শুরু করা যাক!
অগ্নিবীণা : বিপ্লবী সুরের উৎসর্গ
“বল বীর – বল উন্নত মম শীর!” – বিদ্রোহী কবির এই তেজোদীপ্ত আহ্বান আজও আমাদের রক্তে শিহরণ জাগায়। কিন্তু কখনো কি ভেবেছেন, কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’ তিনি কাকে উৎসর্গ করেছিলেন? উৎসর্গের পেছনে লুকিয়ে থাকা গল্পটি হয়তো অনেকেরই অজানা। চলুন, আজ সেই রহস্য উন্মোচন করি।
অগ্নিবীণা শুধু একটি কাব্যগ্রন্থ নয়, এটি যেন পরাধীনতার বিরুদ্ধে এক জ্বলন্ত ঘোষণা। এই গ্রন্থে কবির দ্রোহ, প্রেম ও মানবতাবাদের সুর একাকার হয়ে মিশেছে। তাহলে, এমন একটি বিপ্লবী সৃষ্টি তিনি কাকে উৎসর্গ করলেন?
অগ্নিবীণা : উৎসর্গের অন্তর্নিহিত কথা
কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’ উৎসর্গ করেছিলেন বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে। বারীন্দ্রকুমার ঘোষ ছিলেন যুগান্তর বিপ্লবী দলের অন্যতম নেতা এবং শ্রী অরবিন্দ ঘোষের ছোট ভাই।
বারীন্দ্রকুমার ঘোষ : এক বিপ্লবী জীবন
বারীন্দ্রকুমার ঘোষ ছিলেন এক উজ্জ্বল বিপ্লবী ব্যক্তিত্ব। ১৯০৭ সালে তিনি বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের জন্য কারাবরণ করেন এবং আন্দামান সেলুলার জেলে দীর্ঘকাল বন্দি ছিলেন। তাঁর ত্যাগ ও আদর্শ নজরুলকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। দেশের মুক্তির জন্য বারীন্দ্রকুমারের আত্মত্যাগ নজরুলকে বিদ্রোহী করে তুলেছিল, যা ‘অগ্নিবীণা’র পাতায় পাতায় ধ্বনিত হয়েছে।
উৎসর্গের কারণ
নজরুল কেন বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে ‘অগ্নিবীণা’ উৎসর্গ করেছিলেন, তা নিয়ে কিছু কারণ আলোচনা করা যাক:
- বিপ্লবী আদর্শ: বারীন্দ্রকুমার ঘোষ ছিলেন বিপ্লবের অগ্রদূত। তাঁর বিপ্লবী চেতনা নজরুলকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। নজরুল নিজেও ছিলেন ব্রিটিশ শাসনের ঘোর বিরোধী। তাই, বারীন্দ্রকুমারের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতেই তিনি ‘অগ্নিবীণা’ উৎসর্গ করেন।
- অনুপ্রেরণা: বারীন্দ্রকুমারের জীবনসংগ্রাম নজরুলকে কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। তাঁর আত্মত্যাগ নজরুলের মনে গভীর রেখাপাত করে, যা ‘অগ্নিবীণা’র কবিতাগুলোতে স্পষ্ট।
- শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা: নজরুল বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমারের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অনুভব করতেন। এই শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই তিনি ‘অগ্নিবীণা’ উৎসর্গ করেন।
অগ্নিবীণার বিপ্লবী চেতনা
অগ্নিবীণা কাব্যগ্রন্থটি ১৯২২ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পরপরই এটি বাঙালি পাঠকদের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোতে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার আহ্বান জানানো হয়েছে। ‘বিদ্রোহী’, ‘কামাল পাশা’, ‘মোহররম’ এর মতো কবিতাগুলো আজও তারুণ্যের প্রতীক।
অগ্নিবীণার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কবিতা
অগ্নিবীণায় মোট ১২টি কবিতা রয়েছে। কবিতাগুলো হলো:
- প্রলয়োল্লাস
- অগ্নিবীণা
- বিদ্রোহী
- কামাল পাশা
- মোহররম
- ফাতেহা-ই-দোয়াজদম
- আগমণী
- খেয়াপারের তরণী
- কোরবানী
- রণভেরী
- শাত-ইল-আরব
- কামাল পাশা (দ্বিতীয় কবিতা)
এই কবিতাগুলো তৎকালীন সমাজের চিত্র তুলে ধরে এবং মানুষকে স্বাধীনতার জন্য উদ্বুদ্ধ করে।
নজরুলের জীবনে অগ্নিবীণার প্রভাব
অগ্নিবীণা শুধু একটি কাব্যগ্রন্থ নয়, এটি নজরুলের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পর নজরুল ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে পরিচিত হন। অগ্নিবীণার কবিতাগুলো তাঁকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা এনে দেয় এবং তিনি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অন্যতম মুখ হয়ে ওঠেন।
নজরুলের অন্যান্য সৃষ্টি
নজরুল তাঁর জীবনে অসংখ্য কবিতা, গান ও প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কিছু সৃষ্টি হলো:
- কাব্যগ্রন্থ: বিষের বাঁশী, সাম্যবাদী, সিন্ধু হিন্দোল
- উপন্যাস: বাঁধনহারা, মৃত্যুক্ষুধা, কুহেলিকা
- নাটক: আলেয়া, মধুমালা, ঝিলিমিলি
নজরুলের প্রতিটি লেখায় দেশপ্রেম, মানবতাবাদ ও সাম্যের বাণী ধ্বনিত হয়েছে।
অগ্নিবীণা নিয়ে কিছু প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ)
এখন, ‘অগ্নিবীণা’ নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর জেনে নেওয়া যাক:
অগ্নিবীণা কাব্যগ্রন্থটি কত সালে প্রকাশিত হয়?
অগ্নিবীণা কাব্যগ্রন্থটি ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয়।
অগ্নিবীণা কাব্যগ্রন্থে কয়টি কবিতা রয়েছে?
অগ্নিবীণা কাব্যগ্রন্থে মোট ১২টি কবিতা রয়েছে।
অগ্নিবীণা কবিতা কোন পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়?
বিদ্রোহী কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ৬ই জানুয়ারী, ১৯২২ সালে ‘বিজলী’ পত্রিকায়।
কাজী নজরুল ইসলামকে কেন বিদ্রোহী কবি বলা হয়?
কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কবিতা ও গানের মাধ্যমে সমাজের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। তিনি পরাধীনতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন বলেই তাঁকে বিদ্রোহী কবি বলা হয়।
অগ্নিবীণা কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা কোনটি?
অগ্নিবীণা কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা হল ‘প্রলয়োল্লাস’।
অগ্নিবীণা কাব্যগ্রন্থের সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতা কোনটি?
অগ্নিবীণা কাব্যগ্রন্থের সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতা হলো “বিদ্রোহী”। এই কবিতাটি কাজী নজরুল ইসলামকে ব্যাপক পরিচিতি এনে দিয়েছে।
“অগ্নিবীণা” শব্দের অর্থ কী?
“অগ্নিবীণা” শব্দের অর্থ হলো আগুনের বাদ্যযন্ত্র। এটি মূলত বিপ্লবী চেতনা ও উদ্দীপনার প্রতীক।
অগ্নিবীণার প্রাসঙ্গিকতা আজও
আজও অগ্নিবীণার কবিতাগুলো আমাদের অনুপ্রাণিত করে। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে দেশপ্রেম ও মানবতাবোধ জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে এই কাব্যগ্রন্থের ভূমিকা অপরিহার্য। নজরুলের বিদ্রোহী চেতনা আজও আমাদের পথ দেখায়।
তরুণ প্রজন্মের জন্য বার্তা
তরুণ প্রজন্মের উচিত নজরুলের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশের কল্যাণে কাজ করা। তাঁর কবিতা ও গান থেকে শিক্ষা নিয়ে একটি সুন্দর ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখতে হবে।
উপসংহার : অগ্নিবীণার চিরন্তন সুর
অগ্নিবীণা কাজী নজরুল ইসলামের এক অমর সৃষ্টি। এই কাব্যগ্রন্থ শুধু বাংলা সাহিত্য নয়, বিশ্ব সাহিত্যেও এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে। বারীন্দ্রকুমার ঘোষের প্রতি উৎসর্গীকৃত এই গ্রন্থটি আজও আমাদের বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষিত করে।
আশা করি, আজকের আলোচনা থেকে আপনারা ‘অগ্নিবীণা’ কাকে উৎসর্গ করা হয়েছিল এবং এর পেছনের কারণ জানতে পেরেছেন। ‘অগ্নিবীণা’র চেতনাকে ধারণ করে আপনারাও দেশ ও মানুষের কল্যাণে এগিয়ে আসুন। কেমন লাগলো আজকের আলোচনা, জানাতে ভুলবেন না!