই, তবে মৌলিক উৎপাদকের সাহায্যে অথবা ইউক্লিডীয় অ্যালগরিদম ব্যবহার করে লসাগু নির্ণয় করা যায়। দুটি সংখ্যার ক্ষেত্রে সূত্রটি হল:
- LCM(a, b) = |a * b| / GCD(a, b)
এখানে, GCD(a, b) হল a এবং b এর গরিষ্ঠ সাধারণ গুণনীয়ক (HCF)।
-
এই সূত্রটি ব্যবহার করে আপনি দুটি সংখ্যার গুণফলকে তাদের গসাগু দিয়ে ভাগ করে লসাগু পেতে পারেন।
-
-
গসাগু ও লসাগু এর মধ্যে সম্পর্ক কি?
* গসাগু (GCD) ও লসাগু (LCM) এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হল:
* দুটি সংখ্যার গুণফল = তাদের গসাগু × তাদের লসাগু
এই সম্পর্কটি শুধুমাত্র দুটি সংখ্যার জন্য প্রযোজ্য। এর মানে হল, যদি আপনি দুটি সংখ্যার গসাগু এবং লসাগু জানেন, তাহলে সংখ্যা দুটির গুণফল বের করতে পারবেন, অথবা যদি সংখ্যা দুটির গুণফল এবং গসাগু জানা থাকে, তাহলে লসাগু বের করতে পারবেন।
আশা করি, এই ব্লগ পোস্টটি লঘিষ্ঠ সাধারণ গুণিতক (লসাগু) সম্পর্কে আপনার ধারণা স্পষ্ট করতে সাহায্য করেছে। গণিতের এই মজার বিষয়টি শুধু পরীক্ষার জন্য নয়, আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও অনেক কাজে লাগে। তাই, লসাগু শিখুন, এবং জীবনের জটিল সমস্যাগুলো সহজে সমাধান করুন! গণিতের মজা উপভোগ করুন!