জেনে নিন চেক কি: ব্যবহার, প্রকারভেদ এবং প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী
আচ্ছা, ধরুন তো, মাসের শেষে বাড়ি ভাড়া দিতে হবে, কিন্তু পকেটে নগদ টাকা নেই? কিংবা প্রিয় বন্ধুকে তার জন্মদিনে দারুণ একটা উপহার দিতে চান, কিন্তু অনলাইন পেমেন্টের ঝামেলা এড়াতে চান? এই সব সমস্যার সহজ সমাধান হতে পারে একটি “চেক”। কিন্তু চেক আসলে কী, কিভাবে এটা কাজ করে, আর ব্যবহারের সুবিধাগুলোই বা কি কি? চলুন, বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক!
চেক কী? (What is a Cheque?)
সহজ ভাষায়, চেক হলো একটা লিখিত নির্দেশ। আপনি আপনার ব্যাংককে বলছেন, আপনার অ্যাকাউন্ট থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা যেন ঐ চেকে উল্লিখিত ব্যক্তিকে বা প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়। এটা অনেকটা পুরনো দিনের সেই “হুণ্ডি”র মতো, তবে আধুনিক এবং অনেক বেশি সুরক্ষিত।
চেকের খুঁটিনাটি: আসুন, একটা চেকের অংশগুলো চিনে নেই
একটা চেকের বিভিন্ন অংশ থাকে, যেগুলোর সঠিক ব্যবহার জানা আপনার জন্য খুবই জরুরি। নিচে একটা টেবিলের মাধ্যমে সেই অংশগুলো আলোচনা করা হলো:
অংশের নাম | বিবরণ | যা মনে রাখতে হবে |
---|---|---|
তারিখ | চেকে যেদিন তারিখ দেবেন, সেদিন বা তার পরে ঐ চেকটি কার্যকর হবে৷ পুরনো তারিখ দিলে ব্যাংক নাও নিতে পারে। | তারিখ লেখার সময় খুব সতর্ক থাকুন। কোনো ঘষামাজা করবেন না। |
প্রাপকের নাম | যার নামে চেকটি কাটা হচ্ছে, তার নাম এখানে লিখতে হবে। “স্বয়ং” অথবা “Bearer” লিখলে যে কেউ টাকা তুলতে পারবে। | নাম লেখার সময় বানান ভুল করা চলবে না। যদি কারো নাম ভুল করে লিখে থাকেন, তাহলে অবশ্যই সেটাকে কেটে আপনার সাইন দিয়ে ঠিক করে দিন। |
টাকার পরিমাণ (কথায়) | এখানে সংখ্যায় নয়, কথায় টাকার পরিমাণ লিখতে হবে। যেমন: “এক হাজার টাকা মাত্র”। | লেখার শুরুতে ও শেষে অবশ্যই সতর্কতার সাথে শব্দ বসান, যাতে কেউ টাকার পরিমাণ পরিবর্তন করতে না পারে। যেমনঃ “মাত্র” কথাটি ব্যবহার করুন। |
টাকার পরিমাণ (সংখ্যায়) | এখানে টাকার পরিমাণ সংখ্যায় লিখতে হবে। যেমন: “1000”। | টাকার আগে একটি টাকার চিহ্ন (৳) ব্যবহার করুন এবং পরে একটি হাইফেন (-) দিন যাতে কেউ অতিরিক্ত সংখ্যা যোগ করতে না পারে। |
স্বাক্ষর | এটা সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। আপনার সই ব্যাংকের রেকর্ডের সাথে মিলতেই হবে। | সই করার সময় তাড়াহুড়ো করবেন না। আপনার স্বাভাবিক সই করুন, যেটা ব্যাংকে দেওয়া আছে। |
MICR কোড | এটা চেকের নিচের দিকে থাকা নয়টি সংখ্যার একটি বিশেষ কোড, যা দিয়ে ব্যাংক এবং শাখা সনাক্ত করা হয়। | এই কোড নিয়ে আপনার কিছু করার নেই। এটা ব্যাংক ব্যবহার করে। |
IFSC কোড | এটি একটি ১১ ডিজিটের আলফানিউমেরিক কোড, যা অনলাইন লেনদেনের জন্য দরকার হয়। | MICR এবং IFSC কোড আলাদা। আপনার শাখার IFSC কোড জেনে রাখুন। |
চেকের প্রকারভেদ (Types of Cheques)
বিভিন্ন ধরণের পরিস্থিতির জন্য বিভিন্ন ধরণের চেক রয়েছে। কয়েকটি বহুল ব্যবহৃত চেক নিচে আলোচনা করা হলো:
বাহক চেক (Bearer Cheque)
এই ধরণের চেক সবথেকে সহজলভ্য। যার কাছে এই চেক থাকবে, সে-ই ব্যাংকে গিয়ে টাকা তুলতে পারবে। তবে, এটা খুব ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ চেক হারিয়ে গেলে যে কেউ টাকা তুলে নিতে পারে।
হুকুম চেক (Order Cheque)
এই চেকে প্রাপকের নামের পাশে “অথবা বাহককে” কথাটি কেটে দিতে হয়। এর মানে হলো, যার নাম লেখা আছে, শুধুমাত্র তিনিই টাকা তুলতে পারবেন।
ক্রসড চেক (Crossed Cheque)
এই চেকে চেকে উপরে বাঁ দিকে কোনাকুনি দুটো লাইন টানা হয়। এর মানে হলো, এই চেক শুধুমাত্র প্রাপকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়া যাবে, সরাসরি ক্যাশ তোলা যাবে না। এটা তুলনামূলকভাবে বেশি নিরাপদ।
অ্যাকাউন্ট পেয়ী চেক (Account Payee Cheque)
ক্রসড চেকের মতো, এই চেকের উপরে কোনাকুনি দুটো লাইন টেনে মাঝখানে “Account Payee” অথবা “A/C Payee” লিখে দিতে হয়। এর মানে হলো, এই চেক শুধুমাত্র প্রাপকের অ্যাকাউন্টেই জমা হবে, অন্য কারো অ্যাকাউন্টে নয়।
পোস্ট-ডেটেড চেক (Post-Dated Cheque)
এই চেকে ভবিষ্যতের কোনো তারিখ দেওয়া হয়। এই চেক ঐ তারিখে বা তার পরে ক্যাশ করা যায়। যেমন, আপনি যদি আজকের তারিখে একটি চেক লিখে এক মাস পরের তারিখ দেন, তাহলে ঐ ব্যক্তি এক মাস পরেই কেবল টাকা তুলতে পারবে।
স্টেল চেক (Stale Cheque)
যদি কোনো চেকে দেওয়া তারিখের তিন মাস পেরিয়ে যায়, তাহলে সেটি বাতিল বলে গণ্য হয়। ব্যাংক সাধারণত এই ধরণের চেক গ্রহণ করে না।
চেকের সুবিধা (Advantages of Cheques)
- নিরাপত্তা: নগদ টাকার থেকে অনেক বেশি নিরাপদ, বিশেষ করে ক্রসড চেক।
- রেকর্ড রাখা: প্রতিটি লেনদেনের লিখিত প্রমাণ থাকে, যা হিসাব রাখতে সুবিধা দেয়।
- পরিমাণ: বড় অঙ্কের টাকা লেনদেনের জন্য এটা খুবই উপযোগী।
- দূরবর্তী লেনদেন: দেশের যেকোনো প্রান্তে চেক পাঠানো যায়।
চেক লেখার নিয়মাবলী (How to Write a Cheque)
- সর্বপ্রথম তারিখ লিখুন।
- প্রাপকের নাম লিখুন।
- কথায় টাকার পরিমাণ লিখুন।
- সংখ্যায় টাকার পরিমাণ লিখুন।
- অবশ্যই আপনার সই করুন।
চেক লেখার সময় কিছু সতর্কতা (Precautions while Writing a Cheque)
- কাটিং বা ঘষামাজা করা থেকে বিরত থাকুন। যদি ভুল হয়, নতুন চেক ব্যবহার করুন।
- সই যেন আপনার ব্যাংক রেকর্ডের সাথে মেলে।
- চেকের পিছনে আপনার ফোন নম্বর লিখে দিন, যাতে কোনো সমস্যা হলে যোগাযোগ করা যায়।
- সবসময় ভালো মানের কালি ব্যবহার করুন, যাতে কেউ ঘষে তুলতে না পারে।
বাংলাদেশে চেকের ব্যবহার (Use of Cheques in Bangladesh)
বাংলাদেশে এখনো অনেক ব্যবসা এবং ব্যক্তিগত লেনদেনের জন্য চেক ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে বড় অঙ্কের লেনদেন, বাড়ি ভাড়া দেওয়া, বা অন্য কোনো সার্ভিস চার্জ দেওয়ার জন্য এটা বেশ জনপ্রিয়।
বাংলাদেশে অনলাইন চেকিং-এর সুযোগ (Online Cheque Verification)
বর্তমানে কিছু ব্যাংক অনলাইন চেকিং-এর সুবিধা দিচ্ছে। এর মাধ্যমে আপনি ঘরে বসেই জানতে পারবেন আপনার দেওয়া চেকটি ক্লিয়ার হয়েছে কিনা।
চেক ডিজঅনার (Cheque Dishonour)
যদি আপনার অ্যাকাউন্টে যথেষ্ট টাকা না থাকে অথবা অন্য কোনো কারণে ব্যাংক চেকটি প্রত্যাখ্যান করে, তখন সেটাকে “চেক ডিজঅনার” বলা হয়।
চেক ডিজঅনার হলে কি করবেন? (What to do if a Cheque is Dishonoured?)
- প্রথমে ব্যাংক থেকে ডিজঅনারের কারণ জানুন।
- যাকে চেক দিয়েছেন, তার সাথে যোগাযোগ করে বিষয়টি জানান।
- দ্রুত অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দিন এবং তাকে আবার চেক জমা দিতে বলুন।
মামলার প্রক্রিয়া (Legal Action)
যদি চেক ডিজঅনার হওয়ার পরেও টাকা পরিশোধ করা না হয়, তাহলে আপনি আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। বাংলাদেশে চেক ডিজঅনারের জন্য মামলা করার বিধান রয়েছে।
কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা (Frequently Asked Questions – FAQs)
এখানে চেক নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো, যা আপনাদের কাজে লাগতে পারে।
চেক কত দিনের মধ্যে জমা দিতে হয়?
সাধারণত, ইস্যু করার তারিখ থেকে ৩ মাসের মধ্যে চেক জমা দিতে হয়। এই সময়সীমা পার হয়ে গেলে, চেকটি “স্টেল চেক” হিসেবে গণ্য হয় এবং ব্যাংক তা গ্রহণ করে না।
চেকের মেয়াদ কত দিন থাকে?
চেকের মেয়াদ সাধারণত ইস্যু করার তারিখ থেকে ৩ মাস পর্যন্ত থাকে।
আমি কি আমার নিজের নামে চেক লিখতে পারি?
অবশ্যই পারেন। আপনি যদি নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলতে চান, তাহলে চেকে “স্বয়ং” অথবা “Self” লিখে নিজের সই করে ব্যাংক থেকে টাকা তুলতে পারবেন।
চেক হারিয়ে গেলে কি করব?
- অবিলম্বে আপনার ব্যাংককে বিষয়টি জানান।
- চেকটি বাতিল (Stop Payment) করার জন্য আবেদন করুন।
- যদি আপনি মনে করেন চেকটি চুরি হয়েছে, তাহলে থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (GD) করুন।
চেকের পেমেন্ট বন্ধ করার নিয়ম কি?
চেকের পেমেন্ট বন্ধ করতে হলে, দ্রুত আপনার ব্যাংকের সাথে যোগাযোগ করুন এবং তাদেরকে একটি লিখিত আবেদন দিন। আপনার পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য ব্যাংক কিছু তথ্য চাইতে পারে।
চেক বইয়ের জন্য কিভাবে আবেদন করতে হয়?
চেক বইয়ের জন্য আবেদন করা এখন খুব সহজ। আপনি আপনার ব্যাংকের অনলাইন পোর্টালে লগইন করে অথবা সরাসরি শাখায় গিয়ে আবেদন করতে পারেন। কিছু ব্যাংক মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমেও এই সুবিধা দিয়ে থাকে।
একউন্ট পেয়ী চেক কি অনলাইন ব্যাংকিং-এর মাধ্যমে দেওয়া যায়?
বর্তমানে কিছু ব্যাংক এই সুবিধা দিচ্ছে, যেখানে আপনি অনলাইনে “Account Payee” চেক ইস্যু করতে পারেন। তবে, এই সুবিধাটি এখনো সব ব্যাংকে উপলব্ধ নয়।
আশা করি, এই ব্লগ পোস্টটি আপনাকে চেক সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারণা দিতে পেরেছে। যদি আপনার আরও কিছু জানার থাকে, তবে নির্দ্বিধায় কমেন্ট সেকশনে জিজ্ঞাসা করতে পারেন।
উপসংহার (Conclusion)
তাহলে, চেক শুধু একটা কাগজের টুকরো নয়, এটা আপনার আর্থিক লেনদেনের একটা গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। তাই, চেক ব্যবহারের নিয়মকানুন ও সতর্কতাগুলো জেনে রাখা আমাদের সবার জন্য জরুরি। সঠিক ব্যবহার এবং একটু সাবধানতা অবলম্বন করলে, আপনিও নিরাপদে এবং সহজে আপনার আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করতে পারবেন। মনে রাখবেন, আপনার সচেতনতাই আপনার টাকা সুরক্ষিত রাখার প্রথম পদক্ষেপ। Happy Chequing!
যদি এই আর্টিকেলটি আপনার ভালো লেগে থাকে, তাহলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না। আর হ্যাঁ, আপনার কোনো মতামত বা জিজ্ঞাসা থাকলে নিচে কমেন্ট করে জানাতে পারেন।