ধরুন, আপনি বাজারে গিয়েছেন। দেখলেন, কিছু লোক নিজেদের ইচ্ছেমতো জিনিসপত্রের দাম হাঁকাচ্ছে, কেউ কিছু বলার নেই। কেমন লাগবে? নিশ্চয়ই খারাপ লাগবে! কারণ সেখানে কোনো নিয়ম-কানুন নেই, কোনো ‘শসন’ নেই। আজকের ব্লগ পোস্টে আমরা এই ‘শসন’ নিয়েই কথা বলব। আসুন, জেনে নেই শসন আসলে কী, কেন এটা জরুরি, এবং আমাদের জীবনে এর প্রভাবই বা কেমন।
শসন : শাসনের মূলকথা
শসন (Governance) শব্দটা শুনলেই কেমন যেন গুরুগম্ভীর একটা ব্যাপার মনে হয়, তাই না? আসলে কিন্তু বিষয়টা তেমন কঠিন নয়। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, শসন মানে হলো কোনো একটা সিস্টেম বা প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে কোনো দেশ, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়। এটা একটা কাঠামো, যেখানে নিয়ম-কানুন, নীতি এবং চর্চার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং সেগুলো কার্যকর করা হয়।
শসন একটি বহুমাত্রিক ধারণা। এর মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক—সব ধরনের বিষয় অন্তর্ভুক্ত। একটা দেশের সরকার কিভাবে কাজ করছে, জনগণের অধিকার কতটা সুরক্ষিত, দুর্নীতি কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে—এসবই শাসনের অংশ। আপনারা হয়তো শুনে থাকবেন “সুশাসন” এর কথা, যেখানে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং আইনের শাসনকে গুরুত্ব দেয়া হয়।
শসন কেন প্রয়োজন?
আচ্ছা, একটু চিন্তা করুন তো, যদি কোনো দেশে বা প্রতিষ্ঠানে শসন না থাকে, তাহলে কী হতে পারে? নিঃসন্দেহে একটা বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে, যেখানে শক্তিশালী লোকেরা নিজেদের স্বার্থে সবকিছু ব্যবহার করবে। দুর্বলরা আরও দুর্বল হয়ে পড়বে, আর ন্যায়বিচার বলে কিছুই থাকবে না। তাই শসন প্রয়োজন, কারণ:
- এটা নিশ্চিত করে যে ক্ষমতা যেন সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয়, কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যেন ক্ষমতার অপব্যবহার করতে না পারে।
- এটা জনগণের অধিকার রক্ষা করে এবং তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণে সাহায্য করে।
- এটা অর্থনৈতিক উন্নয়নে সাহায্য করে, কারণ একটি স্থিতিশীল এবং স্বচ্ছ পরিবেশ বিনিয়োগের জন্য অনুকূল।
- এটা সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখে।
সুশাসনের ধারণা
সুশাসন (Good Governance) শব্দটা आजकल বেশ শোনা যায়। সুশাসন হলো শাসনের সেই রূপ, যেখানে সবকিছু স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতার মধ্যে দিয়ে হয়। ধরুন, সরকার জনগণের টাকায় একটা রাস্তা তৈরি করছে। সুশাসন থাকলে, সরকার হিসাব দেবে যে কত টাকা খরচ হয়েছে, কোথায় খরচ হয়েছে, এবং রাস্তার মান কেমন হয়েছে। এর ফলে দুর্নীতি কম হয়, এবং জনগণের আস্থা বাড়ে। সুশাসনের মূল উপাদানগুলো হলো:
- অংশগ্রহণ: নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
- আইনের শাসন: আইনের চোখে সবাই সমান, এবং আইন সবার জন্য প্রযোজ্য।
- স্বচ্ছতা: সরকারের কাজকর্ম সম্পর্কে তথ্য জনগণের কাছে সহজলভ্য होना।
- জবাবদিহিতা: সরকারি কর্মকর্তাদের তাদের কাজের জন্য জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকা।
- কার্যকারিতা ও দক্ষতা: সম্পদের সঠিক ব্যবহার এবং সময় মতো কাজ সম্পন্ন করা।
- বৈষম্যহীনতা: জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ নির্বিশেষে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা।
শসনের প্রকারভেদ
শসন বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যা নির্ভর করে রাজনৈতিক ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক কাঠামো এবং সামাজিক রীতিনীতির উপর। নিচে কয়েকটি প্রধান ধরনের শসন আলোচনা করা হলো:
গণতান্ত্রিক শসন
গণতান্ত্রিক শসন (Democratic Governance) ব্যবস্থায় জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে এবং তাদের মাধ্যমে দেশ পরিচালিত হয়। এখানে জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, এবং সরকার জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকে। বাংলাদেশে আমরা এই ধরনের শাসন ব্যবস্থাই অনুসরণ করি। গণতন্ত্রের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:
- নিয়মিত নির্বাচন
- বহুদলীয় ব্যবস্থা
- বাক-স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা
- সংগঠন করার অধিকার
- আইনের শাসন
স্বৈরাচারী শসন
স্বৈরাচারী শসন (Autocratic Governance) ব্যবস্থায় একজন ব্যক্তি বা একটি দল নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হয়। এখানে জনগণের কোনো মতামত বা অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে না। এই ধরনের শাসনে প্রায়শই মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় এবং ভিন্ন মত দমন করা হয়।
সামরিক শসন
সামরিক শসন (Military Governance)-এ সেনাবাহিনী সরাসরি দেশ পরিচালনা করে। সাধারণত কোনো অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে। এই ধরনের শাসনে জনগণের মৌলিক অধিকার সীমিত হয়ে যায় এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়।
ইসলামী শসন
ইসলামী শসন (Islamic Governance) বলতে বোঝায় ইসলামী শরীয়াহ মোতাবেক দেশ পরিচালনা করা। এর মূল ভিত্তি হলো কুরআন ও সুন্নাহ। এই ব্যবস্থায় ইসলামী মূল্যবোধ ও আইন অনুযায়ী বিচারকার্য ও অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালিত হয়। বর্তমানে বিশ্বের কয়েকটি দেশে ইসলামী শসন ব্যবস্থা চালু আছে।
শসনের উপাদানসমূহ
একটি কার্যকর শসন ব্যবস্থা কিছু নির্দিষ্ট উপাদানের উপর নির্ভরশীল। এই উপাদানগুলো একটি দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নিচে কয়েকটি প্রধান উপাদান আলোচনা করা হলো:
আইন ও বিধিবিধান
আইন ও বিধিবিধান (Laws and Regulations) একটি শসন ব্যবস্থার ভিত্তি। এগুলো সমাজের সদস্যদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে। একটি শক্তিশালী আইন কাঠামো ছাড়া সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। আইনের শাসন মানে হলো:
- আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য
- আইনের মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করা
- নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা (Political Stability) একটি দেশের উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। রাজনৈতিক অস্থিরতা বিনিয়োগের পরিবেশ নষ্ট করে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করে। স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করে যে সরকার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারবে এবং তা বাস্তবায়ন করতে পারবে।
দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন
দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন (Corruption-Free Administration) সুশাসনের অন্যতম পূর্বশর্ত। দুর্নীতি একটি দেশের অর্থনীতিকে দুর্বল করে দেয় এবং জনগণের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করে। একটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক প্রশাসন দুর্নীতি রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দুর্নীতি প্রতিরোধের উপায়গুলো হলো:
- সরকারি কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি করা
- আইনের কঠোর প্রয়োগ
- জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি
কার্যকর স্থানীয় সরকার
কার্যকর স্থানীয় সরকার (Effective Local Government) জনগণের কাছে সেবা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্থানীয় সরকার জনগণের প্রয়োজন অনুযায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে এবং স্থানীয় সমস্যা সমাধানে সহায়তা করতে পারে। শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা জনগণের অংশগ্রহণে উৎসাহিত করে এবং গণতন্ত্রকে তৃণমূল পর্যায়ে নিয়ে যায়।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা (Freedom of Media) একটি গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য অপরিহার্য। গণমাধ্যম সরকারের ভুলত্রুটি তুলে ধরে এবং জনমত গঠনে সহায়তা করে। একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ গণমাধ্যম দুর্নীতি ও অপশাসন রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বাংলাদেশে শসন: প্রেক্ষাপট ও চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশে শসন ব্যবস্থা নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজকের অবস্থানে এসেছে। আমাদের সংবিধানে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এর প্রয়োগ সবসময় মসৃণ নয়।
রাজনৈতিক দুর্বলতা
বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রায়ই অস্থিরতা দেখা যায়, যা শসন ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেয়। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস, সহিংসতা এবং অসহিষ্ণুতা সুশাসনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
দুর্নীতি
দুর্নীতি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সমস্যা। সরকারি অফিসগুলোতে ঘুষ, স্বজনপ্রীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহার প্রায়ই দেখা যায়। এর ফলে সাধারণ মানুষ হয়রানির শিকার হয় এবং উন্নয়নের গতি কমে যায়।
দুর্বল বিচার ব্যবস্থা
আমাদের বিচার ব্যবস্থায় মামলাজট একটি বড় সমস্যা। দীর্ঘদিন ধরে বিচার না হওয়ায় অনেক মানুষ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়। এছাড়াও, বিচার প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের অভিযোগও রয়েছে।
জবাবদিহিতার অভাব
সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে জবাবদিহিতার অভাব দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে তারা জনগণের কাছে কোনো কাজের জন্য দায়বদ্ধ থাকে না। এর ফলে দুর্নীতি ও স্বৈরাচারের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
কীভাবে শসনকে উন্নত করা যায়?
শসনকে উন্নত করার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। নিচে কয়েকটি প্রস্তাবনা আলোচনা করা হলো:
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা (Establish Rule of Law) করতে হলে আইনকে সবার জন্য সমানভাবে প্রয়োগ করতে হবে। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত একটি নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে সবাই ন্যায়বিচার পায়।
দুর্নীতি দমন
দুর্নীতি দমন (Control Corruption) করতে হলে সরকারি কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে কেউ দুর্নীতি করতে সাহস না পায়।
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা (Ensure Political Stability) বজায় রাখার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে সহনশীল হতে হবে এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বাড়াতে হবে। শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে।
সুশীল সমাজের ভূমিকা
সুশীল সমাজ (Role of Civil Society) সরকারকে সঠিক পথে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তারা জনমত গঠন করে এবং সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেয়। সুশীল সমাজের কার্যক্রমে বাধা দেওয়া উচিত নয়। তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা (Ensure Media Freedom) নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা নির্ভয়ে সরকারের সমালোচনা করতে পারে এবং জনগণের কাছে সঠিক তথ্য পৌঁছে দিতে পারে।
শসন নিয়ে কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ)
-
শসন ও সুশাসনের মধ্যে পার্থক্য কী?
শসন হলো governance বা শাসনকার্য, আর সুশাসন হলো good governance বা উত্তম শাসনকার্য। সুশাসনে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, আইনের শাসন ইত্যাদি বিষয়গুলো নিশ্চিত করা হয়। -
একটি ভালো শসন ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য কী কী?
একটি ভালো শসন ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য হলো এটি স্বচ্ছ, জবাবদিহিতামূলক, কার্যকর, এবং আইনের শাসনে বিশ্বাসী হওয়া। -
শসনে জনগণের ভূমিকা কী?
শসনে জনগণের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনগণ ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে, যারা দেশ পরিচালনা করে। এছাড়াও, জনগণ বিভিন্নভাবে সরকারের নীতি ও সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে।
-
ই-গভর্নেন্স কীভাবে শসনকে উন্নত করতে পারে?
ই-গভর্নেন্স (E-governance) হলো তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে সরকারি সেবা জনগণের কাছে সহজে পৌঁছে দেওয়া। এর মাধ্যমে দুর্নীতি কমানো যায়, স্বচ্ছতা বাড়ে, এবং সরকারি কাজকর্ম দ্রুত হয়। -
শসন কি শুধুই সরকারের দায়িত্ব?
না, শসন শুধু সরকারের দায়িত্ব নয়। এখানে জনগণ, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম—সবারই ভূমিকা আছে। সবাই মিলেমিশে কাজ করলেই একটি ভালো শসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব।
উপসংহার
শসন একটি জটিল বিষয়, তবে এর গুরুত্ব অপরিসীম। একটি ভালো শসন ব্যবস্থা একটি দেশকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যেতে পারে, অন্যদিকে দুর্বল শসন দেশকে পিছিয়ে দিতে পারে। তাই আসুন, আমরা সবাই মিলেমিশে একটি ভালো শসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য কাজ করি। আপনার মতামত কমেন্টে জানাতে পারেন!