আসুন, “বিভব কাকে বলে” – এই জটিল বিষয়টিকে সহজ ভাষায় বুঝে নিই!
ছোটবেলায় নিশ্চয়ই বন্ধুদের সাথে ব্যাটারি দিয়ে ছোটখাটো কিছু বানিয়েছিলেন? সেই ব্যাটারির “+” আর “-” প্রান্তের কথা মনে আছে তো? বিভব অনেকটা সেইরকমই একটা ব্যাপার। ভয় নেই, কঠিন মনে হলেও, একটু মনোযোগ দিলেই এটা পানির মতো সোজা লাগবে। তাহলে চলুন, শুরু করা যাক!
বিভব কী? (What is Potential?)
বিভব (Potential) হলো কোনো তড়িৎ ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে একটি একক ধনাত্মক আধানকে অসীম দূরত্ব থেকে আনতে যে পরিমাণ কাজ করতে হয়, তার পরিমাপ। সহজ ভাষায়, এটা অনেকটা এমন যে, কোনো একটা জায়গায় একটা জিনিসকে আনতে কতটা “জোর” বা “ক্ষমতা” লাগবে, সেটাই হলো বিভব।
ধরুন, আপনি একটা চুম্বক নিলেন আর একটা লোহার টুকরা নিলেন। চুম্বকের কাছে লোহার টুকরাটাকে আনলে, চুম্বকটা লোহার টুকরাটাকে নিজের দিকে টানবে। এই টানার জন্য আপনাকে কিছু কাজ করতে হবে, তাই না? বিভবের ব্যাপারটা অনেকটা একই রকম।
বিভবের সংজ্ঞা (Definition of Potential)
বৈদ্যুতিক বিভবকে সংজ্ঞায়িত করতে গেলে আমরা বলতে পারি:
“কোনো তড়িৎক্ষেত্রের কোনো বিন্দুতে একটি ধনাত্মক আধানকে অসীম দূরত্ব থেকে ধীরে ধীরে ওই বিন্দুতে আনতে যে পরিমাণ কাজ সম্পন্ন করতে হয়, তাকে ওই বিন্দুর বিভব বলে।”
বিভবকে সাধারণত V দিয়ে প্রকাশ করা হয় এবং এর একক হলো ভোল্ট (Volt)।
বিভবের প্রকারভেদ (Types of Potential)
বিভব প্রধানত দুই প্রকার:
- বৈদ্যুতিক বিভব (Electric Potential): এটা হলো কোনো তড়িৎ ক্ষেত্রের কারণে সৃষ্ট বিভব। যেমন, কোনো চার্জিত বস্তুর আশেপাশে যে বিভব তৈরি হয়।
- মহাকর্ষীয় বিভব (Gravitational Potential): এটা হলো কোনো বস্তুর ভরের কারণে সৃষ্ট বিভব। যেমন, পৃথিবীর কারণে কোনো বস্তুর উপর যে বিভব তৈরি হয়।
আমরা এখানে মূলত বৈদ্যুতিক বিভব নিয়েই আলোচনা করব।
বিভব পার্থক্য (Potential Difference)
বিভব পার্থক্য (Potential Difference) হলো কোনো তড়িৎ ক্ষেত্রের দুটি বিন্দুর মধ্যে বিভবের পার্থক্য। মানে, একটা বিন্দু থেকে আরেকটা বিন্দুতে একটি আধানকে সরাতে যে পরিমাণ কাজ করতে হয়, সেটাই হলো বিভব পার্থক্য।
ধরুন, আপনার কাছে একটা জল ভর্তি ট্যাঙ্ক আছে। ট্যাঙ্ক থেকে জল বের করার জন্য একটা পাইপ লাগিয়েছেন। জলের উচ্চতা যত বেশি হবে, জলের ধারা তত জোরে বের হবে, তাই না? বিভব পার্থক্য অনেকটা সেইরকম। বিভব পার্থক্য যত বেশি হবে, তড়িৎ প্রবাহ (current) তত বেশি হবে। আমরা ভোল্টেজ (Voltage) বলতে যা বুঝি, তা আসলে বিভব পার্থক্য।
বিভব পার্থক্য কেন গুরুত্বপূর্ণ? (Why is Potential Difference Important?)
বিভব পার্থক্য ছাড়া কোনো বর্তনীতে (circuit) তড়িৎ প্রবাহিত হতে পারবে না। আমাদের বাসা-বাড়িতে যে ইলেকট্রিক তারগুলো আছে, সেগুলোর মধ্যে বিভব পার্থক্য থাকার কারণেই লাইট জ্বলে, ফ্যান ঘুরে, টিভি চলে।
বিভব এবং তড়িৎক্ষেত্র (Potential and Electric Field)
বিভব এবং তড়িৎক্ষেত্র (Electric Field) একে অপরের সাথে সম্পর্কিত। তড়িৎক্ষেত্র হলো সেই অঞ্চল, যেখানে কোনো আধান (charge) রাখলে তার উপর বল প্রযুক্ত হয়। আর বিভব হলো সেই বলের কারণে আধানকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরাতে প্রয়োজনীয় কাজ।
তড়িৎক্ষেত্রকে বিভবের নতি (gradient) হিসেবেও প্রকাশ করা যায়। এর মানে হলো, বিভবের পরিবর্তনের হারই হলো তড়িৎক্ষেত্র।
তড়িৎক্ষেত্র এবং বিভবের মধ্যে সম্পর্ক (Relationship between Electric Field and Potential)
গাণিতিকভাবে, তড়িৎক্ষেত্র (E) এবং বিভবের (V) মধ্যে সম্পর্ক হলো:
E = -∇V
এখানে ∇ হলো gradient অপারেটর। এই সমীকরণটি বলছে যে, তড়িৎক্ষেত্র হলো বিভবের সবচেয়ে দ্রুত পরিবর্তনের দিকের বিপরীত দিকে।
বিভব নির্ণয় (Determining Potential)
বিভব নির্ণয় করার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি আছে। এদের মধ্যে কয়েকটা নিচে আলোচনা করা হলো:
কুলম্বের সূত্র ব্যবহার করে বিভব নির্ণয় (Using Coulomb’s Law)
কুলম্বের সূত্র (Coulomb’s Law) ব্যবহার করে কোনো বিন্দু আধানের (point charge) জন্য বিভব নির্ণয় করা যায়। যদি q পরিমাণ আধান r দূরত্বে থাকে, তাহলে ওই বিন্দুতে বিভব হবে:
V = kq/r
এখানে k হলো কুলম্বের ধ্রুবক (Coulomb’s constant), যার মান প্রায় 8.99 x 10^9 Nm²/C²।
সমবিভব তল (Equipotential Surface)
সমবিভব তল (Equipotential Surface) হলো সেই তল, যার প্রতিটি বিন্দুতে বিভবের মান সমান। এই তলের উপর কোনো আধানকে সরাতে কোনো কাজ করতে হয় না, কারণ বিভব পার্থক্য শূন্য।
সমবিভব তল তড়িৎক্ষেত্রের সাথে লম্বভাবে থাকে।
দৈনন্দিন জীবনে বিভবের ব্যবহার (Uses of Potential in Daily Life)
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিভবের অসংখ্য ব্যবহার রয়েছে। এদের মধ্যে কয়েকটা নিচে উল্লেখ করা হলো:
- বিদ্যুৎ সরবরাহ (Electricity Supply): বাসা-বাড়িতে যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়, তা বিভব পার্থক্যের মাধ্যমেই সম্ভব হয়। পাওয়ার স্টেশন থেকে আমাদের বাসা পর্যন্ত বিদ্যুৎ পৌঁছানোর জন্য উচ্চ বিভব ব্যবহার করা হয়।
- ইলেকট্রনিক্স (Electronics): মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, টিভি ইত্যাদি ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসে বিভব পার্থক্য ব্যবহার করে বিভিন্ন সার্কিট তৈরি করা হয়।
- মেডিকেল যন্ত্রপাতি (Medical Instruments): ইসিজি (ECG), ইইজি (EEG) ইত্যাদি মেডিকেল যন্ত্রপাতিতে শরীরের বিভিন্ন অংশের বিভব পরিমাপ করে রোগ নির্ণয় করা হয়।
কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর (FAQs)
এখানে বিভব নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর দেওয়া হলো, যা আপনাদের ধারণা আরও স্পষ্ট করতে সাহায্য করবে:
বিভবের একক কী? (What is the unit of Potential?)
বিভব এর একক হলো ভোল্ট (Volt)। একে V দিয়ে প্রকাশ করা হয়।
বিভব কি স্কেলার রাশি নাকি ভেক্টর রাশি? (Is Potential a scalar or vector quantity?)
বিভব একটি স্কেলার রাশি (scalar quantity)। এর শুধু মান আছে, কোনো দিক নেই।
বিভব পার্থক্য কিভাবে মাপা হয়? (How is Potential Difference measured?)
বিভব পার্থক্য ভোল্টমিটার (voltmeter) দিয়ে মাপা হয়।
পৃথিবীর বিভব কত ধরা হয়? (What is the potential of the Earth?)
পৃথিবীর বিভব শূন্য (zero) ধরা হয়।
দুটি চার্জের মধ্যে বিভব পার্থক্য কিভাবে কাজ করে?
দুটি চার্জের মধ্যে বিভব পার্থক্য তৈরি হলে, চার্জগুলো উচ্চ বিভব থেকে নিম্ন বিভবের দিকে প্রবাহিত হয়। এই প্রবাহের ফলে তড়িৎ বর্তনীতে (electric circuit) কাজ করা সম্ভব হয়।
বিভব নিয়ে কিছু মজার তথ্য (Fun Facts about Potential)
- ভোল্ট (Volt) এককের নামকরণ করা হয়েছে বিখ্যাত ইতালীয় বিজ্ঞানী আলেসান্দ্রো ভোল্টা (Alessandro Volta)-এর নামানুসারে। তিনিই প্রথম ভোল্টেজ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
- আমাদের শরীরেও খুব সামান্য পরিমাণে বিভব পার্থক্য তৈরি হয়, যা স্নায়ু কোষের (nerve cell) মাধ্যমে সংবেদী অঙ্গ থেকে মস্তিষ্কে সংকেত পাঠাতে সাহায্য করে।
উপসংহার (Conclusion)
আশা করি, “বিভব কাকে বলে” এই বিষয়টি সহজ ভাষায় বোঝাতে পেরেছি। বিভব একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা, যা পদার্থবিজ্ঞান এবং প্রকৌশল বিদ্যার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। এই বিষয়টিকে ভালোভাবে বোঝার মাধ্যমে আপনারা দৈনন্দিন জীবনে বিদ্যুতের ব্যবহার এবং এর পেছনের বিজ্ঞান সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানতে পারবেন।
যদি এই বিষয়ে আরও কিছু জানার থাকে, তাহলে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন। আর হ্যাঁ, লেখাটি ভালো লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না! পদার্থবিজ্ঞানের আরও মজার বিষয় নিয়ে খুব শীঘ্রই আবার হাজির হবো। ততদিন পর্যন্ত ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন! ধন্যবাদ!