জীবনে আলো কত জরুরি, তাই না? আলো না থাকলে চারপাশ অন্ধকার, কিছুই দেখা যায় না। কিন্তু এই আলো শুধু সোজা পথে চলে না, মাঝে মাঝে বাঁকা পথেও চলে, একে অপরের সাথে মিশে নতুন কিছু সৃষ্টি করে। আর আলোর এই মেশামেশিকেই বলে ব্যতিচার।
আলোর ব্যতিচার (Interference of Light) কী, কেন হয়, কীভাবে হয় – এইসব নিয়েই আজকের আলোচনা। তাই, বসুন এবং পড়তে থাকুন!
আলোর ব্যতিচার: আলোর লুকোচুরি খেলা
আলোর ব্যতিচার হলো আলোর একটি বিশেষ ধর্ম। যখন দুটি আলোকরশ্মি একে অপরের ওপর আপতিত হয়, তখন তারা মিলিত হয়ে আলোর তীব্রতার পরিবর্তন ঘটায়। কোনো স্থানে আলো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, আবার কোনো স্থানে অন্ধকার হয়ে যায়। এই উজ্জ্বল এবং অন্ধকার হওয়ার ঘটনাকেই আলোর ব্যতিচার বলে। অনেকটা যেন আলো নিজের সাথে লুকোচুরি খেলছে!
ব্যতিচারের সংজ্ঞা
সহজ ভাষায়, আলোর ব্যতিচার হলো দুটি সুসংগত (coherent) আলোক তরঙ্গের উপরিপাতনের (superposition) ফলে সৃষ্ট তীব্রতার পরিবর্তন। যেখানে তরঙ্গগুলো মিলিত হয়, সেখানে আলো শক্তিশালী অথবা দুর্বল হয়ে যেতে পারে।
সুসংগত আলো কী?
এবার প্রশ্ন আসতে পারে, সুসংগত আলো (Coherent Light) আবার কী জিনিস? সুসংগত আলো হলো সেই আলোকরশ্মিগুলো, যাদের তরঙ্গদৈর্ঘ্য (wavelength), কম্পাঙ্ক (frequency) এবং দশা পার্থক্য (phase difference) সময়ের সাথে ধ্রুব থাকে। সহজভাবে বললে, আলোকরশ্মিগুলো যেন একই তালে বাঁধা।
ব্যতিচার কীভাবে ঘটে?
আলোর ব্যতিচার বুঝতে হলে তরঙ্গের উপরিপাতনের নীতি (Superposition Principle) জানতে হবে। এই নীতি অনুসারে, যখন দুটি বা ততোধিক তরঙ্গ একই স্থানে মিলিত হয়, তখন তাদের সম্মিলিত বিস্তার (amplitude) প্রতিটি তরঙ্গের বিস্তারের যোগফলের সমান হয়।
-
গঠনমূলক ব্যতিচার (Constructive Interference): যখন দুটি তরঙ্গের শীর্ষ (crest) এবং পাদ (trough) একই সময়ে মিলিত হয়, তখন তাদের বিস্তার যোগ হয়ে যায়। ফলে আলোর তীব্রতা বেড়ে যায় এবং উজ্জ্বল আলো দেখা যায়।
-
ধ্বংসাত্মক ব্যতিচার (Destructive Interference): যখন একটি তরঙ্গের শীর্ষ অন্য তরঙ্গের পাদের সাথে মিলিত হয়, তখন তাদের বিস্তার একে অপরকে বাতিল করে দেয়। ফলে আলোর তীব্রতা কমে যায় এবং অন্ধকার দেখা যায়।
দৈনন্দিন জীবনে আলোর ব্যতিচার
আপনি হয়তো ভাবছেন, “আলোর ব্যতিচার তো জটিল একটা বিষয়, এটা আবার দৈনন্দিন জীবনে কোথায় কাজে লাগে?” একটু ভালো করে লক্ষ্য করলেই দেখবেন, আপনার চারপাশে আলোর ব্যতিচারের অনেক উদাহরণ ছড়িয়ে আছে।
সাবানের বুদবুদে রংধনু
ছোটবেলায় নিশ্চয়ই সাবানের বুদবুদ দিয়ে খেলেছেন? বুদবুদের গায়ে রংধনু রঙের ঝলকানি দেখেছেন? এটা আলোর ব্যতিচারের চমৎকার একটা উদাহরণ। সাবানের বুদবুদের পাতলা স্তরের দুই পৃষ্ঠ থেকে আলোকরশ্মি প্রতিফলিত হয়ে ব্যতিচার ঘটায়। বিভিন্ন রঙের আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ভিন্ন হওয়ার কারণে বিভিন্ন স্থানে গঠনমূলক এবং ধ্বংসাত্মক ব্যতিচার সৃষ্টি হয়। ফলে আমরা বুদবুদের গায়ে রংধনু দেখতে পাই।
সিডি বা ডিভিডির পৃষ্ঠে রংধনু
সিডি বা ডিভিডির চকচকে পৃষ্ঠের দিকে তাকালে রংধনুর মতো বর্ণালী দেখা যায়। এর কারণ হলো সিডি বা ডিভিডির পৃষ্ঠে খুব ছোট ছোট খাঁজকাটা দাগ থাকে। এই খাঁজকাটা দাগগুলো আলোর дифракция (Diffraction) ঘটায় এবং তারপর ব্যতিচারের মাধ্যমে বিভিন্ন রঙের সৃষ্টি করে।
তেল বা পেট্রোলের স্তর
বৃষ্টির পরে রাস্তার পাশে জমা জলের ওপর তেলের একটা পাতলা স্তর পড়লে সেখানে রংধনুর মতো দেখা যায়। এখানেও আলোর ব্যতিচার কাজ করে। তেলের স্তরের উপরের এবং নীচের পৃষ্ঠ থেকে আলোকরশ্মি প্রতিফলিত হয়ে ব্যতিচার ঘটায়, যার ফলে বিভিন্ন রঙের সৃষ্টি হয়।
আলোর ব্যতিচারের শর্তাবলী
আলোর ব্যতিচার সবসময় ঘটে না। এর জন্য কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়:
-
আলোর উৎস সুসংগত হতে হবে: আলোর উৎস থেকে নির্গত আলোকরশ্মিগুলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য, কম্পাঙ্ক এবং দশা পার্থক্য সময়ের সাথে ধ্রুব থাকতে হবে।
-
আলোর উৎস কাছাকাছি থাকতে হবে: আলোর উৎসগুলো খুব কাছাকাছি অবস্থানে থাকতে হবে, যাতে আলোকরশ্মিগুলো প্রায় একই পথ অতিক্রম করে।
-
আলোকরশ্মিগুলোর বিস্তার সমান বা প্রায় সমান হতে হবে: আলোকরশ্মিগুলোর বিস্তার (amplitude) সমান অথবা কাছাকাছি না হলে ভালো ব্যতিচার দেখা যায় না।
আলোর ব্যতিচার এবং আলোর অপবর্তন (Diffraction)
আলোর ব্যতিচার এবং আলোর অপবর্তন – এই দুটি বিষয় প্রায়ই গুলিয়ে ফেলা হয়। তবে এদের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে।
বৈশিষ্ট্য | আলোর ব্যতিচার | আলোর অপবর্তন |
---|---|---|
সংজ্ঞা | দুটি সুসংগত আলোর উপরিপাতনের ফলে তীব্রতার পরিবর্তন | আলোর পথে কোনো প্রতিবন্ধক থাকলে আলোর বেঁকে যাওয়া |
কারণ | দুটি আলোর তরঙ্গের মধ্যে দশা পার্থক্য | আলোর তরঙ্গের অগ্রভাগের বিভিন্ন অংশের মধ্যে ব্যতিচার |
উদাহরণ | সাবানের বুদবুদে রংধনু, সিডিতে রংধনু | সিডির কিনারে আলো ফেললে বর্ণালী তৈরি হওয়া |
আলোর ব্যতিচারের প্রকারভেদ
আলোর ব্যতিচার প্রধানত দুই প্রকার:
-
তরঙ্গমুখ বিভাজন (Wavefront Division): এই পদ্ধতিতে একটি আলোক উৎস থেকে নির্গত তরঙ্গমুখকে দুটি অংশে ভাগ করা হয়। এই দুটি অংশ পরে মিলিত হয়ে ব্যতিচার সৃষ্টি করে। ইয়ং-এর দ্বি-চির পরীক্ষা (Young’s Double Slit Experiment) এই পদ্ধতির একটি উদাহরণ। এখানে, একটি আলোক উৎস থেকে আলো এসে দুটি ছোট চিরের (slit) মধ্যে দিয়ে যায় এবং তারপর ব্যতিচার সৃষ্টি করে।
-
বিস্তার বিভাজন (Amplitude Division): এই পদ্ধতিতে একটি আলোক রশ্মিকে আংশিকভাবে প্রতিফলিত ও প্রতিসরিত করে দুটি অংশে ভাগ করা হয়। এই দুটি অংশ পরে মিলিত হয়ে ব্যতিচার সৃষ্টি করে। পাতলা স্তরের ব্যতিচার (Thin Film Interference) এই পদ্ধতির একটি উদাহরণ।
ইয়ং-এর দ্বি-চির পরীক্ষা
থমাস ইয়ং ১৮০১ সালে এই পরীক্ষার মাধ্যমে আলোর তরঙ্গ তত্ত্ব প্রমাণ করেন। পরীক্ষায়, একটি আলোক উৎস থেকে আলো এসে দুটি খুব সরু চিরের (slit) মধ্যে দিয়ে যায়। এই দুটি চির থেকে নির্গত আলোকরশ্মিগুলো একে অপরের সাথে ব্যতিচার ঘটায় এবং পর্দার উপর উজ্জ্বল ও অন্ধকার ডোরা তৈরি করে।
পরীক্ষার ফলাফল
- পর্দার উপরে উজ্জ্বল এবং অন্ধকার ডোরার সৃষ্টি হয়।
- উজ্জ্বল ডোরাগুলো গঠনমূলক ব্যতিচারের (Constructive Interference) কারণে তৈরি হয়।
- অন্ধকার ডোরাগুলো ধ্বংসাত্মক ব্যতিচারের (Destructive Interference) কারণে তৈরি হয়।
- এই ডোরাগুলোর মধ্যে দূরত্ব আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য এবং চিরদ্বয়ের মধ্যে দূরত্বের উপর নির্ভর করে।
আলোর ব্যতিচারের প্রয়োগ
আলোর ব্যতিচার শুধু একটি মজার ঘটনা নয়, এর অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার রয়েছে।
-
হולוגraphy: আলোর ব্যতিচার ব্যবহার করে ত্রিমাত্রিক ছবি তৈরি করা হয়। হולוגraphy-তে, একটি রেফারেন্স আলোকরশ্মি এবং একটি বস্তু থেকে প্রতিফলিত আলোকরশ্মি একে অপরের সাথে ব্যতিচার ঘটায়, যা একটি বিশেষ ফিল্মের উপর ত্রিমাত্রিক চিত্র তৈরি করে।
-
Antireflection Coating: চশমা, ক্যামেরা লেন্স এবং অন্যান্য অপটিক্যাল ডিভাইসে আলোর প্রতিফলন কমানোর জন্য antireflection coating ব্যবহার করা হয়। এই coating-এর মূলনীতি হলো আলোর ব্যতিচার। coating-এর কারণে আলোকরশ্মিগুলো একে অপরের সাথে ধ্বংসাত্মক ব্যতিচার ঘটায়, ফলে প্রতিফলন কমে যায়।
-
Interferometry: এই পদ্ধতিতে আলোর ব্যতিচার ব্যবহার করে খুব সূক্ষ্ম পরিমাপ করা যায়। Interferometry ব্যবহার করে দূরবর্তী নক্ষত্রের দূরত্ব, মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গ এবং অন্যান্য অনেক ভৌত রাশি মাপা হয়।
আলোর ব্যতিচার নিয়ে কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ)
আলোর ব্যতিচার নিয়ে অনেকের মনে অনেক প্রশ্ন থাকে। তাই, এখানে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
-
আলোর ব্যতিচার কি আলোর কণা তত্ত্বের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ?
উত্তরঃ আলোর ব্যতিচার আলোর তরঙ্গ তত্ত্বের একটি প্রমাণ। তবে, আধুনিক কোয়ান্টাম মেকানিক্স অনুসারে, আলো একই সাথে তরঙ্গ এবং কণা হিসেবে আচরণ করতে পারে।
-
আলোর ব্যতিচার এবং অনুরণন (Resonance) কি একই জিনিস?
উত্তরঃ না, আলোর ব্যতিচার এবং অনুরণন এক নয়। ব্যতিচার হলো দুটি তরঙ্গের উপরিপাতনের ফল, যেখানে অনুরণন হলো কোনো বস্তুর স্বাভাবিক কম্পাঙ্কে কম্পিত হওয়ার প্রবণতা।
-
দিনের আলোতে কি ব্যতিচার দেখা যায়?
উত্তরঃ হ্যাঁ, দিনের আলোতেও ব্যতিচার দেখা যায়। তবে, এর জন্য আলোর উৎস সুসংগত হতে হয়।
-
আলোর ব্যতিচার ব্যবহার করে কি অদৃশ্য হওয়ার প্রযুক্তি তৈরি করা সম্ভব?
উত্তরঃ আলোর ব্যতিচার ব্যবহার করে কোনো বস্তুকে সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য করা এখনো সম্ভব নয়। তবে, cloak তৈরি করার জন্য গবেষণা চলছে, যা কোনো বস্তুর চারপাশে আলো এমনভাবে বাঁকাতে পারবে, যাতে বস্তুটি দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়।
-
আলোর ব্যতিচারে আলোর শক্তি কি সংরক্ষিত থাকে?
উত্তরঃ হ্যাঁ, আলোর ব্যতিচারে আলোর শক্তি সংরক্ষিত থাকে। কোনো স্থানে আলো উজ্জ্বল হলে অন্য স্থানে আলো কমে যায়, কিন্তু মোট শক্তি একই থাকে।
উপসংহার
আলোর ব্যতিচার একটি মজার এবং গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই ঘটনার মাধ্যমেই আমরা বুঝতে পারি আলো কীভাবে তরঙ্গ হিসেবে কাজ করে এবং এর মাধ্যমে আধুনিক প্রযুক্তিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন সম্ভব হয়েছে। সাবানের বুদবুদের রংধনু থেকে শুরু করে জটিল holography – সবখানেই আলোর ব্যতিচারের অবদান রয়েছে।
আশা করি, আজকের আলোচনা থেকে আপনি আলোর ব্যতিচার সম্পর্কে অনেক নতুন তথ্য জানতে পেরেছেন। পদার্থবিজ্ঞানের এই মজার বিষয় নিয়ে আরও জানতে চান? তাহলে আমাদের সাথেই থাকুন! কোনো প্রশ্ন থাকলে নিচে কমেন্ট করতে পারেন।