আচ্ছা, লাইটের খেলা কেমন লাগে আপনার? রংধনু দেখলে মনটা নেচে ওঠে, তাই না? কিন্তু এই রংধনুর পেছনে বা লাইটের নানান রঙের কারসাজির পেছনে যে একটা জটিল কিন্তু দারুণ মজার বিজ্ঞান লুকিয়ে আছে, সেটা জানেন কি? আজ আমরা সেই মজার বিজ্ঞান, মানে ব্যতিচার (Interference) নিয়ে কথা বলব। যদি সহজ ভাষায় বলি, ব্যতিচার হলো আলোর ঢেউয়ের মতো স্বভাবের একটা খেলা। চলুন, গভীরে যাওয়া যাক!
ব্যতিচার: আলোর ঢেউয়ের এক মজার খেলা
ব্যতিচার (Interference) হলো আলোর সেই ধর্ম, যেখানে দুই বা ততোধিক আলোকরশ্মি একে অপরের ওপর আপতিত হয়ে মিলিত হয় এবং নতুন একটি আলো তৈরি করে। এই নতুন আলোর তীব্রতা (intensity) আগের আলোকরশ্মিগুলোর তীব্রতা থেকে ভিন্ন হতে পারে। কোথাও আলো বেড়ে যায়, আবার কোথাও কমে গিয়ে অন্ধকারও তৈরি হতে পারে! ব্যাপারটা অনেকটা যেন ঢেউয়ের মতো – দুটো ঢেউ একসঙ্গে এলে যেমন বড় ঢেউ তৈরি হয়, আবার উল্টো দিকে এলে ঢেউয়ের উচ্চতা কমে যায়।
আলোর ব্যতিচার আসলে কী?
আলো মূলত তরঙ্গ আকারে চলে। যখন একাধিক আলোক তরঙ্গ একই স্থানে মিলিত হয়, তখন তাদের মধ্যে একটা যোগ-বিয়োগের খেলা শুরু হয়। এই যোগ-বিয়োগের ফলেই আলোর তীব্রতার পরিবর্তন ঘটে।
-
গঠনমূলক ব্যতিচার (Constructive Interference): যখন দুটি আলোকরশ্মির তরঙ্গশীর্ষ (crest) এবং তরঙ্গপাদ (trough) একই সময়ে মিলিত হয়, তখন তারা একে অপরের শক্তি যোগ করে। ফলে আলোকের তীব্রতা বেড়ে যায়। মানে, যেখানে অন্ধকার থাকার কথা, সেখানেও উজ্জ্বল আলো দেখা যায়!
-
ধ্বংসাত্মক ব্যতিচার (Destructive Interference): যখন একটি আলোকরশ্মির তরঙ্গশীর্ষ অন্যটির তরঙ্গপাদের সঙ্গে মিলিত হয়, তখন তারা একে অপরের শক্তিকে বাতিল করে দেয়। ফলে আলোকের তীব্রতা কমে যায়, এমনকি অন্ধকারও সৃষ্টি হতে পারে।
ব্যতিচারের উদাহরণ: দৈনন্দিন জীবনে আলোর খেলা
আমরা হয়তো সবসময় খেয়াল করি না, কিন্তু আমাদের চারপাশে ব্যতিচারের উদাহরণ ছড়িয়ে আছে। কয়েকটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হবে:
-
সাবানের বুদবুদ: ছোটবেলায় সাবানের বুদবুদ দিয়ে খেলেননি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এই বুদবুদের রংধনুর মতো ঝলমলে রংগুলো কিন্তু ব্যতিচারেরই ফল। বুদবুদের দেয়ালের বিভিন্ন স্থানে আলোর বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্য (wavelength) মিলিত হয়ে গঠনমূলক এবং ধ্বংসাত্মক ব্যতিচার ঘটায়। এর ফলে বিভিন্ন রঙের আলো আমাদের চোখে ধরা দেয়।
-
তেলের ওপর জলের আস্তরণ: রাস্তায় বা কোনো ভেজা জায়গায় তেলের ওপর জলের হালকা আস্তরণ দেখলে রংধনুর মতো একটা আভা দেখা যায়। এখানেও আলোর ব্যতিচার ঘটে। তেলের স্তরের ওপর এবং নীচের পৃষ্ঠ থেকে আলোকরশ্মি প্রতিফলিত হয়ে মিলিত হয় এবং বিভিন্ন রঙের সৃষ্টি করে।
-
লেজার রশ্মি: লেজার রশ্মি ব্যবহার করে ত্রিমাত্রিক ছবি (hologram) তৈরি করা হয়, সেখানেও ব্যতিচারের নীতি কাজে লাগানো হয়।
ব্যতিচারের প্রকারভেদ: কত রকমের হতে পারে এই আলোর খেলা?
আলোর ব্যতিচার মূলত দুই ধরনের হয়ে থাকে:
-
তরঙ্গমুখ বিভাজন (Wavefront Division): এই পদ্ধতিতে একটি আলোর তরঙ্গমুখকে (wavefront) দুটি অংশে ভাগ করা হয়। এই দুটি অংশ তারপর মিলিত হয়ে ব্যতিচার সৃষ্টি করে। ইয়ং-এর ডাবল স্লিট পরীক্ষা (Young’s double-slit experiment) এর সবচেয়ে পরিচিত উদাহরণ।
-
বিস্তার বিভাজন (Amplitude Division): এই পদ্ধতিতে একটি আলোর রশ্মিকে দুটি অংশে বিভক্ত করা হয়, যেখানে প্রতিটি অংশের বিস্তার (amplitude) মূল রশ্মির চেয়ে কম থাকে। এই দুটি রশ্মি পরে মিলিত হয়ে ব্যতিচার তৈরি করে। পাতলা ফিল্মের ব্যতিচার (thin film interference) এর একটি উদাহরণ।
ইয়ং-এর ডাবল স্লিট পরীক্ষা (Young’s Double-Slit Experiment)
থমাস ইয়ং ১৮০১ সালে এই পরীক্ষাটি করেন। এটি ব্যতিচারের একটি চমৎকার উদাহরণ। পরীক্ষায়, একটি আলোকরশ্মিকে দুটি খুব সরু ছিদ্রের (slit) মধ্য দিয়ে চালনা করা হয়। এই দুটি ছিদ্র থেকে আলোকরশ্মি ছড়িয়ে পড়ে এবং একে অপরের সাথে মিলিত হয়ে একটি স্ক্রিনে উজ্জ্বল এবং অন্ধকার ডোরাকাটা (fringe pattern) তৈরি করে। এই ডোরাকাটাগুলোই হলো ব্যতিচারের ফল।
এই পরীক্ষা প্রমাণ করে যে আলো একই সাথে তরঙ্গ এবং কণা হিসেবে আচরণ করতে পারে।
পাতলা ফিল্মের ব্যতিচার (Thin Film Interference)
সাবানের বুদবুদ বা তেলের ওপরিতলে যে রংধনু দেখা যায়, তা হলো পাতলা ফিল্মের ব্যতিচারের উদাহরণ। যখন আলো একটি পাতলা ফিল্মের ওপর পড়ে, তখন আলোর কিছু অংশ ফিল্মের ওপরের পৃষ্ঠ থেকে প্রতিফলিত হয় এবং কিছু অংশ ফিল্মের মধ্যে প্রবেশ করে নীচের পৃষ্ঠ থেকে প্রতিফলিত হয়। এই দুটি প্রতিফলিত রশ্মি মিলিত হয়ে ব্যতিচার ঘটায়।
ফিল্মের বেধ (thickness) এবং আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন রঙের আলো গঠিত বা ধ্বংস হতে পারে। এ কারণেই আমরা বিভিন্ন রঙের ঝলক দেখতে পাই।
ব্যতিচারের শর্ত: কখন এই খেলা জমে উঠবে?
ব্যতিচার ভালোভাবে ঘটার জন্য কিছু শর্ত পূরণ হওয়া দরকার। এই শর্তগুলো না মানলে আলোর খেলাটা ঠিকমতো জমবে না!
-
সুসংগত উৎস (Coherent Sources): আলোর উৎসগুলোকে সুসংগত হতে হবে। এর মানে হলো, উৎস থেকে নির্গত আলোকরশ্মিগুলোর মধ্যে একটি নির্দিষ্ট এবং ধ্রুবক দশা পার্থক্য (phase difference) থাকতে হবে। সহজ ভাষায়, আলোকরশ্মিগুলোকে একই তালে চলতে হবে।
-
একবর্ণী আলো (Monochromatic Light): আলোকরশ্মিগুলোকে একবর্ণী হতে হবে। অর্থাৎ, আলোর একটি নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্য থাকতে হবে। সাদা আলো ব্যবহার করলে বিভিন্ন রঙের আলো মিশে গিয়ে ব্যতিচারের প্যাটার্ন বোঝা কঠিন হয়ে যায়।
-
ছোট পথ পার্থক্য (Small Path Difference): আলোকরশ্মিগুলোর মধ্যে পথ পার্থক্য (path difference) খুব বেশি হওয়া উচিত না। পথ পার্থক্য বেশি হলে ব্যতিচারের প্যাটার্ন দুর্বল হয়ে যায়।
এখানে একটা টেবিল দেওয়া হলো, যেখানে ব্যতিচারের প্রকারভেদ এবং তাদের শর্তগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো:
ব্যতিচারের প্রকারভেদ | আলোর উৎস | শর্ত | উদাহরণ |
---|---|---|---|
তরঙ্গমুখ বিভাজন | সুসংগত এবং একবর্ণী | ছোট পথ পার্থক্য | ইয়ং-এর ডাবল স্লিট পরীক্ষা |
বিস্তার বিভাজন | সুসংগত এবং একবর্ণী | ফিল্মের বেধ আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের কাছাকাছি হতে হবে | পাতলা ফিল্মের ব্যতিচার (যেমন সাবানের বুদবুদ) |
ব্যতিচারের ব্যবহার: কোথায় কাজে লাগে এই আলোর খেলা?
ব্যতিচার শুধু একটা মজার ঘটনাই নয়, এর অনেক ব্যবহারিক প্রয়োগও আছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যতিচারকে কাজে লাগানো হয়।
-
হolography (ত্রিমাত্রিক চিত্র): ব্যতিচারের মাধ্যমে ত্রিমাত্রিক ছবি তৈরি করা হয়। হolography-তে একটি বস্তুর আলোকরশ্মিকে একটি রেফারেন্স রশ্মির সাথে মিলিত করে ব্যতিচার প্যাটার্ন তৈরি করা হয়। এই প্যাটার্নটিকে একটি ফিল্মে ধারণ করা হয়, যা পরে আলো দিয়ে আলোকিত করলে ত্রিমাত্রিক ছবি দেখা যায়।
-
অপটিক্যাল ইন্টারফেরোমিটার (Optical Interferometer): এটি একটি অত্যন্ত সংবেদনশীল যন্ত্র, যা আলোর ব্যতিচার ব্যবহার করে অতি ক্ষুদ্র দূরত্ব বা পৃষ্ঠের অনিয়ম পরিমাপ করতে পারে। এটি বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।
-
অ্যান্টি-রিফ্লেক্টিং কোটিং (Anti-Reflecting Coating): চশমা বা ক্যামেরার লেন্সের ওপর যে অ্যান্টি-রিফ্লেক্টিং কোটিং দেওয়া হয়, সেটিও ব্যতিচারের নীতিতে কাজ করে। এই কোটিংয়ের কারণে লেন্সের ওপর আলো পড়লে আলোর প্রতিফলন কমে যায়, ফলে ছবি আরও স্পষ্ট হয়।
- অপটিক্যাল ফাইবার (Optical Fiber): অপটিক্যাল ফাইবার দিয়ে ডেটা পাঠানোর সময় আলোর ব্যতিচার ব্যবহার করে সিগন্যালকে আরও শক্তিশালী করা হয়।
ব্যতিচার এবং অপবর্তন (Diffraction): এদের মধ্যে পার্থক্য কী?
অনেকের মনেই এই প্রশ্নটা আসে যে, ব্যতিচার আর অপবর্তন কি একই জিনিস, নাকি আলাদা? এদের মধ্যে কিছু মিল থাকলেও এরা কিন্তু আলাদা।
-
ব্যতিচার: যখন দুটি আলাদা উৎস থেকে আসা আলোকরশ্মি মিলিত হয়ে নতুন আলো তৈরি করে, তখন সেটাকে ব্যতিচার বলে। এখানে আলোর উৎস দুটি ভিন্ন ছিদ্র বা উৎস থেকে আসে।
-
অপবর্তন: যখন আলো কোনো ধারালো প্রান্ত বা ছোট ছিদ্রের মধ্যে দিয়ে যায়, তখন সেটি বেঁকে যায় বা ছড়িয়ে পড়ে। এই বেঁকে যাওয়া বা ছড়িয়ে পড়াকে অপবর্তন বলে। এখানে আলোর উৎস একটাই থাকে, কিন্তু আলোর পথ পরিবর্তিত হয়ে যায়।
সহজভাবে বললে, ব্যতিচার হলো একাধিক আলোর তরঙ্গের মধ্যে যোগ-বিয়োগের খেলা, আর অপবর্তন হলো আলোর বাঁক নেওয়ার ঘটনা।
ব্যতিচার নিয়ে কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ)
এখানে ব্যতিচার নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো, যা আপনাদের মনে প্রায়ই উঁকি দেয়:
-
প্রশ্ন: ব্যতিচারের জন্য আলোর উৎস কেমন হওয়া উচিত?
উত্তর: ব্যতিচারের জন্য আলোর উৎস সুসংগত (coherent) এবং একবর্ণী (monochromatic) হওয়া উচিত। এর মানে হলো, উৎস থেকে নির্গত আলোকরশ্মিগুলোর মধ্যে একটি নির্দিষ্ট এবং ধ্রুবক দশা পার্থক্য (phase difference) থাকতে হবে এবং আলোর একটি নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্য থাকতে হবে।
-
প্রশ্ন: গঠনমূলক ও ধ্বংসাত্মক ব্যতিচার বলতে কী বোঝায়?
উত্তর: যখন দুটি আলোকরশ্মির তরঙ্গশীর্ষ (crest) এবং তরঙ্গপাদ (trough) একই সময়ে মিলিত হয়, তখন তারা একে অপরের শক্তি যোগ করে। ফলে আলোকের তীব্রতা বেড়ে যায়, একে গঠনমূলক ব্যতিচার বলে। আর যখন একটি আলোকরশ্মির তরঙ্গশীর্ষ অন্যটির তরঙ্গপাদের সঙ্গে মিলিত হয়, তখন তারা একে অপরের শক্তিকে বাতিল করে দেয়। ফলে আলোকের তীব্রতা কমে যায়, একে ধ্বংসাত্মক ব্যতিচার বলে।
-
প্রশ্ন: দৈনন্দিন জীবনে ব্যতিচারের কয়েকটি উদাহরণ দিন।
**উত্তর:** সাবানের বুদবুদের রংধনু, তেলের ওপর জলের আস্তরণে রংধনু আভা, এবং অ্যান্টি-রিফ্লেক্টিং কোটিং – এগুলো সবই ব্যতিচারের উদাহরণ।
-
প্রশ্ন: ব্যতিচার এবং অপবর্তনের মধ্যে মূল পার্থক্য কী?
উত্তর: ব্যতিচার হলো একাধিক আলোর তরঙ্গের মধ্যে যোগ-বিয়োগের খেলা, যেখানে অপবর্তন হলো আলোর বাঁক নেওয়ার ঘটনা। ব্যতিচারে আলোর একাধিক উৎস লাগে, কিন্তু অপবর্তনে আলোর উৎস একটাই থাকে।
-
প্রশ্ন: ব্যতিচার কোথায় ব্যবহার করা হয়?
উত্তর: ব্যতিচার হolography, অপটিক্যাল ইন্টারফেরোমিটার, অ্যান্টি-রিফ্লেক্টিং কোটিং এবং অপটিক্যাল ফাইবারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।
উপসংহার: আলোর এই খেলা চলতেই থাকুক
ব্যতিচার হলো আলোর এক চমৎকার বৈশিষ্ট্য, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নানাভাবে প্রভাব ফেলে। এই আলোর খেলা শুধু মজার নয়, এটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অনেক গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবনের ভিত্তি। আপনি যখনই রংধনুর মতো কোনো ঝলমলে আলো দেখবেন, মনে রাখবেন সেখানে ব্যতিচারের কারসাজি আছে।
আশা করি, আজকের আলোচনা থেকে ব্যতিচার সম্পর্কে আপনার ধারণা স্পষ্ট হয়েছে। যদি কোনো প্রশ্ন থাকে, তবে নির্দ্বিধায় কমেন্ট করে জানান। আর এই আলোর খেলা নিয়ে আরও জানতে চোখ রাখুন আমাদের ব্লগে!
তাহলে, আলোর এই মজার খেলা চলতেই থাকুক, কেমন?