জিপিএস: পথ হারানো পথিক এখন অতীত! আপনার স্মার্টফোনেই বিশ্ব হাতের মুঠোয়
রাস্তায় হারিয়ে গেছেন? বন্ধু কোথায় আছে জানতে চান? কিংবা ভাবছেন, ড্রোন দিয়ে ছবি তুলবেন কিন্তু লোকেশন ট্র্যাক করবেন কিভাবে? উত্তর একটাই – জিপিএস (GPS)। এই জিপিএস নামক ছোট্ট জিনিসটিই কিন্তু আমাদের জীবনকে করেছে অনেক সহজ। আসুন, জিপিএস কী, কীভাবে কাজ করে, আর আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এর ব্যবহার কোথায়, সেই সবকিছু জেনে নিই!
জিপিএস (GPS) কী?
জিপিএস এর মানে হল গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (Global Positioning System)। এটা আসলে স্যাটেলাইটের একটা নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পৃথিবীর যেকোনো স্থানের অবস্থান নিখুঁতভাবে জানা যায়। ভাবুন তো, আগেকার দিনে নাবিকেরা দিক ভুল করে কোথায় চলে যেত! জিপিএস আসার পর থেকে সেই সমস্যা একদম শেষ।
জিপিএস কিভাবে কাজ করে: একদম সহজ ভাষায়
জিপিএস কিভাবে কাজ করে সেটা একটু কঠিন মনে হতে পারে, কিন্তু আমি আপনাকে সহজ করে বুঝিয়ে দিচ্ছি:
-
স্যাটেলাইট সিগন্যাল: আকাশে অনেকগুলো জিপিএস স্যাটেলাইট আছে। এই স্যাটেলাইটগুলো সবসময় সিগন্যাল পাঠাচ্ছে।
-
রিসিভার: আপনার ফোন বা জিপিএস ডিভাইস সেই সিগন্যাল গ্রহণ করে।
-
ত্রিকোণমিতি: আপনার ডিভাইস তিনটি বা তার বেশি স্যাটেলাইট থেকে আসা সিগন্যাল ব্যবহার করে আপনার অবস্থান হিসাব করে। অনেকটা ত্রিকোণমিতির মতো, যেখানে ত্রিভুজের বাহু আর কোণ থেকে দূরত্ব মাপা হয়।
- অবস্থান নির্ণয়: এই হিসাবের মাধ্যমে আপনার ডিভাইসটি জানিয়ে দেয় আপনি কোথায় আছেন, আপনার গতি কত, এবং আপনি কোন দিকে যাচ্ছেন।
জিপিএস এর ইতিহাস: কিভাবে শুরু হল এই যাত্রা?
জিপিএস কিন্তু একদিনে তৈরি হয়নি। এর পেছনে অনেক বছরের গবেষণা আর পরিশ্রম আছে।
-
শুরুর কথা: ষাটের দশকে মার্কিন সামরিক বাহিনী প্রথম এই সিস্টেমের ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল এমন একটা সিস্টেম তৈরি করা, যার মাধ্যমে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে থাকা সৈন্যদের অবস্থান জানা যাবে।
-
প্রথম স্যাটেলাইট: ১৯৭৮ সালে প্রথম জিপিএস স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হয়।
-
সাধারণের জন্য উন্মুক্ত: নব্বইয়ের দশকে এটি সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
- আজকের জিপিএস: এখন আমাদের হাতে যে জিপিএস, তা আগের থেকে অনেক বেশি আধুনিক এবং নির্ভুল।
জিপিএস এর ব্যবহার: কোথায় নেই জিপিএস?
জিপিএস এখন আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কোথায় এর ব্যবহার নেই, সেটাই বরং খুঁজে বের করা কঠিন!
দৈনন্দিন জীবনে জিপিএস
-
গাড়ি চালানো: গুগল ম্যাপস (Google Maps) বা অন্য কোনো নেভিগেশন অ্যাপ ব্যবহার করে সহজেই রাস্তা খুঁজে বের করা যায়। জিপিএস না থাকলে পথ হারিয়ে যেতে হতো।
-
স্মার্টফোন: आजकल প্রায় সব স্মার্টফোনেই জিপিএস থাকে। এর মাধ্যমে লোকেশন শেয়ার করা, কোনো স্থান খুঁজে বের করা, এমনকি গেম খেলাও যায়।
-
রাইড শেয়ারিং: উবার (Uber) বা পাঠাও (Pathao) এর মতো রাইড শেয়ারিং সার্ভিস জিপিএস এর ওপর নির্ভরশীল। ড্রাইভার এবং যাত্রী উভয়ের অবস্থান জানতে এটা ব্যবহার করা হয়।
- স্বাস্থ্য ও ফিটনেস: স্মার্টওয়াচ (Smartwatch) বা ফিটনেস ট্র্যাকার (Fitness tracker) দিয়ে হাঁটাচলার হিসাব রাখা হয়, যা জিপিএস এর মাধ্যমে করা হয়।
தொழில்முறை ক্ষেত্রে ಜಿಪಿಎಸ್
-
পরিবহন: পণ্য পরিবহনকারী ট্রাক বা জাহাজের অবস্থান জানতে জিপিএস ব্যবহার করা হয়। এর মাধ্যমে সাপ্লাই চেইন (Supply Chain) ম্যানেজমেন্ট সহজ হয়।
-
কৃষি: আধুনিক কৃষিকাজে জিপিএস ব্যবহার করে ট্রাক্টর চালানো এবং ফসলের ফলন বাড়ানো যায়।
-
সামরিক খাত: সামরিক বাহিনীতে সৈন্যদের অবস্থান নির্ণয়, যুদ্ধজাহাজ পরিচালনা এবং আকাশপথে বিমান চালনায় জিপিএস ব্যবহার করা হয়।
- পর্যবেক্ষণ: ভূমিকম্প বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা চিহ্নিত করতে জিপিএস ব্যবহার করা হয়।
জিপিএস ট্র্যাকিং: নিরাপত্তা ও নজরদারি
জিপিএস ট্র্যাকিং এখন খুব জনপ্রিয়। এর মাধ্যমে আপনি আপনার জিনিসপত্র বা প্রিয়জনদের ওপর নজর রাখতে পারেন।
-
গাড়ি ট্র্যাকিং: গাড়িতে জিপিএস ট্র্যাকার (GPS tracker) লাগিয়ে রাখলে গাড়ি চুরি হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। চুরি হয়ে গেলেও দ্রুত খুঁজে বের করা যায়।
-
শিশুদের নিরাপত্তা: बच्चोंরা কোথায় যাচ্ছে, সেটা জানার জন্য তাদের স্মার্টওয়াচে বা অন্য কোনো ডিভাইসে জিপিএস ট্র্যাকার ব্যবহার করা যায়।
-
পোষা প্রাণী ট্র্যাকিং: আপনার পোষা কুকুর বা বিড়াল হারিয়ে গেলে জিপিএস ট্র্যাকারের মাধ্যমে সহজেই খুঁজে বের করতে পারবেন।
জিপিএস এবং অন্যান্য নেভিগেশন সিস্টেম
জিপিএস ছাড়াও আরও অনেক নেভিগেশন সিস্টেম আছে। এদের মধ্যে কয়েকটির সাথে আমরা পরিচিত।
গ্লোনাস (GLONASS)
এটি রাশিয়ার তৈরি করা নেভিগেশন সিস্টেম। জিপিএস এর মতোই কাজ করে এবং বিশ্বব্যাপী অবস্থান নির্ণয়ে সাহায্য করে।
গ্যালিলিও (Galileo)
ইউরোপীয় ইউনিয়নের তৈরি এই সিস্টেমটি জিপিএস এর চেয়েও বেশি নির্ভুল বলে দাবি করা হয়।
বেইদু (BeiDou)
এটি চীনের তৈরি করা নেভিগেশন সিস্টেম। বর্তমানে এটি এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বেশি ব্যবহৃত হয়।
জিপিএস বনাম অন্যান্য নেভিগেশন সিস্টেম: কোনটি ভালো?
আসলে, কোনো একটি সিস্টেম অন্যটির চেয়ে সবসময় ভালো, তা বলা যায় না। এদের মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে:
বৈশিষ্ট্য | জিপিএস (GPS) | গ্লোনাস (GLONASS) | গ্যালিলিও (Galileo) | বেইদু (BeiDou) |
---|---|---|---|---|
দেশ | যুক্তরাষ্ট্র | রাশিয়া | ইউরোপীয় ইউনিয়ন | চীন |
নির্ভুলতা | মোটামুটি ভালো | মোটামুটি ভালো | খুব ভালো | ভালো |
বিশ্বব্যাপী কভারেজ | হ্যাঁ | হ্যাঁ | ধীরে ধীরে বাড়ছে | এশিয়াতে বেশি |
ব্যবহার | বিশ্বব্যাপী | বিশ্বব্যাপী | বিশ্বব্যাপী | এশিয়াতে বেশি |
বেশিরভাগ আধুনিক ডিভাইস একাধিক নেভিগেশন সিস্টেম ব্যবহার করতে পারে। এর ফলে অবস্থান নির্ণয়ের নির্ভুলতা আরও বাড়ে।
জিপিএস এর ভবিষ্যৎ: নতুন দিগন্ত
জিপিএস প্রযুক্তির উন্নতি কিন্তু থেমে নেই। ভবিষ্যতে আমরা আরও অনেক নতুন ব্যবহার দেখতে পাবো।
আরও উন্নত নির্ভুলতা
বিজ্ঞানীরা জিপিএস এর নির্ভুলতা বাড়ানোর জন্য কাজ করছেন। এর ফলে ভবিষ্যতে আমরা আরও নিখুঁতভাবে অবস্থান জানতে পারব।
স্বয়ংক্রিয় গাড়ি
চালকবিহীন গাড়ি বা ড্রোন (Drone) ভবিষ্যতে আরও জনপ্রিয় হবে। এই গাড়িগুলো চালানোর জন্য জিপিএস এর উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে।
ইন্টারনেট অফ থিংস (IoT)
স্মার্ট হোম (Smart home) থেকে শুরু করে স্মার্ট সিটি (Smart city), সবকিছুতেই জিপিএস এর ব্যবহার বাড়বে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং জিপিএস মিলেমিশে আরও উন্নত নেভিগেশন সিস্টেম তৈরি করবে, যা আমাদের জীবনকে আরও সহজ করে দেবে।
সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ): জিপিএস নিয়ে কিছু প্রশ্ন ও উত্তর
জিপিএস নিয়ে অনেকের মনে অনেক প্রশ্ন থাকে। এখানে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
জিপিএস কি ইন্টারনেট ছাড়া কাজ করে?
জিপিএস রিসিভার স্যাটেলাইট থেকে সিগন্যাল গ্রহণ করে, তাই এর জন্য ইন্টারনেটের প্রয়োজন হয় না। তবে, ম্যাপ দেখার জন্য বা ডেটা আপডেট করার জন্য ইন্টারনেটের প্রয়োজন হতে পারে।
জিপিএস ট্র্যাকিং কি আইনত বৈধ?
কিছু ক্ষেত্রে জিপিএস ট্র্যাকিং আইনত বৈধ, আবার কিছু ক্ষেত্রে অবৈধ। যেমন, নিজের গাড়িতে ট্র্যাকার লাগানো বৈধ, কিন্তু কারো অজান্তে তার গাড়িতে ট্র্যাকার লাগানো অবৈধ।
মোবাইলে জিপিএস কিভাবে চালু করব?
আপনার ফোনের সেটিংসে গিয়ে লোকেশন (Location) অপশনটি চালু করলেই জিপিএস চালু হয়ে যাবে।
জিপিএস ব্যবহার করলে কি ফোনের ব্যাটারি বেশি খরচ হয়?
হ্যাঁ, জিপিএস ব্যবহার করলে ফোনের ব্যাটারি বেশি খরচ হয়, কারণ এটি সবসময় স্যাটেলাইট থেকে সিগন্যাল গ্রহণ করতে থাকে।
জিপিএস কি সবসময় সঠিক তথ্য দেয়?
জিপিএস সাধারণত সঠিক তথ্য দেয়, তবে কিছু কারণে যেমন খারাপ আবহাওয়া বা বিল্ডিংয়ের ভেতরে সিগন্যাল দুর্বল থাকলে তথ্যে সামান্য ভুল হতে পারে।
জিপিএস নিয়ে কিছু মজার তথ্য
জিপিএস শুধু কাজের জিনিস না, এটা নিয়ে কিছু মজার তথ্যও আছে!
-
প্রথম জিপিএস স্যাটেলাইটের নাম ছিল Navstar 1.
-
জিপিএস স্যাটেলাইটগুলো ঘণ্টায় প্রায় ১৪,০০০ কিলোমিটার বেগে পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে!
-
জিপিএস সিগন্যাল এত দুর্বল যে, আপনার গাড়ির উইন্ডশিল্ড ভেদ করতেও কষ্ট হয়।
- জিপিএস এর মাধ্যমে শুধু আপনার অবস্থান নয়, আপনার গতিও মাপা যায়।
জিপিএস আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে অনেক সহজ করে দিয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। পথ হারানো থেকে শুরু করে জরুরি অবস্থায় সাহায্য পাওয়া, সব কিছুতেই জিপিএস আমাদের সঙ্গী। তাই জিপিএস সম্পর্কে জানাটা আমাদের জন্য খুব জরুরি।
এই ছিল জিপিএস নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা। আশা করি, আপনি জিপিএস সম্পর্কে অনেক নতুন তথ্য জানতে পেরেছেন। এখন আপনিও জিপিএস ব্যবহার করে নিজের জীবনকে আরও সহজ করতে পারবেন! পথ হারিয়ে গেলে চিন্তা নেই, আপনার স্মার্টফোন তো আছেই!