আচ্ছা, ভাবুন তো, একদিন আপনি হয়তো দেখছেন আপনার ছোট ভাইটি বাবার পকেট থেকে কিছু টাকা সরানোর চেষ্টা করছে। অথবা, আপনার ছোট্ট বোনটি মায়ের বারণ সত্ত্বেও লুকিয়ে ল্যাপটপে গেম খেলছে। তখন আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, “এদের কি কোনো ধারণা নেই কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল?” এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে প্রথমেই যে শব্দটি আমাদের সামনে আসে, তা হলো “নাবালক”। তাহলে চলুন, আজকের ব্লগ পোস্টে আমরা জেনে নিই “নাবালক কাকে বলে” এবং এর সাথে জড়িত আরো কিছু জরুরি বিষয়।
নাবালক: জীবনের শুরুতে আইনি জটিলতা থেকে সুরক্ষা
নাবালক শব্দটা শুনলেই কেমন যেন একটা হালকা ধারণা তৈরি হয়, তাই না? মনে হয় যেন কোনো বাচ্চা ছেলে বা মেয়ের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু আইনের চোখে এর একটা বিশেষ মানে আছে। একজন নাবালক, সহজ ভাষায়, সেই ব্যক্তি যে এখনো আইনত সাবালক হয়নি। অর্থাৎ, যাদের বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হয়নি, তারাই নাবালক।
নাবালক কারা: আইন কী বলে?
আইনের ভাষায়, একজন নাবালক হলো সেই ব্যক্তি যে এখনো সাবালকত্বের বয়স অর্জন করেনি। আমাদের দেশে সাধারণত ১৮ বছর বয়সকে সাবালক হিসেবে ধরা হয়। এই বয়সের নিচে যে কেউ, সে ছেলে হোক বা মেয়ে, আইনের চোখে নাবালক।
নাবালক হওয়ার বয়সসীমা: দেশে দেশে ভিন্নতা
জানেন তো, সব দেশে কিন্তু নাবালকত্বের বয়স এক নয়! কোনো দেশে এই সীমা ১৬ বছর, আবার কোথাও ২১ বছর। আমাদের বাংলাদেশে সাধারণত ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত একজন ব্যক্তি নাবালক হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই, আইনি জটিলতা এড়াতে বিভিন্ন দেশের এই ভিন্নতা সম্পর্কে জেনে রাখা ভালো।
নাবালকের অধিকার ও সুরক্ষা: কেন প্রয়োজন?
নাবালকদের বিশেষ সুরক্ষার প্রয়োজন কেন, জানেন? কারণ তারা শারীরিকভাবে দুর্বল হতে পারে, মানসিকভাবে অপরিণত থাকতে পারে এবং তাদের সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও কম থাকে। তাই রাষ্ট্র এবং পরিবার উভয়েরই তাদের প্রতি বিশেষ নজর রাখা উচিত।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য: মৌলিক অধিকার
সংবিধানে বলা আছে, প্রত্যেক শিশুর শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার আছে। সরকার এবং পরিবারকে এই অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। একজন নাবালক যাতে ভালোভাবে লেখাপড়া করতে পারে এবং সুস্থ জীবনযাপন করতে পারে, সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার।
শ্রম ও শোষণ থেকে সুরক্ষা
অনেক সময় দেখা যায়, নাবালকদের বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ব্যবহার করা হয়। এটা সম্পূর্ণ বেআইনি। আইন অনুযায়ী, ১৮ বছরের কম বয়সী কাউকে কোনো ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে লাগানো যাবে না। যদি কেউ এটা করে, তবে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নাবালকের দায়িত্ব ও কর্তব্য: ধীরে ধীরে বড় হওয়া
যেমন অধিকার আছে, তেমনি নাবালকদেরও কিছু দায়িত্ব থাকে। যদিও তারা সাবালক নয়, তবে তাদেরও সমাজের প্রতি কিছু কর্তব্য পালন করতে হয়।
পরিবারের প্রতি দায়িত্ব
পরিবারের প্রতি নাবালকদের প্রধান দায়িত্ব হলো বাবা-মায়ের কথা শোনা এবং তাদের কাজে সাহায্য করা। এছাড়া, ছোট ভাই-বোনদের প্রতি খেয়াল রাখা এবং তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করাও তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতি দায়িত্ব
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজন নাবালকের প্রধান কাজ হলো মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করা, শিক্ষকের কথা মান্য করা এবং স্কুলের নিয়মকানুন সঠিকভাবে পালন করা। স্কুলের পরিবেশ সুন্দর রাখতেও তাদের সহযোগিতা করা উচিত।
সমাজের প্রতি দায়িত্ব
নাবালকদের সমাজের প্রতিও কিছু দায়িত্ব রয়েছে। যেমন, রাস্তায় কোনো বিপদ দেখলে বড়দের জানানো, পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখতে সাহায্য করা এবং অন্যদের প্রতি সহানুভূতি দেখানো।
নাবালক অবস্থায় বিয়ে: একটি সামাজিক অভিশাপ
বাল্যবিবাহ একটি মারাত্মক সামাজিক সমস্যা। আমাদের দেশে এখনো অনেক জায়গায় নাবালিকাদের বিয়ে দেওয়া হয়, যা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।
বাল্য বিবাহের কুফল
বাল্যবিবাহের কারণে একজন নাবালিকা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়, তার স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যায় এবং সে নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যার শিকার হয়। তাই বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা আমাদের সকলের দায়িত্ব।
নাবালকের সম্পত্তি: কারা দেখাশোনা করে?
নাবালকের সম্পত্তি দেখাশোনার জন্য আইন অভিভাবক নিয়োগের ব্যবস্থা রেখেছে। সাধারণত বাবা-মা অথবা আদালতের মাধ্যমে নিযুক্ত কোনো ব্যক্তি নাবালকের সম্পত্তির তত্ত্বাবধান করেন।
অভিভাবকের দায়িত্ব
অভিভাবকের প্রধান কাজ হলো নাবালকের সম্পত্তির সঠিক ব্যবহার করা এবং তার স্বার্থ রক্ষা করা। তারা নাবালকের সম্পত্তি বিক্রি করতে চাইলে আদালতের অনুমতি নিতে হয়।
নাবালক বিষয়ক আইন: কিছু জরুরি তথ্য
নাবালক বিষয়ক বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আইন রয়েছে, যা আমাদের জানা দরকার।
শিশু আইন ২০১৩
এই আইনে শিশুদের অধিকার ও সুরক্ষা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এখানে শিশুদের প্রতি অবহেলা, নির্যাতন এবং শোষণ বন্ধ করার কথা বলা হয়েছে।
বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭
এই আইন বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করার জন্য তৈরি করা হয়েছে। এই আইনে বাল্যবিবাহকে একটি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে এবং এর জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।
নাবালক এবং অপরাধ: আইনের চোখে বিচার
যদি কোনো নাবালক কোনো অপরাধ করে, তাহলে তার বিচার প্রক্রিয়া সাধারণ অপরাধীদের থেকে ভিন্ন হয়।
শিশু আদালত
নাবালকদের জন্য আলাদা শিশু আদালত রয়েছে। এই আদালতে নাবালকদের বিচার করা হয় এবং তাদের সংশোধনের সুযোগ দেওয়া হয়।
সংশোধন কেন্দ্র
অপরাধী নাবালকদের কারাগারে না পাঠিয়ে সংশোধন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। এখানে তাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, যাতে তারা ভবিষ্যতে ভালো জীবন যাপন করতে পারে।
নাবালক বয়সে ভোটার হওয়া বা জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়ার নিয়ম কি?
ভোটার হওয়ার নিয়ম
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন অনুসারে, ভোটার হওয়ার জন্য একজন ব্যক্তিকে অবশ্যই ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী হতে হবে। যেহেতু নাবালক অর্থাৎ ১৮ বছরের কম বয়সীরা ভোটার হওয়ার যোগ্য নয়, তাই তারা ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করতে পারে না।
জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়ার নিয়ম
জাতীয় পরিচয়পত্র (NID) পাওয়ার জন্য একজন ব্যক্তিকে অবশ্যই বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে এবং তার বয়স ১৮ বছর বা তার বেশি হতে হবে। নাবালক হওয়ার কারণে, ১৮ বছরের কম বয়সীরা জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়ার যোগ্য নয়। তবে, ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার পরে তারা NID-এর জন্য আবেদন করতে পারবে।
নাবালক ছেলে বা মেয়ের সম্পত্তির উত্তরাধিকার কি?
নাবালক ছেলে বা মেয়েরা তাদের বাবা-মা বা অন্যান্য আত্মীয়ের সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে পেতে পারে। এক্ষেত্রে, নাবালক সন্তানের পক্ষে তাদের সম্পত্তি দেখাশোনার জন্য একজন অভিভাবক নিয়োগ করা হয়। এই অভিভাবক আদালতের মাধ্যমে অথবা উইল (Will) করে নির্ধারিত হতে পারেন। অভিভাবকের দায়িত্ব হলো নাবালক সন্তানের সম্পত্তির সঠিক ব্যবস্থাপনা ও সুরক্ষা করা, যতক্ষণ না তারা সাবালক হয় এবং নিজের সম্পত্তি নিজেরা পরিচালনা করতে সক্ষম হয়।
নাবালক অবস্থায় কোন কাজগুলো করা উচিত না?
নাবালক অবস্থায় এমন কিছু কাজ আছে যা করা উচিত না, কারণ এগুলো তাদের শারীরিক, মানসিক ও আইনি সুরক্ষার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। নিচে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কাজ উল্লেখ করা হলো:
- ধূমপান ও মাদক সেবন: নাবালক বয়সে ধূমপান ও মাদক সেবন করা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এটি তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে বাধা দেয়।
- যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হওয়া: নাবালক বয়সে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হওয়া আইনত দণ্ডনীয় এবং এটি শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
- ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করা: যেকোনো ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ, যেমন নির্মাণ সাইটে কাজ করা বা ভারী যন্ত্রপাতি পরিচালনা করা নাবালকদের জন্য বিপজ্জনক।
- আইন ভঙ্গ করা: চুরি, মারামারি বা অন্য কোনো ধরনের অপরাধমূলক কাজে জড়িত হওয়া নাবালকদের জন্য ক্ষতিকর, যা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে।
- অনুমতি ছাড়া বাড়ি থেকে পালানো: বাবা-মায়ের অনুমতি ছাড়া বাড়ি থেকে পালানো নাবালকদের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে, কারণ তারা খারাপ সঙ্গ বা বিপদের সম্মুখীন হতে পারে।
- সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করা: নাবালক বয়সে সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের ব্যক্তিগত তথ্য, যেমন ঠিকানা বা ফোন নম্বর শেয়ার করা উচিত নয়, কারণ এটি তাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।
- অপরিচিত ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ: অপরিচিত ব্যক্তির সাথে অনলাইনে বা অফলাইনে যোগাযোগ করা নাবালকদের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।
FAQ: কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা
নাবালক নিয়ে অনেকের মনেই কিছু প্রশ্ন থাকে। এখানে কয়েকটি সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
- প্রশ্ন: নাবালক ছেলে বা মেয়ের নামে কি সম্পত্তি কেনা যায়?
উত্তর: হ্যাঁ, নাবালক ছেলে বা মেয়ের নামে সম্পত্তি কেনা যায়। তবে এক্ষেত্রে অভিভাবকের মাধ্যমে রেজিস্ট্রি করতে হয়। - প্রশ্ন: নাবালক অবস্থায় কি ব্যাংক একাউন্ট খোলা যায়?
উত্তর: হ্যাঁ, নাবালক অবস্থায় ব্যাংক একাউন্ট খোলা যায়। এক্ষেত্রে অভিভাবকের সহায়তায় একাউন্ট খোলা হয় এবং অভিভাবক একাউন্টটি পরিচালনা করেন। - প্রশ্ন: নাবালক কি ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে পারে?
উত্তর: না, ১৮ বছর পূর্ণ না হলে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া যায় না। - প্রশ্ন: নাবালকের কি ভোটার আইডি কার্ড থাকতে পারে?
উত্তর: না, ভোটার আইডি কার্ড পাওয়ার জন্য ১৮ বছর বয়স হতে হয়। - প্রশ্ন: নাবালক অবস্থায় পাসপোর্ট করার নিয়ম কি?
উত্তর: নাবালক অবস্থায় পাসপোর্ট করার জন্য জন্ম নিবন্ধন সনদ, বাবা-মায়ের ছবি ও পরিচয়পত্র এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিতে হয়। এছাড়া, আবেদনপত্রে বাবা-মায়ের স্বাক্ষর থাকতে হয়।
উপসংহার
তাহলে, “নাবালক কাকে বলে” এই প্রশ্নের উত্তর আমরা এতক্ষণে পেয়ে গেছি। একজন নাবালক হলো সেই ব্যক্তি, যে এখনো সাবালক হয়নি এবং আইনের চোখে বিশেষ সুরক্ষার দাবিদার। তাদের অধিকার রক্ষা করা, তাদের সঠিক পথে পরিচালনা করা এবং তাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা আমাদের সকলের দায়িত্ব।
এই বিষয়ে আপনার কোনো প্রশ্ন থাকলে বা কোনো মতামত জানাতে চাইলে, নিচে কমেন্ট করতে পারেন। আপনার মূল্যবান মতামত আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একসাথে আমরা নাবালকদের জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তে পারি।