অধিকার কাকে বলে ও কয় প্রকার? – সহজ ভাষায় বুঝুন!
জীবন ধারণের জন্য আমাদের অনেক কিছুই প্রয়োজন। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান যেমন জরুরি, তেমনই সমাজে ভালোভাবে বাঁচতে গেলে কিছু অধিকারও দরকার। কিন্তু এই অধিকার আসলে কী? আর কত রকমের অধিকার আমাদের আছে, তা কি আপনি জানেন? চলুন, আজকের ব্লগ পোস্টে আমরা অধিকারের খুঁটিনাটি সবকিছু সহজ ভাষায় জেনে নিই।
অধিকার কী? (What is Adhikar?)
অধিকার মানে হল সেইসব সুযোগ-সুবিধা, যা একজন মানুষ হিসেবে আমাদের প্রাপ্য। এই অধিকারগুলো আমাদের ব্যক্তিত্ব বিকাশে সাহায্য করে এবং সমাজে সুস্থভাবে বাঁচতে দেয়। অধিকার ছাড়া একজন মানুষ পরাধীন হয়ে পড়ে, তার মর্যাদা থাকে না।
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, অধিকার হল সমাজের সেই নিয়মকানুন, যা আমাদের ভালো থাকার জন্য দরকার। এটা অনেকটা খেলার Rules-এর মতো। যেমন ক্রিকেট খেলতে গেলে কিছু নিয়ম মানতে হয়, তেমনি সমাজে বাঁচতে গেলে কিছু অধিকার আমাদের ভোগ করতে হয়।
অধিকার কেন প্রয়োজন? (Why do we need Adhikar?)
অধিকার আমাদের জীবনে কেন এত গুরুত্বপূর্ণ, তা কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে বলছি:
- মর্যাদা রক্ষা: ধরুন, আপনি একটি কাজ করছেন, কিন্তু আপনার পারিশ্রমিক দেওয়া হচ্ছে না। এটা আপনার অধিকারের লঙ্ঘন। অধিকার থাকলে আপনি এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারবেন এবং নিজের ন্যায্য পারিশ্রমিক আদায় করতে পারবেন।
- বিকাশের সুযোগ: শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতির মতো মৌলিক অধিকারগুলো আমাদের নিজেদের এবং সমাজের উন্নয়নে সাহায্য করে। শিক্ষা ছাড়া যেমন জ্ঞান অর্জন করা যায় না, তেমনি অধিকার ছাড়া জীবনও ভালোভাবে কাটানো যায় না।
- নিরাপত্তা: আইনের চোখে সবাই সমান – এই অধিকারটি আমাদের সুরক্ষা দেয়। কোনো ধনী বা ক্ষমতাশালী ব্যক্তি যেন আমাদের ক্ষতি করতে না পারে, তা নিশ্চিত করে।
অধিকার কত প্রকার? (Types of Adhikar)
অধিকারকে সাধারণত কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। নিচে প্রধান কয়েকটি প্রকারভেদ আলোচনা করা হলো:
1. মৌলিক অধিকার (Fundamental Rights)
মৌলিক অধিকারগুলো সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত এবং সুরক্ষিত। এগুলো মানুষের জীবনধারণের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। এই অধিকারগুলো কোনো সরকার বা অন্য কোনো ব্যক্তি কেড়ে নিতে পারে না। আমাদের সংবিধানে কিছু মৌলিক অধিকার দেওয়া আছে। সেগুলো হল:
- জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষার অধিকার: প্রত্যেক নাগরিকের জীবন এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতা রক্ষার অধিকার আছে। কেউ আইন ভঙ্গ না করলে, তাকে গ্রেফতার বা আটক করা যায় না।
- আইনের চোখে সমতা: আইনের চোখে সবাই সমান। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ – এসবের ভিত্তিতে কোনো ভেদাভেদ করা যাবে না। সবাই সমানভাবে আইনের আশ্রয় নিতে পারবে।
- ধর্মীয় স্বাধীনতা: প্রত্যেক নাগরিকের নিজ নিজ ধর্ম পালন ও প্রচারের স্বাধীনতা আছে। কেউ কাউকে ধর্ম পালনে বাধ্য করতে পারবে না।
- বাক ও চিন্তার স্বাধীনতা: প্রত্যেক মানুষের কথা বলার এবং নিজের মতামত প্রকাশের অধিকার আছে। তবে, এই অধিকার ব্যবহারের সময় অন্যের সম্মান ও নিরাপত্তা অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।
2. মানবাধিকার (Human Rights)
মানবাধিকার হলো সেই অধিকার যা একজন মানুষ হিসেবে জন্মগ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই পাওয়া যায়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, ভাষা, রাজনৈতিক বা অন্য কোনো মতাদর্শ নির্বিশেষে বিশ্বের সকল মানুষের এসব অধিকার আছে। মানবাধিকারগুলো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং universal declaration of human rights-এ উল্লেখ করা হয়েছে।
মানবাধিকারের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক:
- জীবন ধারণের অধিকার: খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবার মতো মৌলিক প্রয়োজন পূরণের অধিকার।
- দাসত্ব ও জোরপূর্বক শ্রম থেকে মুক্তি: কাউকে দাস বানানো যাবে না এবং কারও কাছ থেকে জোর করে কাজ করানো যাবে না।
- বৈষম্যহীনতার অধিকার: জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, বা অন্য কোনো পরিচয়ের ভিত্তিতে কোনো মানুষের সাথে বৈষম্য করা যাবে না।
- বিচার পাওয়ার অধিকার: প্রত্যেক মানুষের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। কোনো অপরাধ করলে, আদালতের মাধ্যমে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার সুযোগ থাকতে হবে।
3. সামাজিক অধিকার (Social Rights)
সামাজিক অধিকারগুলো সমাজে ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয়। এগুলো সাধারণত রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত এবং নাগরিকদের জন্য সুযোগ তৈরি করে।
সামাজিক অধিকারের উদাহরণ:
- শিক্ষার অধিকার: প্রত্যেক শিশুর শিক্ষা লাভের অধিকার আছে। সরকার সবার জন্য শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করতে বাধ্য।
- স্বাস্থ্যসেবার অধিকার: অসুস্থ হলে চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার সবার আছে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে বিনামূল্যে বা স্বল্প খরচে চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ থাকা উচিত।
- কর্মের অধিকার: প্রত্যেক সক্ষম ব্যক্তির কাজ করে জীবিকা নির্বাহের অধিকার আছে। বেকারত্ব দূর করার জন্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে পারে।
- আশ্রয়ের অধিকার: সবার একটি নিরাপদ আবাসস্থল পাওয়ার অধিকার আছে। যাদের ঘর নেই, তাদের জন্য সরকার আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ঘর তৈরি করে দিতে পারে।
4. অর্থনৈতিক অধিকার (Economic Rights)
অর্থনৈতিক অধিকারগুলো মানুষের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও স্বনির্ভরতা নিশ্চিত করে।
গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অধিকার:
- ন্যায্য মজুরি: প্রত্যেক শ্রমিককে তার কাজের জন্য ন্যায্য পারিশ্রমিক দিতে হবে। নারী ও পুরুষের মধ্যে মজুরির ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য করা যাবে না।
- সম্পত্তি অর্জনের অধিকার: প্রত্যেক নাগরিকের আইন অনুযায়ী সম্পত্তি কেনার ও মালিক হওয়ার অধিকার আছে।
- চুক্তি করার অধিকার: যে কোনো ব্যক্তি ব্যবসা বা অন্য কোনো প্রয়োজনে চুক্তি করতে পারে। তবে, চুক্তিটি অবশ্যই আইনসম্মত হতে হবে।
- পেশা নির্বাচনের অধিকার: যে কেউ নিজের পছন্দ অনুযায়ী যে কোনো বৈধ পেশা বেছে নিতে পারে।
5. রাজনৈতিক অধিকার (Political Rights)
রাজনৈতিক অধিকারগুলো নাগরিকদের রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়।
রাজনৈতিক অধিকারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
- ভোটাধিকার: প্রত্যেক নাগরিকের ভোট দেওয়ার অধিকার আছে। ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সের যে কোনো সুস্থ নাগরিক নির্বাচনে ভোট দিতে পারে।
- নির্বাচনে অংশগ্রহণের অধিকার: যে কোনো যোগ্য নাগরিক নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারে।
- সরকারের সমালোচনা করার অধিকার: নাগরিকরা সরকারের কাজের সমালোচনা করতে পারে এবং সরকারের কাছে জবাবদিহি চাইতে পারে।
- সংগঠন করার অধিকার: যে কোনো নাগরিক সমিতি, সংঘ বা রাজনৈতিক দল গঠন করতে পারে।
অধিকার এবং দায়িত্বের মধ্যে সম্পর্ক (Relationship between Rights and Responsibilities)
অধিকার এবং দায়িত্ব – এই দুটো বিষয় একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। একটি ছাড়া অন্যটি অর্থহীন। অধিকার ভোগ করার পাশাপাশি আমাদের কিছু দায়িত্বও পালন করতে হয়।
মনে রাখবেন, অধিকার তখনই ফলপ্রসূ হবে যখন আমরা নিজের দায়িত্বগুলো সঠিকভাবে পালন করব।
অধিকারের সীমাবদ্ধতা (Limitations of Rights)
অধিকার অবশ্যই দরকারি, কিন্তু এর কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে। কোনো অধিকারই চরম বা সীমাহীন নয়। অন্যের অধিকার রক্ষা এবং সমাজের শান্তি বজায় রাখার জন্য কিছু ক্ষেত্রে অধিকার সীমিত করা যেতে পারে।
- আইন ও শৃঙ্খলারক্ষা: আপনার কথা বলার অধিকার আছে, কিন্তু আপনি এমন কিছু বলতে পারেন না, যা অন্যের ক্ষতি করে বা আইন ভঙ্গ করে।
- জাতীয় নিরাপত্তা: দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে সরকার কিছু অধিকার সীমিত করতে পারে। যেমন, জরুরি অবস্থায় চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হতে পারে।
- নৈতিকতা ও শালীনতা: আপনি যা খুশি তাই করতে পারেন না। সমাজের নৈতিকতা ও শালীনতা বজায় রাখা আপনার দায়িত্ব।
অধিকার রক্ষায় আমাদের করণীয় (What to do to protect rights)
অধিকার রক্ষার জন্য আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে:
- সচেতনতা তৈরি: নিজের অধিকার সম্পর্কে জানতে হবে এবং অন্যদেরকেও জানাতে হবে। অধিকার সম্পর্কে সচেতন হলে কেউ আমাদের ঠকাতে পারবে না।
- আইনের আশ্রয়: অধিকার ক্ষুণ্ণ হলে আইনের আশ্রয় নিতে হবে। প্রয়োজনে আদালতের শরণাপন্ন হতে হবে।
- সংগঠিত হওয়া: অধিকার আদায়ের জন্য সংঘবদ্ধ হওয়া জরুরি। বিভিন্ন সামাজিক ও মানবাধিকার সংগঠন এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
- সরকারের সহযোগিতা: সরকারকেও অধিকার রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। দুর্বল ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে।
সাধারণ জিজ্ঞাসা (Frequently Asked Questions – FAQs)
অধিকার নিয়ে আপনাদের মনে আরও কিছু প্রশ্ন আসতে পারে। তেমনই কয়েকটি সাধারণ প্রশ্ন ও তার উত্তর নিচে দেওয়া হলো:
১. মানবাধিকার দিবস কবে পালিত হয়?
মানবাধিকার দিবস প্রতি বছর ১০ ডিসেম্বর পালিত হয়। এই দিনে ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়।
২. সংবিধান কী? এখানে অধিকার সম্পর্কে কী বলা আছে?
সংবিধান হলো একটি দেশের সর্বোচ্চ আইন। এখানে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলো লিপিবদ্ধ আছে। আমাদের সংবিধানে তৃতীয় ভাগে (২৬ থেকে ৪৭ নং অনুচ্ছেদে) মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে।
৩. মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে কী করা উচিত?
মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে আপনি হাইকোর্টে বা সুপ্রিম কোর্টে আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। সংবিধানের ৪৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সুপ্রিম কোর্ট মৌলিক অধিকার রক্ষার জন্য বিভিন্ন প্রকার আদেশ ও নির্দেশ দিতে পারে।
৪. শিশুদের অধিকারগুলো কী কী?
জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী, প্রত্যেক শিশুর বেঁচে থাকার, শিক্ষা গ্রহণের, স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার, বিশ্রাম ও বিনোদনের অধিকার আছে। এছাড়া, শিশুদেরকে শ্রম শোষণ ও যে কোনো প্রকার নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে।
৫. একজন নাগরিকের প্রধান দায়িত্বগুলো কী?
একজন নাগরিকের প্রধান দায়িত্ব হলো দেশের আইন মান্য করা, নিয়মিত কর দেওয়া, ভোটাধিকার প্রয়োগ করা, পরিবেশ রক্ষা করা এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা।
উপসংহার
অধিকার আমাদের জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই অধিকারগুলো আমাদের মর্যাদা রক্ষা করে, বিকাশের সুযোগ দেয় এবং সমাজে সুন্দরভাবে বাঁচতে সাহায্য করে। তাই, নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকুন এবং অন্যকেও সচেতন করুন। একসাথে কাজ করে আমরা একটি ন্যায় ও সমতাপূর্ণ সমাজ গড়তে পারি।
এই ব্লগ পোস্টটি পড়ে যদি আপনি উপকৃত হন, তাহলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না। আপনার কোনো প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট বক্সে জানাতে পারেন, আমি উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব। ধন্যবাদ!