আজ আমরা কথা বলব এমন একটা বিষয় নিয়ে, যেটা রসায়ন (chemistry) পড়ার সময় প্রায়ই আমাদের সামনে আসে। বিষয়টা একটু জটিল মনে হলেও, বুঝিয়ে বললে দেখবে খুব সহজ। তাহলে শুরু করা যাক, “বিয়োজন মাত্রা কাকে বলে?” (biyojon matra kake bole) সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা।
বিয়োজন মাত্রা: একটা সহজ ধারণা
ধরো, তুমি এক গ্লাস শরবত বানাচ্ছো। চিনি মেশানোর পরে, সেই চিনিটা জলের সাথে মিশে গিয়ে আলাদা হয়ে যাচ্ছে, তাই তো? বিয়োজন মাত্রা অনেকটা সেরকমই। কোনো রাসায়নিক পদার্থ যখন ভেঙে গিয়ে অন্য পদার্থ তৈরি করে, তখন কী পরিমাণে ভাঙল, সেটাই হলো বিয়োজন মাত্রা।
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, বিয়োজন মাত্রা হলো কোনো বিক্রিয়ায় একটি পদার্থের কত শতাংশ বিয়োজিত হয়েছে (অর্থাৎ ভেঙেছে), তার পরিমাণ। এটাকে সাধারণত শতকরা (%) অথবা ভগ্নাংশে প্রকাশ করা হয়।
বিয়োজন মাত্রা কেন গুরুত্বপূর্ণ?
ভাবছ, এটা জেনে আমার কী লাভ? বিয়োজন মাত্রা জানাটা জরুরি, কারণ এটা দিয়ে বোঝা যায় একটা বিক্রিয়া কতটা সম্পূর্ণ হয়েছে। এছাড়াও, এটা ব্যবহার করে বিক্রিয়ার সাম্যাবস্থা (equilibrium) এবং উৎপাদ (product) সম্পর্কে অনেক ধারণা পাওয়া যায়।
বিয়োজন মাত্রা নির্ণয় করার পদ্ধতি
বিয়োজন মাত্রা বের করার কয়েকটা নিয়ম আছে। চলো, সেগুলো একটু দেখে নেওয়া যাক:
সাধারণ সূত্র
বিয়োজন মাত্রা (α) = (বিয়োজিত অণুর সংখ্যা / শুরুতে মোট অণুর সংখ্যা)
ধরা যাক, প্রথমে 100টা অণু ছিল, আর তার মধ্যে 40টা ভেঙে গেছে। তাহলে বিয়োজন মাত্রা হবে (40/100) = 0.4 বা 40%.
গাণিতিক উদাহরণ
ধরা যাক, একটা পাত্রে N₂O₄ গ্যাস আছে। এটা ভেঙে গিয়ে 2NO₂ তৈরি করে। শুরুতে N₂O₄-এর 1 মোল ছিল। সাম্যাবস্থায় দেখা গেল N₂O₄-এর 0.2 মোল বিয়োজিত হয়েছে। তাহলে,
- বিয়োজিত N₂O₄-এর মোল সংখ্যা = 0.2
- মোট N₂O₄-এর মোল সংখ্যা (শুরুতে) = 1
- বিয়োজন মাত্রা (α) = 0.2 / 1 = 0.2 বা 20%
বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিয়োজন মাত্রা
বিয়োজন মাত্রা বিভিন্ন কারণে পরিবর্তিত হতে পারে। যেমন:
- তাপমাত্রা: তাপমাত্রা বাড়লে সাধারণত বিয়োজন মাত্রা বাড়ে।
- চাপ: চাপের পরিবর্তনেও বিয়োজন মাত্রার পরিবর্তন হতে পারে।
- ঘনমাত্রা: ঘনমাত্রা কমালে বিয়োজন মাত্রা বাড়তে পারে।
বিয়োজন মাত্রাকে প্রভাবিত করার বিষয়গুলো
কিছু জিনিস আছে, যেগুলো বিয়োজন মাত্রার উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। সেগুলো নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।
তাপমাত্রা
তাপমাত্রা বাড়লে অণুগুলোর মধ্যে গতিশক্তি (kinetic energy) বাড়ে, ফলে তারা সহজে ভেঙে যেতে পারে। তাই, তাপমাত্রা বাড়লে বিয়োজন মাত্রা সাধারণত বাড়ে।
চাপ
চাপের প্রভাবে গ্যাসের বিয়োজন মাত্রা পরিবর্তিত হতে পারে। যদি বিক্রিয়ায় গ্যাসীয় পদার্থের মোল সংখ্যা বাড়ে, তাহলে চাপ কমালে বিয়োজন মাত্রা বাড়বে।
অনুঘটক (Catalyst)
অনুঘটক বিয়োজন মাত্রাকে সরাসরি প্রভাবিত করে না, কিন্তু এটা বিক্রিয়ার গতি বাড়িয়ে দেয়। ফলে, খুব কম সময়ে বেশি সংখ্যক অণু বিয়োজিত হতে পারে।
সাধারণ আয়ন প্রভাব (Common Ion Effect)
যদি দ্রবণে কোনো সাধারণ আয়ন থাকে, তাহলে বিয়োজন মাত্রা কমে যেতে পারে। কারণ সাধারণ আয়ন সাম্যাবস্থাকে পেছনের দিকে ঠেলে দেয়। যেমন, অ্যাসিটিক অ্যাসিডের দ্রবণে যদি সোডিয়াম অ্যাসিটেট মেশানো হয়, তাহলে অ্যাসিটিক অ্যাসিডের বিয়োজন মাত্রা কমে যাবে।
বিয়োজন মাত্রা এবং সাম্যাবস্থা ধ্রুবক (Equilibrium Constant)
সাম্যাবস্থা ধ্রুবক (K) এবং বিয়োজন মাত্রার মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে। এই সম্পর্ক ব্যবহার করে আমরা বিক্রিয়ার সাম্যাবস্থা সম্পর্কে জানতে পারি।
K-এর সাথে সম্পর্ক
ধরা যাক, একটা বিক্রিয়া এরকম:
A ⇌ B + C
যদি A-এর বিয়োজন মাত্রা α হয়, তাহলে সাম্যাবস্থা ধ্রুবক K-কে এভাবে লেখা যায়:
K = ([B][C]) / [A]
এখানে [A], [B], এবং [C] হলো A, B, এবং C-এর সাম্যাবস্থায় ঘনমাত্রা।
গাণিতিক উদাহরণ
ধরা যাক, PCl₅ গ্যাস ভেঙে PCl₃ এবং Cl₂ তৈরি করে:
PCl₅ ⇌ PCl₃ + Cl₂
যদি PCl₅-এর শুরুতে 1 মোল থাকে এবং বিয়োজন মাত্রা α হয়, তাহলে সাম্যাবস্থায়:
- [PCl₅] = 1 – α
- [PCl₃] = α
- [Cl₂] = α
সুতরাং, K = (α * α) / (1 – α)
বাস্তব জীবনে বিয়োজন মাত্রার ব্যবহার
ভাবছো, এই জটিল জিনিসটা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কোথায় কাজে লাগে? চলো, কয়েকটা উদাহরণ দেখি:
শিল্পক্ষেত্রে
বিভিন্ন শিল্পক্ষেত্রে, যেমন সার উৎপাদন, ওষুধ তৈরি, এবং পেট্রোলিয়াম পরিশোধন—এই সব জায়গায় বিয়োজন মাত্রা ব্যবহার করা হয়। বিক্রিয়াগুলোকে অপটিমাইজ করার জন্য এটা খুব দরকারি।
পরিবেশ সুরক্ষায়
দূষণ কমাতে এবং পরিবেশকে রক্ষা করতে বিয়োজন মাত্রা কাজে লাগে। দূষিত পদার্থগুলোকে ভেঙে পরিবেশবান্ধব পদার্থে পরিণত করতে এটা ব্যবহার করা হয়।
গবেষণাগারে
গবেষণাগারে নতুন যৌগ তৈরি করতে এবং বিক্রিয়াগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে বিয়োজন মাত্রা ব্যবহার করা হয়।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ও উত্তর (FAQ)
-
প্রশ্ন: বিয়োজন মাত্রা কি সব বিক্রিয়ার জন্য একই থাকে?
উত্তর: না, এটা নির্ভর করে বিক্রিয়ার প্রকৃতি, তাপমাত্রা, চাপ এবং অন্যান্য অনেক বিষয়ের উপর। -
প্রশ্ন: বিয়োজন মাত্রা ঋণাত্মক হতে পারে কি?
উত্তর: না, বিয়োজন মাত্রা সবসময় ধনাত্মক হবে, কারণ এটা ভাঙনের পরিমাণ নির্দেশ করে। -
প্রশ্ন: বিয়োজন মাত্রা ১০০% হওয়া মানে কী?
<b>উত্তর:</b> এর মানে হলো বিক্রিয়ক (reactant) সম্পূর্ণরূপে উৎপাদে (product) পরিণত হয়েছে। আর কোনো বিক্রিয়ক অবশিষ্ট নেই।
-
“ডিগ্রি অফ ডিসোসিয়েশন” (Degree of Dissociation) বলতে কী বোঝায়?
ডিগ্রি অফ ডিসোসিয়েশন বা বিয়োজন মাত্রা হলো একটি রাসায়নিক বিক্রিয়ায় কোনো পদার্থ কী পরিমাণে ভেঙে গিয়ে নতুন পদার্থ তৈরি করেছে, তার পরিমাপ। এটি সাধারণত শতকরা (%) অথবা ভগ্নাংশে প্রকাশ করা হয়। উচ্চ বিয়োজন মাত্রা মানে হলো বেশি পরিমাণ পদার্থ ভেঙেছে, আর নিম্ন বিয়োজন মাত্রা মানে কম পরিমাণ পদার্থ ভেঙেছে।
-
বিয়োজন মাত্রা কোন কোন বিষয়ের উপর নির্ভরশীল?
বিয়োজন মাত্রা মূলত তাপমাত্রা, চাপ এবং দ্রবণের ঘনত্বের উপর নির্ভরশীল। তাপমাত্রা বাড়লে সাধারণত বিয়োজন মাত্রা বাড়ে, কারণ অণুগুলোর মধ্যে সংঘর্ষের হার বৃদ্ধি পায়। চাপের প্রভাবে গ্যাসের বিয়োজন মাত্রা পরিবর্তিত হতে পারে। এছাড়াও, দ্রবণের ঘনত্বের পরিবর্তনও বিয়োজন মাত্রার উপর প্রভাব ফেলে।
-
বিয়োজন ধ্রুবক (Dissociation Constant) এবং বিয়োজন মাত্রার মধ্যে সম্পর্ক কী?
বিয়োজন ধ্রুবক (K dissociation) হলো একটি সাম্যাবস্থা ধ্রুবক, যা কোনো রাসায়নিক যৌগের বিয়োজন প্রক্রিয়ার মাত্রা প্রকাশ করে। অন্যদিকে, বিয়োজন মাত্রা (α) হলো ওই যৌগের কত শতাংশ বিয়োজিত হয়েছে, তার পরিমাণ। এই দুটি রাশির মধ্যে সম্পর্ক আছে। K dissociation এর মান যত বেশি, বিয়োজন মাত্রা (α)-এর মানও তত বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
-
আয়নিক যৌগ (Ionic Compound) এবং সমযোজী যৌগের (Covalent compound) মধ্যে বিয়োজন মাত্রা কিভাবে ভিন্ন হয়?
আয়নিক যৌগগুলো সাধারণত পানিতে দ্রবীভূত হলে সম্পূর্ণরূপে আয়নিত হয়ে যায়, তাই এদের বিয়োজন মাত্রা বেশি। অন্যদিকে, সমযোজী যৌগগুলো পানিতে দ্রবীভূত হলে আংশিকভাবে আয়নিত হয়, তাই এদের বিয়োজন মাত্রা তুলনামূলকভাবে কম থাকে। তবে কিছু শক্তিশালী অ্যাসিড এবং ক্ষার সম্পূর্ণরূপে বিয়োজিত হতে পারে।
শেষ কথা
আশা করি, “বিয়োজন মাত্রা কাকে বলে” (biyojon matra kake bole) – এই প্রশ্নের উত্তর তোমরা সহজেই বুঝতে পেরেছ। রসায়নের জটিল বিষয়গুলোকে সহজভাবে জানতে আমাদের সাথেই থেকো। আর যদি কোনো প্রশ্ন থাকে, তাহলে নির্দ্বিধায় কমেন্ট করো। সবাই ভালো থেকো, সুস্থ থেকো।