আচ্ছা, ভাবুন তো, আপনি বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছেন আর একজন বলছে, “আজকের দিনটা দারুণ!” এখানে “দারুণ” শব্দটা দিনটাকে বিশেষ করে বোঝাচ্ছে, তাই না? ব্যাকরণে এই “দারুণ”-এর মতো শব্দগুলোর একটা পোশাকি নাম আছে – বিশেষণ। তাহলে চলুন, বিশেষণ কাকে বলে (Bisheshon kake bole) এবং এর খুঁটিনাটি সবকিছু জেনে আসি!
বিশেষণ শব্দটা শুনলেই কেমন যেন একটা গুরুগম্ভীর ভাব আসে, তাই না? কিন্তু বিশ্বাস করুন, এটা মোটেও কঠিন কিছু নয়। বরং, বাংলা ভাষার সৌন্দর্য বুঝতে এটা আপনাকে সাহায্য করবে।
বিশেষণ কী? (Bisheshon Ki?)
সহজ ভাষায়, বিশেষণ হলো সেই শব্দ যা বিশেষ্য (নামবাচক শব্দ) বা সর্বনামের (নামের পরিবর্তে ব্যবহৃত শব্দ) দোষ, গুণ, অবস্থা, সংখ্যা, পরিমাণ ইত্যাদি প্রকাশ করে। এটা অনেকটা আপনার ছবিতে ফিল্টার দেওয়ার মতো – যেমন “সুন্দর” একটি ফিল্টার, যা একটি সাধারণ ছবিকেও আকর্ষণীয় করে তোলে!
অন্যভাবে বলতে গেলে, বিশেষণ বিশেষ্য বা সর্বনামকে মডিফাই (modify) করে। মডিফাই মানে কী? এখানে মডিফাই মানে হলো বিশেষ্য বা সর্বনাম সম্পর্কে অতিরিক্ত তথ্য দেওয়া।
যেমন:
- লাল গোলাপ (এখানে “লাল” গোলাপের রং বোঝাচ্ছে)
- দুষ্টু ছেলে (এখানে “দুষ্টু” ছেলেটির দোষ বোঝাচ্ছে)
- পাঁচটি কলম (এখানে “পাঁচটি” কলমের সংখ্যা বোঝাচ্ছে)
বিশেষণের কাজ কী? (Bisheshoner Kaj Ki?)
বিশেষণের প্রধান কাজ হলো বিশেষ্য বা সর্বনামকে বিশেষিত করা, অর্থাৎ তাদের সম্পর্কে নতুন কিছু তথ্য দেওয়া। এর মাধ্যমে আমরা কোনো ব্যক্তি, বস্তু বা ধারণা সম্পর্কে আরও স্পষ্ট ধারণা পাই।
বিশেষণের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিচে উল্লেখ করা হলো:
- বর্ণনা দেওয়া: কোনো কিছুর রূপ, রং, আকার, আকৃতি ইত্যাদি বর্ণনা করে।
- গুণাগুণ উল্লেখ করা: ভালো, মন্দ, সৎ, অসৎ ইত্যাদি গুণাগুণ প্রকাশ করে।
- সংখ্যা বা পরিমাণ নির্দেশ করা: কয়টি, কতটুকু ইত্যাদি সংখ্যা বা পরিমাণ বোঝায়।
- অবস্থা বোঝানো: ভেজা, শুকনো, ঠান্ডা, গরম ইত্যাদি অবস্থা প্রকাশ করে।
বিশেষণের প্রকারভেদ (Types of Adjectives)
বাংলা ব্যাকরণে বিশেষণকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়। এদের মধ্যে কয়েকটি প্রধান ভাগ আলোচনা করা হলো:
রূপ বা গঠন অনুসারে বিশেষণ (Rūp ba Gothon anusare Bisheshon)
রূপ বা গঠন অনুসারে বিশেষণ দুই প্রকার:
-
নাম-বিশেষণ: যে বিশেষণ কোনো বিশেষ্য পদকে বিশেষিত করে, তাকে নাম-বিশেষণ বলে।
যেমন: নীল আকাশ, সোনার কলম, পাথরের বাড়ি।
-
ক্রিয়া-বিশেষণ: যে বিশেষণ কোনো ক্রিয়াপদকে বিশেষিত করে, তাকে ক্রিয়া-বিশেষণ বলে।
যেমন: ধীরে চল, দ্রুত হাঁটো, জোরে কথা বলো।
অর্থ বা ভাব অনুসারে বিশেষণ (Artho ba Bhab anusare Bisheshon)
অর্থ বা ভাব অনুসারে বিশেষণকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়:
গুণবাচক বিশেষণ (Gunbachak Bisheshon)
যে বিশেষণ বিশেষ্য বা সর্বনামের গুণ, দোষ, অবস্থা, বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি প্রকাশ করে, তাকে গুণবাচক বিশেষণ বলে।
যেমন:
- ভালো ছেলে (গুণ)
- খারাপ কাজ (দোষ)
- ঠান্ডা জল (অবস্থা)
- লম্বা মানুষ (বৈশিষ্ট্য)
সংখ্যাবাচক বিশেষণ (Sonkhyabachak Bisheshon)
যে বিশেষণ বিশেষ্য বা সর্বনামের সংখ্যা নির্দেশ করে, তাকে সংখ্যাবাচক বিশেষণ বলে।
যেমন:
- একটি বই
- দশ জন লোক
- প্রথম শ্রেণি
- কিছু ফল
সংখ্যাবাচক বিশেষণের প্রকারভেদ (Sonkhyabachak Bisheshoner Prokarbhed)
সংখ্যাবাচক বিশেষণ আবার কয়েক রকমের হতে পারে:
- সংখ্যাবাচক: এক, দুই, তিন… (One, two, three…)
- ক্রমবাচক: প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়… (First, second, third…)
- পরিমাণবাচক: এক কেজি, দুই লিটার… (One kg, two liters…)
- অংকবাচক: ভগ্নাংশ বা শতাংশ (Fractions or percentages)
পরিমাণবাচক বিশেষণ (Porimanbachak Bisheshon)
যে বিশেষণ বিশেষ্য বা সর্বনামের পরিমাণ নির্দেশ করে, তাকে পরিমাণবাচক বিশেষণ বলে। এটি সাধারণত বস্তুবাচক বিশেষ্যের ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়।
যেমন:
- অল্প জল
- অনেক চিনি
- একটু দুধ
- প্রচুর খাবার
নির্দেশক বিশেষণ (Nirdeshok Bisheshon)
যে বিশেষণ বিশেষ্য বা সর্বনামকে নির্দিষ্ট করে বোঝায়, তাকে নির্দেশক বিশেষণ বলে।
যেমন:
- এই ছেলে
- ঐ বইটি
- ওই লোকটি
- এ বছর
প্রশ্নবাচক বিশেষণ (Proshnobachak Bisheshon)
যে বিশেষণ প্রশ্ন করার জন্য ব্যবহৃত হয়, তাকে প্রশ্নবাচক বিশেষণ বলে।
যেমন:
- কেমন আছো?
- কয়টি বই চাও?
- কী খবর?
- কোথায় যাবে?
ব্যক্তিবাচক বা সর্বনামীয় বিশেষণ (ব্যক্তিবাচক বা Sorbonamiyo Bisheshon)
এই ধরণের বিশেষণ সর্বনাম পদ থেকে তৈরি হয় এবং বিশেষ্য পদের পূর্বে বসে তাকে বিশেষিত করে।
- আমার বই
- তোমার কলম
অব্যয়জাত বিশেষণ ( অব্যয়জাত Bisheshon)
এই ধরণের বিশেষণ অব্যয় পদ থেকে তৈরি হয় এবং বিশেষ্য পদের পূর্বে বসে তাকে বিশেষিত করে।
- উপরের ঘর
- ভেতরের মানুষ
বিশেষণ চেনার সহজ উপায় (Bisheshon Chenar Sohoj Upay)
বিশেষণ চেনা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। তবে কিছু সহজ উপায় অবলম্বন করে আপনি সহজেই বিশেষণ চিনতে পারবেন:
-
বিশেষ্য বা সর্বনামের আগে কী বা কেমন যোগ করে প্রশ্ন করুন। উত্তরের শব্দটিই হবে বিশেষণ।
- যেমন: “ফুলটি সুন্দর।” – ফুলটি কেমন? উত্তর: সুন্দর (সুতরাং, “সুন্দর” হল বিশেষণ)
-
লক্ষ্য করুন, কোনো শব্দ বিশেষ্য বা সর্বনাম সম্পর্কে অতিরিক্ত তথ্য দিচ্ছে কিনা। যদি দেয়, তবে সেটি বিশেষণ।
-
বিভিন্ন প্রকার বিশেষণের সংজ্ঞা ও উদাহরণগুলো ভালোভাবে মনে রাখুন।
বাক্যে বিশেষণের ব্যবহার (Bakke Bisheshoner Bebohar)
বাক্যে বিশেষণের ব্যবহার নানাভাবে হতে পারে। কয়েকটি উদাহরণ নিচে দেওয়া হলো:
- “বৃষ্টির দিনে গরম চা খেতে ভালো লাগে।” (এখানে “গরম” হলো বিশেষণ)
- “আমার একটি লাল রঙের গাড়ি আছে।” (এখানে “লাল রঙের” হলো বিশেষণ)
- “সে খুব দ্রুত দৌড়াতে পারে।” (এখানে “দ্রুত” হলো ক্রিয়া বিশেষণ)
- “আজ আকাশটা খুব নীল দেখাচ্ছে।” (এখানে “নীল” হলো বিশেষণ)
- “লোকটি খুব সাহসী”(এখানে সাহসী হল বিশেষণ)
দৈনন্দিন জীবনে বিশেষণের গুরুত্ব (Dainondin Jibone Bisheshoner Gurutto)
আমরা প্রতিদিনের জীবনে অসংখ্য বিশেষণ ব্যবহার করি। এটা আমাদের ভাষার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে এবং আমাদের চিন্তা প্রকাশ করতে সাহায্য করে।
- যোগাযোগ: সঠিক বিশেষণ ব্যবহার করে আপনি আপনার বক্তব্যকে আরও স্পষ্ট ও কার্যকর করতে পারেন।
- বর্ণনা: কোনো ব্যক্তি, বস্তু বা স্থানকে যথাযথভাবে বর্ণনা করার জন্য বিশেষণ অপরিহার্য।
- সাহিত্য: কবিতা, গল্প, উপন্যাস ইত্যাদি সাহিত্যকর্মে বিশেষণ ভাষার মাধুর্য ও গভীরতা বৃদ্ধি করে।
অনুশীলন (Practice)
নিচের বাক্যগুলোতে বিশেষণ চিহ্নিত করুন:
- “ছোট্ট পাখিটি মিষ্টি গান গাইছে।”
- “আজকের দিনটা খুবই গরম।”
- “আমার কাছে পাঁচটি কলম আছে।”
- “লোকটি সাহসী।”
- “ছেলেটি খুব দ্রুত হাটে”।
উত্তর:
- ছোট্ট, মিষ্টি
- গরম
- পাঁচটি
- সাহসী
- দ্রুত
বিশেষণ নিয়ে কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা (Frequently Asked Questions – FAQs)
এখানে বিশেষণ নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
বিশেষণ ও ক্রিয়া বিশেষণের মধ্যে পার্থক্য কী? (Bisheshon o Kriya Bisheshoner Moddhe Parthokko Ki?)
বিশেষণ বিশেষ্য বা সর্বনামকে বিশেষিত করে, অন্যদিকে ক্রিয়া বিশেষণ ক্রিয়াকে বিশেষিত করে।
যেমন:
- বিশেষণ: “সুন্দর ফুল” (এখানে “সুন্দর” ফুলটিকে বিশেষিত করছে)
- ক্রিয়া বিশেষণ: “সে দ্রুত হাঁটে” (এখানে “দ্রুত” হাঁটা ক্রিয়াটিকে বিশেষিত করছে)
একটি শব্দ কি একই সাথে বিশেষণ ও অন্য কিছু হতে পারে? (Ekti Shabd Ki Ekই Sathe Bisheshon o Onno Kichu Hote Pare?)
হ্যাঁ, একটি শব্দ বাক্যের ব্যবহারের ওপর ভিত্তি করে বিশেষণ বা অন্য কোনো পদ হতে পারে।
যেমন: “আমি একটি লাল গোলাপ চাই।” এই বাক্যে “লাল” বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু “লালের প্রতি আমার দুর্বলতা আছে।” এই বাক্যে “লাল” বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
বিশেষণ কিভাবে বাক্যকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে? (Bisheshon Kivabe Bakyoke Aro Akorshoniyo Kore Tole?)
বিশেষণ ব্যবহার করে আপনি আপনার বক্তব্যকে আরও জীবন্ত ও স্পষ্ট করতে পারেন। এটি শ্রোতা বা পাঠকের মনে একটি স্পষ্ট চিত্র তৈরি করতে সাহায্য করে, যা তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে এবং বিষয়বস্তু বুঝতে সহজ করে তোলে।
বিশেষণ শেখা কেন জরুরি?
বাংলা ভাষা ভালোভাবে বুঝতে ও ব্যবহার করতে বিশেষণ শেখা খুবই জরুরি। এটা আপনার ভাষার দক্ষতা বাড়ায় এবং আপনাকে আরও সহজে নিজের চিন্তা প্রকাশ করতে সাহায্য করে।
উপসংহার (Conclusion)
আশা করি, “বিশেষণ কাকে বলে (Bisheshon kake bole)” এই প্রশ্নের উত্তর আপনি পেয়েছেন এবং বিশেষণ সম্পর্কে আপনার ধারণা স্পষ্ট হয়েছে। ব্যাকরণ ভয়ের কিছু নয়, বরং এটা ভাষার সৌন্দর্য আবিষ্কারের একটি উপায়। নিয়মিত অনুশীলন করুন এবং বাংলা ভাষার এই মজার দিকটি উপভোগ করুন!
যদি আপনার মনে এখনও কোনো প্রশ্ন থাকে, তাহলে নির্দ্বিধায় নিচে কমেন্ট করে জানাতে পারেন। আর হ্যাঁ, এই লেখাটি আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না! শুভ কামনা!