বাংলা ব্যাকরণ কাকে বলে (কত প্রকার ও কি কি)
আচ্ছা, ভাবুন তো, আপনি একটি দারুণ রান্না করতে জানেন। কিন্তু রেসিপিটা যদি কেউ গুছিয়ে না লিখে দেয়, তাহলে কি প্রতিবার একইরকম স্বাদ পাবেন? ভাষাও অনেকটা সেরকম। মনের ভাব প্রকাশ করতে আমরা শব্দ আর বাক্য ব্যবহার করি, কিন্তু সেই শব্দ আর বাক্যগুলোকে সুন্দর করে সাজানোর কিছু নিয়ম আছে। আর এই নিয়মগুলোই হলো ব্যাকরণ।
ব্যাকরণ ছাড়া ভাষা অনেকটা লাগামছাড়া ঘোড়ার মতো। তাই, চলুন আজ আমরা বাংলা ব্যাকরণ কী, এর প্রকারভেদ এবং খুঁটিনাটি কিছু বিষয় জেনে নেই!
বাংলা ব্যাকরণ: ভাষার নিয়মের বাঁধন
ব্যাকরণ হলো সেই “গাইডবুক”, যা একটি ভাষাকে নির্ভুলভাবে বলতে, লিখতে ও বুঝতে সাহায্য করে। এটা ভাষার কাঠামো এবং ব্যবহারের নিয়মকানুন নিয়ে আলোচনা করে। ব্যাকরণের জ্ঞান ভাষাকে ত্রুটিমুক্ত করে এবং যোগাযোগকে আরও সহজ করে তোলে।
সহজ ভাষায়, বাংলা ব্যাকরণ হলো বাংলা ভাষার সংবিধান। এই সংবিধানে লেখা আছে বাংলা ভাষা কিভাবে চলবে, কোন শব্দ কিভাবে ব্যবহার হবে, কিভাবে বাক্য তৈরি হবে – তার সবকিছু।
ব্যাকরণের সংজ্ঞা
ব্যাকরণ (Grammar) শব্দটির ব্যুৎপত্তি হলো: বি + আ + √কৃ + অন। এর অর্থ বিশেষভাবে বিশ্লেষণ করা। বাংলা ব্যাকরণ বই ভাষায় ব্যবহৃত শব্দ ও বাক্যকে বিশ্লেষণ করে সেগুলোর গঠন ও ব্যবহারবিধি বুঝিয়ে দেয়।
ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, “যে পুস্তক পাঠ করিলে বাংলা ভাষা শুদ্ধরূপে লিখিতে, পড়িতে ও বলিতে পারা যায়, তাহাকে বাংলা ব্যাকরণ বলে।”
ব্যাকরণ কেন প্রয়োজন?
ব্যাকরণ শেখা কেন দরকার, সেটা নিয়ে ভাবছেন? তাহলে কয়েকটা কারণ জেনে নিন:
- ভাষা শুদ্ধভাবে ব্যবহার: ব্যাকরণ ভাষাকে নির্ভুলভাবে ব্যবহার করতে শেখায়। আপনি যখন ব্যাকরণ জানেন, তখন আপনার কথা বা লেখায় ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
- যোগাযোগে স্পষ্টতা: সঠিক ব্যাকরণ ব্যবহার করলে আপনার বক্তব্য স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়। ফলে, শ্রোতা বা পাঠকের বুঝতে সুবিধা হয়।
- ভাষার সৌন্দর্য রক্ষা: ব্যাকরণ ভাষার সৌন্দর্য এবং মাধুর্য রক্ষা করে। এটা ভাষাকে আরও শ্রুতিমধুর এবং আকর্ষণীয় করে তোলে।
- অন্য ভাষা শিখতে সাহায্য: একটি ভাষার ব্যাকরণ ভালোভাবে জানলে অন্য ভাষা শেখা সহজ হয়। কারণ ভাষার মূল কাঠামো সম্পর্কে ধারণা তৈরি হয়।
- চাকরির বাজারে এগিয়ে থাকা: বর্তমানে অনেক চাকরির পরীক্ষায় বাংলা ব্যাকরণ থেকে প্রশ্ন আসে। তাই, ব্যাকরণ জানা থাকলে আপনি অন্যদের থেকে এগিয়ে থাকবেন।
বাংলা ব্যাকরণের আলোচ্য বিষয়
বাংলা ব্যাকরণে প্রধানত চারটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়:
- ধ্বনি তত্ত্ব (Phonology): ধ্বনি (sound) মানে আওয়াজ। এই অংশে আলোচনা করা হয় ভাষার মৌলিক ধ্বনিগুলো, তাদের উচ্চারণ, এবং তাদের একত্রিত হওয়ার নিয়ম নিয়ে। যেমন, স্বরধ্বনি, ব্যঞ্জনধ্বনি, ধ্বনির পরিবর্তন ইত্যাদি।
- রূপ তত্ত্ব বা শব্দ তত্ত্ব (Morphology): রূপ মানে আকৃতি। শব্দ কিভাবে তৈরি হয়, শব্দের প্রকারভেদ, শব্দগঠনের নিয়ম, ইত্যাদি বিষয় এই অংশে আলোচিত হয়। যেমন, উপসর্গ, অনুসর্গ, শব্দরূপ, ধাতুরূপ, কারক ও বিভক্তি ইত্যাদি।
- বাক্যতত্ত্ব বা পদক্রম (Syntax): বাক্য মানে কথা বা sentence। বাক্য কিভাবে গঠিত হয়, পদের গঠন এবং তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক, বাক্যবিন্যাস, ইত্যাদি বিষয় এখানে আলোচনা করা হয়। কোন পদের পর কোন পদ বসবে, তার নিয়মকানুনও আলোচনা করা হয়।
- অর্থ তত্ত্ব (Semantics): অর্থ মানে মানে বা purpose। শব্দ এবং বাক্যের অর্থ, অর্থের পরিবর্তন, বিভিন্ন ধরনের অর্থবাচকতা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে এই অংশে আলোচনা করা হয়।
ধ্বনি তত্ত্ব: শব্দের সূক্ষ্ম জাল
ভাষার মূল ভিত্তি হলো ধ্বনি। ধ্বনিতত্ত্বে আমরা ধ্বনির স্বরূপ ও গঠন নিয়ে আলোচনা করি।
- ধ্বনি ও বর্ণের আলোচনা: কোন ধ্বনি কিভাবে উচ্চারিত হয়, কোন বর্ণের উচ্চারণস্থান কোথায়, এইসব বিষয় ধ্বনিতত্ত্বে আলোচনা করা হয়।
- সন্ধি: পাশাপাশি দুটি ধ্বনি মিলেমিশে কিভাবে একটি নতুন রূপ নেয়, তা আমরা সন্ধির মাধ্যমে জানতে পারি।
রূপ তত্ত্ব: শব্দের রূপকথা
শব্দ কিভাবে তৈরি হয়, তার ভেতরের গঠন কেমন – এসব কিছু জানতে পারি রূপতত্ত্ব থেকে।
- শব্দ ও পদ: শব্দ কিভাবে বাক্যে ব্যবহারের যোগ্য হয়ে ওঠে, তা রূপতত্ত্বের মাধ্যমে জানা যায়।
- লিঙ্গ, বচন, কারক ও বিভক্তি: একটি শব্দের লিঙ্গ (স্ত্রীবাচক না পুরুষবাচক), বচন (একবচন না বহুবচন), কারক (কর্তা, কর্ম ইত্যাদি) এবং বিভক্তি (শব্দের সঙ্গে যুক্ত চিহ্ন) রূপতত্ত্বের অংশ।
বাক্যতত্ত্ব: কথার মালা
কতগুলো শব্দ পাশাপাশি বসে যখন একটি সম্পূর্ণ অর্থ প্রকাশ করে, তখন তাকে বাক্য বলে। বাক্যতত্ত্বে আমরা একটি বাক্য গঠনের নিয়মকানুন শিখি।
- বাক্যের গঠন: একটি বাক্যে কী কী অংশ থাকে (যেমন: কর্তা, কর্ম, ক্রিয়া), কোথায় বসে, তা আমরা বাক্যতত্ত্ব থেকে জানতে পারি।
- পদক্রম: কোন পদের পর কোন পদ বসবে, তার সঠিক নিয়ম জানা যায় বাক্যতত্ত্বের মাধ্যমে।
অর্থতত্ত্ব: অর্থের গভীরে
অর্থতত্ত্বে আমরা শব্দ ও বাক্যের অর্থ নিয়ে আলোচনা করি। একটি শব্দের একাধিক অর্থ হতে পারে, আবার একটি বাক্যের বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
- শব্দের অর্থবিচার: একটি শব্দের মূল অর্থ কী, তা কিভাবে পরিবর্তিত হতে পারে, এইসব বিষয় অর্থতত্ত্বে আলোচনা করা হয়।
- বাগধারা ও প্রবাদ: বাগধারা এবং প্রবাদ-প্রবচনের অন্তর্নিহিত অর্থ আমরা অর্থতত্ত্বের মাধ্যমে জানতে পারি।”যেমন “নাকের ডগায়” একটি বাগধারা, যার অর্থ অত্যন্ত নিকটে।
বাংলা ব্যাকরণের প্রকারভেদ
বাংলা ব্যাকরণকে প্রধানত দুইটি ভাগে ভাগ করা যায়:
- বর্ণনাত্মক ব্যাকরণ (Descriptive Grammar): এই প্রকার ব্যাকরণ ভাষার বর্তমান রূপের বর্ণনা দেয়। এটি ভাষার নিয়মকানুন বিশ্লেষণ করে এবং ব্যবহারকারীদের মধ্যে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী ব্যাকরণ তৈরি করে।
- নির্দেশনাত্মক ব্যাকরণ (Prescriptive Grammar): এই প্রকার ব্যাকরণ ভাষার শুদ্ধ রূপ কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়ে আলোচনা করে। এটি ভাষার কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম তৈরি করে, যা অনুসরণ করে ভাষাকে শুদ্ধভাবে ব্যবহার করা যায়।
বর্ণনাত্মক ব্যাকরণ: ভাষার বাস্তব চিত্র
বর্ণনাত্মক ব্যাকরণ অনেকটা আয়নার মতো। এটি ভাষাটিকে যেমন দেখে, তেমনই বর্ণনা করে।
- ব্যবহারভিত্তিক: এই ব্যাকরণ ভাষার ব্যবহারকারীদের কথা এবং লেখার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়।
- পরিবর্তনশীল: ভাষার পরিবর্তন এবং বিবর্তনকে এটি গ্রহণ করে।
নির্দেশনাত্মক ব্যাকরণ: শুদ্ধতার পথ
নির্দেশনাত্মক ব্যাকরণ হলো পথপ্রদর্শকের মতো। এটি ভাষার সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে নির্দেশনা দেয়।
- নিয়মনিষ্ঠ: এই ব্যাকরণ কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম এবং মানদণ্ড অনুসরণ করে।
- শুদ্ধতার আদর্শ: ভাষার কোন রূপটি শুদ্ধ, তা নির্ধারণ করে এবং সেই অনুযায়ী চলতে উৎসাহিত করে।
বাংলা ব্যাকরণের উৎস ও ইতিহাস
বাংলা ব্যাকরণের ইতিহাস বেশ পুরনো। এই ব্যাকরণের যাত্রা শুরু হয় মূলত বাংলা ভাষাকে একটি নির্দিষ্ট কাঠামো দেওয়ার উদ্দেশ্যে।
- প্রাচীন ব্যাকরণ: খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীতে পর্তুগিজ মিশনারি ম্যানুয়েল দাAssunção প্রথম বাংলা ব্যাকরণ রচনা করেন।
- আধুনিক ব্যাকরণ: এরপর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ ভাষাবিদ বাংলা ব্যাকরণকে আরও সমৃদ্ধ করেছেন।
প্রথম বাংলা ব্যাকরণ
বাংলা ভাষার প্রথম ব্যাকরণ রচনা করেন একজন পর্তুগিজ মিশনারী। তাঁর নাম ছিল ম্যানুয়েল দা Assunção। ১৭৩৪ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর লেখা “Vocabolario em idioma Bengalla, e Potuguez dividido em duas partes” নামক একটি গ্রন্থে বাংলা ভাষার ব্যাকরণ ও শব্দকোষ প্রকাশিত হয়।
আধুনিক বাংলা ব্যাকরণ
আধুনিক যুগে বাংলা ব্যাকরণকে নতুন রূপে তুলে ধরেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তাঁর “ব্যাকরণ কৌমুদী” (১৮৫৩) বইটি বাংলা ব্যাকরণ শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক। এরপর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্-এর মতো ভাষাবিজ্ঞানীরা বাংলা ব্যাকরণকে আরও উন্নত করেন।
বাংলা ব্যাকরণ শিক্ষার গুরুত্ব
বাংলা ব্যাকরণ শুধু একটি বিষয় নয়, এটি বাংলা ভাষাকে জানার এবং ভালোবাসার একটি উপায়। ব্যাকরণ শিক্ষার মাধ্যমে আমরা ভাষার সৌন্দর্য এবং গভীরতা উপলব্ধি করতে পারি।
- সঠিক ভাষা ব্যবহার: ব্যাকরণ আমাদের শেখায় কিভাবে নির্ভুলভাবে বাংলা লিখতে ও বলতে হয়।
- যোগাযোগের দক্ষতা বৃদ্ধি: ব্যাকরণের জ্ঞান থাকলে আমরা অন্যদের সঙ্গে সহজে এবং স্পষ্টভাবে যোগাযোগ করতে পারি।
- সাহিত্য অনুধাবন: সাহিত্য পড়ার সময় ব্যাকরণ আমাদের কবিতা, গল্প ও উপন্যাসের গভীরতা বুঝতে সাহায্য করে।
ব্যাকরণ শেখাটা অনেকটা সাঁতার শেখার মতো। প্রথমে একটু কঠিন লাগতে পারে, কিন্তু একবার শিখে গেলে জীবনটা অনেক সহজ হয়ে যায়।
বাংলা ব্যাকরণ বিষয়ক কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ)
ব্যাকরণ নিয়ে অনেকের মনে অনেক প্রশ্ন থাকে। এখানে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
বাংলা ব্যাকরণের জনক কাকে বলা হয়?
বাংলা ব্যাকরণের জনক বলা হয় উইলিয়াম কেরি-কে। তিনি একজন ইংরেজ মিশনারী ছিলেন এবং ১৮০১ সালে “A Grammar of the Bengal Language” নামে একটি বাংলা ব্যাকরণ রচনা করেন। তবে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকেও বাংলা ব্যাকরণকে আধুনিক রূপ দেওয়ার জন্য অনেকে জনক মনে করেন।
বাংলা ব্যাকরণ কত প্রকার?
বাংলা ব্যাকরণ প্রধানত দুই প্রকার: বর্ণনাত্মক ব্যাকরণ এবং নির্দেশনাত্মক ব্যাকরণ।
বাংলা ব্যাকরণের আলোচ্য বিষয় কি কি?
বাংলা ব্যাকরণের আলোচ্য বিষয় চারটি: ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব, বাক্যতত্ত্ব এবং অর্থতত্ত্ব।
ব্যাকরণ পাঠের প্রয়োজনীয়তা কি?
ব্যাকরণ পাঠের মাধ্যমে ভাষা শুদ্ধভাবে ব্যবহার করা যায়, যোগাযোগের দক্ষতা বৃদ্ধি পায় এবং সাহিত্যের গভীরতা উপলব্ধি করা যায়।
রূপতত্ত্ব কাকে বলে?
রূপতত্ত্ব হলো ব্যাকরণের সেই অংশ, যেখানে শব্দ এবং শব্দের গঠন নিয়ে আলোচনা করা হয়।
উপসংহার
বাংলা ব্যাকরণ একটি বিশাল সমুদ্রের মতো। এর গভীরে ডুব দিলে ভাষার অনেক অজানা রত্ন খুঁজে পাওয়া যায়। ব্যাকরণ ভীতি দূর করে, একে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করুন, দেখবেন বাংলা ভাষা আপনার কাছে আরও সুন্দর হয়ে উঠবে।
আজ আমরা জানলাম, বাংলা ব্যাকরণ কাকে বলে, এর প্রকারভেদ এবং কেন এটা শেখা জরুরি। এখন আপনার পালা। ব্যাকরণের নিয়মগুলো ভালোভাবে জেনে, বাংলা ভাষাকে আরও সুন্দর করে ব্যবহার করুন। আপনার বাংলা ভাষার জ্ঞান অন্যদের সাথে শেয়ার করুন। হয়তো আপনার হাত ধরেই কেউ একজন বাংলা ব্যাকরণে দক্ষ হয়ে উঠবে।
তাহলে, শুরু হোক বাংলা ব্যাকরণের পথচলা!