ধরুন, আপনি একটি নির্জন দ্বীপে ঘুরতে গেছেন। সেখানে গিয়ে দেখলেন, একটি পুরোনো রেডিও পড়ে আছে। আপনি সেটি চালু করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু কোনো শব্দ নেই। কেন? কারণ, রেডিওটি চালানোর জন্য যে শক্তি দরকার, তা उसमें নেই। এই শক্তিকেই আমরা ‘আহিত’ বলতে পারি। তবে শুধু রেডিও নয়, আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও আহিতের ব্যবহার ব্যাপক। চলুন, আজ আমরা ‘আহিত কাকে বলে’ সেই সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করি।
আহিত (Charge) কী, তার প্রকারভেদ, বৈশিষ্ট্য এবং আমাদের জীবনে এর প্রভাব – সবকিছু নিয়েই আমরা কথা বলব।
আহিত: বিদ্যুতের প্রাণভোমরা
আহিত হলো পদার্থের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য। এটি একটি কণা বা বস্তুকে একটি তাড়িৎ চৌম্বকীয় ক্ষেত্রে আকর্ষণ বা বিকর্ষণ করার ক্ষমতা দেয়। আরও সহজভাবে বলতে গেলে, আহিত হলো সেই শক্তি, যা কোনো বস্তুকে ইলেক্ট্রিক্যালি সক্রিয় করে তোলে।
আহিত কত প্রকার ও কী কী?
আহিত প্রধানত দুই প্রকার:
- ধনাত্মক আহিত (Positive Charge): ধনাত্মক আহিত প্রোটনের মধ্যে থাকে। প্রোটন হলো পরমাণুর নিউক্লিয়াসের একটি অংশ।
- ঋণাত্মক আহিত (Negative Charge): ঋণাত্মক আহিত ইলেকট্রনের মধ্যে থাকে। ইলেকট্রন পরমাণুর নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘোরে।
এছাড়াও, কিছু বস্তু নিরপেক্ষ (Neutral) হতে পারে। এর মানে হলো, সেই বস্তুতে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক আহিতের সংখ্যা সমান।
আহিতের বৈশিষ্ট্য
আহিতের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে:
- আকর্ষণ ও বিকর্ষণ: বিপরীত আধান পরস্পরকে আকর্ষণ করে এবং সম আধান পরস্পরকে বিকর্ষণ করে। অর্থাৎ, ধনাত্মক আধান ঋণাত্মক আধানকে আকর্ষণ করে, কিন্তু দুটি ধনাত্মক আধান বা দুটি ঋণাত্মক আধান পরস্পরকে দূরে ঠেলে দেয়। এই আকর্ষণ ও বিকর্ষণ বলই তড়িৎ ক্ষেত্রের মূল ভিত্তি। অনেকটা চুম্বকের মতো, যেখানে বিপরীত মেরু আকর্ষণ করে আর একই মেরু বিকর্ষণ করে।
- সংরক্ষণযোগ্যতা: আহিত সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না, কেবল এক বস্তু থেকে অন্য বস্তুতে স্থানান্তর করা যায়। মহাবিশ্বে মোট আহিতের পরিমাণ সবসময় ধ্রুব থাকে।
- কোয়ান্টাইজেশন: আহিত একটি কোয়ান্টাইজড রাশি, মানে এটি একটি নির্দিষ্ট ন্যূনতম মানের গুণিতকে থাকে। এই ন্যূনতম মান হলো একটি ইলেকট্রনের চার্জ (e), যার মান প্রায় 1.602 x 10^-19 কুলম্ব।
- যোগাযোগ: একটি বস্তুর মোট আহিত হলো তার মধ্যে থাকা সকল ধনাত্মক ও ঋণাত্মক আহিতের বীজগণিতীয় যোগফল। যদি একটি বস্তুতে +5 কুলম্ব এবং -3 কুলম্ব চার্জ থাকে তবে তার মোট চার্জ হবে +2 কুলম্ব।
দৈনন্দিন জীবনে আহিতের ব্যবহার
আহিত আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর ব্যবহার ব্যাপক ও বহুমাত্রিক। নিচে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ব্যবহার উল্লেখ করা হলো:
বিদ্যুৎ উৎপাদন
আহিতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার হলো বিদ্যুৎ উৎপাদন। কয়লা, গ্যাস বা জলবিদ্যুৎ ব্যবহার করে টারবাইন ঘোরানো হয়। এই টারবাইন একটি জেনারেটরের সাথে যুক্ত থাকে। জেনারেটরের মধ্যে থাকা কন্ডাক্টর এবং চুম্বকক্ষেত্রের মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়ার ফলে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়। এখানে ইলেকট্রনের প্রবাহই বিদ্যুৎ, যা আহিত কণার স্থানান্তরের মাধ্যমে সম্ভব হয়।
ইলেকট্রনিক্স
কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, টেলিভিশন থেকে শুরু করে আধুনিক সব ইলেকট্রনিক ডিভাইসই আহিতের উপর নির্ভরশীল। এই ডিভাইসগুলোর ভেতরের সার্কিটগুলোতে ইলেকট্রনের সুনিয়ন্ত্রিত প্রবাহের মাধ্যমে বিভিন্ন কাজ সম্পন্ন করা হয়। ট্রানজিস্টর, ডায়োড এবং ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট (IC) -এর মতো উপাদানগুলো আহিত ব্যবহার করে সিগন্যাল প্রক্রিয়াকরণ এবং ডেটা সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আপনি যখন আপনার স্মার্টফোনটি ব্যবহার করছেন, তখন আসলে আপনি আহিত কণার কারসাজি দেখছেন।
চিকিৎসা বিজ্ঞান
চিকিৎসা বিজ্ঞানেও আহিতের ব্যবহার অনেক। ইমেজিং কৌশল যেমন এক্স-রে, সিটি স্ক্যান এবং এমআরআই (MRI)-এর মাধ্যমে শরীরের অভ্যন্তরের ছবি তোলা হয়। এই পদ্ধতিগুলোতে আহিত কণা ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও, রেডিওথেরাপির মাধ্যমে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করতে আহিত কণা ব্যবহার করা হয়।
শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহার
শিল্পক্ষেত্রে বিভিন্ন কাজে আহিত ব্যবহার করা হয়। যেমন, ইলেক্ট্রোস্ট্যাটিক পেইন্টিং-এর মাধ্যমে গাড়ির বডিতে রং করা হয়। এই পদ্ধতিতে রং করার ফলে রঙের অপচয় কম হয় এবং নিখুঁত ফিনিশিং পাওয়া যায়। এছাড়াও, বিভিন্ন সেন্সর এবং অ্যাকচুয়েটরগুলোতে আহিত ব্যবহার করা হয় যা স্বয়ংক্রিয় সিস্টেমগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে।
আহিত এবং তড়িৎ ক্ষেত্র
আহিত এবং তড়িৎ ক্ষেত্র (Electric Field) একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটি আহিত কণা তার চারপাশে একটি তড়িৎ ক্ষেত্র তৈরি করে। এই ক্ষেত্রটি অন্য কোনো আহিত কণার উপর বল প্রয়োগ করতে পারে।
তড়িৎ ক্ষেত্র কী?
তড়িৎ ক্ষেত্র হলো একটি অঞ্চল, যেখানে কোনো আহিত কণা রাখলে সেটি একটি বল অনুভব করে। এই বল আকর্ষণীয় বা বিকর্ষণীয় হতে পারে, যা আহিত কণার প্রকৃতির উপর নির্ভর করে।
তড়িৎ ক্ষেত্রের বৈশিষ্ট্য
- তড়িৎ ক্ষেত্র একটি ভেক্টর রাশি, এর মান এবং দিক উভয়ই আছে।
- তড়িৎ ক্ষেত্রের দিক ধনাত্মক আধান থেকে বাইরের দিকে এবং ঋণাত্মক আধানের দিকে ভেতরের দিকে হয়।
- তড়িৎ ক্ষেত্রের তীব্রতা (Electric Field Intensity) হলো প্রতি একক ধনাত্মক আধানে প্রযুক্ত বল।
আহিত এবং তড়িৎ বিভব (Electric Potential)
আহিত এবং তড়িৎ বিভবও পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। তড়িৎ বিভব হলো কোনো নির্দিষ্ট বিন্দুতে একটি একক ধনাত্মক আধানকে অসীম দূরত্ব থেকে আনতে যে পরিমাণ কাজ করতে হয়, তার পরিমাপ।
আকর্ষণীয় কিছু উদাহরণ
আহিতের কিছু মজার এবং আকর্ষণীয় উদাহরণ নিচে দেওয়া হলো:
- ** static electricity (স্ট্যাটিক ইলেকট্রিসিটি):** শীতকালে শুকনো চুলে চিরুনি দিয়ে আঁচড়ালে ছোট ছোট কাগজের টুকরা আকর্ষণ করে। এটা স্ট্যাটিক ইলেকট্রিসিটির কারণে হয়। ঘর্ষণের ফলে চিরুনিতে আহিত তৈরি হয়, যা কাগজগুলোকে আকর্ষণ করে।
- বিদ্যুৎ চমকানো: মেঘে মেঘে ঘর্ষণের ফলে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়, যা আকাশে চমকানোর মাধ্যমে দেখা যায়। এই সময় মেঘে অনেক বেশি পরিমাণে আহিত জমা হয়।
- লেজার প্রিন্টার: লেজার প্রিন্টারে টোনার (Toner) নামক বিশেষ কালি ব্যবহার করা হয়। এই কালি আহিতযুক্ত থাকে এবং এটি ড্রামের উপর স্থির হয়ে ছবি তৈরি করে।
কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ)
আহিত নিয়ে অনেকের মনে কিছু প্রশ্ন থাকে। নিচে কয়েকটি সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
প্রশ্ন ১: আহিত কিভাবে তৈরি হয়?
উত্তর: আহিত তৈরি হয় মূলত ঘর্ষণের মাধ্যমে অথবা অন্য কোনো বস্তুর সংস্পর্শে আসার ফলে। যখন দুটি ভিন্ন বস্তু ঘর্ষণের মাধ্যমে একত্রিত হয়, তখন একটি বস্তু থেকে অন্য বস্তুতে ইলেকট্রন স্থানান্তরিত হতে পারে। যে বস্তু ইলেকট্রন হারায় তা ধনাত্মকভাবে আহিত হয়, এবং যা গ্রহণ করে তা ঋণাত্মকভাবে আহিত হয়।
প্রশ্ন ২: কুলম্ব (Coulomb) কী?
উত্তর: কুলম্ব হলো আহিতের একক। একজন ইলেকট্রনের চার্জ প্রায় 1.602 x 10^-19 কুলম্ব।
প্রশ্ন ৩: পরিবাহী (Conductor) এবং অন্তরক (Insulator) পদার্থের মধ্যে পার্থক্য কী?
উত্তর: পরিবাহী পদার্থ হলো সেগুলি, যাদের মাধ্যমে খুব সহজে বিদ্যুৎ চলাচল করতে পারে, যেমন তামা বা সোনা। অন্যদিকে, অন্তরক পদার্থ হলো সেগুলি, যাদের মাধ্যমে বিদ্যুৎ চলাচল করতে পারে না, যেমন কাঠ বা প্লাস্টিক। পরিবাহীর মধ্যে প্রচুর মুক্ত ইলেকট্রন থাকে, যা বিদ্যুৎ পরিবহনে সাহায্য করে।
প্রশ্ন ৪: আহিত কি শরীরের জন্য ক্ষতিকর?
উত্তর: খুব বেশি মাত্রার আহিত শরীরের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, বজ্রপাতে শরীরের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। তবে, সাধারণভাবে ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক ডিভাইস থেকে নির্গত আহিত তেমন ক্ষতিকর নয়।
প্রশ্ন ৫: আহিত এবং কারেন্টের মধ্যে সম্পর্ক কী?
উত্তর: কারেন্ট হলো আহিতের প্রবাহ। যখন কোনো পরিবাহীর মধ্যে দিয়ে ইলেকট্রন প্রবাহিত হয়, তখন তাকে কারেন্ট বলা হয়। কারেন্টকে অ্যাম্পিয়ার (Ampere) এককে মাপা হয়।
উপসংহার
আশা করি, “আহিত কাকে বলে” সে সম্পর্কে আপনার ধারণা স্পষ্ট হয়েছে। আহিত শুধু একটি ভৌত রাশি নয়, এটি আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে জড়িয়ে আছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে শুরু করে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার পর্যন্ত, সর্বত্রই আহিতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এই বিষয়ে আরও জানতে এবং নিজের জ্ঞানকে আরও সমৃদ্ধ করতে বিভিন্ন বিজ্ঞান বিষয়ক বই এবং ওয়েবসাইট অনুসরণ করতে পারেন।
যদি কোনো প্রশ্ন থাকে, তবে নিচে কমেন্ট করে জানাতে পারেন। আপনার মতামত আমাদের কাছে অত্যন্ত মূল্যবান। আর হ্যাঁ, এই ব্লগটি ভালো লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না!