আহিত বস্তু কাকে বলে? বিদ্যুতের খুঁটিনাটি: সহজ ভাষায় বুঝুন
আচ্ছা, কখনো কি ভেবেছেন, বিদ্যুতের তারে হাত লাগালে কেন শক লাগে? অথবা, চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ানোর পর ছোট কাগজের টুকরোগুলো কেন চিরুনির দিকে আকৃষ্ট হয়? এর কারণ হল “আহিত বস্তু”! ভয় নেই, কঠিন মনে হচ্ছে? আসুন, খুব সহজ ভাষায়, মজার ছলে জেনে নিই আহিত বস্তু আসলে কী, কীভাবে তৈরি হয়, আর এর পেছনের বিজ্ঞানটাই বা কী!
বিদ্যুৎ আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আলো জ্বালানো থেকে শুরু করে মোবাইল চার্জ করা পর্যন্ত, সবকিছুতেই এর ব্যবহার। তাই, এই বিদ্যুতের একদম বেসিক বিষয়গুলো জানা থাকা দরকার।
আহিত বস্তু: একদম জলের মতো সোজা করে বুঝুন
সহজ ভাষায়, আহিত বস্তু মানে হল এমন কোনো বস্তু যার মধ্যে বৈদ্যুতিক চার্জ (Electric charge) আছে। এই চার্জ দুই ধরনের হতে পারে: পজিটিভ (+) বা নেগেটিভ (-)। যখন কোনো বস্তুতে এই চার্জের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বা কম হয়, তখন সেই বস্তুকে আহিত বস্তু বলা হয়।
বিষয়টা আরেকটু ভেঙে বলি। প্রত্যেক বস্তুই ছোট ছোট কণা দিয়ে তৈরি, যাদের আমরা পরমাণু (Atom) বলি। পরমাণুর মধ্যে থাকে ইলেকট্রন (Electron), প্রোটন (Proton) ও নিউট্রন (Neutron)। ইলেকট্রনের চার্জ নেগেটিভ (-), প্রোটনের চার্জ পজিটিভ (+), আর নিউট্রনের কোনো চার্জ নেই। স্বাভাবিক অবস্থায়, একটা পরমাণুতে ইলেকট্রন আর প্রোটনের সংখ্যা সমান থাকে, তাই বস্তুটা নিস্তড়িৎ (Neutral) থাকে। কিন্তু যখন কোনো কারণে এই সমতা নষ্ট হয়, তখনই বস্তু আহিত হয়ে যায়।
আধান বা চার্জ (Charge) কী?
আধান বা চার্জ হলো পদার্থের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য যা তড়িৎ এবং চৌম্বকীয় প্রভাব তৈরি করে। এটা দুই প্রকার: ধনাত্মক (পজিটিভ) এবং ঋণাত্মক (নেগেটিভ)। সমধর্মী চার্জ পরস্পরকে বিকর্ষণ করে, বিপরীতধর্মী চার্জ পরস্পরকে আকর্ষণ করে। চার্জের একক হলো কুলম্ব (Coulomb)।
আহিতকরণ (Charging) প্রক্রিয়া: কীভাবে একটি বস্তু চার্জিত হয়?
আহিতকরণ হল সেই প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে একটি বস্তুকে চার্জিত করা হয়। সাধারণত তিনটি উপায়ে এটা করা যায়:
-
ঘর্ষণ (Friction): যখন দুটি বস্তুকে आपस में ঘষা হয়, তখন একটি বস্তু থেকে অন্য বস্তুতে ইলেকট্রন স্থানান্তরিত হতে পারে। যে বস্তু ইলেকট্রন হারায়, সেটি পজিটিভ চার্জে আহিত হয়, আর যে বস্তু ইলেকট্রন গ্রহণ করে, সেটি নেগেটিভ চার্জে আহিত হয়। ছোটবেলার সেই experiment মনে আছে তো? স্কেল দিয়ে চুল ঘষে কাগজের টুকরা সরানো!
-
পরিবহন (Conduction): যখন একটি চার্জিত বস্তুকে অন্য একটি নিস্তড়িৎ বস্তুর সংস্পর্শে আনা হয়, তখন চার্জ উভয়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে নিস্তড়িৎ বস্তুটিও চার্জিত হয়ে যায়।
-
আবেশ (Induction): এই পদ্ধতিতে কোনো সংস্পর্শ ছাড়াই একটি বস্তুকে চার্জিত করা যায়। যখন একটি চার্জিত বস্তুকে একটি নিস্তড়িৎ বস্তুর কাছে আনা হয়, তখন নিস্তড়িৎ বস্তুর মধ্যে চার্জের পুনর্বিন্যাস ঘটে। এর ফলে বস্তুটি চার্জিত হয়।
আহিত বস্তুর প্রকারভেদ: পজিটিভ নাকি নেগেটিভ?
আহিত বস্তু মূলত দুই প্রকার:
-
ধনাত্মক বা পজিটিভ চার্জযুক্ত বস্তু: যখন কোনো বস্তু ইলেকট্রন হারায়, তখন তাতে প্রোটনের সংখ্যা বেশি হয়ে যায়। ফলে বস্তুটা পজিটিভ চার্জে আহিত হয়।
-
ঋণাত্মক বা নেগেটিভ চার্জযুক্ত বস্তু: যখন কোনো বস্তু ইলেকট্রন গ্রহণ করে, তখন তাতে ইলেকট্রনের সংখ্যা বেশি হয়ে যায়। ফলে বস্তুটা নেগেটিভ চার্জে আহিত হয়।
চার্জের বৈশিষ্ট্য: আকর্ষণ ও বিকর্ষণ
চার্জের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল আকর্ষণ ও বিকর্ষণ। সমধর্মী চার্জ (পজিটিভ-পজিটিভ অথবা নেগেটিভ-নেগেটিভ) পরস্পরকে বিকর্ষণ করে, অর্থাৎ দূরে সরিয়ে দেয়। আর বিপরীতধর্মী চার্জ (পজিটিভ-নেগেটিভ) পরস্পরকে আকর্ষণ করে, অর্থাৎ কাছে টানে। এই আকর্ষণ ও বিকর্ষণের ফলেই মূলত বিদ্যুৎ সংক্রান্ত ঘটনাগুলো ঘটে থাকে।
আহিত বস্তুর ব্যবহার: দৈনন্দিন জীবনে এর প্রভাব
আহিত বস্তুর ব্যবহার আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অনেক। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হল:
-
স্থির তড়িৎ (Static electricity): চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ালে যে কাগজের টুকরা আকর্ষণ করে, সেটা স্থির বিদ্যুতের উদাহরণ। এছাড়াও, বজ্রপাতের সময় যে বিদ্যুৎ চমকায়, সেটাও স্থির বিদ্যুৎ।
-
বৈদ্যুতিক জেনারেটর (Electric generator): জেনারেটরের মাধ্যমে যান্ত্রিক শক্তিকে বৈদ্যুতিক শক্তিতে রূপান্তরিত করা হয়। এখানে চৌম্বক ক্ষেত্রের মধ্যে তারের কুণ্ডলী ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।
-
মোটর (Electric motor): বৈদ্যুতিক মোটর বিদ্যুৎ শক্তিকে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে। ফ্যান, ওয়াশিং মেশিন, ব্লেন্ডার সহ বিভিন্ন যন্ত্রে এই মোটর ব্যবহার করা হয়।
আহিত বস্তু এবং পরিবাহী, অপরিবাহী ও অর্ধপরিবাহী পদার্থ
বিদ্যুৎ পরিবাহিতার ওপর ভিত্তি করে পদার্থকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়: পরিবাহী (Conductor), অপরিবাহী (Insulator) ও অর্ধপরিবাহী (Semiconductor)।
বৈশিষ্ট্য | পরিবাহী (Conductor) | অপরিবাহী (Insulator) | অর্ধপরিবাহী (Semiconductor) |
---|---|---|---|
বিদ্যুৎ পরিবাহিতা | খুব ভালো (বিদ্যুৎ সহজে চলাচল করতে পারে) | খুব খারাপ (বিদ্যুৎ চলাচল করতে পারে না) | পরিবাহী ও অপরিবাহীর মাঝামাঝি |
উদাহরণ | তামা, রূপা, লোহা | কাঠ, প্লাস্টিক, কাঁচ | সিলিকন, জার্মেনিয়াম |
ইলেকট্রনের চলাচল | সহজে ইলেকট্রন চলাচল করতে পারে | ইলেকট্রন চলাচল করতে পারে না | বিশেষ পরিস্থিতিতে ইলেকট্রন চলাচল করতে পারে |
আহিত করার ক্ষমতা | সহজে আহিত করা যায়, তবে চার্জ ধরে রাখতে পারে না (কারণ চার্জ দ্রুত ছড়িয়ে যায়) | সহজে আহিত করা যায় এবং চার্জ ধরে রাখতে পারে | বিশেষ উপায়ে ডোপিং (ডoping) করে পরিবাহিতা পরিবর্তন করা যায় |
ব্যবহার | বৈদ্যুতিক তার, সার্কিট | বৈদ্যুতিক তারের ওপরের আবরণ, সুইচ | ট্রানজিস্টর, ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট (IC) |
আধানের পরিমাণ (Quantity of Charge)
আধানের পরিমাণ বলতে কোনো বস্তুতে কতটুকু চার্জ আছে, তা বোঝায়। এর এস.আই. একক হলো কুলম্ব (Coulomb), যাকে C দিয়ে প্রকাশ করা হয়। একটি ইলেকট্রনের চার্জের পরিমাণ হলো -1.602 × 10⁻¹⁹ কুলম্ব, যা খুবই ক্ষুদ্র।
কুলম্বের সূত্র (Coulomb’s Law): দুটি চার্জের মধ্যেকার আকর্ষণ-বিকর্ষণ বল
কুলম্বের সূত্র অনুযায়ী, দুটি বিন্দু চার্জের মধ্যে আকর্ষণ বা বিকর্ষণ বলের মান চার্জদ্বয়ের গুণফলের সমানুপাতিক এবং তাদের মধ্যবর্তী দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক। এই বল চার্জদ্বয়কে সংযোগকারী সরলরেখা বরাবর ক্রিয়া করে।
গাণিতিকভাবে, সূত্রটি হলো:
F = k * (|q1 * q2|) / r²
যেখানে:
- F হলো আকর্ষণ বা বিকর্ষণ বল (Force)
- k হলো কুলম্বের ধ্রুবক (Coulomb’s constant)
- q1 ও q2 হলো দুটি চার্জের মান (Charge)
- r হলো চার্জদ্বয়ের মধ্যে দূরত্ব (Distance)
আহিত বস্তু নিয়ে কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ):
-
আহিত বস্তু কী দিয়ে তৈরি?
আহিত বস্তু পরমাণু দিয়ে তৈরি। পরমাণুর মধ্যে থাকা ইলেকট্রন ও প্রোটনের চার্জের ভারসাম্য পরিবর্তনের ফলেই বস্তু আহিত হয়।
-
কীভাবে বুঝব কোনো বস্তু আহিত হয়েছে কিনা?
একটি সহজ উপায় হল электроскоп (Electroscope) ব্যবহার করা। এছাড়াও, ছোট কাগজের টুকরা কাছে আনলে যদি আকর্ষণ করে, তাহলে বোঝা যায় বস্তুটা আহিত হয়েছে।
-
আহিত বস্তুর উদাহরণ কী কী?
বজ্রপাত, স্থির বিদ্যুৎ, চার্জিত মোবাইল ফোন – এগুলো সবই আহিত বস্তুর উদাহরণ।
-
আহিত বস্তু কত প্রকার?
আহিত বস্তু দুই প্রকার: ধনাত্মক (পজিটিভ) ও ঋণাত্মক (নেগেটিভ)।
-
আহিত বস্তু কিভাবে তৈরি হয়?
ঘর্ষণ, পরিবহন এবং আবেশ এই তিনটি প্রধান উপায়ে আহিত বস্তু তৈরি হতে পারে।
-
আহিত বস্তুর একক কি?
আহিত বস্তুর চার্জের একক হল কুলম্ব (Coulomb)।
-
আহিত বস্তুর বৈশিষ্ট্য কি?
আকর্ষণ ও বিকর্ষণ – এটিই আহিত বস্তুর প্রধান বৈশিষ্ট্য।
-
আহিত বস্তুর প্রকারভেদ কি কি?
আহিত বস্তু দুই প্রকার – ধনাত্মক (পজিটিভ) এবং ঋণাত্মক (নেগেটিভ)।
আহিত বস্তুর ব্যবহারিক প্রয়োগ
আহিত বস্তুর ধারণা শুধু তাত্ত্বিক নয়, এর ব্যবহারিক প্রয়োগও অনেক। যেমন:
- তড়িৎ জেনারেটর এবং মোটর: এই যন্ত্রগুলোতে আহিত কণাগুলোর চলাচলকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং ব্যবহার করা হয়।
- কম্পিউটার এবং অন্যান্য ইলেকট্রনিক ডিভাইস: ট্রানজিস্টর এবং অন্যান্য সেমিকন্ডাক্টর ডিভাইসগুলো আহিত কণাগুলোর প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে কাজ করে।
- ই ink jet printer: এই প্রিন্টারগুলোতে চার্জিত কালির ফোঁটা ব্যবহার করে কাগজের উপর ছবি বা লেখা ছাপা হয়।
নিরাপত্তা টিপস: বিদ্যুৎ ব্যবহারে সতর্কতা
বিদ্যুৎ আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অনেক সুবিধা দিলেও, এর ব্যবহারে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ টিপস দেওয়া হলো:
- বৈদ্যুতিক তার ছেঁড়া থাকলে তা মেরামত না করা পর্যন্ত ব্যবহার করবেন না।
- ভেজা হাতে বৈদ্যুতিক সুইচ স্পর্শ করবেন না।
- বজ্রঝড়ের সময় খোলা জায়গায় বা ধাতব বস্তুর নিচে দাঁড়াবেন না।
- বিদ্যুৎ সংক্রান্ত কাজ করার সময় রাবারের গ্লাভস এবং জুতা ব্যবহার করুন।
- বাড়িতে ভালো মানের আর্থিং (Earthing) এর ব্যবস্থা রাখুন।
- কোনো বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ত্রুটিপূর্ণ হলে নিজে সারানোর চেষ্টা না করে ইলেক্ট্রিশিয়ান ডাকুন।
উপসংহার: বিদ্যুতের খেলা বোঝা!
আশা করি, “আহিত বস্তু কাকে বলে” – এই প্রশ্নের উত্তর সহজভাবে বোঝাতে পেরেছি। বিদ্যুৎ আমাদের জীবনে অনেক কাজে লাগে, কিন্তু এর সঠিক ব্যবহার জানাটাও জরুরি। তাই, বিদ্যুতের খুঁটিনাটি জেনে নিজের জীবনকে আরও সুরক্ষিত করুন।
যদি এই বিষয়ে আরও কিছু জানতে চান, তাহলে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন। আর হ্যাঁ, লেখাটি ভালো লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না! কারণ জ্ঞান বিতরণেই বাড়ে৷ আর আমি আছি আপনাদের পাশে , নতুন কিছু নিয়ে আসার জন্য।