আজকে আমরা কথা বলবো বাংলা ব্যাকরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিয়ে – বিশেষণ বা Adjective নিয়ে। বিশেষণ কাকে বলে, কত প্রকার ও কী কী – এই সবকিছু সহজ ভাষায় আলোচনা করবো। যারা ব্যাকরণ নিয়ে একটু ভয়ের মধ্যে থাকেন, তাদের জন্য এই ব্লগপোস্টটি বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে। তাই, খাতা-কলম নিয়ে বসতে পারেন, অথবা মন দিয়ে পড়তে থাকুন!
বিশেষণ: শব্দটির গভীরে প্রবেশ
বিশেষণ (Adjective) হলো সেই শব্দ, যা বিশেষ্য (Noun) বা সর্বনাম (Pronoun)-এর দোষ, গুণ, অবস্থা, সংখ্যা, পরিমাণ ইত্যাদি প্রকাশ করে। সহজভাবে বললে, বিশেষণ অন্য কোনো শব্দকে বিশেষিত করে বা তার সম্পর্কে অতিরিক্ত তথ্য দেয়।
উদাহরণ:
- ভালো ছেলে (এখানে “ভালো” ছেলেটির একটি গুণ)
- পাঁচটি কলম (এখানে “পাঁচটি” কলমের সংখ্যা)
- ঠান্ডা আবহাওয়া (এখানে “ঠান্ডা” আবহাওয়ার অবস্থা)
তাহলে, বুঝতেই পারছেন বিশেষণ বাক্যকে কতখানি অর্থপূর্ণ করে তোলে।
বিশেষণের প্রকারভেদ: কত রকমের হতে পারে বিশেষণ?
বাংলা ব্যাকরণে বিশেষণকে প্রধানত কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। নিচে সেগুলো আলোচনা করা হলো:
১. নাম বিশেষণ
নাম বিশেষণ সেই বিশেষণ, যা সরাসরি কোনো বিশেষ্য (Noun) বা নামপদকে বিশেষিত করে।
উদাহরণ:
- সুন্দর ফুল
- লাল গোলাপ
- গরীব মানুষ
নাম বিশেষণের প্রকারভেদ
নাম বিশেষণকে আবার কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়:
- গুণবাচক নাম বিশেষণ: যে বিশেষণ বিশেষ্যের গুণ প্রকাশ করে। যেমন: মিষ্টি ফল ।
- অবস্থাবাচক নাম বিশেষণ: যে বিশেষণ বিশেষ্যের অবস্থা বোঝায়। যেমন: রোগা ছেলে।
- সংখ্যাবাচক নাম বিশেষণ: যে বিশেষণ বিশেষ্যের সংখ্যা বোঝায়। যেমন: দুটি কলম।
- পরিমাণবাচক নাম বিশেষণ: যে বিশেষণ বিশেষ্যের পরিমাণ বোঝায়। যেমন: অনেক চিনি।
- ক্রমবাচক নাম বিশেষণ: যে বিশেষণ বিশেষ্যের ক্রম বা পর্যায় বোঝায়। যেমন: প্রথম স্থান।
- সংজ্ঞাবাচক নাম বিশেষণ: যখন কোনো বিশেষ্য পদ বিশেষণের মতো কাজ করে। যেমন: ঢাকা শহর।
২. ভাব বিশেষণ
ভাব বিশেষণ হলো সেই বিশেষণ, যা বিশেষ্য বা সর্বনামকে বিশেষিত না করে ক্রিয়া, বিশেষণ বা অন্য কোনো ভাববাচক পদকে বিশেষিত করে।
উদাহরণ:
- সে দ্রুত দৌড়ায়। (এখানে “দ্রুত” দৌড়ানোর গতি বোঝাচ্ছে)
- ফুলটি খুব সুন্দর। (এখানে “খুব” সৌন্দর্যের মাত্রা বোঝাচ্ছে)
ভাব বিশেষণের প্রকারভেদ
ভাব বিশেষণকে সাধারণত চারটি ভাগে ভাগ করা হয়:
- ক্রিয়া বিশেষণ: যে বিশেষণ ক্রিয়াকে বিশেষিত করে। যেমন: ধীরে ধীরে হাঁটো।
- বিশেষণের বিশেষণ: যে বিশেষণ অন্য কোনো বিশেষণকে বিশেষিত করে। যেমন: খুব ভালো।
- অব্যয়ের বিশেষণ: যে বিশেষণ অব্যয় পদকে বিশেষিত করে। যেমন: শুধুমাত্র তুমি।
- বাক্যের বিশেষণ: যে বিশেষণ পুরো বাক্যকে বিশেষিত করে। যেমন: সম্ভবত সে আসবে না।
৩. সর্বনামের বিশেষণ
যখন কোনো সর্বনাম পদ বিশেষণের মতো কাজ করে, তখন তাকে সর্বনামের বিশেষণ বলা হয়।
উদাহরণ:
- কোন বইটা তোমার?
- ঐ লোকটি কে?
- আমার এই কলমটি দরকার।
৪. ক্রিয়ার বিশেষণ
ক্রিয়ার বিশেষণ হলো সেই বিশেষণ যা ক্রিয়ার বৈশিষ্ট্য, সময়, স্থান, কারণ, পদ্ধতি, বা উদ্দেশ্য নির্দেশ করে। এটি ক্রিয়ার ধরন বা প্রক্রিয়া সম্পর্কে অতিরিক্ত তথ্য প্রদান করে।
উদাহরণ:
- সে ধীরে ধীরে হাঁটে। (পদ্ধতি)
- আমরা কালকে যাব। (সময়)
- সে এখানে বসে। (স্থান)
- বৃষ্টির কারণে আমরা বাধ্য হয়ে ঘরে প্রবেশ করলাম। (কারণ)
ক্রিয়া বিশেষণের প্রকারভেদ
- সময়বাচক ক্রিয়া বিশেষণ: যে বিশেষণ ক্রিয়ার সময় নির্দেশ করে। যেমন: আজ, কাল, এখন।
- স্থানবাচক ক্রিয়া বিশেষণ: যে বিশেষণ ক্রিয়ার স্থান নির্দেশ করে। যেমন: এখানে, সেখানে, উপরে।
- পদ্ধতিবাচক ক্রিয়া বিশেষণ: যে বিশেষণ ক্রিয়ার পদ্ধতি বা ধরণ নির্দেশ করে। যেমন: ধীরে, দ্রুত, সাবধানে।
- কারণবাচক ক্রিয়া বিশেষণ: যে বিশেষণ ক্রিয়ার কারণ নির্দেশ করে। যেমন: অতএব, সুতরাং, কারণ।
- পরিমাণবাচক ক্রিয়া বিশেষণ: যে বিশেষণ ক্রিয়ার পরিমাণ বা মাত্রা নির্দেশ করে। যেমন: কম, বেশি, যথেষ্ট।
বিশেষণের ব্যবহার: বাক্যে কিভাবে ব্যবহার করবেন?
বিশেষণের সঠিক ব্যবহার বাক্যের সৌন্দর্য এবং অর্থকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। নিচে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো:
- “মেঘলা আকাশ” – এখানে “মেঘলা” শব্দটি আকাশের অবস্থা বোঝাচ্ছে।
- “দুষ্টু ছেলে” – এখানে “দুষ্টু” শব্দটি ছেলের একটি গুণ (বা দোষ) বোঝাচ্ছে।
- “লম্বা গাছ” – এখানে “লম্বা” শব্দটি গাছের আকার বোঝাচ্ছে।
বিশেষণ ব্যবহারের সময় কিছু জিনিস মনে রাখতে হবে:
- বিশেষণ সবসময় বিশেষ্য বা সর্বনামের আগে বসে, তবে ক্ষেত্রবিশেষে পরেও বসতে পারে।
- বিশেষণ পদের লিঙ্গ, বচন অনুসারে পরিবর্তিত হতে পারে।
বিশেষণ চেনার সহজ উপায়
বিশেষণ চেনার জন্য আপনি কিছু সহজ উপায় অবলম্বন করতে পারেন:
- দেখুন কোনো শব্দ বিশেষ্য বা সর্বনাম সম্পর্কে অতিরিক্ত তথ্য দিচ্ছে কিনা।
- শব্দটি কোনো গুণ, দোষ, অবস্থা, সংখ্যা বা পরিমাণ বোঝাচ্ছে কিনা।
- শব্দটি সরিয়ে দিলে বাক্যের অর্থ অসম্পূর্ণ মনে হচ্ছে কিনা।
যদি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর হ্যাঁ হয়, তাহলে সেটি বিশেষণ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ
বিশেষ্য | বিশেষণ |
---|---|
মানুষ | ভালো, খারাপ |
ফুল | সুন্দর, তাজা |
আকাশ | নীল, মেঘলা |
নদী | বিশাল, খরস্রোতা |
বই | শিক্ষামূলক, মজার |
বিশেষণ নিয়ে কিছু সাধারণ ভুল
অনেকেই বিশেষণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু ভুল করে থাকেন। তাদের মধ্যে কয়েকটি নিচে উল্লেখ করা হলো:
- বিশেষ্য ও বিশেষণের মধ্যে লিঙ্গ বা বচন সঙ্গতি না রাখা।
- যেখানে বিশেষণ ব্যবহার করার প্রয়োজন নেই, সেখানেও ব্যবহার করা।
- ভুল বিশেষণ নির্বাচন করা, যা বাক্যের অর্থ পরিবর্তন করে দেয়।
এই ভুলগুলো এড়িয়ে চলতে পারলে, আপনি সহজেই বিশেষণ ব্যবহার করতে পারবেন।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত কিছু প্রশ্ন (FAQ)
এখানে বিশেষণ সম্পর্কিত কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
প্রশ্ন ১: বিশেষণ ও ক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য কী?
উত্তর: বিশেষণ বিশেষ্য বা সর্বনামকে বিশেষিত করে, অন্যদিকে ক্রিয়া কাজ বোঝায়। যেমন, “সুন্দর ফুল” – এখানে “সুন্দর” বিশেষণ, কারণ এটি ফুলটিকে বিশেষিত করছে। “সে গান গায়” – এখানে “গায়” ক্রিয়া, কারণ এটি একটি কাজ বোঝাচ্ছে।
প্রশ্ন ২: একটি শব্দ কি একই সাথে বিশেষণ ও ক্রিয়া হতে পারে?
উত্তর: হ্যাঁ, কিছু শব্দ বাক্যের গঠন ও অর্থের ওপর নির্ভর করে বিশেষণ ও ক্রিয়া উভয়ই হতে পারে। এই ধরনের শব্দকে “বিশেষণীয় ক্রিয়া” বলা হয়।
প্রশ্ন ৩: বিশেষণ কিভাবে বাক্যকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে?
উত্তর: বিশেষণ ব্যবহার করে আপনি কোনো ব্যক্তি, বস্তু বা অবস্থার বৈশিষ্ট্যগুলি স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে পারেন। এটি পাঠক বা শ্রোতার মনে একটি স্পষ্ট চিত্র তৈরি করতে সাহায্য করে, যা বাক্যকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে।
প্রশ্ন ৪: বিশেষণের উদাহরণ দিন যা স্থান বোঝায়।
উত্তর: স্থানবাচক বিশেষণের উদাহরণ হলো “গ্রামীণ জীবন”। এখানে “গ্রামীণ” শব্দটি স্থান বোঝাচ্ছে। আরও কিছু উদাহরণ: “শহুরে”, “পার্বত্য”, “সমুদ্রতীরবর্তী” ইত্যাদি।
প্রশ্ন ৫: বিশেষণের কারক বিভক্তি কিভাবে হয়?
উত্তর: বিশেষণের কারক বিভক্তি সাধারণত হয় না। তবে, যখন কোনো বিশেষণ বিশেষ্যরূপে ব্যবহৃত হয়, তখন কারক বিভক্তি হতে পারে। যেমন: “জ্ঞানীকে সম্মান করা উচিত।”
প্রশ্ন ৬: “কমলা রঙের জামা” – এখানে বিশেষণ পদ কোনটি?
উত্তর: এখানে বিশেষণ পদ হলো “কমলা রঙের”। এটি জামার রং উল্লেখ করে জামাটিকে বিশেষিত করছে।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যে বিশেষণের ব্যবহার
আধুনিক বাংলা সাহিত্যে বিশেষণ বহুমাত্রিকভাবে ব্যবহৃত হয়। লেখকরা তাদের লেখায় নতুনত্ব আনতে এবং পাঠকের মনে গভীর অনুভূতি জাগাতে বিভিন্ন প্রকার বিশেষণ ব্যবহার করেন। উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক ইত্যাদি অলঙ্কারের মাধ্যমে বিশেষণ ব্যবহার করে ভাষাকে আরও সমৃদ্ধ করা হয়।
উদাহরণ:
- “রাতের আকাশ যেন তারাদের মেলা” – এখানে “তারাদের মেলা” একটি রূপক, যা আকাশের সৌন্দর্যকে বিশেষিত করছে।
- “বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ” – এখানে “রিমঝিম” শব্দটি বৃষ্টির ধ্বনিকে বিশেষিত করছে।
উপসংহার
আশা করি, বিশেষণ কাকে বলে এবং এর প্রকারভেদ সম্পর্কে আপনার ধারণা স্পষ্ট হয়েছে। ব্যাকরণের এই অংশটি ভালোভাবে বুঝতে পারলে, বাংলা ভাষায় আপনার দখল আরও বাড়বে। যদি কোনো প্রশ্ন থাকে, তবে নির্দ্বিধায় কমেন্ট বক্সে জিজ্ঞাসা করতে পারেন। আর হ্যাঁ, ব্যাকরণের অন্যান্য বিষয় নিয়েও আমরা পরবর্তীতে আলোচনা করব। তাই, আমাদের সাথেই থাকুন!