অমেরুদণ্ডী প্রাণী: যাদের মেরুদণ্ড নেই, তাদের জগৎ!
আচ্ছা, কখনো কি ভেবেছেন, আমাদের এই পৃথিবীতে মেরুদণ্ডী প্রাণীদের (যাদের পিঠের দিকে হাড় আছে) বাইরেও এক বিশাল জগৎ লুকিয়ে আছে? সেই জগতে বাস করে লক্ষ লক্ষ অমেরুদণ্ডী প্রাণী! ভাবছেন, অমেরুদণ্ডী প্রাণী কাকে বলে? এদের জীবনযাত্রা কেমন? তাহলে চলুন, আজ আমরা অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের সেই রহস্যময় জগতে ডুব দেই!
অমেরুদণ্ডী প্রাণী: পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য
অমেরুদণ্ডী প্রাণী বলতে সেই সকল প্রাণীদের বোঝায় যাদের মেরুদণ্ড বা স্পাইনাল কলাম নেই। “মেরুদণ্ড” শব্দটা শুনলেই আমাদের প্রথমেই নিজেদের কথা মনে পড়ে, তাই না? কিন্তু প্রকৃতির খেয়ালে এমন অনেক প্রাণী তৈরি হয়েছে যাদের শরীরে এই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটি নেই।
অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য
অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা তাদের মেরুদণ্ডী প্রাণীদের থেকে আলাদা করে:
- মেরুদণ্ডের অনুপস্থিতি: এদের শরীরে মেরুদণ্ড থাকে না।
- ছোট আকার: এদের অধিকাংশই ছোট আকারের হয়। তবে কিছু ব্যতিক্রমও আছে, যেমন – অক্টোপাস বা স্কুইড।
- বৈচিত্র্যময় গঠন: এদের শারীরিক গঠন খুবই বৈচিত্র্যপূর্ণ। কারো শরীর নরম, কারো শরীর শক্ত খোলসে ঢাকা।
- দ্রুত বংশবৃদ্ধি: এদের বংশবৃদ্ধির হার সাধারণত বেশি।
অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের শ্রেণীবিন্যাস
অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের বিশাল বৈচিত্র্যের কারণে এদের বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে। এদের কয়েকটি প্রধান শ্রেণী নিচে উল্লেখ করা হলো:
স্পঞ্জ (Sponges)
স্পঞ্জ হলো সরলতম বহুকোষী প্রাণী। এদের কোনো সুগঠিত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নেই। এরা সাধারণত সমুদ্রের তলদেশে কোনো কিছুর সাথে আটকে থাকে।
নিডারিয়া (Cnidaria)
এই শ্রেণীর প্রাণীদের মধ্যে জেলিফিশ, প্রবাল ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। এদের শরীর নরম এবং মুখছিদ্রের চারপাশে tentacle থাকে। এই tentacle শিকার ধরতে সাহায্য করে।
প্লাটিহেলমিনথেস (Platyhelminthes )
এই শ্রেণীর প্রাণীদের চ্যাপ্টা কৃমি বলা হয়। এরা সাধারণত পরজীবী হিসেবে অন্য প্রাণীর দেহে বাস করে। যেমন – ফিতা কৃমি।
নেমাটোডা (Nematoda)
এদের গোলকৃমি বলা হয়। এরা মাটি, জল এবং অন্যান্য প্রাণীর দেহে বাস করতে পারে।
অ্যানিলিডা (Annelida)
এই শ্রেণীর প্রাণীদের শরীর লম্বা এবং অসংখ্য খণ্ড দ্বারা গঠিত। যেমন – কেঁচো, জোঁক।
আর্থ্রোপোডা (Arthropoda)
অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় পর্ব এটি। এদের শরীর শক্ত বহিরাবরণ (exoskeleton) দ্বারা আবৃত এবং পাগুলো জোড়াযুক্ত। যেমন – insects, মাকড়সা, চিংড়ি, কাঁকড়া।
মোলাস্কা (Mollusca)
এদের শরীর নরম এবং সাধারণত একটি খোলস দ্বারা ঢাকা থাকে। যেমন – শামুক, ঝিনুক, অক্টোপাস।
এchinodermata: (Echinodermata)
এদের ত্বক কাঁটাযুক্ত। যেমন – তারা মাছ, সমুদ্র শসা।
অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের বাসস্থান
অমেরুদণ্ডী প্রাণীরা প্রায় সকল পরিবেশে বাস করতে পারে। এদের কেউ বাস করে সমুদ্রে, কেউ মিষ্টি জলে, আবার কেউ মাটিতে। এমনকি কিছু অমেরুদণ্ডী প্রাণী অন্য জীবের শরীরে পরজীবী হিসেবেও বাস করে।
সমুদ্রের অমেরুদণ্ডী প্রাণী
সমুদ্র অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের এক বিশাল আবাসস্থল। এখানে স্পঞ্জ, জেলিফিশ, প্রবাল, শামুক, ঝিনুক, অক্টোপাস, তারা মাছের মতো অসংখ্য অমেরুদণ্ডী প্রাণী বাস করে। এদের মধ্যে অনেকেই সমুদ্রের খাদ্যচক্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
মিষ্টি জলের অমেরুদণ্ডী প্রাণী
পুকুর, নদী, হ্রদের মতো মিষ্টি জলের আবাসস্থলে বিভিন্ন ধরনের অমেরুদণ্ডী প্রাণী দেখা যায়। যেমন – কিছু কীট, মশা, চিংড়ি, শামুক ইত্যাদি।
মাটির অমেরুদণ্ডী প্রাণী
মাটিতেও অনেক অমেরুদণ্ডী প্রাণী বাস করে, যারা মাটির উর্বরতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। কেঁচো তাদের মধ্যে অন্যতম। এছাড়াও পিঁপড়া, উইপোকা, বিভিন্ন ধরনের কৃমি মাটিতে বাস করে।
পরজীবী অমেরুদণ্ডী প্রাণী
কিছু অমেরুদণ্ডী প্রাণী অন্য জীবের শরীরে পরজীবী হিসেবে বাস করে এবং তাদের থেকে খাদ্য গ্রহণ করে। ফিতা কৃমি, গোলকৃমি এর উদাহরণ।
অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের খাদ্য
অমেরুদণ্ডী প্রাণীরা বিভিন্ন ধরনের খাদ্য গ্রহণ করে। কিছু প্রাণী ছোট উদ্ভিদ বা প্ল্যাঙ্কটন খায়, আবার কিছু প্রাণী অন্য ছোট জীবজন্তু শিকার করে খায়। কিছু অমেরুদণ্ডী প্রাণী মৃত জৈব পদার্থ খেয়ে পরিবেশ পরিষ্কার রাখে।
শাকাশী অমেরুদণ্ডী প্রাণী
কিছু অমেরুদণ্ডী প্রাণী শুধু উদ্ভিদ বা উদ্ভিজ্জ খাদ্য গ্রহণ করে। যেমন – কিছু শামুক, কীট।
মাংসাশী অমেরুদণ্ডী প্রাণী
কিছু অমেরুদণ্ডী প্রাণী অন্য জীবজন্তু শিকার করে খায়। যেমন – মাকড়সা, জেলিফিশ।
পরজীবী অমেরুদণ্ডী প্রাণী
পরজীবী অমেরুদণ্ডী প্রাণীরা অন্য জীবের শরীর থেকে রক্ত বা অন্যান্য পুষ্টিকর পদার্থ শোষণ করে বেঁচে থাকে।
অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের গুরুত্ব
অমেরুদণ্ডী প্রাণীরা আমাদের পরিবেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
- খাদ্যচক্রে ভূমিকা: এরা খাদ্যচক্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অনেক মেরুদণ্ডী প্রাণী অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে।
- পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা: কিছু অমেরুদণ্ডী প্রাণী মৃত জৈব পদার্থ খেয়ে পরিবেশ পরিষ্কার রাখে।
- মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি: কেঁচোর মতো প্রাণী মাটিতে বাস করে মাটির উর্বরতা বাড়ায়।
- পরাগায়ন: অনেক insect পরাগায়নের মাধ্যমে উদ্ভিদের বংশবিস্তারে সাহায্য করে।
- চিকিৎসা ক্ষেত্রে: কিছু অমেরুদণ্ডী প্রাণী থেকে ওষুধ তৈরি করা হয়।
অমেরুদণ্ডী প্রাণী সম্পর্কিত কিছু মজার তথ্য
অমেরুদণ্ডী প্রাণীজগৎ নানা রকম বিস্ময়ে ভরা। এদের সম্পর্কে কিছু মজার তথ্য নিচে দেওয়া হলো:
- কিছু জেলিফিশ অমর! Turritopsis dohrn নামের জেলিফিশ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজেকে পলিপ দশায় ফিরিয়ে আনতে পারে এবং আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে পারে।
- অক্টোপাসের তিনটি হৃদপিণ্ড এবং নয়টি মস্তিষ্ক আছে! এদের দুটি হৃদপিণ্ড সারা শরীরে রক্ত সরবরাহ করে এবং অন্যটি শুধুমাত্র ফুলকায় রক্ত সরবরাহ করে।
- পিঁপড়ারা তাদের শরীরের চেয়ে ৫০ গুণ বেশি ওজন বহন করতে পারে।
- কিছু প্রজাপতি তাদের পায়ের সাহায্যে স্বাদ গ্রহণ করে!
অমেরুদণ্ডী প্রাণী: কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ)
অমেরুদণ্ডী প্রাণী নিয়ে আপনাদের মনে কিছু প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক। তাই নিচে কয়েকটি সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
সবচেয়ে বড় অমেরুদণ্ডী প্রাণী কোনটি?
সবচেয়ে বড় অমেরুদণ্ডী প্রাণী হলো কলোসাল স্কুইড (Colossal Squid)। এটি প্রায় ১২-১৪ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে।
সবচেয়ে ছোট অমেরুদণ্ডী প্রাণী কোনটি?
সবচেয়ে ছোট অমেরুদণ্ডী প্রাণী হলো রটিফার (Rotifers)। এগুলো আকারে খুবই ছোট হয়, এমনকি এদের খালি চোখে দেখাও যায় না।
অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের জীবনকাল কতদিন?
অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের জীবনকাল বিভিন্ন হয়। কিছু প্রাণী কয়েক ঘণ্টা বাঁচে, আবার কিছু প্রাণী কয়েক বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে।
অমেরুদণ্ডী প্রাণীরা কি রোগ ছড়ায়?
হ্যাঁ, কিছু অমেরুদণ্ডী প্রাণী রোগ ছড়াতে পারে। যেমন – মশা ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ইত্যাদি রোগ ছড়ায়।
কীটপতঙ্গ কি অমেরুদণ্ডী প্রাণী?
হ্যাঁ, কীটপতঙ্গ আর্থ্রোপোডা পর্বের অন্তর্গত, যা অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় পর্ব।
কেন অমেরুদণ্ডী প্রাণীরা গুরুত্বপূর্ণ?
অমেরুদণ্ডী প্রাণীরা খাদ্য শৃঙ্খল এবং বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও, এরা পরিবেশ পরিষ্কার রাখতে এবং মাটির উর্বরতা বাড়াতে সাহায্য করে।
কীভাবে অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের সংরক্ষণ করা যায়?
অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের সংরক্ষণের জন্য তাদের আবাসস্থল রক্ষা করা, দূষণ কমানো, এবং কীটনাশকের ব্যবহার কমানো প্রয়োজন।
অমেরুদণ্ডী প্রাণী: উপসংহার
অমেরুদণ্ডী প্রাণীরা আমাদের পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এদের সম্পর্কে জানা আমাদের পরিবেশ সম্পর্কে জ্ঞানকে আরও সমৃদ্ধ করে। এই প্রাণীদের রক্ষা করা আমাদের সকলের দায়িত্ব। তাহলে, আজ থেকেই না হয় আমরা আমাদের চারপাশের অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের প্রতি আরও একটু বেশি মনোযোগ দেই, কেমন হয় বলুন তো?