প্রিয় পাঠক, আপনারা কি জানেন, কোন বাঙালি নেতাকে ভালোবেসে ‘দেশবন্ধু’ নামে ডাকা হতো? তিনি ছিলেন একাধারে বিপ্লবী, রাজনীতিবিদ এবং সমাজসেবক। শুধু তাই নয়, তিনি ছিলেন বাংলার মানুষের হৃদয়ের স্পন্দন। চলুন, আজ আমরা সেই মহান মানুষটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানি।
দেশবন্ধু কে ছিলেন?
দেশবন্ধু ছিলেন আমাদের সকলের প্রিয় চিত্তরঞ্জন দাশ। হ্যাঁ, আপনি ঠিক ধরেছেন! চিত্তরঞ্জন দাশ, যিনি তাঁর দেশপ্রেম, ত্যাগ এবং অসাধারণ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়ে বাংলার মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন, তিনিই ‘দেশবন্ধু’ নামে পরিচিত। “দেশবন্ধু” মানে “দেশের বন্ধু”। নামের মতোই তিনি দেশের আপামর মানুষের বন্ধু ছিলেন।
চিত্তরঞ্জন দাশের পরিচয়
চিত্তরঞ্জন দাশ ১৮৭০ সালের ৫ই নভেম্বর কলকাতার এক সম্ভ্রান্ত বৈদ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ভুবনমোহন দাশ এবং মাতার নাম নিস্তারিণী দেবী। চিত্তরঞ্জন ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। ১৮৯৪ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ. এবং পরে ইংল্যান্ড থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করেন।
কেন তিনি “দেশবন্ধু”?
চিত্তরঞ্জন দাশ কেন “দেশবন্ধু” উপাধি পেয়েছিলেন, তা জানতে হলে আমাদের একটু পেছনের দিকে তাকাতে হবে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যখন সারা বাংলা উত্তাল, তখন চিত্তরঞ্জন দাশ ঝাঁপিয়ে পড়েন দেশের কাজে।
-
আইনজীবী থেকে দেশসেবক: ব্যারিস্টার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও, দেশের ডাকে তিনি নিজের বিলাসবহুল জীবন ত্যাগ করে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন।
-
অসহযোগ আন্দোলনে নেতৃত্ব: ১৯২০ সালে মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে চিত্তরঞ্জন দাশের অবদান ছিল অসামান্য। তিনি শুধু নিজে এই আন্দোলনে যোগ দেননি, বরং বহু মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।
-
ত্যাগ ও উৎসর্গ: দেশের জন্য তিনি নিজের সম্পত্তি, আরাম-আয়েশ সবকিছু ত্যাগ করেন। তাঁর এই নিঃস্বার্থ ত্যাগ ও দেশপ্রেমের জন্য মানুষ ভালোবেসে তাঁকে ‘দেশবন্ধু’ উপাধি দেয়।
দেশবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন
দেশবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন ছিল নানা ঘটনায় পরিপূর্ণ। তিনি ছিলেন একাধারে একজন দক্ষ সংগঠক, বাগ্মী এবং আপোষহীন নেতা।
প্রথম দিকের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড
চিত্তরঞ্জন দাশের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় কংগ্রেসের হাত ধরে। ১৯০৬ সালের কলকাতা কংগ্রেসে তিনি প্রথম যোগদান করেন। এরপর তিনি ধীরে ধীরে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন।
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে চিত্তরঞ্জন দাশ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তিনি সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর মতো নেতাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেন।
হোমরুল লীগ
অ্যানি বেসান্তের হোমরুল লীগেও চিত্তরঞ্জন দাশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তিনি এই আন্দোলনের মাধ্যমে দেশের মানুষের মধ্যে স্বরাজ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলেন।
অসহযোগ আন্দোলন ও দেশবন্ধুর ভূমিকা
১৯২০-এর দশকে গান্ধীজির নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে, চিত্তরঞ্জন দাশ ঝাঁপিয়ে পড়েন দেশের কাজে।
-
আইন ব্যবসা ত্যাগ: তিনি তাঁর সফল ব্যারিস্টারি পেশা ত্যাগ করেন এবং অসহযোগ আন্দোলনে সর্বতোভাবে আত্মনিয়োগ করেন।
-
কারাবরণ: এই আন্দোলনে অংশ নেওয়ার জন্য তিনি কারাবরণ করেন এবং বহু মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেন।
-
বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটি: ১৯২১ সালে তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন।
স্বরাজ পার্টি প্রতিষ্ঠা
অসহযোগ আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পর চিত্তরঞ্জন দাশ উপলব্ধি করেন যে, আইনসভার ভেতরে প্রবেশ করে সরকারের বিরোধিতা করা প্রয়োজন। এই ভাবনা থেকেই ১৯২৩ সালে তিনি মতিলাল নেহেরুর সঙ্গে मिलकर গঠন করেন স্বরাজ পার্টি।
স্বরাজ পার্টির উদ্দেশ্য
স্বরাজ পার্টির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আইনসভার মাধ্যমে সরকারের কাজে বাধা সৃষ্টি করা এবং স্বরাজ বা সেল্ফ-রুল প্রতিষ্ঠা করা। এই পার্টি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং যথেষ্ট সাফল্যও পায়।
বেঙ্গল প্যাক্ট
১৯২৩ সালে চিত্তরঞ্জন দাশ বেঙ্গল প্যাক্ট নামে একটি চুক্তি করেন, যা হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য স্থাপনের চেষ্টা চালায়। এই চুক্তির মাধ্যমে তিনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার চেষ্টা করেন।
দেশবন্ধুর সমাজসেবা ও শিক্ষা
চিত্তরঞ্জন দাশ শুধু একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন সমাজসেবক এবং শিক্ষানুরাগী। সমাজের দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য তিনি অনেক কাজ করেছেন।
শিক্ষা বিস্তারে অবদান
চিত্তরঞ্জন দাশ শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন এবং শিক্ষা বিস্তারে নানা উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
-
স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা: তিনি বহু স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেন।
-
শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি: দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য তিনি বৃত্তির ব্যবস্থা করেন।
সমাজকল্যাণমূলক কাজ
চিত্তরঞ্জন দাশ সমাজের দরিদ্র ও অসহায় মানুষের জন্য বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক কাজ করেন।
-
দাতব্য চিকিৎসালয়: তিনি দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেন, যেখানে বিনামূল্যে দরিদ্র মানুষদের চিকিৎসা করা হতো।
-
বন্যা ও দুর্ভিক্ষে ত্রাণ: বন্যা ও দুর্ভিক্ষে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য তিনি ত্রাণ সরবরাহ করেন।
দেশবন্ধুর সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা
চিত্তরঞ্জন দাশ ছিলেন সাহিত্য ও সংস্কৃতির একজন অনুরাগী। তিনি নিজে কবিতা লিখতেন এবং অন্যদের সাহিত্য চর্চায় উৎসাহিত করতেন।
কবিতা ও গান
চিত্তরঞ্জন দাশের লেখা বহু কবিতা ও গান আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। তাঁর কবিতাগুলোতে দেশপ্রেম, মানবতা ও প্রকৃতির প্রতি গভীর ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে।
সাহিত্য পত্রিকা
তিনি ‘নারায়ণ’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করতেন, যা তৎকালীন সাহিত্যিক মহলে খুব জনপ্রিয় ছিল।
মৃত্যু ও legado
১৯২৫ সালের ১৬ই জুন মাত্র ৫৫ বছর বয়সে দার্জিলিংয়ে চিত্তরঞ্জন দাশের জীবনাবসান ঘটে। তাঁর মৃত্যুতে সারা দেশে শোকের ছায়া নেমে আসে।
দেশবাসীর শোক
দেশবন্ধুর মৃত্যুতে মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, “দেশবন্ধু ছিলেন দেশবাসীর বন্ধু, তাঁর মৃত্যুতে ভারতবাসী একজন মহান নেতাকে হারালো।”
দেশবন্ধুর legado
চিত্তরঞ্জন দাশের legado আজও অমলিন। তিনি তাঁর দেশপ্রেম, ত্যাগ ও সমাজসেবার জন্য চিরকাল মানুষের মনে বেঁচে থাকবেন।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অনুপ্রেরণা
দেশবন্ধুর জীবন ও আদর্শ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাঁর ত্যাগ ও দেশপ্রেম থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা দেশকে আরও উন্নত করতে পারি।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত কিছু প্রশ্ন (FAQ)
আসুন, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ সম্পর্কে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর জেনে নেওয়া যাক:
প্রশ্ন ১: চিত্তরঞ্জন দাশের জন্ম কোথায় হয়েছিল?
উত্তর: চিত্তরঞ্জন দাশ ১৮৭০ সালের ৫ই নভেম্বর কলকাতার এক সম্ভ্রান্ত বৈদ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
প্রশ্ন ২: চিত্তরঞ্জন দাশের বিখ্যাত উক্তি কি ছিল?
উত্তর: তাঁর একটি বিখ্যাত উক্তি হলো, “আমি মানব, আমি ভালোবাসি, আমি বাঁচি।” (I am, I love, I live.) এছাড়া তিনি বলেছিলেন, “স্বরাজ চাই, এবং তা এখনই।”
প্রশ্ন ৩: দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ কোন কলেজের ছাত্র ছিলেন?
উত্তর: তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র ছিলেন।
প্রশ্ন ৪: চিত্তরঞ্জন দাশ কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন?
উত্তর: তিনি প্রথমে কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং পরে তিনি স্বরাজ পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রশ্ন ৫: চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রীর নাম কি ছিল?
উত্তর: চিত্তরঞ্জন দাশের স্ত্রীর নাম ছিল বাসন্তী দেবী। তিনিও ছিলেন একজন সমাজসেবী ও স্বাধীনতা সংগ্রামী।
প্রশ্ন ৬: চিত্তরঞ্জন দাশ কিভাবে মারা যান?
উত্তর: ১৯২৫ সালের ১৬ই জুন দার্জিলিংয়ে তাঁর জীবনাবসান ঘটে।
প্রশ্ন ৭: চিত্তরঞ্জন দাশ কি কোনো পত্রিকা সম্পাদনা করতেন?
উত্তর: হ্যাঁ, তিনি ‘নারায়ণ’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করতেন।
প্রশ্ন ৮: চিত্তরঞ্জন দাশ কেন বিখ্যাত?
উত্তর: চিত্তরঞ্জন দাশ তাঁর দেশপ্রেম, ত্যাগ, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং সমাজসেবার জন্য বিখ্যাত।
প্রশ্ন ৯: চিত্তরঞ্জন দাশের রাজনৈতিক গুরু কে ছিলেন?
উত্তর: চিত্তরঞ্জন দাশের রাজনৈতিক গুরু ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী।
প্রশ্ন ১০: চিত্তরঞ্জন দাশের সমাধিস্থল কোথায় অবস্থিত?
উত্তর: চিত্তরঞ্জন দাশের সমাধিস্থল কলকাতার কেওড়াতলা মহাশ্মশানে অবস্থিত।
উপসংহার
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর জীবন আমাদের ত্যাগ, দেশপ্রেম ও মানবসেবার শিক্ষা দেয়। তিনি শুধু একজন রাজনৈতিক নেতাই ছিলেন না, ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারক, সাহিত্যিক এবং শিক্ষানুরাগী। তাঁর অবদান চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
যদি এই ব্লগ পোস্টটি ভালো লেগে থাকে, তাহলে অবশ্যই আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন এবং আপনার মতামত কমেন্ট করে জানান। আপনার আগ্রহ আমাদের আরও ভালো কিছু লিখতে উৎসাহিত করবে।