আলো ঝলমলে দিনে, দিগন্তের দিকে তাকিয়ে কখনও মনে হয়েছে আলো যেন বেঁকে যাচ্ছে? অথবা, জলে ডোবানো পেনসিলটাকে দেখলে মনে হয় যেন ওটা মাঝখান থেকে ভেঙে গেছে? এই সমস্ত ঘটনার পিছনে লুকিয়ে আছে আলোর প্রতিসরণের খেলা। আর এই প্রতিসরণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক। তাই, “আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক কাকে বলে?” – এই প্রশ্নের উত্তর আজ আমরা খুঁজে বের করব, একদম সহজ ভাষায়! চলুন, আলোর জগতে ডুব দেওয়া যাক!
আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক: আলোর বাঁকানো পথের হিসাব
আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক (Relative Refractive Index) হলো দুটি মাধ্যমের প্রতিসরাঙ্ক এর অনুপাত। আলোর একটি নির্দিষ্ট মাধ্যমে বেগ কত, তার ওপর নির্ভর করে ঐ মাধ্যমের প্রতিসরাঙ্ক। যখন আলো একটি মাধ্যম থেকে অন্য মাধ্যমে যায়, তখন আলোর গতির পরিবর্তন হয় ও দিক পরিবর্তিত হয়। এই দিক পরিবর্তনের পরিমাণ নির্ভর করে মাধ্যম দুটির প্রতিসরাঙ্কের ওপর।
প্রতিসরাঙ্ক (Refractive Index) কি?
আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক বুঝতে হলে আগে জানতে হবে প্রতিসরাঙ্ক কী। কোনো মাধ্যমে আলোর বেগ শূন্য মাধ্যমে আলোর বেগের কত গুণ কম, সেই সংখ্যাই হলো ঐ মাধ্যমের প্রতিসরাঙ্ক। একে প্রায়শই n অক্ষর দিয়ে প্রকাশ করা হয়।
প্রতিসরাঙ্ক ( (n) ) = ( \frac{c}{v} )
এখানে,
- ( c ) হলো শূন্য মাধ্যমে আলোর দ্রুতি (প্রায় (3 \times 10^8) মিটার/সেকেন্ড)
- ( v ) হলো নির্দিষ্ট মাধ্যমে আলোর দ্রুতি।
প্রতিসরাঙ্ক একটি মাধ্যম থেকে আলো কত সহজে যেতে পারে, তার একটি পরিমাপ। এর মান সবসময় ১ বা তার বেশি হয়।
আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক কিভাবে কাজ করে?
ধরা যাক, আলো মাধ্যম 1 থেকে মাধ্যম 2-তে প্রবেশ করছে। তাহলে মাধ্যম 2 এর সাপেক্ষে মাধ্যম 1 এর আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক হবে:
( n_{12} = \frac{n_1}{n_2} )
এখানে,
- ( n_{12} ) হলো মাধ্যম 2 এর সাপেক্ষে মাধ্যম 1 এর আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক।
- ( n_1 ) হলো মাধ্যম 1 এর প্রতিসরাঙ্ক।
- ( n_2 ) হলো মাধ্যম 2 এর প্রতিসরাঙ্ক।
এই সূত্র থেকে আমরা বুঝতে পারি, আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক হলো দুটি মাধ্যমের প্রতিসরাঙ্কের তুলনা। এর মাধ্যমে জানা যায়, আলো একটি মাধ্যম থেকে অন্য মাধ্যমে প্রবেশ করলে কতটুকু বেঁকে যাবে।
আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্কের প্রয়োজনীয়তা
আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক শুধু একটি সংজ্ঞা নয়, এর অনেক ব্যবহারিক প্রয়োগও রয়েছে। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র আলোচনা করা হলো:
- লেন্স তৈরি করা: লেন্সের কার্যকারিতা আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্কের ওপর নির্ভরশীল। বিভিন্ন ধরনের লেন্স তৈরি করার সময় কাঁচ এবং অন্যান্য মাধ্যমের আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক বিবেচনা করা হয়।
- অপটিক্যাল ফাইবার: অপটিক্যাল ফাইবারের মাধ্যমে ডেটা প্রেরণের ক্ষেত্রে আলোর প্রতিসরণ এবং আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্কের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- দৃষ্টিcorrector: চশমা বা কন্টাক্ট লেন্সের পাওয়ার নির্ধারণের সময় চোখের লেন্স এবং বাতাসের আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক বিবেচনা করা হয়।
বাস্তব জীবনে আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্কের উদাহরণ
দৈনন্দিন জীবনে আমরা আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্কের অনেক উদাহরণ দেখতে পাই। তার মধ্যে কয়েকটি নিচে উল্লেখ করা হলো:
- জলে মাছকে তার প্রকৃত অবস্থানের চেয়ে উপরে দেখা যায়। এর কারণ হলো আলো যখন জল থেকে বাতাসে আসে, তখন প্রতিসরণের কারণে মাছের অবস্থান পরিবর্তিত মনে হয়।
- সূর্যাস্তের সময় সূর্যকে লাল দেখানোর কারণও আলোর প্রতিসরণ।
আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক এবং আলোর বেগ
আলোর বেগ এবং আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্কের মধ্যে একটি সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। যে মাধ্যমে আলোর বেগ কম, সেই মাধ্যমে প্রতিসরাঙ্ক বেশি। এর কারণ হলো, প্রতিসরাঙ্ক আলোর বেগ কমার পরিমাণ নির্দেশ করে।
আলোর বেগের ওপর আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্কের প্রভাব
ধরা যাক, আলো বাতাস থেকে পানিতে প্রবেশ করছে। বাতাসের প্রতিসরাঙ্ক প্রায় 1 এবং পানির প্রতিসরাঙ্ক প্রায় 1.33। সুতরাং, পানির সাপেক্ষে বাতাসের আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক হবে:
( n_{বাতাস,পানি} = \frac{1}{1.33} \approx 0.75 )
এর মানে হলো, আলো যখন বাতাস থেকে পানিতে প্রবেশ করবে, তখন এর বেগ কমে যাবে।
আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক নির্ণয়ের পদ্ধতি
আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক নির্ণয় করার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। তার মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পদ্ধতি নিচে আলোচনা করা হলো:
স্নেলের সূত্র (Snell’s Law) ব্যবহার করে আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক নির্ণয়
স্নেলের সূত্র ব্যবহার করে খুব সহজেই আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক নির্ণয় করা যায়। স্নেলের সূত্রটি হলো:
( n_1 \sin(\theta_1) = n_2 \sin(\theta_2) )
এখানে,
- ( n_1 ) হলো প্রথম মাধ্যমের প্রতিসরাঙ্ক
- ( \theta_1 ) হলো প্রথম মাধ্যমে আপতন কোণ (Angle of Incidence)
- ( n_2 ) হলো দ্বিতীয় মাধ্যমের প্রতিসরাঙ্ক
- ( \theta_2 ) হলো দ্বিতীয় মাধ্যমে প্রতিসরণ কোণ (Angle of Refraction)
এই সূত্র ব্যবহার করে, যদি আপতন কোণ এবং প্রতিসরণ কোণ জানা থাকে, তাহলে দুটি মাধ্যমের আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক নির্ণয় করা সম্ভব।
পরীক্ষাগারে আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক নির্ণয়
পরীক্ষাগারে বিভিন্ন যন্ত্র ব্যবহার করে আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক নির্ণয় করা যায়। এর জন্য সাধারণত স্পেকট্রোমিটার (Spectrometer) ব্যবহার করা হয়।
স্পেকট্রোমিটার ব্যবহারের নিয়ম
- প্রথমে, স্পেকট্রোমিটারটিকে সঠিকভাবে সেট আপ করতে হবে।
- এরপর, যে দুটি মাধ্যমের আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক নির্ণয় করতে হবে, সেই মাধ্যম দুটিকে স্পেকট্রোমিটারে স্থাপন করতে হবে।
- আলোকরশ্মি একটি মাধ্যম থেকে অন্য মাধ্যমে প্রবেশ করার সময় আপতন কোণ এবং প্রতিসরণ কোণ পরিমাপ করতে হবে।
- স্নেলের সূত্র ব্যবহার করে আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক নির্ণয় করতে হবে।
বিভিন্ন মাধ্যমে আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক
বিভিন্ন মাধ্যমের আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক বিভিন্ন হয়। নিচে কয়েকটি সাধারণ মাধ্যমের প্রতিসরাঙ্ক এবং আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক আলোচনা করা হলো:
মাধ্যম | প্রতিসরাঙ্ক (n) |
---|---|
শূন্য | 1.00 |
বাতাস | 1.0003 |
পানি | 1.33 |
কাঁচ | 1.50 – 1.90 |
হীরা | 2.42 |
পানি ও কাঁচের মধ্যে আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক
যদি আলো পানি থেকে কাঁচের দিকে যায়, তাহলে কাঁচের সাপেক্ষে পানির আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক হবে:
( n_{পানি,কাঁচ} = \frac{1.33}{1.50} \approx 0.89 )
এর মানে হলো, আলো যখন পানি থেকে কাঁচের দিকে যাবে, তখন আলোর গতি সামান্য কমবে এবং দিক পরিবর্তিত হবে।
আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক বিষয়ক কিছু গাণিতিক সমস্যা ও সমাধান
আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক ভালোভাবে বোঝার জন্য কিছু গাণিতিক সমস্যা ও তাদের সমাধান দেখা যাক।
সমস্যা ১:
আলো বাতাস থেকে পানিতে প্রবেশ করছে। আপতন কোণ ( 30^\circ ) এবং প্রতিসরণ কোণ ( 22^\circ ) হলে, পানির প্রতিসরাঙ্ক নির্ণয় করো।
সমাধান:
স্নেলের সূত্রানুসারে,
( n_1 \sin(\theta_1) = n_2 \sin(\theta_2) )
এখানে,
- ( n_1 = 1.00 ) (বাতাসের প্রতিসরাঙ্ক)
- ( \theta_1 = 30^\circ )
- ( \theta_2 = 22^\circ )
অতএব, ( n_2 = \frac{n_1 \sin(\theta_1)}{\sin(\theta_2)} = \frac{1.00 \times \sin(30^\circ)}{\sin(22^\circ)} \approx 1.33 )
সুতরাং, পানির প্রতিসরাঙ্ক প্রায় 1.33।
সমস্যা ২:
একটি আলোকরশ্মি কাঁচ থেকে হীরাতে প্রবেশ করছে। কাঁচের প্রতিসরাঙ্ক 1.50 এবং হীরার প্রতিসরাঙ্ক 2.42 হলে, হীরার সাপেক্ষে কাঁচের আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক নির্ণয় করো।
সমাধান:
আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্কের সূত্রানুসারে,
( n_{কাঁচ,হীরা} = \frac{n_{কাঁচ}}{n_{হীরা}} = \frac{1.50}{2.42} \approx 0.62 )
সুতরাং, হীরার সাপেক্ষে কাঁচের আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক প্রায় 0.62।
আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক নিয়ে কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ)
আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক নিয়ে অনেকের মনে কিছু প্রশ্ন জাগতে পারে। নিচে কয়েকটি সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক কি আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ওপর নির্ভর করে?
হ্যাঁ, আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ওপর নির্ভর করে। বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোর জন্য মাধ্যমের প্রতিসরাঙ্ক ভিন্ন হয়। এই কারণে প্রিজমের মধ্যে দিয়ে সাদা আলো গেলে তা সাতটি রঙে বিভক্ত হয়ে যায়।
পরম প্রতিসরাঙ্ক (Absolute Refractive Index) এবং আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্কের মধ্যে পার্থক্য কী?
পরম প্রতিসরাঙ্ক হলো কোনো মাধ্যমের প্রতিসরাঙ্ক শূন্য মাধ্যমের সাপেক্ষে। অন্যদিকে, আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক হলো দুটি মাধ্যমের প্রতিসরাঙ্কের অনুপাত। পরম প্রতিসরাঙ্ক একটি নির্দিষ্ট মাধ্যমের বৈশিষ্ট্য, যেখানে আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক দুটি মাধ্যমের মধ্যে আলোর গতির পার্থক্য নির্দেশ করে।
আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্কের মান কি একের চেয়ে কম হতে পারে?
হ্যাঁ, আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্কের মান একের চেয়ে কম হতে পারে। যদি আলো বেশি প্রতিসরাঙ্কের মাধ্যম থেকে কম প্রতিসরাঙ্কের মাধ্যমে প্রবেশ করে, তাহলে আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্কের মান একের চেয়ে কম হবে।
আলোর প্রতিসরণের নিয়ম কি কি?
আলোর প্রতিসরণের দুইটি প্রধান নিয়ম আছে:
- আপতিত রশ্মি, প্রতিসৃত রশ্মি এবং আপতন বিন্দুতে বিভেদতলের উপর অঙ্কিত অভিলম্ব একই সমতলে থাকে।
- আলোর নির্দিষ্ট রং ও নির্দিষ্ট দুটি মাধ্যমের জন্য আপতন কোণের সাইন ও প্রতিসরণ কোণের সাইনের অনুপাত সর্বদা ধ্রুব থাকে। এই ধ্রুব সংখ্যাকে প্রথম মাধ্যমের সাপেক্ষে দ্বিতীয় মাধ্যমের প্রতিসরাঙ্ক বলে।
প্রতিসরাঙ্কের একক কি?
প্রতিসরাঙ্কের কোনো একক নেই, কারণ এটি দুটি একই রাশির অনুপাত (আলোর দ্রুতি)। তাই প্রতিসরাঙ্ক একটি dimensionless রাশি।
সংকট কোণ (Critical Angle) কি?
সংকট কোণ হল সেই আপতন কোণ, যে কোণে আলোকরশ্মি ঘন মাধ্যম থেকে হালকা মাধ্যমে যাওয়ার সময় প্রতিসৃত রশ্মি বিভেদতল ঘেঁষে যায় (প্রতিসরণ কোণ (90^\circ) হয়)। এই কোণের চেয়ে বড় আপতন কোণে আলোকরশ্মি সম্পূর্ণরূপে প্রতিফলিত হয়ে আবার ঘন মাধ্যমে ফিরে আসে, যাকে অভ্যন্তরীণ পূর্ণ প্রতিফলন (Total Internal Reflection) বলে।
উপসংহার
আশা করি, “আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক কাকে বলে” এই প্রশ্নের উত্তর আপনি পেয়েছেন। আপেক্ষিক প্রতিসরাঙ্ক আলোর প্রতিসরণ এবং এর ব্যবহারিক প্রয়োগ বোঝার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পদার্থবিজ্ঞান এবং প্রকৌশলের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ রয়েছে। তাই, এই ধারণাটি ভালোভাবে আয়ত্ত করা আমাদের চারপাশের জগতকে বুঝতে সাহায্য করে। আলোর এই মজার খেলা জানতে পেরে নিশ্চয়ই ভালো লাগছে, তাই না? পদার্থবিজ্ঞান এমনই মজার সব তথ্যে ভরা!
যদি এই বিষয়ে আপনার আরও কিছু জানার থাকে, তাহলে নির্দ্বিধায় জিজ্ঞাসা করতে পারেন। আপনার বিজ্ঞান বিষয়ক যে কোনো জিজ্ঞাসার উত্তর দিতে আমি সবসময় প্রস্তুত। শুভকামনা!