আসুন, রসায়নের গভীরে ডুব দেই! আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর (Relative Atomic Mass) জিনিসটা আসলে কী, সেটা নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে। ভয় নেই, জটিল সংজ্ঞা আর কঠিন ভাষায় না গিয়ে, সহজভাবে বিষয়টা বুঝিয়ে দেব। আপনি যদি রসায়ন ক্লাসের ছাত্র হন বা শুধু রসায়নের প্রতি আগ্রহী হন, তাহলে এই ব্লগ পোস্টটি আপনার জন্য।
আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর: একদম জলের মতো সোজা!
আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর হলো কোনো মৌলের একটি পরমাণুর ভরকে কার্বন-১২ (Carbon-12) আইসোটোপের ভরের ১/১২ অংশের সাথে তুলনা করে প্রকাশ করা। অনেকটা এরকম, ধরুন বাজারে গিয়ে আপনি একটি তরমুজ কিনলেন। বিক্রেতা আপনাকে বলল, “এই তরমুজটা ৫ কেজি।” এখানে কেজি হলো ভরের একক। আপেক্ষিক পারমাণবিক ভরও অনেকটা তেমনই, তবে এখানে ভরের এককটা একটু অন্যরকম।
আপেক্ষিক পারমাণবিক ভরের সংজ্ঞা (Relative Atomic Mass Definition)
কোনো মৌলের একটি পরমাণুর গড় ভরকে কার্বন-১২ আইসোটোপের একটি পরমাণুর ভরের ১/১২ অংশ দ্বারা ভাগ করলে যে সংখ্যা পাওয়া যায়, তাকে ঐ মৌলের আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর বলে। এর কোনো একক নেই।
এই সংজ্ঞাটা একটু জটিল মনে হচ্ছে? চিন্তা নেই, আরও সহজ করে বুঝিয়ে দিচ্ছি।
কেন আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর দরকার?
আমরা জানি পরমাণুগুলো খুবই ছোট। তাদের ভর মাপাটা খুব কঠিন। তাই বিজ্ঞানীরা একটা বুদ্ধি বের করলেন। তারা কার্বন-১২ আইসোটোপকে একটা স্ট্যান্ডার্ড ধরলেন। কার্বন-১২ এর ভরকে ১২ ধরে, অন্যান্য মৌলের পরমাণুর ভর এর সাথে তুলনা করলেন।
তাহলে, আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর আসলে একটা তুলনামূলক মাপকাঠি। এটা দিয়ে আমরা বুঝতে পারি, একটা মৌলের পরমাণু কার্বন-১২ এর তুলনায় কত ভারী।
আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর কিভাবে বের করা হয়?
আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর বের করার জন্য, প্রথমে জানতে হবে ঐ মৌলের আইসোটোপগুলো সম্পর্কে। আইসোটোপ কী, ভাবছেন?
আইসোটোপ (Isotope): একই মৌলের ভিন্ন রূপ
আইসোটোপ হলো একই মৌলের ভিন্ন পরমাণু, যাদের প্রোটন সংখ্যা একই কিন্তু নিউট্রন সংখ্যা ভিন্ন। যেমন, হাইড্রোজেনের তিনটি আইসোটোপ আছে: প্রোটিয়াম (Protium), ডিউটেরিয়াম (Deuterium) এবং ট্রিটিয়াম (Tritium)। এদের প্রত্যেকের প্রোটন সংখ্যা ১, কিন্তু নিউট্রন সংখ্যা যথাক্রমে ০, ১ এবং ২।
আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর বের করার নিয়ম
আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর বের করতে হলে, প্রথমে প্রতিটি আইসোটোপের ভর এবং প্রকৃতিতে তাদের প্রাচুর্য (abundance) জানতে হয়। তারপর নিচের সূত্র ব্যবহার করে আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর নির্ণয় করা হয়:
আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর = Σ (আইসোটোপের ভর x প্রকৃতিতে প্রাচুর্য)/100
এখানে Σ মানে হলো summation বা যোগফল।
একটি উদাহরণ: ক্লোরিনের আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর
ক্লোরিনের দুটি আইসোটোপ রয়েছে: ক্লোরিন-৩৫ (35Cl) এবং ক্লোরিন-৩৭ (37Cl)। প্রকৃতিতে এদের প্রাচুর্য হলো যথাক্রমে ৭৫.৭৭% এবং ২৪.২৩%।
তাহলে, ক্লোরিনের আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর হবে:
(৩৫ x ৭৫.৭৭ + ৩৭ x ২৪.২৩) / ১০০ = ৩৫.৪৫
সুতরাং, ক্লোরিনের আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর হলো ৩৫.৪৫।
আইসোটোপ | ভর | প্রকৃতিতে প্রাচুর্য (%) |
---|---|---|
ক্লোরিন-৩৫ | ৩৫ | ৭৫.৭৭ |
ক্লোরিন-৩৭ | ৩৭ | ২৪.২৩ |
আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর এবং পারমাণবিক ভর: পার্থক্যটা কোথায়?
অনেকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর আর পারমাণবিক ভর কি একই জিনিস? উত্তর হলো, না। এদের মধ্যে কিছু সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে।
-
পারমাণবিক ভর (Atomic mass): একটি নির্দিষ্ট পরমাণুর প্রকৃত ভরকে পারমাণবিক ভর বলে। একে সাধারণত পারমাণবিক ভর একক (atomic mass unit বা amu) দিয়ে প্রকাশ করা হয়।
-
আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর (Relative atomic mass): এটি হলো একটি মৌলের পরমাণুর গড় ভর, যা কার্বন-১২ আইসোটোপের ভরের ১/১২ অংশের সাথে তুলনা করে প্রকাশ করা হয়। এর কোনো একক নেই।
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, পারমাণবিক ভর হলো একটা পরমাণুর “ওজন”, আর আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর হলো সেই “ওজনটা” কার্বনের সাথে তুলনা করে বলা।
আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর কেন প্রয়োজন?
আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর রসায়নের বিভিন্ন হিসাব-নিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এর কয়েকটি উদাহরণ নিচে দেওয়া হলো:
-
মোল সংখ্যা নির্ণয়: কোনো পদার্থের মোল সংখ্যা বের করতে আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর ব্যবহার করা হয়।
-
রাসায়নিক বিক্রিয়ার সমীকরণ: রাসায়নিক বিক্রিয়ার সমীকরণ লেখার সময় আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর কাজে লাগে।
-
যৌগের শতকরা সংযুক্তি: কোনো যৌগে বিভিন্ন মৌলের শতকরা পরিমাণ নির্ণয় করতে আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর লাগে।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ মৌলের আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর
এখানে কয়েকটি প্রয়োজনীয় মৌলের আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর দেওয়া হলো:
মৌল (Element) | প্রতীক (Symbol) | আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর |
---|---|---|
হাইড্রোজেন (Hydrogen) | H | ১.০০৮ |
কার্বন (Carbon) | C | ১২.০১ |
নাইট্রোজেন (Nitrogen) | N | ১৪.০০৭ |
অক্সিজেন (Oxygen) | O | ১৫.৯৯৯ |
সোডিয়াম (Sodium) | Na | ২৩.০০ |
ম্যাগনেসিয়াম (Magnesium) | Mg | ২৪.৩০৫ |
অ্যালুমিনিয়াম (Aluminum) | Al | ২৬.৯৮২ |
ফসফরাস (Phosphorus) | P | ৩০.৯৭৪ |
সালফার (Sulfur) | S | ৩২.০৬৫ |
ক্লোরিন (Chlorine) | Cl | ৩৫.৪৫ |
পটাশিয়াম (Potassium) | K | ৩৯.১০০ |
ক্যালসিয়াম (Calcium) | Ca | ৪০.০৭৮ |
আয়রন (Iron) | Fe | ৫৫.৮৪৫ |
কপার (Copper) | Cu | ৬৩.৫৪৬ |
জিংক (Zinc) | Zn | ৬৫.৩৮ |
সিলভার (Silver) | Ag | ১০৭.৮৬৮ |
আয়োডিন (Iodine) | I | ১২৬.৯০৪ |
গোল্ড (Gold) | Au | ১৯৬.৯৬৭ |
মার্কারি (Mercury) | Hg | ২০০.৫৯ |
সীসা (Lead) | Pb | ২০৭.২ |
ইউরেনিয়াম (Uranium) | U | ২৩৮.০২৮ |
আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন (FAQ)
এখানে আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন এবং তার উত্তর দেওয়া হলো:
আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর কি পরিবর্তন হয়?
সাধারণত, আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর পরিবর্তন হয় না। কারণ এটা বিভিন্ন আইসোটোপের প্রাচুর্যের উপর নির্ভর করে এবং প্রকৃতিতে আইসোটোপের প্রাচুর্য প্রায় একই থাকে।
আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর কিভাবে মনে রাখব?
সব মৌলের আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর মুখস্ত রাখা সম্ভব নয়। তবে, পরীক্ষার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ মৌলের ভর মনে রাখতে পারেন। পর্যায় সারণি দেখেও অনেক মৌলের ভর জানা যায়।
আপেক্ষিক আণবিক ভর (Relative Molecular Mass) কি?
আপেক্ষিক আণবিক ভর হলো কোনো যৌগের একটি অণুর ভরকে কার্বন-১২ আইসোটোপের ভরের ১/১২ অংশের সাথে তুলনা করে প্রকাশ করা। এটি যৌগের গাঠনিক সংকেতের মাধ্যমে বের করা যায়।
আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর নির্ণয়ের গুরুত্ব কি?
আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর রসায়নের বিভিন্ন গাণিতিক সমস্যার সমাধানে অপরিহার্য। এটি মোল সংখ্যা নির্ণয়, রাসায়নিক সমীকরণ সমাধান এবং যৌগের শতকরা সংযুক্তি বের করতে কাজে লাগে।
আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর এবং মোলার ভর (Molar Mass) কি একই?
না, আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর এবং মোলার ভর এক নয়। আপেক্ষিক পারমাণবিক ভরের কোনো একক নেই, কিন্তু মোলার ভরের একক হলো গ্রাম/মোল (g/mol)। মোলার ভর হলো এক মোল পরিমাণ কোনো পদার্থের ভর।
“amu” মানে কী?
“amu” হলো atomic mass unit বা পারমাণবিক ভর একক। এটি পরমাণু এবং অণুর ভর প্রকাশের একক।
আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর কিভাবে পর্যায় সারণিতে সাজানো হয়?
পর্যায় সারণিতে মৌলগুলোকে তাদের পারমাণবিক সংখ্যা (atomic number) অনুযায়ী সাজানো হয়। পারমাণবিক সংখ্যা হলো কোনো মৌলের পরমাণুর নিউক্লিয়াসে থাকা প্রোটনের সংখ্যা। তবে, পর্যায় সারণিতে মৌলগুলোর আপেক্ষিক পারমাণবিক ভরও উল্লেখ করা থাকে।
কার্বন-১২ (Carbon-12) কেন স্ট্যান্ডার্ড?
কার্বন-১২ আইসোটোপকে স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে ধরা হয়েছে কারণ এটি প্রকৃতিতে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় এবং এটি স্থিতিশীল। এছাড়া, কার্বন জীবজগতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর বের করার সময় আইসোটোপের প্রাচুর্য কেন প্রয়োজন?
কোনো মৌলের বিভিন্ন আইসোটোপ প্রকৃতিতে বিভিন্ন অনুপাতে থাকে। আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর বের করার সময়, প্রতিটি আইসোটোপের প্রাচুর্য বিবেচনা করা হয় যাতে গড় ভর সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায়।
শেষ কথা
আশা করি, আপেক্ষিক পারমাণবিক ভর নিয়ে আপনার মনে আর কোনো দ্বিধা নেই। রসায়ন মজার একটা বিষয়, শুধু একটু মনোযোগ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করতে হয়। নিয়মিত অনুশীলন করলে আপনিও রসায়নের জটিল বিষয়গুলো সহজে আয়ত্ত করতে পারবেন।
যদি এই ব্লগ পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে, তাহলে অবশ্যই বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন। আর কোনো প্রশ্ন থাকলে, নিচে কমেন্ট করে জানাতে পারেন! হ্যাপি লার্নিং!