আসুন শুরু করি!
আচ্ছা, ধরুন আপনার প্রিয় স্মার্টফোনটি চার্জ দেওয়ার জন্য বিদ্যুতের প্রয়োজন। সেই বিদ্যুৎ কোত্থেকে আসে জানেন তো? হতে পারে সৌরবিদ্যুৎ থেকে আসছে, আবার হতে পারে কয়লা পুড়িয়ে তৈরি করা হচ্ছে! এই যে কয়লা, এটা কিন্তু অনবায়নযোগ্য শক্তি (Non-renewable energy)। তার মানে একবার শেষ হয়ে গেলে, সহজে আর পাওয়া যাবে না। চলুন, “অনবায়নযোগ্য শক্তি কাকে বলে” – এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজি এবং এই সম্পর্কিত নানা বিষয় জেনে আসি!
অনবায়নযোগ্য শক্তি: যখন ফুরিয়ে যায়…
অনবায়নযোগ্য শক্তি হলো সেই সব শক্তির উৎস, যা একবার ব্যবহার করার পর পুনরায় তৈরি হতে অনেক সময় নেয় – কয়েক হাজার বছর থেকে কয়েক লক্ষ বছর পর্যন্ত! এই সময়ের মধ্যে সেগুলি প্রায় ফুরিয়ে যায় বলাই ভালো। অনেকটা আপনার দাদুর আমলের অ্যান্টিক ঘড়ির মতো, যা আর তৈরি করা যায় না।
অনবায়নযোগ্য শক্তির উৎসগুলো কী কী?
পৃথিবীতে অনবায়নযোগ্য শক্তির বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উৎস রয়েছে। তাদের কয়েকটা নিয়ে আলোচনা করা যাক:
কয়লা: কালো হীরের গল্প
কয়লা হলো প্রধান অনবায়নযোগ্য শক্তি উৎস। যুগ যুগ ধরে মাটির নিচে চাপা পড়া গাছপালা থেকে এটি তৈরি হয়। এই কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ তৈরি করা হয়, যা আমাদের ঘরবাড়ি আলোকিত করে, কলকারখানা চালায়। তবে কয়লা পোড়ালে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হয়, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।
কয়লার প্রকারভেদ
কয়লা বিভিন্ন প্রকারের হয়, যেমন:
- পিট কয়লা (Peat): এটি সবচেয়ে নিম্নমানের কয়লা, যাতে কার্বনের পরিমাণ কম থাকে।
- লিগনাইট কয়লা (Lignite): এটি পিট কয়লার চেয়ে একটু ভালো, তবে এতেও অনেক ভেজা উপাদান থাকে।
- বিটোমিনাস কয়লা (Bituminous): এটি মাঝারি মানের কয়লা এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বহুল ব্যবহৃত।
- অ্যানথ্রাসাইট কয়লা (Anthracite): এটি সবচেয়ে উন্নত মানের কয়লা, যাতে কার্বনের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি এবং এটি পোড়ালে ধোঁয়া কম হয়।
পেট্রোলিয়াম বা খনিজ তেল: মাটির তলার তরল সোনা
পেট্রোলিয়াম একটি গুরুত্বপূর্ণ জীবাশ্ম জ্বালানি। এটি মূলত সমুদ্রের নিচে থাকা মৃত জীবজন্তু ও উদ্ভিদের অবশেষ থেকে তৈরি হয়। পেট্রোলিয়াম থেকে পেট্রল, ডিজেল, কেরোসিন ইত্যাদি তৈরি করা হয়, যা যানবাহন চালাতে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে এবং অন্যান্য শিল্পে ব্যবহার করা হয়।
পেট্রোলিয়ামের ব্যবহার
পেট্রোলিয়ামের ব্যবহার বহুমুখী:
- পরিবহন: গাড়ি, বাস, ট্রাক, উড়োজাহাজ ইত্যাদি চালাতে পেট্রোল ও ডিজেল ব্যবহার করা হয়।
- বিদ্যুৎ উৎপাদন: অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পেট্রোলিয়াম পুড়িয়ে বিদ্যুৎ তৈরি করা হয়।
- শিল্প: প্লাস্টিক, রাবার, কীটনাশকসহ বিভিন্ন শিল্পে পেট্রোলিয়াম ব্যবহৃত হয়।
প্রাকৃতিক গ্যাস: প্রকৃতির গ্যাসীয় সম্পদ
প্রাকৃতিক গ্যাস হলো মিথেন, ইথেন ইত্যাদি গ্যাসের মিশ্রণ। এটি পেট্রোলিয়ামের মতোই মাটির নিচে পাওয়া যায়। প্রাকৃতিক গ্যাস সরাসরি চুলায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়, বিদ্যুৎ উৎপাদনে কাজে লাগে এবং বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য তৈরিতেও লাগে।
প্রাকৃতিক গ্যাসের সুবিধা
প্রাকৃতিক গ্যাসের কিছু উল্লেখযোগ্য সুবিধা হলো:
- পরিবেশবান্ধব: কয়লা ও পেট্রোলিয়ামের তুলনায় এটি কম দূষণ ঘটায়।
- সহজলভ্য: পাইপলাইনের মাধ্যমে সহজেই পরিবহন করা যায়।
- বহুমুখী ব্যবহার: এটি বিদ্যুৎ উৎপাদন, শিল্প এবং গৃহস্থালীর কাজে ব্যবহার করা যায়।
নিউক্লিয়ার শক্তি: পরমাণুর শক্তি
নিউক্লিয়ার শক্তি হলো ইউরেনিয়াম বা প্লুটোনিয়ামের মতো তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে পাওয়া শক্তি। এই পদার্থগুলোর পরমাণু ভাঙলে প্রচুর পরিমাণে তাপ উৎপন্ন হয়, যা দিয়ে বিদ্যুৎ তৈরি করা হয়।
নিউক্লিয়ার শক্তির সুবিধা ও অসুবিধা
নিউক্লিয়ার শক্তির কিছু সুবিধা ও অসুবিধা রয়েছে:
- সুবিধা: এটি অল্প পরিমাণ জ্বালানি থেকে অনেক বেশি শক্তি উৎপাদন করতে পারে।
- অসুবিধা: এটি তেজস্ক্রিয় বর্জ্য তৈরি করে, যা পরিবেশ ও মানুষের জন্য ক্ষতিকর। এছাড়াও, নিউক্লিয়ার দুর্ঘটনা ঘটলে মারাত্মক বিপর্যয় হতে পারে।
কেন এই শক্তি অনবায়নযোগ্য?
কারণ একটাই- এগুলো তৈরি হতে লক্ষ লক্ষ বছর সময় লাগে! ধরুন, কয়লা তৈরি হওয়ার জন্য মাটির নিচে চাপা পড়া গাছপালা এবং অন্যান্য জৈব পদার্থকে প্রথমে পিটে পরিণত হতে হয়। তারপর ধীরে ধীরে তাপ ও চাপের ফলে লিগনাইট, বিটুমিনাস এবং সবশেষে অ্যানথ্রাসাইট কয়লায় রূপান্তরিত হয়। এই পুরো প্রক্রিয়াটি এতটাই ধীর গতির যে, মানুষের জীবনকালে এর পুনরাবৃত্তি দেখা প্রায় অসম্ভব। তাই এগুলোকে অনবায়নযোগ্য বলা হয়।
অনবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার: আমাদের জীবনে এর প্রভাব
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অনবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার ব্যাপক। একটু খেয়াল করলেই দেখবেন:
- বিদ্যুৎ উৎপাদন: কয়লা, তেল এবং গ্যাস ব্যবহার করে বিদ্যুৎ তৈরি করা হয়, যা আমাদের ঘরবাড়ি আলোকিত করে, ফ্যান চালায়, এবং মোবাইল ফোন চার্জ করে।
- পরিবহন: গাড়ি, বাস, উড়োজাহাজ – সবকিছুই চলে পেট্রোল, ডিজেল অথবা গ্যাসের সাহায্যে।
- শিল্পকারখানা: বিভিন্ন শিল্পকারখানায় যন্ত্র চালানোর জন্য অনবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করা হয়।
- গৃহস্থালি: রান্নার গ্যাস থেকে শুরু করে হিটার – সবকিছুতেই এর ব্যবহার রয়েছে।
অনবায়নযোগ্য শক্তির সুবিধা এবং অসুবিধা
যেকোনো জিনিসের ভালো-খারাপ দুটো দিকই থাকে। অনবায়নযোগ্য শক্তিরও কিছু সুবিধা আছে, আবার কিছু অসুবিধাও আছে। চলুন, সেগুলো জেনে নেওয়া যাক:
সুবিধা:
- সহজলভ্যতা: এই শক্তিগুলো সহজে পাওয়া যায়। কয়লা বা তেলের খনি থেকে এগুলো উত্তোলন করা বেশ সহজ।
- নির্ভরযোগ্যতা: চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এগুলো বেশ নির্ভরযোগ্য। যখন প্রয়োজন, তখনই ব্যবহার করা যায়।
- উচ্চ শক্তি উৎপাদন ক্ষমতা: অল্প পরিমাণ জ্বালানি ব্যবহার করেই অনেক বেশি শক্তি পাওয়া যায়।
অসুবিধা:
- দূষণ: অনবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের ফলে বায়ু দূষণ, পানি দূষণ এবং মাটি দূষণ হয়। কয়লা পোড়ালে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত হয়, যা গ্রিনহাউস গ্যাস এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণ।
- সীমিত উৎস: এই শক্তিগুলোর উৎস সীমিত। একবার শেষ হয়ে গেলে, সহজে আর পাওয়া যাবে না।
- পরিবেশের ক্ষতি: খনি থেকে কয়লা বা তেল উত্তোলনের সময় পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়। বনভূমি ধ্বংস হয়, জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয় এবং মাটি দূষিত হয়।
alternatives of অনবায়নযোগ্য শক্তি
তাহলে উপায় কী? একটাই পথ খোলা আছে, তা হলো নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়ানো। নবায়নযোগ্য শক্তি মানে হলো সেই শক্তি, যা পুনরায় ব্যবহার করা যায় এবং যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নয়। যেমন – সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, জলবিদ্যুৎ, ইত্যাদি।
নবায়নযোগ্য শক্তির কিছু উদাহরণ:
- সৌরশক্তি: সূর্যের আলো ব্যবহার করে বিদ্যুৎ তৈরি করা।
- বায়ুশক্তি: বাতাস ব্যবহার করে টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ তৈরি করা।
- জলবিদ্যুৎ: নদীর স্রোত ব্যবহার করে টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ তৈরি করা।
- বায়োমাস: জৈব পদার্থ (যেমন – গাছপালা, খড়কুটো, ইত্যাদি) ব্যবহার করে শক্তি উৎপাদন করা।
FAQ: কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা
এখন কিছু সাধারণ প্রশ্ন এবং তাদের উত্তর জেনে নেওয়া যাক, যা আপনাদের মনে প্রায়ই উঁকি দেয়:
জীবাশ্ম জ্বালানি কি অনবায়নযোগ্য শক্তি?
জ্বি, অবশ্যই। জীবাশ্ম জ্বালানি, যেমন – কয়লা, পেট্রোলিয়াম এবং প্রাকৃতিক গ্যাস হলো অনবায়নযোগ্য শক্তি। কারণ এগুলো তৈরি হতে লক্ষ লক্ষ বছর লাগে এবং একবার ব্যবহার করলে তা শেষ হয়ে যায়।
কেন আমাদের অনবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার কমানো উচিত?
কারণ একটাই – পরিবেশের সুরক্ষা! অনবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের ফলে পরিবেশ দূষিত হয়, গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হয় এবং জলবায়ু পরিবর্তন হয়। তাই আমাদের উচিত নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়ানো।
কোন অনবায়নযোগ্য শক্তি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়?
কয়লা। এখনো পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লা সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। তবে ধীরে ধীরে অন্যান্য শক্তির ব্যবহার বাড়ছে।
অনবায়নযোগ্য শক্তি কি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর?
অবশ্যই। অনবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের ফলে পরিবেশের অনেক ক্ষতি হয়। বায়ু দূষণ, পানি দূষণ, মাটি দূষণ – সবকিছুই এর কারণে হয়।
কীভাবে আমরা অনবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার কমাতে পারি?
সহজ উপায় হলো নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়ানো। সৌরবিদ্যুৎ, বায়ুবিদ্যুৎ এবং জলবিদ্যুৎ ব্যবহার করে আমরা অনবায়নযোগ্য শক্তির উপর নির্ভরতা কমাতে পারি।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অনবায়নযোগ্য শক্তির ভবিষ্যৎ কী?
বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত অনবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বেশি। তবে সরকার নবায়নযোগ্য শক্তির প্রসারে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। আশা করা যায়, ভবিষ্যতে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের পরিমাণ বাড়বে।
অনবায়নযোগ্য শক্তি নিয়ে কিছু মজার তথ্য
- কয়লা তৈরি হতে প্রায় ৩০০-৩৬০ মিলিয়ন বছর লেগেছিল!
- পেট্রোলিয়াম শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘পেট্রা’ (পাথর) এবং ‘ওলিয়াম’ (তেল) থেকে।
- পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কয়লা খনিটি রয়েছে চীনে।
- প্রাকৃতিক গ্যাসকে পরিবেশ-বান্ধব জ্বালানি হিসেবে ধরা হয়, কারণ এটি কয়লার চেয়ে কম কার্বন নির্গমন করে।
আমাদের করণীয়
আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করলে অনবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার কমাতে পারি। আসুন, আমরা কিছু সহজ পদক্ষেপ নেই:
- বিদ্যুৎ সাশ্রয় করি: অপ্রয়োজনীয় লাইট ও ফ্যান বন্ধ রাখি।
- নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করি: সৌর প্যানেল ব্যবহার করে নিজের বাড়ির বিদ্যুৎ নিজেই তৈরি করি।
- পরিবহনে সচেতন হই: ব্যক্তিগত গাড়ির বদলে সাইকেল বা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করি।
- সচেতনতা তৈরি করি: বন্ধু-বান্ধব ও পরিবারের সদস্যদের অনবায়নযোগ্য শক্তির ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জানাই।
উপসংহার:
অনবায়নযোগ্য শক্তি আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও, এর ক্ষতিকর প্রভাবগুলো উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুস্থ ও সুন্দর পৃথিবী গড়তে আমাদের নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে মনোযোগ দিতে হবে। আপনার ছোট একটি পদক্ষেপও এই পরিবর্তনে বিশাল ভূমিকা রাখতে পারে।