আরে দোস্ত! রসায়ন ক্লাসে স্যার যখন ‘কেন্দ্রীয় পরমাণু’ নিয়ে কথা বলছিলেন, তখন কি একটু অন্যমনস্ক ছিলে? চিন্তা নেই! আজ আমরা এই বিষয়টা নিয়ে এমনভাবে আলোচনা করব, যেন সবকিছু জলের মতো সোজা হয়ে যায়। শুধু সংজ্ঞাই নয়, এর পেছনের আসল রহস্যটাও আমরা ভেদ করব। তাহলে চলো, শুরু করা যাক!
কেন্দ্রীয় পরমাণু: রসায়নের বস
আসলে কেন্দ্রীয় পরমাণুটা কী?
কোনো যৌগের অণুতে যে পরমাণুগুলো অন্য পরমাণুদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে একটা “সেন্ট্রাল হাব” তৈরি করে, সেটাই হলো কেন্দ্রীয় পরমাণু। অনেকটা যেন একটা পরিবারের প্রধান, যার চারপাশে অন্য সদস্যরা থাকে। জটিল লাগছে? উদাহরণ দিলেই দেখবে ব্যাপারটা কত সহজ।
উদাহরণ দিয়ে বুঝি
মনে করো, আমাদের সবার পরিচিত জল (H₂O)। এখানে অক্সিজেন (O) হলো কেন্দ্রীয় পরমাণু। কারণ দুটো হাইড্রোজেন (H) পরমাণু অক্সিজেনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। অক্সিজেন যেন দুই বাহু বাড়িয়ে দুটো হাইড্রোজেনকে ধরে রেখেছে।
আবার, মিথেন (CH₄)-এর কথা ভাবো। এখানে কার্বন (C) হলো সেই বস। চারটে হাইড্রোজেন পরমাণু কার্বনের সঙ্গে জুড়ে আছে।
কেন এই পরমাণুগুলো “সেন্ট্রাল”?
আসলে, কিছু পরমাণুর যোজ্যতা (valence) বেশি থাকে। মানে, তারা বেশি সংখ্যক বন্ধন (bond) তৈরি করতে পারে। এই কারণেই তারা অন্য পরমাণুদের “আকর্ষণ” করে নিজের সঙ্গে জুড়ে নেয়, এবং কেন্দ্রীয় পরমাণু হয়ে ওঠে।
কেন্দ্রীয় পরমাণু চেনার সহজ উপায়
কীভাবে বুঝবে, কোন পরমাণুটি সেন্ট্রাল পজিশনে আছে? কয়েকটা জিনিস খেয়াল রাখলেই কেল্লা ফতে!
- যোজ্যতা: সাধারণত, যে পরমাণুর যোজ্যতা বেশি, সেটাই কেন্দ্রীয় পরমাণু হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। যেমন, কার্বনের যোজ্যতা ৪, অক্সিজেনের ২, আর হাইড্রোজেনের ১। তাই কার্বন সাধারণত সেন্ট্রাল অ্যাটম হয়।
- সংখ্যা: কোনো যৌগে যে পরমাণুর সংখ্যা কম থাকে, সেটাই সাধারণত কেন্দ্রীয় পরমাণু হয়। যেমন, CO₂-তে কার্বন একটা, অক্সিজেন দুটো। তাই কার্বন এখানে কেন্দ্রীয় পরমাণু।
কেন্দ্রীয় পরমাণুর খুঁটিনাটি: আরেকটু গভীরে ঢোকা যাক
কেন্দ্রীয় পরমাণু চেনার কয়েকটা নিয়ম তো জানলাম, তবে এর আরও কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যা আমাদের জানা দরকার।
যোজ্যতা ইলেকট্রন (Valence Electron)
যোজ্যতা ইলেকট্রন কী, সেটা জানা জরুরি। কোনো পরমাণুর বাইরের কক্ষপথে (outermost shell) যতগুলো ইলেকট্রন থাকে, সেটাই তার যোজ্যতা ইলেকট্রন। এই ইলেকট্রনগুলোই রাসায়নিক বন্ধন (chemical bond) তৈরিতে অংশ নেয়।
যোজ্যতা ইলেকট্রন এবং কেন্দ্রীয় পরমাণু
কেন্দ্রীয় পরমাণুর যোজ্যতা ইলেকট্রনগুলো বন্ধন তৈরির জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই ইলেকট্রনগুলো অন্য পরমাণুর সঙ্গে শেয়ার (share) করে অথবা আদান-প্রদান (exchange) করে যৌগ তৈরি করে।
অষ্টক নিয়ম (Octet Rule)
রাসায়নিক বন্ধনের সময় পরমাণুগুলো চায় তাদের বাইরের কক্ষপথে আটটা ইলেকট্রন থাকুক। এটাকে অষ্টক নিয়ম বলে। তবে কিছু ব্যতিক্রম আছে, যেমন হাইড্রোজেন (H) চায় দুটো ইলেকট্রন থাকুক (ডুয়েট নিয়ম)।
অষ্টক নিয়ম এবং কেন্দ্রীয় পরমাণু
কেন্দ্রীয় পরমাণু অন্য পরমাণুদের সঙ্গে বন্ধন তৈরি করে অষ্টক পূরণের চেষ্টা করে। এই অষ্টক পূরণের মাধ্যমেই যৌগ স্থিতিশীল (stable) হয়।
বহু-পরমাণুক অণু (Polyatomic Molecules)
বহু-পরমাণুক অণু হলো সেই অণু, যেখানে তিন বা তার বেশি পরমাণু থাকে। এই ধরনের অণুতে কেন্দ্রীয় পরমাণুর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কেন্দ্রীয় পরমাণুর গুরুত্ব
বহু-পরমাণুক অণুর গঠন (structure) এবং বৈশিষ্ট্য (properties) কেন্দ্রীয় পরমাণুর ওপর নির্ভর করে। কেন্দ্রীয় পরমাণু ঠিক কেমনভাবে অন্য পরমাণুদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে, তার ওপর ভিত্তি করে অণুর আকার এবং ধর্ম নির্ধারিত হয়।
কিছু জটিল উদাহরণ: ভয় নেই, আমরা আছি!
কিছু যৌগ আছে, যেখানে কেন্দ্রীয় পরমাণু খুঁজে বের করা একটু কঠিন। চলো, সেগুলোর কয়েকটা উদাহরণ দেখে নিই।
সালফিউরিক অ্যাসিড (H₂SO₄)
এখানে সালফার (S) হলো কেন্দ্রীয় পরমাণু। সালফারের সঙ্গে দুটো অক্সিজেন (O) এবং দুটো হাইড্রোক্সিল গ্রুপ (OH) যুক্ত থাকে।
কেন সালফার কেন্দ্রীয় পরমাণু?
সালফারের যোজ্যতা ৬, যা অক্সিজেন এবং হাইড্রোজেনের থেকে বেশি। তাই সালফার এখানে সেন্ট্রাল রোল প্লে করে।
ফসফরিক অ্যাসিড (H₃PO₄)
এই যৌগে ফসফরাস (P) হলো কেন্দ্রীয় পরমাণু। ফসফরাসের সঙ্গে চারটা অক্সিজেন (O) এবং তিনটা হাইড্রোজেন (H) যুক্ত থাকে।
ফসফরাসের বিশেষত্ব
ফসফরাসের যোজ্যতা ৫, তাই সে অনায়াসে চারটা অক্সিজেন এবং তিনটা হাইড্রোজেনের সঙ্গে বন্ধন তৈরি করতে পারে।
“কেন্দ্রীয় পরমাণু” নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন (FAQ)
তোমাদের মনে নিশ্চয়ই এই বিষয় নিয়ে অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। চলো, কয়েকটা সাধারণ প্রশ্ন এবং তার উত্তর জেনে নিই।
প্রশ্ন ১: সব যৌগের কি কেন্দ্রীয় পরমাণু থাকে?
উত্তর: না, সব যৌগের কেন্দ্রীয় পরমাণু থাকে না। শুধুমাত্র বহু-পরমাণুক যৌগের ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় পরমাণু দেখা যায়। যেমন, HCl-এ কোনো কেন্দ্রীয় পরমাণু নেই, কারণ এখানে দুটো পরমাণু আছে – হাইড্রোজেন (H) এবং ক্লোরিন (Cl)।
প্রশ্ন ২: কেন্দ্রীয় পরমাণুর জারণ সংখ্যা (oxidation number) কিভাবে বের করে?
উত্তর: কেন্দ্রীয় পরমাণুর জারণ সংখ্যা বের করতে হলে প্রথমে যৌগের অন্যান্য পরমাণুগুলোর জারণ সংখ্যা জানতে হবে। তারপর সব পরমাণুর জারণ সংখ্যার সমষ্টিকে শূন্য ধরে কেন্দ্রীয় পরমাণুর জারণ সংখ্যা হিসাব করতে হয়।
উদাহরণ: KClO₃-এ Cl-এর জারণ সংখ্যা বের করতে হলে, K-এর (+1) এবং O-এর (-2) জারণ সংখ্যা বসিয়ে হিসাব করতে হবে: +1 + Cl + 3(-2) = 0, সুতরাং Cl = +5
প্রশ্ন ৩: জটিল যৌগে (complex compound) কিভাবে কেন্দ্রীয় ধাতু পরমাণু (central metal atom) খুঁজে বের করব?
উত্তর: জটিল যৌগে কেন্দ্রীয় ধাতু পরমাণু সাধারণত transition metal (যেমন: লোহা, কপার, নিকেল) হয়। এটি লিগ্যান্ড (ligand) নামক ঋণাত্মক আয়ন বা প্রশম অণু দ্বারা বেষ্টিত থাকে। জটিল যৌগের সংকেতে ধাতু পরমাণুটি সাধারণত প্রথমে লেখা হয়।
উদাহরণ: [Fe(CN)₆]³⁻-এ Fe হল কেন্দ্রীয় ধাতু পরমাণু।
প্রশ্ন ৪: কেন্দ্রীয় পরমাণুর আকার কি যৌগের ধর্মকে প্রভাবিত করে?
উত্তর: হ্যাঁ, কেন্দ্রীয় পরমাণুর আকার যৌগের অনেক ধর্মকে প্রভাবিত করে, যেমন বন্ধন দৈর্ঘ্য (bond length), বন্ধন শক্তি (bond energy) এবং যৌগের স্থিতিশীলতা (stability)।
প্রশ্ন ৫: কেন্দ্রীয় পরমাণুর সংকরণ (hybridization) কিভাবে নির্ণয় করে?
উত্তর: কেন্দ্রীয় পরমাণুর সংকরণ নির্ণয় করতে হলে প্রথমে লুইস গঠন (Lewis structure) আঁকতে হয়। তারপর সিগমা বন্ধন (sigma bond) এবং নিঃসঙ্গ ইলেকট্রন জোড় (lone pair) গণনা করে সংকরণ নির্ণয় করা যায়।
উদাহরণ: CH₄-এ কার্বনের চারটি সিগমা বন্ধন আছে এবং কোনো নিঃসঙ্গ ইলেকট্রন জোড় নেই, তাই এর সংকরণ sp3।
প্রশ্ন ৬: জৈব যৌগে (organic compound) কিভাবে কেন্দ্রীয় পরমাণু চিহ্নিত করব?
উত্তর: জৈব যৌগে কার্বন (C) প্রায়শই কেন্দ্রীয় পরমাণু হিসেবে থাকে, কারণ কার্বনের যোজ্যতা ৪ এবং এটি একাধিক কার্বন বা অন্যান্য পরমাণুর সাথে যুক্ত হতে পারে।
প্রশ্ন ৭: কেন্দ্রীয় পরমাণুর যোজ্যতা ইলেকট্রন কিভাবে রাসায়নিক বিক্রিয়াকে প্রভাবিত করে?
উত্তর: কেন্দ্রীয় পরমাণুর যোজ্যতা ইলেকট্রন রাসায়নিক বিক্রিয়ার সময় বন্ধন গঠন এবং ভাঙ্গনে সরাসরি অংশ নেয়। এই ইলেকট্রনগুলোই নির্ধারণ করে পরমাণুটি কয়টি বন্ধন তৈরি করতে পারবে এবং কোন ধরনের যৌগ গঠন করবে।
প্রশ্ন ৮: কেন্দ্রীয় পরমাণুর চার্জ (charge) কিভাবে যৌগের নামকরণকে প্রভাবিত করে?
উত্তর: কেন্দ্রীয় পরমাণুর চার্জ যৌগের নামকরণের সময় উল্লেখ করতে হয়। জটিল যৌগের নামকরণে ধাতুর চার্জ বন্ধনীর মধ্যে রোমান সংখ্যায় লেখা হয়।
উদাহরণ: [Cu(NH₃)₄]SO₄-এ কপারের চার্জ +২, তাই এর নাম টেট্রামিন কপার(II) সালফেট।
প্রশ্ন ৯: কিছু ব্যতিক্রমী অণু যেখানে অষ্টক নিয়ম (octet rule) মানা হয় না, সেখানে কিভাবে কেন্দ্রীয় পরমাণু সনাক্ত করব?
উত্তর: অষ্টক নিয়ম না মানা অণুগুলোতে কেন্দ্রীয় পরমাণু সনাক্ত করতে হলে দেখতে হবে কোন পরমাণুটি সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বন্ধন তৈরি করেছে বা যার যোজ্যতা বেশি।
উদাহরণ: BF₃-এ বোরন (B) তিনটি ফ্লোরিন (F) পরমাণুর সাথে যুক্ত, কিন্তু এর অষ্টক পূরণ হয়নি। এখানে বোরন কেন্দ্রীয় পরমাণু।
প্রশ্ন ১০: পোলার যৌগ (polar compound) এবং অপোলার যৌগ (nonpolar compound) গঠনে কেন্দ্রীয় পরমাণুর ভূমিকা কি?
উত্তর: পোলার যৌগে কেন্দ্রীয় পরমাণুর সাথে যুক্ত পরমাণুগুলোর তড়িৎ ঋণাত্মকতার (electronegativity) পার্থক্য থাকে, ফলে অণুতে চার্জের বিভাজন ঘটে। অপোলার যৌগে তড়িৎ ঋণাত্মকতার পার্থক্য কম থাকে বা অণুর গঠন প্রতিসম (symmetrical) হয়, ফলে চার্জের বিভাজন হয় না।
আরও কিছু দরকারি কথা
- চার্জ: কোনো পরমাণুর চার্জ (charge) পজিটিভ (+) বা নেগেটিভ (-) হতে পারে। চার্জের কারণে পরমাণুগুলো একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট হয় বা বিকর্ষণ করে।
- আয়ন: আয়ন হলো সেই পরমাণু বা পরমাণুসমষ্টি, যাদের মধ্যে ইলেকট্রনের সংখ্যা স্বাভাবিকের চেয়ে কম বা বেশি হওয়ার কারণে চার্জ সৃষ্টি হয়েছে।
লেখার শেষে কিছু গুরুত্ত্বপূর্ণ কথা
আমরা এতক্ষণ ধরে “কেন্দ্রীয় পরমাণু” নিয়ে যা আলোচনা করলাম, তাতে আশা করি তোমরা এই বিষয়টির গভীরে ঢুকতে পেরেছ। রসায়নের এই মৌলিক ধারণাটি ভালোভাবে বুঝতে পারলে, জটিল যৌগগুলোও তোমাদের কাছে সহজ হয়ে যাবে। তাহলে আর দেরি কেন, বন্ধুদের সঙ্গে এই ব্লগটি শেয়ার করো আর রসায়নের মজা নিতে থাকো! কে জানে, হয়তো তুমিই হচ্ছো ভবিষ্যতের কোনো বড় রসায়নবিদ!