আচরণ কাকে বলে? খুঁটিনাটি জানুন!
আচ্ছা, কখনো কি ভেবেছেন, আমরা কেন বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষ আচরণ করি? ধরুন, পরীক্ষার আগের রাতে আপনি অস্থির, আবার পছন্দের গান শুনলে শান্ত। এই যে মনের ভেতরের অবস্থা বদলে যাচ্ছে, এর সঙ্গে আপনার শরীর ও পারিপার্শ্বিক জগতের একটা সম্পর্ক আছে। এই সবকিছু মিলিয়েই কিন্তু আচরণ তৈরি হয়। সহজ ভাষায়, আচরণ মানে হল কোনো ব্যক্তি বা প্রাণীর বিশেষ পরিস্থিতিতে দেওয়া প্রতিক্রিয়া বা Response।
তাহলে চলুন, আজকের ব্লগ পোস্টে আমরা ‘আচরণ কাকে বলে’ সেই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করি।
আচরণ: একদম বেসিক থেকে শুরু
আচরণ শুধু মানুষ নয়, জীবজগতের সকলের মধ্যেই দেখা যায়। একটা পিঁপড়ে খাবার দেখলে লাইনে চলতে শুরু করে, আবার একটি বিড়াল ইঁদুর দেখলে তার দিকে ঝাঁপ দেয় – এগুলো সবই আচরণের উদাহরণ।
আচরণের সংজ্ঞা (Definition of Behavior)
আচরণ হলো কোনো জীব বা ব্যক্তির পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি, অভ্যন্তরীণ অবস্থা (যেমন: চিন্তা, অনুভূতি) এবং অন্যান্য উদ্দীপকের (Stimulus) প্রতি শারীরিক ও মানসিক প্রতিক্রিয়া। এটি একটি জটিল প্রক্রিয়া, যা স্নায়ু তন্ত্র, হরমোন এবং অন্যান্য শারীরিক কার্যক্রম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
আচরণের প্রকারভেদ (Types of Behavior)
আচরণ বিভিন্ন রকমের হতে পারে। এদের মধ্যে কয়েকটি প্রধান ভাগ নিচে আলোচনা করা হলো:
-
স্বাভাবিক আচরণ (Innate Behavior): এই ধরনের আচরণ জন্মগতভাবে পাওয়া যায়। এর জন্য কোনো অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয় না। যেমন, মায়ের স্তন চুষে বাচ্চা দুধ পান করা।
-
অর্জিত আচরণ (Learned Behavior): পরিবেশের সঙ্গে interactions বা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে যে আচরণ শেখা হয়, তাকে অর্জিত আচরণ বলে। যেমন, সাইকেল চালানো শেখা।
-
সামাজিক আচরণ (Social Behavior): সমাজের অন্যান্য সদস্যের সঙ্গে মেলামেশা করার সময় যে আচরণ করা হয়। যেমন, সাহায্য করা, কথা বলা, ইত্যাদি।
- লক্ষ্য-ভিত্তিক আচরণ (Goal-Oriented Behavior): কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য পূরণের জন্য যে আচরণ করা হয়। যেমন, ভালো ফল করার জন্য পড়াশোনা করা।
কেন আমাদের আচরণ পরিবর্তন হয়?
আমাদের আচরণ সবসময় একই রকম থাকে না। পরিবেশ, পরিস্থিতি, এমনকি আমাদের ভেতরের চিন্তা ভাবনার ওপরও এটা নির্ভর করে। নিচে কয়েকটি কারণ আলোচনা করা হলো:
পরিবেশের প্রভাব (Influence of Environment)
পরিবেশ আমাদের আচরণের ওপর অনেক বড় প্রভাব ফেলে। উদাহরণস্বরূপ, গরম লাগলে আমরা অস্থির হয়ে যাই, ঠান্ডা লাগলে শরীর কুঁকড়ে যায়।
জিনগত প্রভাব (Genetic Influence)
আমাদের জিনেও কিছু আচরণ লেখা থাকে। বাবা-মায়ের কাছ থেকে পাওয়া কিছু বৈশিষ্ট্য আমাদের আচরণকে প্রভাবিত করে।
শেখা বা অভিজ্ঞতার প্রভাব (Influence of Learning and Experience)
অভিজ্ঞতা আমাদের অনেক কিছু শেখায়, যা আমাদের আচরণে পরিবর্তন আনে। ছোটবেলার কোনো traumatic experience পরবর্তী জীবনে আমাদের decision making-এ প্রভাব ফেলতে পারে৷
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব (Social and Cultural Influences)
আমরা जिस সমাজে বড় হই, সেই সমাজের রীতিনীতি, সংস্কৃতি আমাদের আচরণকে অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ করে।
আচরণের গুরুত্বপূর্ণ দিক
আচরণকে বুঝতে গেলে এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক জানা দরকার। নিচে কয়েকটি বিষয় আলোচনা করা হলো:
উদ্দেশ্য (Purpose)
আচরণের একটা উদ্দেশ্য থাকে। কোনো বিশেষ কারণে আমরা কোনো বিশেষ আচরণ করি। সেই কারণটি হতে পারে নিজের ভালো লাগা, অন্যকে সাহায্য করা, অথবা কোনো বিপদ থেকে নিজেকে বাঁচানো।
অভিযোজন (Adaptation)
আচরণ আমাদের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করে। পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজেকে বদলে ফেলাই হলো অভিযোজন।
যোগাযোগ (Communication)
আচরণ একটি শক্তিশালী মাধ্যম যার সাহায্যে আমরা অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করি। আমাদের কথা বলা, অঙ্গভঙ্গি, মুখের অভিব্যক্তি – সব কিছুই আচরণের অংশ এবং এগুলো দিয়ে আমরা একে অপরের সঙ্গে ভাবের আদান প্রদান করি।
মানুষের আচরণ এবং মনস্তত্ত্ব (Human Behavior and Psychology)
মানুষের আচরণ বুঝতে হলে মনস্তত্ত্ব বা psychology-র ধারণা থাকা দরকার। মানুষের মন কিভাবে কাজ করে, কিভাবে চিন্তা ভাবনা তৈরি হয়, এবং কিভাবে আবেগ অনুভূতিগুলো আমাদের আচরণকে প্রভাবিত করে – এইসব বিষয় আলোচনা করে মনস্তত্ত্ব।
মনস্তত্ত্বের ভূমিকা (Role of Psychology)
মনস্তত্ত্ব আমাদের নিজেদের এবং অন্যদের আচরণ বুঝতে সাহায্য করে। কেন একজন মানুষ ডিপ্রেশনে ভোগে, কিভাবে শিশুদের সঠিক পথে পরিচালনা করা যায়, কিভাবে workplace-এ team building করা যায় – এইসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় মনস্তত্ত্বের মাধ্যমে।
দৈনন্দিন জীবনে মনস্তত্ত্বের প্রয়োগ (Application of Psychology in Daily Life)
আমাদের প্রতিদিনের জীবনে মনস্তত্ত্বের অনেক প্রয়োগ আছে। যেমন:
-
ভালো communication skills তৈরি করা।
-
stress management বা মানসিক চাপ কমানো।
-
নিজের weaknesses গুলো খুঁজে বের করে সেগুলো improve করা।
আচরণ এবং আবেগ (Behavior and Emotions)
আবেগ আমাদের আচরণের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। রাগ, ভয়, আনন্দ, দুঃখ – এই সব আবেগ আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করে।
আবেগের সংজ্ঞা (Definition of Emotion)
আবেগ হলো মনের একটা অবস্থা, যা আমাদের অনুভূতি, চিন্তা এবং আচরণকে প্রভাবিত করে।
আবেগের প্রকারভেদ (Types of Emotions)
প্রধান আবেগগুলো হলো:
- আনন্দ (Joy)
- দুঃখ (Sadness)
- রাগ (Anger)
- ভয় (Fear)
- ঘৃণা (Disgust)
- আশ্চর্য (Surprise)
আবেগ কিভাবে আচরণকে প্রভাবিত করে? (How Emotions Influence Behavior)
আবেগ আমাদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া এবং দীর্ঘমেয়াদী সিদ্ধান্ত গ্রহণ – দুটোকেই প্রভাবিত করে। কোনো কারণে ভয় পেলে আমরা দৌড়ে পালাতে পারি, আবার আনন্দ পেলে হাসি খুশি থাকি। আবেগ আমাদের কাজের motivation হিসেবেও কাজ করে।
সামাজিক প্রেক্ষাপটে আচরণ (Behavior in Social Context)
মানুষ সামাজিক জীব। তাই সমাজে আমাদের আচরণ কেমন হবে, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক রীতিনীতি, মূল্যবোধ এবং প্রত্যাশা আমাদের আচরণকে shape করে।
সামাজিক রীতিনীতি (Social Norms)
সমাজে বসবাস করার জন্য কিছু নিয়মকানুন আছে, যেগুলো আমরা মেনে চলি। এগুলোকে সামাজিক রীতিনীতি বলে। যেমন, বড়দের সম্মান করা, লাইনে দাঁড়ানো, ইত্যাদি।
সামাজিক ভূমিকা (Social Roles)
সমাজে আমাদের বিভিন্ন ভূমিকা থাকে। কেউ ছাত্র, কেউ শিক্ষক, কেউ ডাক্তার, আবার কেউ ইঞ্জিনিয়ার। এই role গুলো অনুযায়ী আমাদের আচরণও ভিন্ন হয়।
সামাজিক প্রত্যাশা (Social Expectations)
সমাজ আমাদের কাছে কিছু আচরণ আশা করে। সেই প্রত্যাশা অনুযায়ী আমরা নিজেদের adjust করি।
অস্বাভাবিক আচরণ (Abnormal Behavior)
সব আচরণ স্বাভাবিক নয়। কিছু আচরণ আছে যেগুলো সমাজের চোখে অস্বাভাবিক বা unacceptable। এই ধরনের আচরণকে অস্বাভাবিক আচরণ বলা হয়।
অস্বাভাবিক আচরণের সংজ্ঞা (Definition of Abnormal Behavior)
যে আচরণ সমাজের general norms বা রীতিনীতির সাথে মেলে না, এবং যা ব্যক্তির নিজের বা অন্যের জন্য ক্ষতিকর, তাকে অস্বাভাবিক আচরণ বলে।
অস্বাভাবিক আচরণের কারণ (Causes of Abnormal Behavior)
অস্বাভাবিক আচরণের পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে:
- মানসিক রোগ (Mental Illness)
- জিনগত সমস্যা (Genetic Factors)
- শারীরিক আঘাত (Physical Trauma)
- পরিবেশগত চাপ (Environmental Stress)
অস্বাভাবিক আচরণ চিহ্নিত করার উপায় (Ways to Identify Abnormal Behavior)
কিছু লক্ষণ দেখে অস্বাভাবিক আচরণ চিহ্নিত করা যায়:
- মেজাজের পরিবর্তন (Mood Swings)
- ঘুমের সমস্যা (Sleep Problems)
- খাবারের অভ্যাসের পরিবর্তন (Changes in Eating Habits)
- সামাজিক বিচ্ছিন্নতা (Social Isolation)
আচরণ পরিবর্তনের উপায় (Ways to Change Behavior)
খারাপ আচরণ পরিবর্তন করা সম্ভব। কিছু কৌশল অবলম্বন করে আমরা নিজেদের আচরণকে ভালো দিকে নিয়ে যেতে পারি।
আচরণ পরিবর্তনের কৌশল (Strategies for Behavior Change)
- লক্ষ্য নির্ধারণ (Goal Setting): প্রথমে ঠিক করুন আপনি কী পরিবর্তন করতে চান।
- ছোট করে শুরু (Start Small): বড় পরিবর্তন একবারে না করে ছোট ছোট ধাপে করুন।
- নিয়মিত অনুশীলন (Regular Practice): নতুন আচরণ আয়ত্ত করতে হলে নিয়মিত practice করতে হবে।
- পুরস্কার ও উৎসাহ (Rewards and Motivation): ভালো কাজের জন্য নিজেকে reward দিন।
থেরাপির ভূমিকা (Role of Therapy)
মানসিক স্বাস্থ্য professionals বা থেরাপিস্টরা আচরণ পরিবর্তনে সাহায্য করতে পারেন। তারা বিভিন্ন থেরাপি যেমন কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি (CBT) এবং ডায়ালেক্টিক্যাল বিহেভিয়ার থেরাপি (DBT) ব্যবহার করে মানুষের আচরণ পরিবর্তনে সাহায্য করেন।
আচরণ নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর (FAQs)
আচরণ নিয়ে আমাদের মনে অনেক প্রশ্ন জাগে। এখানে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
প্রশ্ন ১: মানুষের আচরণ কেন এত জটিল?
উত্তর: মানুষের আচরণ জটিল হওয়ার কারণ হলো এটা অনেকগুলো জিনিসের ওপর নির্ভর করে – জিন, পরিবেশ, অভিজ্ঞতা, সামাজিক রীতিনীতি, ইত্যাদি।
প্রশ্ন ২: ভালো আচরণ বলতে কী বোঝায়?
উত্তর: ভালো আচরণ মানে হলো সেই সব কাজ বা কথা, যা অন্যের জন্য ক্ষতিকর নয়, যা সমাজে শান্তি বজায় রাখতে সাহায্য করে।
প্রশ্ন ৩: খারাপ আচরণ কিভাবে পরিবর্তন করা যায়?
উত্তর: খারাপ আচরণ পরিবর্তন করার জন্য প্রথমে নিজের ভুল স্বীকার করতে হবে, তারপর ধীরে ধীরে ভালো অভ্যাস তৈরি করতে হবে। প্রয়োজনে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিতে পারেন।
প্রশ্ন ৪: শিশুদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত?
উত্তর: শিশুদের আচরণ হওয়া উচিত বন্ধুত্বপূর্ণ, শ্রদ্ধাপূর্ণ এবং সহযোগিতামূলক। তাদের ভালো manners শেখানো উচিত এবং অন্যদের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে উৎসাহিত করা উচিত।
প্রশ্ন ৫: “আচরণ কাকে বলে” – এই প্রশ্নের সবচেয়ে সহজ উত্তর কী?
উত্তর: সবচেয়ে সহজ উত্তর হলো, কোনো পরিস্থিতিতে মানুষ বা অন্য কোনো জীব যা করে বা দেখায়, সেটাই তার আচরণ।
পরিশিষ্ট: আরও কিছু দরকারি তথ্য
আচরণ একটি বিশাল বিষয়। এই সম্পর্কে আরও জানতে হলে আপনাকে বিভিন্ন বই ও research paper পড়তে হবে।
বিষয় | উৎস |
---|---|
মানব আচরণ | বিভিন্ন মনস্তত্ত্বের বই, জার্নাল |
সামাজিক আচরণ | সমাজবিজ্ঞান এবং সামাজিক মনোবিজ্ঞান বিষয়ক বই |
অস্বাভাবিক আচরণ | অস্বাভাবিক মনোবিজ্ঞান বিষয়ক বই |
আচরণ পরিবর্তনের কৌশল | কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি (CBT) এবং ডায়ালেক্টিক্যাল বিহেভিয়ার থেরাপি (DBT) |
আচরণ নিয়ে পড়াশোনা শুধু academic নয়, আমাদের ব্যক্তিগত জীবনেও খুব কাজে লাগে।
আশা করি, আজকের আলোচনা থেকে আপনারা “আচরণ কাকে বলে” সেই বিষয়ে একটা স্পষ্ট ধারণা পেয়েছেন। নিজের এবং অন্যের আচরণ বুঝুন, ভালো থাকুন!