বিদআত: ইসলামে নতুন কিছু? নাকি পথভ্রষ্টতা? আসুন, জেনে নেই!
আচ্ছা, আপনি যদি এমন একটা রেস্টুরেন্টে যান, যেখানে মেন্যুতে এমন কিছু খাবার যোগ করা হয়েছে যা আগে কখনও শোনেননি, তাহলে কেমন লাগবে? একটু অবাক লাগতে পারে, তাই না? অনেকটা তেমনই, ইসলামে যদি এমন কিছু নতুন আমল বা প্রথা চালু করা হয়, যা কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত নয়, তবে তাকে বিদআত বলা হয়। চলুন, বিদআত সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
বিদআত কী?
বিদআত (Bid’ah) একটি আরবি শব্দ, যার আক্ষরিক অর্থ হলো ‘নতুন কিছু উদ্ভাবন করা’ অথবা ‘পূর্বের দৃষ্টান্ত ব্যতীত নতুন কিছু তৈরি করা’। ইসলামের পরিভাষায়, বিদআত বলতে দ্বীনের মধ্যে এমন নতুন কিছু প্রবর্তন করাকে বোঝায়, যা কুরআন ও সুন্নাহর মূল শিক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক অথবা যা শরীয়তে নেই, কিন্তু মানুষ সেটাকে দ্বীনের অংশ মনে করে আমল করে।
বিদআত কেন খারাপ?
ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। আল্লাহ তা’আলা কুরআন মাজীদে বলেছেন, “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম।” (সূরা আল-মায়েদা: ৩)। যখন দ্বীন পরিপূর্ণ, তখন এর মধ্যে নতুন কিছু যোগ করার অর্থ হলো, আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা)-এর ওপর অভিযোগ করা যে তিনি দ্বীনকে পরিপূর্ণ করেননি অথবা (নাউজুবিল্লাহ) নতুন কিছু যোগ করে দ্বীনকে আরও উন্নত করা!
বিদআত মূলত সুন্নাহর বিপরীত। সুন্নাহ হলো নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর দেখানো পথ। বিদআত সুন্নাহকে দুর্বল করে দেয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আমাদের দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছু সৃষ্টি করে যা এর অন্তর্ভুক্ত নয়, তা প্রত্যাখ্যাত।” (বুখারী ও মুসলিম)।
বিদআতের উদাহরণ
আমাদের সমাজে অনেক ধরনের বিদআত প্রচলিত আছে। এখানে কয়েকটি সাধারণ উদাহরণ দেওয়া হলো:
- মিলাদ ও কিয়াম: নবী (সা.)-এর জন্মদিনে বিশেষ অনুষ্ঠান করা এবং দাঁড়িয়ে সম্মান জানানো।
- কুলখানি ও চেহলাম: মৃত্যুর পর ৩ দিন, ৪০ দিন বা বাৎসরিক অনুষ্ঠান করা।
- কবর পূজা: কবরকে সিজদা করা, কবরের কাছে সাহায্য চাওয়া অথবা কবরকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মানত করা।
- শবে বরাত ও শবে কদর বিষয়ক বিদআত: এই রাতে বিশেষ নামাজ ও ইবাদতের নামে বিভিন্ন রীতিনীতি পালন করা, যা কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত নয়।
বিদআত কত প্রকার?
বিদআতকে সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা হয়:
বিদআতে হাসানা (উত্তম বিদআত):
কিছু আলেম বলেন, যদি কোনো নতুন কাজ শরীয়তের মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক না হয় এবং মানুষের কল্যাণে আসে, তবে তা বিদআতে হাসানা। তবে, অধিকাংশ ইসলামিক স্কলারের মতে, ইসলামে ‘বিদআতে হাসানা’ বলে কিছু নেই। কারণ, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “প্রত্যেক বিদআতই ভ্রষ্টতা।”
বিদআতে সাইয়্যিআ (মন্দ বিদআত):
যে বিদআত কুরআন ও সুন্নাহর বিরোধী এবং দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছু সংযোজন করে, যা শরীয়তে অনুমোদিত নয়, তাই বিদআতে সাইয়্যিআ। এটি সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাজ্য।
বিদআত থেকে বাঁচার উপায়
বিদআত থেকে বাঁচতে হলে কুরআন ও সুন্নাহর সঠিক জ্ঞান অর্জন করা জরুরি। এছাড়া নির্ভরযোগ্য আলেমদের সংস্পর্শে থাকা এবং তাঁদের কাছ থেকে দ্বীনের সঠিক শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। পাশাপাশি, সমাজে প্রচলিত ভুল রীতিনীতি সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা এবং নিজে সেগুলোর থেকে দূরে থাকা প্রয়োজন।
কুরআন ও হাদিসের আলোকে বিদআত
কুরআন ও হাদিসে বিদআত সম্পর্কে কঠোরWarning দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আর তোমরা সেই পথে চলো, যা আমার দিকে ফিরে আসার পথ।” (সূরা লুকমান: ১৫)। এই আয়াতে আল্লাহ তা’আলার আনুগত্য এবং রাসূল (সা.)-এর সুন্নাহ অনুসরণ করার কথা বলা হয়েছে।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “আমি তোমাদের মাঝে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যতদিন তোমরা তা আঁকড়ে ধরে থাকবে, ততদিন পথভ্রষ্ট হবে না। তা হলো আল্লাহর কিতাব (কুরআন) এবং আমার সুন্নাহ।” (মুয়াত্তা ইমাম মালিক)।
বিদআত নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন (FAQ)
বিদআত নিয়ে আমাদের সমাজে অনেক প্রশ্ন থাকে। এখানে কয়েকটি সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
বিদআত কি শুধু ইবাদতের ক্ষেত্রেই হয়?
না, বিদআত শুধু ইবাদতের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। জীবনের যে কোনো ক্ষেত্রে যদি দ্বীনের নামে নতুন কিছু চালু করা হয়, যা কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত নয়, তবে তা বিদআতের অন্তর্ভুক্ত।
ছোট বিদআত কি ক্ষতিকর নয়?
সব ধরনের বিদআতই ক্ষতিকর, ছোট হোক বা বড়। কারণ, বিদআত ধীরে ধীরে মানুষকে সুন্নাহ থেকে দূরে সরিয়ে দেয় এবং দ্বীনের মধ্যে বিকৃতি নিয়ে আসে।
আমরা কিভাবে বুঝবো যে কোনটা বিদআত?
কোনো আমল বা প্রথা কুরআন ও সুন্নাহর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কি না, তা জানার জন্য নির্ভরযোগ্য আলেমদের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। তাঁরা কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে সঠিক পথ দেখাতে পারেন।
কেউ যদি ভালো নিয়তে বিদআত করে, তাহলে কি গুনাহ হবে?
ইসলামে নিয়তের গুরুত্ব অবশ্যই আছে, তবে কোনো কাজ ইবাদত হিসেবে গণ্য হওয়ার জন্য তা কুরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক হতে হয়। ভালো নিয়তে বিদআত করলেও তা গ্রহণযোগ্য নয়, বরং তা গুনাহের কারণ হতে পারে।
বিদআত করলে কি ঈমান চলে যায়?
বিদআত করলে ঈমান চলে যায় কিনা, তা নির্ভর করে বিদআতের ধরনের ওপর। যদি কোনো ব্যক্তি এমন বিদআত করে, যা সরাসরি কুফরি বা শিরকের সাথে জড়িত, তবে তার ঈমান চলে যেতে পারে। তবে সাধারণ বিদআত করলে ঈমান চলে না গেলেও, এটি একটি মারাত্মক গুনাহ। এই কারণে আমাদের সকলের খুব সাবধান হওয়া উচিত।
বিদআত ও আমাদের সমাজ
আমাদের সমাজে অনেক ধরনের বিদআত প্রচলিত আছে, যা আমরা না জেনে বা গুরুত্ব না দিয়ে পালন করে থাকি। এই বিদআতগুলো ধীরে ধীরে আমাদের সমাজকে সুন্নাহ থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। তাই, আমাদের উচিত এই বিষয়ে সচেতন হওয়া এবং অন্যকেও সচেতন করা।
বিদআতের কুফল
- সুন্নাহর বিলুপ্তি: বিদআত সুন্নাহকে দুর্বল করে দেয় এবং ধীরে ধীরে সমাজে সুন্নাহর চর্চা কমে যায়।
- দ্বীনের বিকৃতি: বিদআত দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছু যোগ করে দ্বীনকে বিকৃত করে ফেলে।
- উম্মাহর মধ্যে বিভেদ: বিদআত উম্মাহর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে এবং মুসলিমদের মধ্যে ঐক্য নষ্ট করে।
- আল্লাহর অসন্তুষ্টি: বিদআত আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে এবং তাঁর রহমত থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
কীভাবে বিদআত পরিহার করবেন?
- কুরআন ও সুন্নাহর জ্ঞান অর্জন: কুরআন ও সুন্নাহর সঠিক জ্ঞান অর্জন করার মাধ্যমে আপনি জানতে পারবেন কোনটি সঠিক পথ এবং কোনটি ভুল।
- আলেমদের পরামর্শ: নির্ভরযোগ্য আলেমদের কাছ থেকে দ্বীনের সঠিক শিক্ষা গ্রহণ করুন এবং তাঁদের পরামর্শ অনুযায়ী চলুন।
- সচেতনতা বৃদ্ধি: সমাজে প্রচলিত ভুল রীতিনীতি সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করুন এবং নিজে সেগুলোর থেকে দূরে থাকুন।
- সুন্নাহর অনুসরণ: নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর সুন্নাহ অনুসরণ করুন এবং তাঁর দেখানো পথে চলুন।
বিদআত নিয়ে কিছু ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
ইসলামের ইতিহাসে দেখা যায়, বিভিন্ন সময়ে কিছু মানুষ দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছু প্রথা চালু করার চেষ্টা করেছে। সাহাবায়ে কেরাম এবং পরবর্তী যুগের আলেমগণ সবসময় এর বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। ইমাম মালিক (রহ.) বলতেন, “যে ব্যক্তি ইসলামে নতুন কিছু প্রবর্তন করে এবং সেটাকে ভালো কাজ মনে করে, সে যেন প্রকারান্তরে রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে খেয়ানতকারী সাব্যস্ত করলো।” কারণ আল্লাহ তা’আলা দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন এবং রাসূল (সা.) তা যথাযথভাবে পৌঁছে দিয়েছেন।
বিদআত বনাম ইজতিহাদ
এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট করা দরকার, আর তা হলো ইজতিহাদ। ইজতিহাদ মানে হলো কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে নতুন কোনো সমস্যার সমাধান বের করা। ইজতিহাদ অবশ্যই শরীয়তের মূলনীতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে এবং এর জন্য গভীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা প্রয়োজন। বিদআত হলো দ্বীনের মধ্যে নতুন কিছু যোগ করা, যা শরীয়তের সাথে সাংঘর্ষিক। অন্যদিকে, ইজতিহাদ হলো শরীয়তের মূল কাঠামোর মধ্যে থেকে নতুন সমস্যার সমাধান বের করা।
বিদআত থেকে সাবধান থাকার গুরুত্ব
ইসলামে বিদআত থেকে সাবধান থাকার গুরুত্ব অপরিসীম। বিদআত শুধুমাত্র একটি ছোটখাটো ভুল নয়, বরং এটি দ্বীনের মধ্যে মারাত্মক বিকৃতি নিয়ে আসতে পারে। তাই, আমাদের সকলের উচিত এই বিষয়ে সতর্ক থাকা এবং অন্যকে সতর্ক করা।
বিদআত পরিহারের উপায়
- নিয়মিত কুরআন ও হাদিস অধ্যয়ন করুন।
- ইসলাম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন করুন।
- ইসলামিক স্কলার ও আলেমদের সাথে যোগাযোগ রাখুন।
- সন্দেহজনক বিষয়গুলো এড়িয়ে চলুন।
- নিজেকে এবং পরিবারকে বিদআতের কুফল সম্পর্কে সচেতন করুন।
উপসংহার
বিদআত একটি মারাত্মক ব্যাধি, যা ধীরে ধীরে আমাদের ঈমান ও আমলকে ধ্বংস করে দেয়। আসুন, আমরা সবাই কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে জীবন গড়ি এবং বিদআত থেকে দূরে থাকি। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক পথে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এই ব্লগ পোস্টটি যদি আপনার ভালো লেগে থাকে, তাহলে অবশ্যই বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন এবং বিদআত সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে সাহায্য করুন। আপনার কোনো প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট বক্সে জানাতে পারেন।