আসুন, মহাবিশ্বের গভীরে ডুব দেই! ব্ল্যাক হোল: মহাবিশ্বের কৃষ্ণগহ্বর! জানুন এর রহস্য
মহাবিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় বস্তুগুলোর মধ্যে একটি হলো ব্ল্যাক হোল। এটা এমন একটা জায়গা, যেখানে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি এতটাই বেশি যে আলো পর্যন্ত পালাতে পারে না। ভাবছেন, এটা কীভাবে সম্ভব? তাহলে চলুন, ব্ল্যাক হোল কী, কীভাবে তৈরি হয়, এর বৈশিষ্ট্যগুলো কী কী, এবং এটা নিয়ে বিজ্ঞানীদের গবেষণাগুলো কী বলছে, সেসব বিষয়ে বিস্তারিত জেনে নেই!
ব্ল্যাক হোল কী?
ব্ল্যাক হোলকে বাংলায় কৃষ্ণগহ্বর বলা হয়। এটা হলো মহাবিশ্বের এমন একটি এলাকা, যেখানে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি (Gravitational Force) এতটাই বেশি যে কোনো কিছুই—আলো, পদার্থ, এমনকি সময়ও—এর কবল থেকে পালাতে পারে না। ব্ল্যাক হোল নামটি এর কৃষ্ণ বর্ণের কারণেই রাখা হয়েছে, কারণ এর মধ্যে আলো প্রবেশ করে আর ফেরত আসতে পারে না। আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব (General Theory of Relativity) ব্ল্যাক হোলের ধারণা দেয়।
ব্ল্যাক হোল কীভাবে তৈরি হয়?
ব্ল্যাক হোল কীভাবে তৈরি হয়, সেটা একটা মজার প্রশ্ন। এর উত্তর জানতে হলে নক্ষত্রের জীবনচক্র (life cycle of stars) সম্পর্কে একটু ধারণা থাকতে হবে।
১. নক্ষত্রের মৃত্যু এবং সুপারনোভা
-
ব্ল্যাক হোলের জন্ম হয় মূলত বিশাল আকারের নক্ষত্রের মৃত্যুর পর। যখন একটি নক্ষত্রের ভেতরের জ্বালানি ফুরিয়ে যায়, তখন তার বাইরের স্তরগুলো ভেতরের দিকে ধসে পড়তে শুরু করে।
-
যদি নক্ষত্রের ভর সূর্যের ভরের চেয়ে প্রায় ২০ গুণ বা তার বেশি হয়, তাহলে এটি একটি সুপারনোভা (supernova) নামক বিশাল বিস্ফোরণের মাধ্যমে শেষ হয়।
-
এই বিস্ফোরণের পরে নক্ষত্রের কোর (core) সংকুচিত হতে থাকে।
২. সিঙ্গুলারিটি ও হরাইজন
-
কোর সংকুচিত হতে হতে একটি পর্যায়ে এতটাই ছোট হয়ে যায় যে এর ঘনত্ব অসীম (infinite) হয়ে যায়। এই অবস্থাকে সিঙ্গুলারিটি (singularity) বলে।
-
সিঙ্গুলারিটির চারপাশে একটি অদৃশ্য সীমানা তৈরি হয়, যাকে ইভেন্ট হরাইজন (event horizon) বলা হয়। এই সীমানার ভেতরে যা কিছু প্রবেশ করে, তা আর কখনো ফিরে আসতে পারে না।
ব্ল্যাক হোলের অংশগুলো
ব্ল্যাক হোলের প্রধান দুটি অংশ আছে:
-
সিঙ্গুলারিটি (Singularity):
-
এটা হলো ব্ল্যাক হোলের কেন্দ্রে থাকা সেই বিন্দু, যেখানে সমস্ত ভর সংকুচিত হয়ে একটি অসীম ঘনত্ব তৈরি করে।
-
আমাদের বর্তমান পদার্থবিদ্যা অনুযায়ী, সিঙ্গুলারিটির আচরণ ব্যাখ্যা করা প্রায় অসম্ভব।
-
-
ইভেন্ট হরাইজন (Event Horizon):
-
এটি ব্ল্যাক হোলের চারপাশের একটি কল্পিত সীমানা।
-
এই সীমানা পার হলে কোনো কিছুই, এমনকি আলোও ব্ল্যাক হোলের মহাকর্ষ থেকে বাঁচতে পারে না। তাই কোনো কিছুই আর ফিরে আসতে পারে না।
-
ইভেন্ট হরাইজনের আকার ব্ল্যাক হোলের ভরের ওপর নির্ভর করে। ভর যত বেশি, হরাইজনও তত বড়।
-
ব্ল্যাক হোলের প্রকারভেদ
ভর (mass) অনুসারে ব্ল্যাক হোল বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। এদের মধ্যে প্রধান কয়েকটি হলো:
১. স্টেলার ব্ল্যাক হোল (Stellar Black Hole):
এগুলো সাধারণত কোনো বৃহৎ নক্ষত্রের জীবনকালের শেষে তৈরি হয়। এদের ভর সাধারণত আমাদের সূর্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি হয়ে থাকে। আমাদের গ্যালাক্সি ছায়াপথে (galaxy) এমন অনেক ব্ল্যাক হোল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
২. সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল (Supermassive Black Hole):
এই ব্ল্যাক হোলগুলো অনেক বিশাল। এদের ভর কয়েক মিলিয়ন থেকে বিলিয়ন পর্যন্ত হতে পারে। মনে করা হয়, প্রায় সব গ্যালাক্সির কেন্দ্রে এই ধরনের ব্ল্যাক হোল রয়েছে। আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রেও স্যাজিটেরিয়াস এ* (Sagittarius A*) নামের একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল আছে।
৩. ইন্টারমিডিয়েট-মাস ব্ল্যাক হোল (Intermediate-mass Black Hole):
এগুলো স্টেলার ব্ল্যাক হোল থেকে বড়, কিন্তু সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলের চেয়ে ছোট। এদের ভর কয়েকশ থেকে কয়েক হাজার সৌর ভর পর্যন্ত হতে পারে। এই ব্ল্যাক হোলগুলো সম্পর্কে এখনো অনেক কিছু জানা বাকি।
৪. মাইক্রো ব্ল্যাক হোল (Micro Black Hole):
এগুলো খুবই ছোট আকারের ব্ল্যাক হোল। এদের ভর খুব কম হতে পারে। কেউ কেউ মনে করেন যে এগুলো মহাবিশ্বের একদম শুরুতে তৈরি হয়েছিল। তবে এগুলো এখনো তাত্ত্বিকভাবেই বিদ্যমান, বাস্তবে এদের দেখা যায়নি।
ব্ল্যাক হোলের বৈশিষ্ট্য
ব্ল্যাক হোলকে কেন এত অদ্ভুত বলা হয়? এর কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা একে অন্য যেকোনো মহাজাগতিক বস্তু থেকে আলাদা করে তোলে।
১. মহাকর্ষীয় টান (Gravitational Pull)
ব্ল্যাক হোলের মহাকর্ষীয় টান এতটাই শক্তিশালী যে এর কাছাকাছি আসা কোনো বস্তু—আলো বা অন্য কোনো পদার্থ—আর পালাতে পারে না। এই কারণে ব্ল্যাক হোলকে সরাসরি দেখা যায় না। বিজ্ঞানীরা এর চারপাশের বস্তুর ওপর এর প্রভাব দেখে অস্তিত্ব টের পান।
২. সময় dilation (Time dilation)
আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব অনুসারে, ব্ল্যাক হোলের কাছাকাছি সময় ধীর হয়ে যায়। এর মানে হলো, যদি কেউ ব্ল্যাক হোলের কাছাকাছি থাকে, তার জন্য সময় পৃথিবীর মানুষের চেয়ে অনেক ধীরে চলবে।
৩. স্প্যাগেটিফিকেশন (Spaghettification)
যদি কোনো বস্তু ব্ল্যাক হোলের খুব কাছে চলে যায়, তাহলে স্প্যাগেটিফিকেশন নামক একটি ঘটনা ঘটে। ব্ল্যাক হোলের শক্তিশালী মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র (gravitational field) বস্তুকে লম্বা করে দেয়— অনেকটা স্প্যাগেটির মতো। কারণ ব্ল্যাক হোলের কাছের অংশের ওপর মহাকর্ষীয় টান দূরের অংশের চেয়ে অনেক বেশি থাকে।
৪. হকিং রেডিয়েশন (Hawking radiation)
স্টিফেন হকিং (Stephen Hawking) দেখিয়েছিলেন যে ব্ল্যাক হোল ধীরে ধীরে শক্তি বিকিরণ (radiate) করতে পারে। এই বিকিরণকে হকিং রেডিয়েশন বলা হয়। এর মাধ্যমে ব্ল্যাক হোল ধীরে ধীরে ভর হারায় এবং শেষ পর্যন্ত বাষ্পীভূত (evaporate) হয়ে যেতে পারে।
ব্ল্যাক হোল নিয়ে গবেষণা
ব্ল্যাক হোল নিয়ে বিজ্ঞানীদের আগ্রহের কমতি নেই। প্রতিনিয়ত তারা এটি নিয়ে গবেষণা করছেন। এই গবেষণা মহাবিশ্বের অনেক অজানা রহস্য উন্মোচন করতে সাহায্য করছে।
১. ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ (Event Horizon Telescope)
ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপ (EHT) হলো আটটি রেডিও টেলিস্কোপের একটি আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক। এটি আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রে থাকা সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল স্যাজিটেরিয়াস এ*-এর প্রথম ছবি তৈরি করেছে। এই ছবি ব্ল্যাক হোল সম্পর্কে আমাদের ধারণা আরও স্পষ্ট করেছে।
২. মহাকর্ষীয় তরঙ্গ (Gravitational Waves)
ব্ল্যাক হোল যখন একে অপরের সাথে মেশে, তখন মহাকর্ষীয় তরঙ্গ তৈরি হয়। এই তরঙ্গগুলো আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ। লাইগো (LIGO) এবং Virgo-এর মতো ডিটেক্টরগুলো এই তরঙ্গ শনাক্ত করতে পারে, যা ব্ল্যাক হোল সম্পর্কে নতুন তথ্য দেয়।
৩. ব্ল্যাক ஹோলের প্রভাব
গবেষকরা ব্ল্যাক হোল কীভাবে গ্যালাক্সির গঠন এবং বিবর্তনে (evolution) প্রভাব ফেলে, তা নিয়েও কাজ করছেন। ব্ল্যাক হোল থেকে নির্গত শক্তি গ্যালাক্সির গ্যাস এবং ধূলিকণাকে উত্তপ্ত করতে পারে, যা নক্ষত্র তৈরির প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে।
কিছু সাধারণ প্রশ্ন (Frequently Asked Questions – FAQs)
ব্ল্যাক হোল নিয়ে কিছু প্রশ্ন প্রায়ই लोगोंদের মনে আসে। এখানে কয়েকটি সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
ব্ল্যাক হোল কি সত্যিই সবকিছু গিলে ফেলে?
হ্যাঁ, ব্ল্যাক হোল সবকিছু গিলে ফেলতে পারে, কিন্তু এর জন্য কোনো বস্তুকে ব্ল্যাক হোলের খুব কাছে যেতে হবে। যদি কোনো বস্তু একটি নির্দিষ্ট দূরত্বের মধ্যে আসে, তবে তা ব্ল্যাক হোলের মধ্যে পতিত হবে। তবে ব্ল্যাক হোল তার आसपासের সবকিছু लगातार গিলে ফেলে, এমন ধারণা ঠিক নয়।
ব্ল্যাক হোল কি আমাদের জন্য বিপজ্জনক?
যদি কোনো ব্ল্যাক হোল আমাদের সৌরজগতের কাছাকাছি থাকত, তবে তা বিপজ্জনক হতে পারত। কিন্তু সৌভাগ্যবশত, আমাদের কাছাকাছি কোনো ব্ল্যাক হোল নেই। আমাদের সবচেয়ে কাছের ব্ল্যাক হোল অনেক দূরে অবস্থিত।
ব্ল্যাক হোল কিভাবে কাজ করে?
ব্ল্যাক হোল মহাকর্ষীয় শক্তির মাধ্যমে কাজ করে। এর ভর অত্যন্ত বেশি হওয়ায় এর আশেপাশে একটি শক্তিশালী মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র তৈরি হয়। এই ক্ষেত্রের মধ্যে আসা যেকোনো কিছুই ব্ল্যাক হোলের দিকে আকৃষ্ট হয়।
ব্ল্যাক হোল কোথায় পাওয়া যায়?
ব্ল্যাক হোল মূলত গ্যালাক্সির কেন্দ্রে এবং নক্ষত্রমণ্ডলে পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, প্রায় প্রতিটি গ্যালাক্সির কেন্দ্রে একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল রয়েছে।
ব্ল্যাক ஹோলের ছবি কিভাবে তোলা হয়?
ব্ল্যাক হোল থেকে আলো বের হতে পারে না বলে সাধারণভাবে এর ছবি তোলা সম্ভব নয়। বিজ্ঞানীরা ইভেন্ট হরাইজন টেলিস্কোপের মাধ্যমে ব্ল্যাক হোলের आसपासের গ্যাস এবং ধূলিকণার ছবি তোলেন। এই ছবিগুলো থেকে ব্ল্যাক হোলের আকৃতি এবং বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীতে ব্ল্যাক হোল(Black hole in science fiction )
ব্ল্যাক হোল দীর্ঘদিন ধরেই কল্পবিজ্ঞান লেখকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। বিভিন্ন গল্পে ব্ল্যাক হোলকে সময় পরিভ্রমণ(time travel), অন্য জগতে যাওয়ার পথ হিসেবে দেখানো হয়েছে। ক্রিস্টোফার নোলানের “ইন্টারস্টেলার” (Interstellar) সিনেমায় ব্ল্যাক হোলকে কেন্দ্র করে জটিল সব ধারণা তুলে ধরা হয়েছে, যা দর্শকদের মনে বিজ্ঞান ও কল্পনার এক মিশ্র অনুভূতি তৈরি করে।
বাস্তব জীবনে ব্ল্যাক হোল(Black hole in reality)
যদিও ব্ল্যাক হোলকে ঘিরে অনেক কল্পকাহিনী প্রচলিত আছে, বাস্তবে এর প্রভাব আরও অনেক বেশি গভীর। ব্ল্যাক হোল মহাবিশ্বের গঠন এবং গ্যালাক্সির বিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন, ব্ল্যাক হোল গ্যালাক্সির কেন্দ্রে নক্ষত্র তৈরির হার নিয়ন্ত্রণ করে এবং গ্যালাক্সির আকার গঠনে সাহায্য করে।
শেষ কথা
ব্ল্যাক হোল সত্যিই মহাবিশ্বের এক বিস্ময়। এটা যেমন ভয়ের, তেমনই কৌতুহলের। বিজ্ঞানীদের নিরন্তর গবেষণা আমাদের এই কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কে আরও নতুন তথ্য জানতে সাহায্য করছে। ব্ল্যাক হোল সম্পর্কে আরও জানতে এবং মহাবিশ্বের এই রহস্যময় জগৎ নিয়ে আপনার ভাবনা জানাতে মন্তব্য করুন। কে জানে, হয়তো আপনিই একদিন ব্ল্যাক হোল নিয়ে নতুন কোনো তত্ত্ব দেবেন!