শৈশবের সেই মিষ্টি সুর, মায়ের মুখের গল্প, আর দাদুর কাঁধে চড়ে জগৎ দেখার আনন্দ – এই সবকিছু যেন এক সুতোয় বাঁধা। আর সেই সুতোটা হলো ছড়া। আচ্ছা, কখনো কি ভেবেছেন ছড়া আসলে কী? শুধু কি কয়েকটা ছন্দ মেলানো শব্দ, নাকি এর ভেতরে লুকিয়ে আছে আরও অনেক কিছু? চলুন, আজ আমরা ছড়ার জগতে ডুব দেই, আর খুঁজে বের করি “ছড়া কাকে বলে” – এই প্রশ্নের উত্তর।
ছড়া: শব্দে আঁকা জীবনের ছবি
ছড়া হলো বাংলা সাহিত্যের এক মজার আর জনপ্রিয় শাখা। এটা কবিতা নয়, কিন্তু কবিতার মতোই ছন্দ আছে, সুর আছে, আর আছে জীবনের কথা বলার এক নিজস্ব ভঙ্গি। ছড়া ছোটদের জন্য লেখা হলেও, এর আবেদন কিন্তু সব বয়সের মানুষের কাছেই সমান।
ছড়ার সংজ্ঞা (Definition of Chhara)
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, ছড়া হলো অল্প কয়েকটি লাইনের ছোট কবিতা। এর মূল উদ্দেশ্য আনন্দ দেওয়া। ছড়ার ভাষা সহজ-সরল হয়, যেন খুব সহজেই তা ছোটদের মনে গেঁথে যায়। ছড়ার ছন্দ থাকে খুব মিষ্টি আর মনে রাখার মতো। ছড়ার বিষয় হতে পারে যেকোনো কিছু – পাখি, ফুল, ফল, নদী, মানুষ, কিংবা মজার কোনো ঘটনা।
ছড়ার বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Chhara)
ছড়াকে অন্য সাহিত্যকর্ম থেকে আলাদা করে এর কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য। নিচে কয়েকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হলো:
- সংক্ষিপ্ত: ছড়া সাধারণত খুব ছোট হয়। কয়েক লাইন থেকে শুরু করে বড়জোর কয়েক প্যারার মধ্যে এটি শেষ হয়ে যায়।
- ছন্দময়: ছড়ার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এর ছন্দ। ছন্দে বাঁধা থাকার কারণে এটি সহজে মুখস্থ করা যায় এবং শুনতে ভালো লাগে।
- সরল ভাষা: ছড়ার ভাষা সহজ ও সরল হয়। জটিল শব্দ বা কঠিন বাক্য এখানে ব্যবহার করা হয় না।
- আনন্দদায়ক: ছড়ার মূল উদ্দেশ্য হলো পাঠককে আনন্দ দেওয়া। এটি পড়ার সময় মন ভালো হয়ে যায়।
- শিক্ষণীয়: অনেক ছড়ার মধ্যে শিক্ষামূলক বার্তা থাকে। গল্পের ছলে শিশুদের অনেক কিছু শেখানো যায়।
- চিত্রকল্প: ভালো ছড়া পড়ার সময় চোখের সামনে যেন একটি ছবি ভেসে ওঠে। ছড়াকার শব্দের মাধ্যমে এমন একটি জগৎ তৈরি করেন।
ছড়ার প্রকারভেদ (Types of Chhara)
ছড়া বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকের ওপর ভিত্তি করে। নিচে কয়েকটি প্রধান প্রকার উল্লেখ করা হলো:
-
**রূপকথা বিষয়ক ছড়াঃ ** এই ধরনের ছড়াগুলোতে সাধারণত রাজপুত্র, রাজকন্যা, দৈত্য-দানো, পরি ইত্যাদি কাল্পনিক চরিত্র এবং ঘটনা স্থান পায়। এই ছড়াগুলো শিশুদের এক কল্পনার জগতে নিয়ে যায়, যেখানে তারা নিজের মতো করে সবকিছু ভাবতে পারে।
-
ইতিহাস বিষয়ক ছড়াঃ ইতিহাসের কোনো ঘটনা বা ঐতিহাসিক চরিত্র নিয়ে লেখা ছড়া এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। এর মাধ্যমে শিশুরা খেলার ছলে ইতিহাস জানতে পারে।
-
কৌতুক বিষয়ক ছড়াঃ এই ছড়াগুলোতে হাস্যরস ও মজার ঘটনা থাকে। পড়ার সময় হাসি চেপে রাখা কঠিন।
-
প্রকৃতি বিষয়ক ছড়াঃ প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদান যেমন – ফুল, পাখি, নদী, আকাশ ইত্যাদি নিয়ে লেখা ছড়া এই শ্রেণিতে পড়ে।
-
শিখন বিষয়ক ছড়াঃ যে ছড়াগুলোর মধ্যে কোনো উপদেশ বা শিক্ষার বার্তা থাকে।
-
সামাজিক বিষয়ক ছড়াঃ এই ছড়াগুলোতে সমাজের নানা দিক ও সমস্যাগুলো তুলে ধরা হয়।
কেন ছড়া শিশুদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ?
ছোটবেলায় ছড়া শোনার বা পড়ার অনেক উপকারিতা আছে। এটা শুধু বিনোদন নয়, শিশুদের মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশেও সাহায্য করে। এখানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ উল্লেখ করা হলো:
- ভাষা শিক্ষার সহায়ক: ছড়া শিশুদের নতুন শব্দ শিখতে সাহায্য করে। ছন্দের মাধ্যমে ভাষার ধ্বনি ও উচ্চারণ সম্পর্কে ধারণা তৈরি হয়।
- স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে: ছড়া সহজে মুখস্থ করা যায়। এর মাধ্যমে শিশুদের স্মৃতিশক্তি বাড়ে।
- কল্পনাশক্তির বিকাশ ঘটায়: ছড়া শিশুদের মনে কল্পনার জগৎ তৈরি করে। তারা নিজের মতো করে ভাবতে শেখে।
- আনন্দ দেয় ও মানসিক চাপ কমায়: ছড়া শিশুদের আনন্দ দেয় এবং তাদের মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে।
- সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করায়: ছড়া আমাদের সংস্কৃতির একটি অংশ। এর মাধ্যমে শিশুরা নিজেদের ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারে।
- নৈতিক শিক্ষা দেয়: অনেক ছড়ার মধ্যে নীতি ও নৈতিকতার কথা বলা থাকে, যা শিশুদের ভালো মানুষ হতে সাহায্য করে।
সেরা কিছু বাংলা ছড়া (Best Bengali Chharas)
বাংলা সাহিত্যে অনেক বিখ্যাত ছড়া আছে, যা আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। এখানে কয়েকটি জনপ্রিয় ছড়ার উদাহরণ দেওয়া হলো:
ছড়ার নাম | রচয়িতা |
---|---|
“আতা গাছে তোতা পাখি” | যোগীন্দ্রনাথ সরকার |
“খোকন খোকন ডাক পাড়ি” | যতীন্দ্রমোহন বাগচী |
“কাজলা দিদি” | যতীন্দ্রমোহন বাগচী |
“আমাদের ছোট নদী” | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর |
“বাবুরাম সাপুড়ে” | অন্নদাশঙ্কর রায় |
“ট্রেন” | শামসুর রাহমান |
“হাট্টিমাটিম টিম” | উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী |
এই ছড়াগুলো শুধু ছোটদের নয়, বড়দের কাছেও সমান প্রিয়।
ছড়া লেখার নিয়ম (Rules of Writing Chhara)
আপনিও চাইলে ছড়া লিখতে পারেন। ছড়া লেখা কঠিন কিছু নয়, শুধু কয়েকটি বিষয় মনে রাখতে হয়।
- বিষয় নির্বাচন: প্রথমে একটি মজার বিষয় বেছে নিন। সেটা হতে পারে আপনার দেখা কোনো ঘটনা, কোনো মজার মানুষ, কিংবা প্রকৃতির কোনো দৃশ্য।
- ভাষা: সহজ ও সরল ভাষায় লিখুন। কঠিন শব্দ ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন।
- ছন্দ: ছড়া লেখার সময় ছন্দের দিকে মনোযোগ দিন। প্রতিটি লাইনের শেষে মিল রাখার চেষ্টা করুন।
- সরল বাক্য: ছোট ছোট বাক্য ব্যবহার করুন, যাতে বুঝতে সুবিধা হয়।
- উপমা ও রূপক: ছড়াকে সুন্দর করার জন্য উপমা ও রূপক ব্যবহার করতে পারেন।
উদাহরণস্বরূপ একটি ছোট ছড়া:
ঘুম পাড়ানি মাসি পিসি,
এসো আমার বাড়ি।
কলমি লতায় বাঁধাই আসন,
জল চৌকির পাড়ি।
বর্তমান সময়ে ছড়ার প্রাসঙ্গিকতা
আধুনিক যুগে এসেও ছড়ার গুরুত্ব কমেনি। বরং, এখনকার শিশুরা কার্টুন, ভিডিও গেমসের পাশাপাশি ছড়ার প্রতিও আগ্রহ দেখাচ্ছে। অনেক ওয়েবসাইট ও অ্যাপে এখন বাংলা ছড়া পাওয়া যায়, যা শিশুদের জন্য শেখা ও শোনা আরও সহজ করে দিয়েছে।
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ছড়া
বর্তমানে ইউটিউব, স্পটিফাইয়ের মতো প্ল্যাটফর্মে ছড়াগুলো খুব সহজেই পাওয়া যায়। এর ফলে নতুন প্রজন্মের শিশুরা ছড়ার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে।
ছড়া নিয়ে আধুনিক কাজ
- বর্তমানে অনেক লেখক শিশুদের জন্য নতুন নতুন ছড়া লিখছেন, যা সমসাময়িক বিষয় নিয়ে তৈরি।
- অনেকে ছড়াগুলোকে সুর দিয়ে গান আকারে প্রকাশ করছেন, যা শিশুদের কাছে আরও বেশি জনপ্রিয় হচ্ছে।
- বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছড়া আবৃত্তি ও লেখার প্রতিযোগিতা আয়োজিত হচ্ছে, যা শিশুদের উৎসাহিত করছে।
ছড়া নিয়ে কিছু মজার তথ্য
- বাংলা সাহিত্যের প্রথম ছড়া সম্ভবত চর্যাপদের কবিতাগুলো।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেক বিখ্যাত ছড়া লিখেছেন, যা আজও শিশুদের কাছে খুব জনপ্রিয়।
- উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছিলেন একজন বিখ্যাত ছড়াকার ও শিশুসাহিত্যিক। তাঁর লেখা “টুনটুনির বই” আজও খুব জনপ্রিয়।
- সুকুমার রায়, সত্যজিৎ রায়, অন্নদাশঙ্কর রায়-এর মতো লেখকরাও অনেক মজার ছড়া লিখেছেন।
কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসা (Frequently Asked Questions – FAQs)
১. ছড়া ও কবিতার মধ্যে পার্থক্য কী?
ছড়া মূলত ছোট আকারের হয় এবং এর প্রধান উদ্দেশ্য আনন্দ দেওয়া। এর ভাষা সহজ ও সরল থাকে। অন্যদিকে, কবিতা বড় হতে পারে এবং এতে গভীর অনুভূতি ও জটিল বিষয় থাকতে পারে। কবিতার ভাষা ছড়ার চেয়ে বেশি অলঙ্কৃত হতে পারে।
২. শিশুদের জন্য কেমন ছড়া নির্বাচন করা উচিত?
শিশুদের জন্য এমন ছড়া নির্বাচন করা উচিত, যা সহজবোধ্য, ছন্দময় এবং শিক্ষামূলক। ছড়ার বিষয়বস্তু যেন তাদের আগ্রহের সঙ্গে মেলে।
৩. ছড়া কি শুধু ছোটদের জন্য?
না, ছড়া শুধু ছোটদের জন্য নয়। ছড়া সব বয়সের মানুষের কাছেই জনপ্রিয়। অনেক বড়রাও নস্টালজিয়া থেকে কিংবা নিছক আনন্দের জন্য ছড়া পড়েন।
৪. ছড়া আবৃত্তি করার উপকারিতা কী?
ছড়া আবৃত্তি করলে উচ্চারণ স্পষ্ট হয়, জড়তা কাটে এবং আত্মবিশ্বাস বাড়ে।
৫. বর্তমানে শিশুরা কি ছড়ার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে?
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের সহজলভ্যতার কারণে নতুন প্রজন্মের শিশুদের মধ্যেও ছড়ার জনপ্রিয়তা বাড়ছে।
উপসংহার
তাহলে, ছড়া শুধু কয়েকটি শব্দের সমষ্টি নয় – এটা আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের শৈশব, আর আমাদের জীবনের প্রতিচ্ছবি। ছড়া আমাদের আনন্দ দেয়, শেখায়, আর ভাবতে শেখায়। তাই, আসুন, আমরা সবাই মিলে ছড়ার এই ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখি, আর আমাদের শিশুদের জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ি। আর হ্যাঁ, অবসর পেলে দু-চার লাইন ছড়া লিখতেই পারেন, কেমন? কে জানে, হয়তো আপনার হাত ধরেই জন্ম নেবে নতুন কোনো জনপ্রিয় ছড়া!