আজ আমরা কথা বলব বাংলা সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে – অক্ষরবৃত্ত ছন্দ। কবিতা পড়তে বা লিখতে ভালোবাসেন, অথচ ছন্দের মারপ্যাঁচ নিয়ে একটু ধোঁয়াশা আছে, এমন মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয়। তাই, অক্ষরবৃত্ত ছন্দ কী, এর বৈশিষ্ট্য, প্রকারভেদ এবং কবিতা লেখার ক্ষেত্রে এর ব্যবহার নিয়ে আমরা আজ বিস্তারিত আলোচনা করব। যেন, চা খেতে খেতে গল্পের ছলে জটিল বিষয়গুলো সহজে বুঝে নিতে পারেন – সেই চেষ্টাই থাকবে।
অক্ষরবৃত্ত ছন্দ: কবিতার চালে এক নতুনত্বের ছোঁয়া
অক্ষরবৃত্ত ছন্দ বাংলা কবিতার জগতে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। এর বৈশিষ্ট্য, গঠন এবং প্রয়োগ কৌশল একে অন্যান্য ছন্দ থেকে আলাদা করেছে।
অক্ষরবৃত্ত ছন্দ কী? (What is Aksharbritta Chanda?)
অক্ষরবৃত্ত ছন্দ বাংলা ছন্দের তিনটি প্রধান বিভাগের (স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত) মধ্যে অন্যতম। একে মিশ্রকলাবৃত্ত ছন্দ বা যৌগিক ছন্দও বলা হয়। এই ছন্দে মুক্তাক্ষর ১ মাত্রা এবং বদ্ধাক্ষর ১ মাত্রা অথবা ২ মাত্রা হিসেবে গণনা করা হয়। সাধারণত, শব্দের প্রথমে অথবা মধ্যে বদ্ধাক্ষর ১ মাত্রা এবং শেষে ২ মাত্রা গণনা করার নিয়ম। এই ছন্দের মূল বৈশিষ্ট্য হলো এর ধ্বনিপ্রবাহে একটি স্বাধীনতা থাকে, যা কবিকে বিভিন্ন সুর এবং লয় সৃষ্টি করতে সাহায্য করে। আপনি যদি কবিতার ছন্দ নিয়ে আগ্রহী হন, তাহলে অক্ষরবৃত্ত ছন্দ আপনার জন্য এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।
অক্ষরবৃত্ত ছন্দের নামকরণের ইতিহাস
অক্ষরবৃত্ত ছন্দের নামকরণের পেছনে একটি интересная গল্প আছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ছন্দবিশারদরা এর ভিন্ন ভিন্ন নাম দিয়েছেন। কেউ একে বলেছেন মিশ্রকলাবৃত্ত, কেউবা যৌগিক ছন্দ। তবে “অক্ষরবৃত্ত” নামটিই সবচেয়ে বেশি পরিচিতি লাভ করেছে। এই নামকরণের কারণ হলো, এই ছন্দে অক্ষরের গুরুত্ব বিশেষভাবে বিবেচনা করা হয়। অক্ষরবৃত্ত ছন্দে অক্ষর গণনা এবং অক্ষরের ধ্বনিগত বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করে ছন্দ নির্ণয় করা হয়। তাই, এর নামকরণটি বেশ সার্থক।
অক্ষরবৃত্ত ছন্দের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Aksharbritta Chanda)
অক্ষরবৃত্ত ছন্দকে ভালোভাবে বুঝতে হলে এর কিছু বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতে হবে। এই বৈশিষ্ট্যগুলো ছন্দটিকে অন্যান্য ছন্দ থেকে আলাদা করে তোলে।
-
মাত্রাসংখ্যা: অক্ষরবৃত্ত ছন্দের চরণে সাধারণত ৬, ৮, ১০, ১২, ১৪ বা ১৬ মাত্রা থাকে। তবে এর ব্যতিক্রমও দেখা যায়।
-
পর্ব: প্রতিটি চরণ কয়েকটি পর্বে বিভক্ত থাকে। পর্বগুলোর মধ্যে বিশ্রাম বা ফাঁক থাকে, যা কবিতাটিকে একটি নির্দিষ্ট গতি দেয়।
-
লয়: এই ছন্দের লয় ধীর এবং গম্ভীর প্রকৃতির হয়।
-
মুক্তাক্ষর ও বদ্ধাক্ষর: অক্ষরবৃত্ত ছন্দে মুক্তাক্ষর সবসময় ১ মাত্রা হিসেবে গণনা করা হয়, তবে বদ্ধাক্ষর শব্দের প্রথমে বা মধ্যে থাকলে ১ মাত্রা এবং শেষে থাকলে ২ মাত্রা হিসেবে গণনা করা হয়।
বৈশিষ্ট্য বর্ণনা মাত্রাসংখ্যা ৬, ৮, ১০, ১২, ১৪, ১৬ (তবে ব্যতিক্রমও দেখা যায়) পর্ব প্রতিটি চরণ কয়েকটি পর্বে বিভক্ত লয় ধীর এবং গম্ভীর মুক্তাক্ষর ১ মাত্রা বদ্ধাক্ষর প্রথমে বা মধ্যে ১ মাত্রা, শেষে ২ মাত্রা
অক্ষরবৃত্ত ছন্দের প্রকারভেদ (Types of Aksharbritta Chanda)
অক্ষরবৃত্ত ছন্দকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যায়:
- অক্ষরবৃত্ত বা মিশ্র কলাবৃত্ত: এই প্রকার ছন্দে মুক্তাক্ষর ১ মাত্রা এবং বদ্ধাক্ষর ১ অথবা ২ মাত্রা হিসেবে গণনা করা হয়।
- তানপ্রধান অক্ষরবৃত্ত: এই প্রকার ছন্দে শ্বাসাঘাতের ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়।
উদাহরণস্বরূপ
“আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।” – এটি ১৪ মাত্রার একটি অক্ষরবৃত্ত ছন্দের উদাহরণ। এখানে, “আমার” (১+২), “সোনার” (২+২), “বাংলা” (২+১), “আমি” (১+১), “তোমায়” (১+২), “ভালোবাসি” (২+২)। প্রতিটি শব্দে মাত্রা গণনা করে ১৪ পাওয়া যাচ্ছে।
অক্ষরবৃত্ত ছন্দের গঠন (Structure of Aksharbritta Chanda)
অক্ষরবৃত্ত ছন্দের গঠন বেশ নমনীয়। কবি নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী এই ছন্দের গঠন পরিবর্তন করতে পারেন।
চরণ (Line)
চরণ হলো কবিতার এক একটি লাইন। অক্ষরবৃত্ত ছন্দে চরণের দৈর্ঘ্য বিভিন্ন হতে পারে। যেমন – ৬, ৮, ১০, ১২, ১৪, ১৬ ইত্যাদি মাত্রার চরণ দেখা যায়।
পর্ব (Cadence)
পর্ব হলো চরণের একটি অংশ, যেখানে কয়েকটি শব্দ মিলে একটি অর্থপূর্ণ ইউনিট তৈরি করে। অক্ষরবৃত্ত ছন্দে পর্বের পরে একটি বিরাম থাকে। এই বিরাম কবিতাটিকে একটি নির্দিষ্ট ছন্দোময় গতি দেয়।
লয় (Tempo)
অক্ষরবৃত্ত ছন্দের লয় সাধারণত ধীর হয়ে থাকে, যা কবিতাটিকে একটি গভীরতা দেয়।
অক্ষরবৃত্ত ছন্দে কবিতা লেখার নিয়ম (Rules for Writing Poems in Aksharbritta Chanda)
অক্ষরবৃত্ত ছন্দে কবিতা লিখতে হলে কিছু নিয়ম অনুসরণ করতে হয়। এই নিয়মগুলো ছন্দটিকে সঠিক রূপ দিতে সাহায্য করে।
- প্রথমে কবিতার বিষয় নির্বাচন করুন।
- এরপর চরণের মাত্রা ঠিক করুন (৬, ৮, ১০, ১২, ১৪, ১৬)।
- প্রতিটি চরণে পর্ব ভাগ করুন এবং পর্বগুলোর মধ্যে বিশ্রাম দিন।
- মুক্তাক্ষর ও বদ্ধাক্ষরের মাত্রা গণনা করে চরণ তৈরি করুন।
- কবিতার লয় এবং সুরের দিকে খেয়াল রাখুন।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপস
- শব্দের উচ্চারণ এবং ধ্বনির দিকে মনোযোগ দিন।
- বিভিন্ন প্রকার অক্ষরবৃত্ত ছন্দের কবিতা পড়ুন এবং অনুশীলন করুন।
- ছন্দ মিলিয়ে লেখার জন্য শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ করুন।
- কবিতার বিষয় অনুযায়ী উপযুক্ত শব্দ ব্যবহার করুন।
অক্ষরবৃত্ত ছন্দের ব্যবহার (Use of Aksharbritta Chanda)
অক্ষরবৃত্ত ছন্দ বাংলা কবিতায় বহুল ব্যবহৃত একটি ছন্দ। এর নমনীয়তা এবং ধ্বনিগত মাধুর্যের কারণে এটি কবিদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়।
আধুনিক বাংলা কবিতায় অক্ষরবৃত্ত ছন্দ
আধুনিক বাংলা কবিতায় অক্ষরবৃত্ত ছন্দের ব্যবহার বিশেষভাবে লক্ষণীয়। অনেক আধুনিক কবি এই ছন্দকে ব্যবহার করে তাদের কবিতায় নতুনত্ব এনেছেন।
জনপ্রিয় কবিতা ও গান (Popular Poems and Songs)
অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচিত কিছু জনপ্রিয় কবিতা ও গান:
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “সোনার তরী”।
- কাজী নজরুল ইসলামের “বিদ্রোহী”।
- জীবনানন্দ দাশের “বনলতা সেন”।
অক্ষরবৃত্ত ছন্দ এবং অন্যান্য ছন্দ (Aksharbritta Chanda and Other Chanda)
বাংলা ছন্দের জগতে অক্ষরবৃত্ত ছাড়াও স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত ছন্দ উল্লেখযোগ্য। এই তিনটি ছন্দের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে।
স্বরবৃত্ত ছন্দ (Swarabritta Chanda)
স্বরবৃত্ত ছন্দে প্রতি শ্বাসাঘাতে একটি করে দল গণনা করা হয়। এখানে মুক্তাক্ষর ও বদ্ধাক্ষর উভয়ই ১ মাত্রা হিসেবে ধরা হয়। এই ছন্দের গতি দ্রুত।
মাত্রাবৃত্ত ছন্দ (Matrabritta Chanda)
মাত্রাবৃত্ত ছন্দে মুক্তাক্ষর ১ মাত্রা এবং বদ্ধাক্ষর ২ মাত্রা হিসেবে গণনা করা হয়। তবে বদ্ধাক্ষর সব সময় ২ মাত্রা পায় না, এটি উচ্চারণের ওপর নির্ভর করে।
ছন্দ | মুক্তাক্ষর | বদ্ধাক্ষর | লয় |
---|---|---|---|
স্বরবৃত্ত | ১ মাত্রা | ১ মাত্রা | দ্রুত |
মাত্রাবৃত্ত | ১ মাত্রা | ২ মাত্রা (উচ্চারণের ওপর নির্ভরশীল) | মধ্যম |
অক্ষরবৃত্ত | ১ মাত্রা | ১/২ মাত্রা (অবস্থানের ওপর নির্ভরশীল) | ধীর |
অক্ষরবৃত্ত ছন্দ: কিছু মজার তথ্য (Some Fun Facts)
- অক্ষরবৃত্ত ছন্দকে বাংলা ছন্দের “রাজা” বলা হয়।
- এই ছন্দে কবিতা লেখার সময় কবিরা প্রায়শই শব্দের সঙ্গে খেলা করেন।
- অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচিত গানগুলো সাধারণত খুব জনপ্রিয় হয়ে থাকে।
FAQ (Frequently Asked Questions)
এখানে অক্ষরবৃত্ত ছন্দ নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
অক্ষরবৃত্ত ছন্দ চেনার উপায় কি? (How to identify Aksharbritta Chanda?)
অক্ষরবৃত্ত ছন্দ চেনার সহজ উপায় হলো মুক্তাক্ষর এবং বদ্ধাক্ষরের মাত্রা গণনা করা। মুক্তাক্ষর সবসময় ১ মাত্রা এবং বদ্ধাক্ষর শব্দের প্রথমে অথবা মধ্যে থাকলে ১ মাত্রা এবং শেষে থাকলে ২ মাত্রা হয়।
অক্ষরবৃত্ত ছন্দে কি সব ধরনের কবিতা লেখা যায়?
হ্যাঁ, অক্ষরবৃত্ত ছন্দের নমনীয়তার কারণে এটিতে সব ধরনের কবিতা লেখা যায়। তবে, এই ছন্দ সাধারণত ধীর এবং গম্ভীর ভাব প্রকাশের জন্য বেশি উপযোগী।
অক্ষরবৃত্ত ছন্দ কি কঠিন?
প্রথম দিকে অক্ষরবৃত্ত ছন্দ কিছুটা কঠিন মনে হতে পারে, তবে নিয়মিত অনুশীলন করলে এটি সহজ হয়ে যায়।
অক্ষরবৃত্ত ছন্দে কবিতা লেখার জন্য ভালো কিছু টিপস দিন।
- প্রথমে সহজ কবিতা দিয়ে শুরু করুন।
- বিভিন্ন কবির লেখা অক্ষরবৃত্ত ছন্দের কবিতা পড়ুন।
- নিয়মিত ছন্দ মিলিয়ে লেখার অনুশীলন করুন।
উপসংহার (Conclusion)
আশা করি, অক্ষরবৃত্ত ছন্দ নিয়ে আপনার মনে যে প্রশ্নগুলো ছিল, সেগুলোর উত্তর দিতে পেরেছি। কবিতা শুধু শব্দ আর ছন্দের খেলা নয়, এটি মনের ভাব প্রকাশের এক অনন্য মাধ্যম। তাই, ছন্দ শেখার পাশাপাশি নিজের অনুভূতি আর চিন্তাভাবনাকেও গুরুত্ব দিন। কে জানে, হয়তো আপনার হাত ধরেই বাংলা সাহিত্য নতুন পথের সন্ধান পাবে! তাহলে, কলম ধরুন আর লিখতে থাকুন। শুভ কামনা!