জিনিসপত্রের হিসাব মেলানোর গল্প: অডিট আসলে কী?
আচ্ছা, কখনো ভেবেছেন আপনার বাসার খরচের হিসাবটা যদি কেউ যাচাই করত, তাহলে কেমন হতো? অনেকটা সেরকমই, তবে সেটা যদি হয় কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য, তখন তাকে আমরা অডিট বলি। বিষয়টা হয়তো একটু জটিল মনে হচ্ছে, কিন্তু বিশ্বাস করুন, অডিট আসলে খুবই দরকারি একটা জিনিস! চলুন, সহজ ভাষায় জেনে নিই “অডিট কাকে বলে” এবং কেন এটা এত গুরুত্বপূর্ণ।
যদি আপনাক কেউ প্রশ্ন করে অডিট কি, আপনি এক কথায় উত্তর দিতে পারেন “হিসাব মেলানো”। তবে এর গভীরে আরও কিছু বিষয় আছে, যা আমাদের জানতে হবে। ধরুন, একটি কোম্পানির সারা বছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব আছে। এখন এই হিসাবগুলো সত্যি কি না, তা যাচাই করার জন্য একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই নিরপেক্ষ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানই হিসাবগুলো খুঁটিয়ে দেখে এবং একটি প্রতিবেদন দেয়। এই পুরো প্রক্রিয়াটিই হলো অডিট।
অডিট কেন প্রয়োজন?
অডিট কেন দরকার, তা বুঝতে হলে আমাদের একটু পেছনের দিকে তাকাতে হবে। একটা সময় ছিল, যখন ব্যবসায়ীরা নিজেদের ইচ্ছামতো হিসাব করতেন। কিন্তু এতে অনেক সমস্যা হতো। বিনিয়োগকারীরা (investor) ভরসা পেতেন না, কারণ তারা জানতেন না যে হিসাবগুলো আসলে সত্যি কি না।
বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি
অডিটের প্রধান কাজ হলো একটি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক হিসাবের ওপর বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করা। যখন একজন অডিটর (auditor) বলেন যে হিসাবগুলো ঠিক আছে, তখন বিনিয়োগকারী, ঋণদাতা এবং অন্যান্য অংশীজনদের (stakeholders) মধ্যে আস্থা বাড়ে।
জালিয়াতি ও ভুলত্রুটি চিহ্নিতকরণ
অডিটের মাধ্যমে হিসাবের গরমিল, জালিয়াতি (fraud) এবং ভুলত্রুটি খুঁজে বের করা যায়। যদি কোনো কর্মচারী বা কর্মকর্তা ভুল করে বা ইচ্ছাকৃতভাবে হিসাবে কোনো কারচুপি করে, তাহলে অডিটের মাধ্যমে তা ধরা পড়ে।
আইন ও নিয়মকানুন মেনে চলা
বিভিন্ন দেশে আইন ও নিয়মকানুন অনুযায়ী, কোম্পানিগুলোকে নিয়মিত অডিট করাতে হয়। অডিটের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয় যে কোম্পানিগুলো সরকারের নিয়মকানুন এবং হিসাব সংক্রান্ত মানদণ্ড (accounting standards) মেনে চলছে।
অডিটের প্রকারভেদ
অডিট বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন ও পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। নিচে কয়েকটি প্রধান প্রকারভেদ আলোচনা করা হলো:
আভ্যন্তরীণ অডিট (Internal Audit)
আভ্যন্তরীণ অডিট হলো যখন একটি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কর্মকর্তারা তাদের প্রতিষ্ঠানের কাজকর্ম এবং হিসাব পরীক্ষা করেন। এর মূল উদ্দেশ্য হলো প্রতিষ্ঠানের কর্মদক্ষতা বাড়ানো এবং ঝুঁকিগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর সমাধান করা। অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা সাধারণত নিম্নলিখিত বিষয়গুলির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে:
- প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা মূল্যায়ন।
- কর্ম প্রক্রিয়াগুলির কার্যকারিতা এবং দক্ষতা মূল্যায়ন।
- ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়াগুলির পর্যাপ্ততা মূল্যায়ন।
- আইন ও বিধিবিধানের সাথে সম্মতি নিশ্চিত করা।
অভ্যন্তরীণ অডিটের সুবিধা
- প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করতে সাহায্য করে।
- কর্মদক্ষতা বাড়াতে সহায়তা করে।
- ঝুঁকিগুলো আগে থেকে চিহ্নিত করে সেগুলোর জন্য প্রস্তুতি নিতে সাহায্য করে।
বাহ্যিক অডিট (External Audit)
বাহ্যিক অডিট হলো যখন কোনো নিরপেক্ষ তৃতীয় পক্ষ (independent third party), যেমন কোনো অডিট ফার্ম, একটি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক হিসাব পরীক্ষা করে। এই নিরীক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য হলো আর্থিক বিবরণীগুলি যেন সঠিকভাবে তৈরি করা হয় এবং সেগুলি যেন সাধারণত স্বীকৃত হিসাব মান (Generally Accepted Accounting Principles – GAAP) অনুযায়ী প্রস্তুত করা হয়েছে তা নিশ্চিত করা। এই নিরীক্ষার ফলে বিনিয়োগকারী এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের কাছে আর্থিক তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়।
বাহ্যিক অডিটের সুবিধা
- আর্থিক তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ায়।
- বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করা যায়।
- আইন ও নিয়মকানুন মেনে চলতে সাহায্য করে।
কমপ্লায়েন্স অডিট (Compliance Audit)
কমপ্লায়েন্স অডিট হলো যখন একটি প্রতিষ্ঠান দেখে যে তারা আইন, নিয়মকানুন এবং নীতিগুলো সঠিকভাবে মেনে চলছে কিনা। এই অডিট সাধারণত সরকারি সংস্থা বা নিয়ন্ত্রক সংস্থা দ্বারা পরিচালিত হয়। এর মূল উদ্দেশ্য হল এটি নিশ্চিত করা যে প্রতিষ্ঠানটি সমস্ত প্রাসঙ্গিক আইন ও বিধিবিধান অনুসরণ করছে।
কমপ্লায়েন্স অডিটের সুবিধা
- আইন ও নিয়মকানুন মেনে চলা নিশ্চিত করা যায়।
- জরিমানা এবং অন্যান্য আইনি জটিলতা এড়ানো সম্ভব হয়।
- প্রতিষ্ঠানের সুনাম রক্ষা করা যায়।
ফরেনসিক অডিট (Forensic Audit)
ফরেনসিক অডিট হলো একটি বিশেষ ধরনের অডিট, যা সাধারণত কোনো আর্থিক অপরাধ বা জালিয়াতি উদ্ঘাটনের জন্য করা হয়। এই নিরীক্ষায় হিসাবের গভীর তল্লাশি চালানো হয় এবং অপরাধের প্রমাণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়।
ফরেনসিক অডিটের সুবিধা
- আর্থিক জালিয়াতি উদ্ঘাটন করা যায়।
- অপরাধীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
- প্রতিষ্ঠানের সম্পদ রক্ষা করা যায়।
আইটি অডিট (IT Audit)
আইটি অডিট হলো একটি প্রতিষ্ঠানের তথ্য প্রযুক্তি (Information Technology) অবকাঠামো এবং সিস্টেমগুলির মূল্যায়ন। এই নিরীক্ষার মাধ্যমে দেখা হয় যে প্রতিষ্ঠানের তথ্য সুরক্ষিত আছে কিনা এবং সিস্টেমগুলো সঠিকভাবে কাজ করছে কিনা।
আইটি অডিটের সুবিধা
- তথ্য সুরক্ষিত রাখা যায়।
- সিস্টেমগুলোর কার্যকারিতা মূল্যায়ন করা যায়।
- তথ্য প্রযুক্তি সংক্রান্ত ঝুঁকি কমানো যায়।
অডিট কিভাবে করা হয়?
অডিট করার জন্য কিছু নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। নিচে একটি সাধারণ অডিট প্রক্রিয়ার ধাপগুলো উল্লেখ করা হলো:
পরিকল্পনা (Planning)
অডিট শুরু করার আগে একটি পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। এই পরিকল্পনাতে অডিটের উদ্দেশ্য, পরিধি এবং সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়।
ঝুঁকি মূল্যায়ন (Risk Assessment)
কোন বিভাগে জালিয়াতির সম্ভাবনা বেশি, তা চিহ্নিত করা হয়। এই অনুযায়ী অডিটের কৌশল তৈরি করা হয়।
নিয়ন্ত্রণ পরীক্ষা (Control Testing)
প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা (internal control system) পরীক্ষা করা হয়। দেখা হয় যে এই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাগুলো কতটা কার্যকর।
তথ্য সংগ্রহ (Evidence Gathering)
হিসাব বই, রশিদ, চুক্তিপত্র এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক কাগজপত্র সংগ্রহ করা হয়।
বিশ্লেষণ (Analysis)
সংগ্রহ করা তথ্য বিশ্লেষণ করা হয় এবং হিসাবের যথার্থতা যাচাই করা হয়।
প্রতিবেদন তৈরি (Reporting)
অডিট শেষে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এই প্রতিবেদনে অডিটের ফলাফল, দুর্বলতা এবং সুপারিশ উল্লেখ করা হয়।
অডিট রিপোর্টের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান
অডিট রিপোর্ট হলো অডিটের ফলাফলের সারসংক্ষেপ। একটি ভালো অডিট রিপোর্টে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়:
মতামত (Opinion)
অডিটর হিসাব সম্পর্কে তার মতামত দেন। যদি হিসাবগুলি সঠিকভাবে উপস্থাপন করা হয়, তাহলে অডিটর একটি ইতিবাচক মতামত দেন। অন্যথায়, তিনি নেতিবাচক বা শর্তযুক্ত মতামত দিতে পারেন।
আর্থিক বিবরণী (Financial Statements)
আর্থিক বিবরণী, যেমন ব্যালেন্স শীট, ইনকাম স্টেটমেন্ট এবং ক্যাশ ফ্লো স্টেটমেন্ট, অডিট রিপোর্টের সাথে সংযুক্ত করা হয়।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় (Key Audit Matters)
অডিটর কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় চিহ্নিত করেন, যা হিসাবের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
সুপারিশ (Recommendations)
অডিটর প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতাগুলো দূর করার জন্য কিছু সুপারিশ করেন।
বাংলাদেশে অডিটের প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশে অডিটের গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে কোম্পানি আইন অনুযায়ী, প্রতিটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিকে (public limited company) এবং কিছু প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানিকেও (private limited company) বাধ্যতামূলকভাবে অডিট করাতে হয়।
সরকারি নিয়মকানুন
বাংলাদেশ সরকার কোম্পানি আইন, আয়কর আইন এবং অন্যান্য বিধি-বিধানের মাধ্যমে অডিট প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে।
অডিট পেশার সুযোগ
বাংলাদেশে অডিট পেশায় ক্যারিয়ার গড়ার অনেক সুযোগ রয়েছে। চার্টার্ড অ্যাকাউন্টিং (Chartered Accounting) এবং কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টিং (Cost and Management Accounting) -এর মতো প্রফেশনাল কোর্স করে এই ক্ষেত্রে আসা যায়।
অডিট নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন (Frequently Asked Questions):
অডিট নিয়ে অনেকের মনে অনেক প্রশ্ন থাকে। নিচে কয়েকটি সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
১. অডিট কি শুধুই বড় কোম্পানির জন্য?
উত্তর: না, অডিট ছোট-বড় সব ধরনের কোম্পানির জন্য দরকারি। ছোট কোম্পানির জন্য এটা আর্থিক শৃঙ্খলা আনতে সাহায্য করে, আর বড় কোম্পানির জন্য এটা আইনি বাধ্যবাধকতা।
২. অডিট করতে কত খরচ লাগে?
উত্তর: অডিটের খরচ কোম্পানির আকার, জটিলতা এবং অডিটরের ওপর নির্ভর করে। সাধারণত, ছোট কোম্পানির চেয়ে বড় কোম্পানির অডিট খরচ বেশি হয়।
৩. অডিট কত দিন পর পর করা উচিত?
উত্তর: সাধারণত, বছরে একবার অডিট করানো উচিত। তবে, কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ প্রয়োজনে একাধিকবারও অডিট করানো হতে পারে।
৪. অডিটর কিভাবে নিরপেক্ষ থাকে?
উত্তর: অডিটরকে নিরপেক্ষ থাকার জন্য কিছু নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। যেমন, অডিটর কোম্পানির সাথে কোনো ব্যক্তিগত সম্পর্ক রাখতে পারেন না। এছাড়াও, তিনি শুধুমাত্র তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তার মতামত দেন।
৫. অডিট কি শুধু হিসাব মেলানো, নাকি আরও কিছু?
উত্তর: অডিট শুধু হিসাব মেলানো নয়। এর মাধ্যমে কোম্পানির আর্থিক অবস্থা, জালিয়াতির ঝুঁকি এবং অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যায়।
অডিটের ভবিষ্যৎ
বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তি (information technology) এবং অটোমেশনের (automation) ব্যবহার বাড়ছে, তাই অডিটের পদ্ধতিতেও পরিবর্তন আসছে। ভবিষ্যতে ডেটা অ্যানালিটিক্স (data analytics) এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (artificial intelligence) মাধ্যমে অডিট আরও দ্রুত এবং নির্ভুলভাবে করা সম্ভব হবে।
প্রযুক্তি নির্ভর অডিট
প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে অডিটররা এখন খুব সহজেই বিশাল পরিমাণ ডেটা বিশ্লেষণ করতে পারেন এবং জালিয়াতির ঝুঁকি কমাতে পারেন।
রিয়েল-টাইম অডিট
ভবিষ্যতে রিয়েল-টাইম অডিট (real-time audit) খুব জনপ্রিয় হবে, যেখানে লেনদেন হওয়ার সাথে সাথেই অডিট করা সম্ভব হবে।
সাইবার নিরাপত্তা অডিট
সাইবার নিরাপত্তা এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই ভবিষ্যতে সাইবার নিরাপত্তা অডিট আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।
অডিট একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া, যা একটি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক স্বচ্ছতা (financial transparency) এবং জবাবদিহিতা (accountability) নিশ্চিত করে। তাই, “অডিট কাকে বলে” এবং এর গুরুত্ব সম্পর্কে জানা আমাদের সকলের জন্য দরকারি।
এই ছিলো অডিট নিয়ে কিছু কথা। যদি আপনার মনে আরও কোনো প্রশ্ন থাকে, তবে নির্দ্বিধায় জিজ্ঞাসা করতে পারেন।