আজকের পোস্টে আমরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি রচনা শেয়ার করব “বিজ্ঞান ও আধুনিক জীবন“। এই রচনাটি আশা করি তোমাদের পরীক্ষায় কমন আসবে। আমরা এই রচনাটি যত সম্ভব সহজ রাখার চেষ্টা করেছি – তোমাদের পড়তে সুবিধা হবে। চলো শুরু করা যাক।
বিজ্ঞান ও আধুনিক জীবন
ভূমিকা : বিখ্যাত বিজ্ঞান-গবেষক কলিন কেনান বলেছেন, “মানুষের মনে বিজ্ঞান চেতনার দীপশিখা প্রথম জ্বলে ওঠেছিল আজ থেকে প্রায় দশ হাজার বছর আগে, মধ্যপ্রাচ্যে।” সেই সময় সভ্য মানুষ শুধু প্রাত্যহিক জীবনের প্রয়োজনে নয়, নিছক জানার বা বোঝার আগ্রহেই নানা বিষয় সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান আহরণ করতে শুরু করে । বর্তমান সভ্যতা মানুষের বহু শতাব্দীর সাধনার ক্রম-পরিণাম । মানুষ তার যুগ-যুগান্তরের স্বপ্ন ও সাধনার অনবদ্য ফসল দিয়ে গড়ে তুলেছে সভ্যতার এই বিশাল ইমারত। বিজ্ঞানও মানুষের অতন্দ্র সাধনার ফসল । কালক্রমে মানুষ বিজ্ঞানকে তার সভ্যতার বিজয়রথের বাহন করে শতাব্দীর পর শতাব্দী পার হয়ে এসে উপনীত হয়েছে বর্তমানের পাদপীঠতলে । বলাবাহুল্য, মানুষের সভ্যতার এই চরম সমুন্নতির মূলে রয়েছে বিজ্ঞানের অপরিসীম বিস্ময়।
প্রাচীন যুগে বিজ্ঞান : প্যাপিরাস জাতীয় নলখাগড়া থেকে মিসরের মানুষ প্রথম লেখার উপযোগী কাগজ বানায়। ইরাক অঞ্চলের মানুষেরা প্রথম চাকাযুক্ত গাড়ি বানিয়ে পরিবহন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে যুগান্তর আনে। কয়েক হাজার বছর আগে চীনের বিজ্ঞানীরা অতি দ্রুত যান্ত্রিক পদ্ধতিতে যোগ-বিয়োগ করার উপযোগী গণকযন্ত্র বা ‘আবাকাস’ তৈরি করেন। ‘অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ক্লক’ প্রথম তৈরি করেছিলেন আলেকজান্দ্রিয়ার বিজ্ঞানীরা আজ থেকে দু’হাজার বছরেরও আগে। জল তোলার উপযোগী বিশেষ ধরনের পাম্প এবং যন্ত্রচালিত ঘড়ি প্রথম আবিষ্কৃত হয় চীনদেশে। প্রথম ছাপাখানা এবং কম্পাস যন্ত্র ঐ দেশেরই আবিষ্কার। এ সমস্তই ঘটেছিল খ্রিষ্টজন্মের আগে। গ্রিসের মানুষেরা প্রথম পৃথিবী ও মহাকাশের মানচিত্র বানায়। প্রাণিবিদ্যার ক্ষেত্রে, চিকিৎসাশাস্ত্র, স্থাপত্যবিদ্যা এবং জ্যামিতির ক্ষেত্রে গ্রিক বিজ্ঞানীদের অবদান বড় কম ছিল না। অন্যদিকে বীজগণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, শল্যচিকিৎসা, রসায়নশাস্ত্র, জীববিদ্যা প্রভৃতির ক্ষেত্রে প্রাচীন ভারতের ও আরব দেশের বিজ্ঞানীরা যেসব তত্ত্ব উদ্ভাবন করেছিলেন, তা মানুষের জীবনযাত্রাকে যথেষ্ট সহজ করে দেয়। জলস্রোতের কিংবা বাতাসের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে প্রাচীন গ্রিস ও ইরাকের বিজ্ঞানীরা যথাক্রমে ওয়াটার মিল ও উইন্ডমিল বানিয়েছিলেন । আজকের জীবনে বিজ্ঞানের সফল ব্যবহার মানুষের দীর্ঘকালব্যাপী সাধনার গৌরবময় ফল।
আধুনিক যুগে বিজ্ঞান : সভ্যতার ক্রমবিকাশের পথে অগ্রসর হয়ে বিজ্ঞান বর্তমানে পূর্ণরূপে সমৃদ্ধি লাভ করেছে। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে বিজ্ঞান নতুন শক্তি নিয়ে অবতীর্ণ হলো। শিল্পজগতে নতুন আলোড়নের সৃষ্টি করল বিজ্ঞান। দ্রুত উৎপাদনের তাগিদে নতুন নতুন যন্ত্র আবিষ্কারের হিড়িক পড়ে গেল। বিজ্ঞানের মহিমায় সমস্ত কাজকর্মই হচ্ছে যন্ত্রের সাহায্যে। আধুনিক বিজ্ঞানের অসীম শক্তিতে মানুষ প্রকৃতিকে যেন হাতের মুঠোর মধ্যে এনে ফেলেছে। নব নব শিল্প প্রকরণে বিজ্ঞান উৎপাদনের জগতে এনেছে যুগান্তর এবং সুদূরকে করেছে নিকটতম । বিজ্ঞানের সাফল্যে জীবধাত্রী বসুধা আজ কলহাস্য মুখরা ।
দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান : দৈনন্দিন জীবনে মানুষ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকে পূর্ণাঙ্গরূপে কাজে লাগিয়েছে ইউরোপে শিল্প-বিপ্লব ঘটে যাবার পর থেকে, উনিশ শতকে। ঐ সময়ই মানুষ বাষ্পের শক্তিকে নানান কাজে ব্যবহার করতে শিখে। তারপরে ক্রমে ক্রমে বিদ্যুৎশক্তিকে কাজে লাগাতে শিখে। এই শতকে আমরা জ্বালানি কয়লা ছাড়াও পেট্রোলিয়াম, প্রাকৃতিক গ্যাস এমনকি পারমাণবিক শক্তিকে মানুষের কল্যাণের কাজে লাগাতে পেরেছি। বাষ্পশক্তি, প্রাকৃতিক গ্যাসের শক্তি, সর্বোপরি বিদ্যুৎশক্তির ব্যাপক প্রচলন রয়েছে গৃহস্থের ঘরে ঘরে । তাই আধুনিককালে তার সাহায্য ছাড়া আমাদের একমিনিটও চলে না। পরিবহন ব্যবস্থায় বিজ্ঞান তো রীতিমত যুগান্তর এনেছে। হাজার হাজার মাইল দূরের পথ হাতের মুঠোয় এসেছে বিমানের বদৌলতে। বাস, ট্যাক্সি ও ট্রেনের সাহায্যে দ্রুতগতিতে একস্থান থেকে অন্যস্থানে চলে যাওয়া যায়। জলপথে যাওয়া যায় লঞ্চ, স্টিমার ও ইঞ্জিনচালিত নৌকার সাহায্যে। মেশিনের সাহায্যে চাষাবাদ ও পাম্পের সাহায্যে ফসলের ক্ষেতে জলসেচন করা যায়। এসবই বিজ্ঞানের দান ।
আমোদ-প্রমোদের ক্ষেত্রে টেলিভিশন ও ভিডিও বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলেও পৌঁছে গেছে। ঘরে বসে আমরা এখন দেখছি এশিয়াড, বিশ্বকাপ ফুটবল, বিশ্বকাপ ক্রিকেট, অলিম্পিক গেমস, কুস্তি, হকি ইত্যাদি খেলা। রেডিওর প্রভাতী ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভাঙে আমাদের । বিজ্ঞানের কৌশলে ততক্ষণে কলে পানি এসে যায়। প্রয়োজনমত কখনো সে পানি উষ্ণ, কখনো বা শীতল। সৌরশক্তি চালিত পকেট ক্যালকুলেটর করে দিচ্ছে দুরূহ হিসাব-নিকাশ। গৃহস্থালির কাজে কত রকম বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম যে আমরা ব্যবহার করছি, তার সঠিক হিসেব দেওয়া কঠিন। যেমন : রান্নার জন্য রয়েছে কুকিং রেঞ্জ, মশলা বাটার মেশিন, রয়েছে বাসন ও কাপড় ধোয়ার যন্ত্র। এছাড়া ঘর সাফাই মেশিন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র, বৈদ্যুতিক পাখা, টাইপ রাইটার থেকে শুরু করে ছোটদের জন্য রয়েছে ইলেকট্রিক খেলনা। প্রতিদিন বাজারে যাবারও প্রয়োজন হয় না। বিজ্ঞানের বদৌলতে ফ্রিজের মধ্যে কয়েকদিনের বাজার এসে রেখে দেওয়া যায়। রোটারি বা নানাপ্রকার অফসেট মেশিন তো বিজ্ঞানেরই অবদান। আছে টেলিফোন, মোবাইল ফোন। এর মাধ্যমে আমরা প্রতিদিন অফিস-আদালত, ব্যবসায় বাণিজ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে অনেক কাজ সেরে নিতে পারছি। খোঁজ-খবর নিতে পারছি আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের। পোশাক-পরিচ্ছদ ইস্ত্রি করতে পারছি ইস্ত্রির সাহায্যে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানও আমাদের প্রতিদিনের জীবনকে নিরাময় রাখছে। রোগ-ব্যাধির প্রয়োজনে আবিষ্কৃত হয়েছে ওষুধ। নানা দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসা সম্ভবপর হয়েছে এই বিজ্ঞানের বদৌলতে। আল্ট্রাসনোগ্রাফি এবং এক্স-রে আবিষ্কার এক্ষেত্রে নবযুগের সূত্রপাত করেছে। কলেরা, নিউমোনিয়া, টাইফয়েড, কালাজ্বর, যক্ষ্মা এসব ব্যাধি নিরাময় করার ব্যাপারে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার যুগান্তর এনেছে। পেনিসিলিন আবিষ্কৃত হবার কারণে মৃত্যুপথযাত্রী বহু রোগী বাঁচার আশ্বাস পেয়েছে। বিজ্ঞানের অবদানের জন্য স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে অনেক পঙ্গু রোগী। কতজন অভিশপ্ত জীবনের দুঃখ-বেদনা থেকে মুক্তি লাভ করেছে। বিশ্বময় মানুষ আজ জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যার্জনের নেশায় মেতেছে। জ্ঞানচর্চার জন্য চাই কাগজ ও কলম এবং আরও নানা উপকরণ। দৈনন্দিন জীবনে কাগজ যে আমাদের কাছে সহজলভ্য হচ্ছে তার মূলেও রয়েছে বিজ্ঞান। লেখার জন্য দরকার যে কলমের তাও বিজ্ঞানের দান। শহরে-বন্দরে পানি সরবরাহ করার জন্য বৈজ্ঞানিক প্রণালী গ্রহণ করা হচ্ছে। সংক্ষেপে বলতে গেলে, বিজ্ঞান আধুনিক মানুষকে চলার পথে গতি দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে তাকে, যুক্তিবাদী করেছে। আপন সৃষ্টির মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করার যে আনন্দ সে আনন্দ বিজ্ঞানবাদীকে অনুপ্রাণিত করেছে । আজ বিজ্ঞান ছাড়া আধুনিক জীবনের কথা ভাবাই যায় না।
বিজ্ঞানের কুফল : প্রাত্যহিক জীবনে অতিমাত্রায় যন্ত্রনির্ভরতার কুফলও কম নয়। বিজ্ঞান আমাদের ঐহ্যিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দিয়েছে, আমাদের নিত্য জীবনযাত্রাকে করেছে আরামপ্রদ বিলাসময় । কিন্তু বিজ্ঞান যেন মানুষের প্রাণকে হরণ করেছে, তার সহজ ও স্বাভাবিক অনায়াস জীবনচর্চাকে করেছে ব্যাহত। তার শরীর ও মন যেন প্রকৃতির আনন্দময় প্রাণদায়ক সান্নিধ্য থেকে বিচ্যুত হচ্ছে। যন্ত্রকে আমরা যত বেশি প্রশ্রয় দেব ততই জীবনে কৃত্রিমতা, অবসাদ বাড়বে। বর্তমান শতকে কলের মানুষ রোবটেরা হয়ত গৃহস্থের বাচ্চা সামলাবে, ঘর, বাসন সাফ করবে, রান্নার কাজ সেরে ফেলবে, কম্পিউটারের নির্দেশে আমরা ঘুম থেকে জেগে ওঠবো, তার হিসেব মতো চলব ঠিক এমনটা আমাদের কাম্য নয় ।
উপসংহার : আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে এক হয়ে গেছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞানকে বাদ দিলে আমাদের সবার বেঁচে থাকা দুরূহ। মানুষ বিজ্ঞানকে ব্যবহার করছে তার নিত্য কর্মে। দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান মানুষকে কেবল সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যই দিচ্ছে না, প্রতি মুহূর্তে বিজ্ঞানের প্রয়োগ তার মনকে করছে পরিশীলিত, বিশ্ববিধানের স্বরূপ উপলব্ধিতে প্রণোদিত করছে। আমাদের জীবনে তাই আমরা বিজ্ঞানকে বরণ করেছি প্রয়োজনের অনুরাগে ।
সম্পূর্ণ পোস্টটি মনোযোগ দিয়ে পড়ার জন্য তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আশা করছি আমাদের এই পোস্ট থেকে রচনা যেটি তুমি চাচ্ছিলে সেটি পেয়ে গিয়েছ। যদি তুমি আমাদেরকে কোন কিছু জানতে চাও বা এই রচনা নিয়ে যদি তোমার কোনো মতামত থাকে, তাহলে সেটি আমাদের কমেন্টে জানাতে পারো। আজকের পোস্টে এই পর্যন্তই, তুমি আমাদের ওয়েবসাইট ভিজিট করে আমাদের বাকি পোস্ট গুলো দেখতে পারো।