জেনে নিন খাঁটি বাংলা শব্দ: অতৎসম শব্দ (তদ্ভব শব্দ)
শুরুতেই একটা মজার গল্প বলি। ধরুন, আপনি বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছেন। কথায় কথায় এমন কিছু শব্দ ব্যবহার করলেন, যেগুলো শুনতেও বেশ দেশি দেশি লাগে, আবার এদের উৎসও সরাসরি সংস্কৃত নয়। এগুলোই কিন্তু আমাদের আলোচনার বিষয় – অতৎসম শব্দ!
বাংলা শব্দভাণ্ডার বিশাল। এখানে বিভিন্ন ভাষার শব্দ এসে মিশেছে, আপন হয়ে গেছে। এর মধ্যে কিছু শব্দ আছে যারা সরাসরি সংস্কৃত থেকে আসেনি, আবার বিদেশিও নয়। এরা যেন আমাদের ঘরের ছেলে, একটু আদুরে, একটু অন্যরকম। তাহলে চলুন, আজ আমরা এই “ঘরের ছেলেদের” – মানে অতৎসম বা তদ্ভব শব্দদের নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করি।
অতৎসম শব্দ কী?
সহজ ভাষায়, যে সকল শব্দ সংস্কৃত ভাষা থেকে প্রাকৃত ভাষার মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়ে বাংলা ভাষায় এসেছে, সেগুলোকে অতৎসম শব্দ বলে। এদেরকে তদ্ভব শব্দও বলা হয়। “তদ্ভব” শব্দের অর্থ হলো “তা থেকে উৎপন্ন”। অর্থাৎ, এই শব্দগুলো সংস্কৃত থেকে সরাসরি আসেনি, বরং একটি পরিবর্তনের পথ পেরিয়ে বাংলায় এসেছে।
অতৎসম শব্দের উৎপত্তি: একটু গভীরে
সংস্কৃত ছিলো এক সময়ের প্রধান ভাষা। কিন্তু সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য এটি কিছুটা কঠিন ছিলো। তাই প্রাকৃত ভাষার উদ্ভব হয়, যা ছিলো অনেক সহজ সরল। এই প্রাকৃত ভাষার মাধ্যমে অনেক সংস্কৃত শব্দ পরিবর্তিত হয়ে সাধারণ মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত হতে থাকে। এরপর প্রাকৃত ভাষা থেকে পরিবর্তিত হয়ে সেই শব্দগুলো বাংলা ভাষায় জায়গা করে নেয়।
তৎসম, তদ্ভব, অর্ধ-তৎসম ও দেশী শব্দের মধ্যে পার্থক্য
বাংলা ভাষায় শব্দের উৎস বিচার করে পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়: তৎসম, তদ্ভব, অর্ধ-তৎসম, দেশী ও বিদেশী শব্দ। এদের মধ্যে পার্থক্যগুলো নিচে একটি ছকের সাহায্যে দেখানো হলো:
শব্দ | সংজ্ঞা | উদাহরণ |
---|---|---|
তৎসম | যে শব্দগুলো সরাসরি সংস্কৃত ভাষা থেকে কোনোরূপ পরিবর্তন ছাড়াই বাংলা ভাষায় এসেছে। | চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র, ভবন, মনুষ্য, বৃক্ষ |
তদ্ভব (অতৎসম) | যে শব্দগুলো প্রাকৃত ভাষার মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়ে বাংলা ভাষায় এসেছে। | হাত (হস্ত > হत्থ > হাত), চাঁদ (চন্দ্র > চন্দ > চাঁদ), কাজ (কার্য > কज्ज > কাজ), সাপ (সর্প > সপ্প > সাপ) |
অর্ধ-তৎসম | যে শব্দগুলো সংস্কৃত থেকে সামান্য পরিবর্তিত হয়ে বাংলা ভাষায় এসেছে। | জ্যোৎস্না > জোছনা, শ্রাদ্ধ > ছেরাদ্দ, গৃহিণী > গিন্নী |
দেশী | যে শব্দগুলো কোনো স্থানীয় আদিবাসী ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় এসেছে। | কুড়ি, পেট, চোঙ্গা, টপর, ডাব |
অতৎসম শব্দ চেনার সহজ উপায়
অতৎসম শব্দ চেনার জন্য কিছু বিষয় মনে রাখতে পারেন:
- এই শব্দগুলো শুনতে একটু দেশি দেশি লাগবে।
- এগুলোর মধ্যে তৎসম শব্দের মতো কঠিনতা থাকবে না।
- সাধারণত দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করা হয় এমন শব্দগুলোই অতৎসম হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
কিছু সাধারণ অতৎসম শব্দের উদাহরণ
এখানে কিছু বহুল ব্যবহৃত অতৎসম শব্দের উদাহরণ দেওয়া হলো:
- হাত (হস্ত থেকে)
- পা (পদ থেকে)
- মাছ (মৎস্য থেকে)
- দুধ (দুগ্ধ থেকে)
- ভাত (ভক্ত থেকে)
- কান (কর্ণ থেকে)
- নাক (নাসিকা থেকে)
- চামড়া (চর্ম থেকে)
- গলা (গল থেকে)
- দাঁত (দন্ত থেকে)
- বোন (ভগিনী থেকে)
- ঘর (গৃহ থেকে)
- আলো (আলোক থেকে)
- আগুন (অগ্নি থেকে)
- কাজ (কার্য থেকে)
- রূপা (রূপ্য থেকে)
বাক্যে অতৎসম শব্দের ব্যবহার
এবার চলুন, কয়েকটি বাক্যে এই শব্দগুলোর ব্যবহার দেখি:
- “আমার হাত টা খুব ব্যথা করছে।”
- “আজ মাছ দিয়ে ভাত খাবো।”
- “মেয়েটির চোখ দুটি খুব সুন্দর।”
- “গরমে গলা শুকিয়ে কাঠ।”
- “তোমার বোন দেখতে খুব মিষ্টি।”
বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অতৎসম শব্দ
বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বাংলা ব্যাকরণ থেকে প্রশ্ন আসে, যেখানে শব্দ এবং তাদের প্রকারভেদ একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অতৎসম শব্দ বা তদ্ভব শব্দ থেকে প্রায়ই প্রশ্ন দেখা যায়। তাই এই বিষয়ে আপনার স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার।
বিসিএস (BCS) পরীক্ষায় অতৎসম শব্দ
বিসিএস পরীক্ষায় বাংলা ব্যাকরণ অংশে প্রায়শই অতৎসম শব্দ সম্পর্কিত প্রশ্ন থাকে৷ সাধারণত, শব্দ নির্ণয়, উৎস অথবা এদের ব্যবহার জানতে চাওয়া হয়।
- প্রশ্ন: নিচের কোনটি তদ্ভব শব্দ?
- (ক) চন্দ্র (খ) সূর্য (গ) হাত (ঘ) নক্ষত্র
- উত্তর: (গ) হাত
বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় অতৎসম শব্দ
বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় বাংলা অংশে শব্দ বিষয়ক প্রশ্ন থাকে। এখানেও তদ্ভব শব্দ গুরুত্বপূর্ণ।
- প্রশ্ন : ‘চামড়া’ শব্দটি কোন শ্রেণির?
- (ক) তৎসম (খ) তদ্ভব (গ) দেশী (ঘ) বিদেশী
- উত্তর: (খ) তদ্ভব
ব্যাংক নিয়োগ পরীক্ষায় অতৎসম শব্দ
ব্যাংক নিয়োগ পরীক্ষায় বাংলা ব্যাকরণ অংশে প্রায়ই শব্দ এবং তাদের প্রকারভেদ থেকে প্রশ্ন এসে থাকে। এখানেও তদ্ভব শব্দ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
কিছু জটিল অতৎসম শব্দ ও তাদের উৎস
কিছু অতৎসম শব্দ আছে যেগুলো সহজে চেনা যায় না। এদের উৎস একটু জটিল। নিচে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো:
অতৎসম শব্দ | মূল (সংস্কৃত) শব্দ | প্রাকৃত রূপ |
---|---|---|
আজ | অদ্য | অজ্জ |
কাঠ | কাষ্ঠ | কট্ট |
তেঁতুল | তিক্ত তেঁতুলিকা | তেত্থলী |
দাঁত | দন্ত | দন্ত > দন্তঅ > দাঁত |
অতৎসম শব্দ: মনে রাখার কিছু টিপস
- নিয়মিত বাংলা ব্যাকরণ পড়ুন।
- বিভিন্ন ধরণের শব্দ এবং তাদের উৎস সম্পর্কে জানার চেষ্টা করুন।
- বেশি করে উদাহরণ দেখুন এবং সেগুলো মনে রাখার চেষ্টা করুন।
- পুরোনো বাংলা সাহিত্য ও লোককথার বই পড়ুন, যেখানে প্রচুর দেশীয় শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।
FAQ: অতৎসম শব্দ নিয়ে কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা
এখানে অতৎসম শব্দ নিয়ে কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসার উত্তর দেওয়া হলো:
তদ্ভব ও তৎসম শব্দের মধ্যে পার্থক্য কি?
তৎসম শব্দ সরাসরি সংস্কৃত থেকে আগত, অপরপক্ষে তদ্ভব শব্দ প্রাকৃত ভাষার মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়ে এসেছে।
সকল দেশী শব্দ কি অতৎসম?
না, দেশী শব্দ স্থানীয় আদিবাসী ভাষা থেকে এসেছে। অতৎসম শব্দ মূলত সংস্কৃত থেকে প্রাকৃত ভাষার মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়ে বাংলায় এসেছে।
অতৎসম শব্দ মনে রাখার সহজ উপায় কি?
নিয়মিত অনুশীলন এবং বেশি বেশি শব্দ দেখা। এছাড়া, শব্দগুলোর উৎস জানার চেষ্টা করলে সহজে মনে রাখা যায়।
প্রত্যেক ভাষার শব্দ কি অতৎসম হতে পারে?
না, অতৎসম শব্দ মূলত সংস্কৃত ভাষা থেকে প্রাকৃত ভাষায় পরিবর্তিত হয়ে আসা শব্দগুলোকে বোঝায়।
“চাঁদ” কি ধরনের শব্দ?
“চাঁদ” একটি অতৎসম বা তদ্ভব শব্দ। এর মূল হলো সংস্কৃত “চন্দ্র”।
তদ্ভব শব্দের অন্য নাম কি?
তদ্ভব শব্দের অন্য নাম হলো অতৎসম শব্দ।
উপসংহার
অতৎসম শব্দ বাংলা ভাষার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এগুলো আমাদের ভাষার মাধুর্য বৃদ্ধি করেছে। আশা করি, এই আলোচনার মাধ্যমে আপনি অতৎসম শব্দ সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা পেয়েছেন। এখন আপনি সহজেই এই শব্দগুলো চিনতে পারবেন এবং সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারবেন। বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করতে আপনার আগ্রহ অব্যাহত থাকুক।
যদি আপনার মনে এখনও কোনো প্রশ্ন থাকে, তবে নির্দ্বিধায় কমেন্ট করে জানাতে পারেন। আর হ্যাঁ, লেখাটি ভালো লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না!