আজ আমরা রসায়নের এক মজার বিষয় নিয়ে কথা বলব – d ব্লক মৌল। রসায়ন ক্লাসে হয়তো এই নামটা শুনেছেন, কিন্তু ব্যাপারটা আসলে কী, তা নিয়ে অনেকের মনেই ধোঁয়াশা থাকে। তাই, আজকের ব্লগ পোস্টে আমরা d ব্লক মৌল কী, এদের বৈশিষ্ট্য, পর্যায় সারণিতে এদের অবস্থান এবং আমাদের জীবনে এদের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করব।
d ব্লক মৌল: রসায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ
d ব্লক মৌলগুলো পর্যায় সারণির একেবারে মাঝবরাবর অবস্থিত। এদেরকে संक्रमण মৌলও বলা হয়। এখন প্রশ্ন হল, কেন এদেরকে d ব্লক মৌল বলা হয়? এদের ইলেকট্রন বিন্যাসেই এর উত্তর লুকিয়ে আছে।
d ব্লক মৌল কাকে বলে?
যেসব মৌলের সর্বশেষ ইলেকট্রনটি d অরবিটালে প্রবেশ করে, তাদেরকে d ব্লক মৌল বলা হয়। পর্যায় সারণিতে গ্রুপ ৩ থেকে গ্রুপ ১২ পর্যন্ত মৌলগুলো এই ব্লকের অন্তর্ভুক্ত। এদের সাধারণ ইলেকট্রন বিন্যাস হল (n-1)d1-10ns0-2।
d ব্লক মৌলের ইলেকট্রন বিন্যাস
d ব্লক মৌলগুলোর ইলেকট্রন বিন্যাস একটু ব্যতিক্রমী হতে পারে। কারণ, এদের ক্ষেত্রে d অরবিটাল এবং s অরবিটালের মধ্যে শক্তির পার্থক্য খুব কম থাকে। তাই ইলেকট্রন আগে d অরবিটালে প্রবেশ করতে পারে, আবার কখনও s অরবিটালে প্রবেশ করে d অরবিটালকে স্থিতিশীল করার চেষ্টা করে।
উদাহরণস্বরূপ, ক্রোমিয়ামের (Cr) ইলেকট্রন বিন্যাস হওয়ার কথা ছিল [Ar] 3d44s2, কিন্তু বাস্তবে এর ইলেকট্রন বিন্যাস [Ar] 3d54s1। এর কারণ হল, অর্ধপূর্ণ (half-filled) d অরবিটাল (d5) বেশি স্থিতিশীল। একইভাবে, কপার (Cu)-এর ইলেকট্রন বিন্যাস হওয়ার কথা ছিল [Ar] 3d94s2, কিন্তু বাস্তবে এর ইলেকট্রন বিন্যাস [Ar] 3d104s1। এখানে সম্পূর্ণরূপে পূর্ণ (fully-filled) d অরবিটাল (d10) বেশি স্থিতিশীল।
d ব্লক মৌলের বৈশিষ্ট্য
d ব্লক মৌলগুলোর কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা এদেরকে অন্য মৌলগুলো থেকে আলাদা করে। নিচে এদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হলো:
পরিবর্তনশীল জারণ অবস্থা
d ব্লক মৌলগুলোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল এরা পরিবর্তনশীল জারণ অবস্থা প্রদর্শন করে। এর কারণ হল, এদের d অরবিটাল থেকে ইলেকট্রন সহজেই অপসারিত হতে পারে। যেমন, আয়রন (Fe) +2 এবং +3 জারণ অবস্থা প্রদর্শন করে। কপার (Cu) +1 এবং +2 জারণ অবস্থা প্রদর্শন করে।
জটিল যৌগ গঠন
d ব্লক মৌলগুলো জটিল যৌগ (complex compound) গঠন করতে পারে। জটিল যৌগ হল সেই যৌগ, যেখানে একটি কেন্দ্রীয় ধাতব আয়ন (metal ion) লিগ্যান্ড (ligand) নামক কিছু অণু বা আয়নের সাথে সন্নিবেশ বন্ধন (coordinate bond) দ্বারা যুক্ত থাকে। d ব্লক মৌলগুলোর ছোট আকার, উচ্চ চার্জ এবং d অরবিটালের উপস্থিতির কারণে এরা জটিল যৌগ গঠন করতে সক্ষম।
অনুঘটক হিসেবে ব্যবহার
d ব্লক মৌল এবং এদের যৌগগুলো অনেক রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অনুঘটক (catalyst) হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অনুঘটক হল সেই পদার্থ, যা কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়ার গতি বাড়িয়ে দেয়, কিন্তু বিক্রিয়ার শেষে নিজে অপরিবর্তিত থাকে। যেমন, আয়রন (Fe) অ্যামোনিয়া (NH3) উৎপাদনে এবং ভ্যানADIUM পেন্টক্সাইড (V2O5) সালফিউরিক অ্যাসিড (H2SO4) উৎপাদনে অনুঘটক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
রঙিন যৌগ গঠন
d ব্লক মৌলগুলো সাধারণত রঙিন যৌগ গঠন করে। এর কারণ হল, এদের d অরবিটালের ইলেকট্রনগুলো দৃশ্যমান আলো শোষণ করে নিম্ন শক্তিস্তর থেকে উচ্চ শক্তিস্তরে স্থানান্তরিত হতে পারে (d-d transition)। এই কারণে এদের যৌগগুলো বিভিন্ন রঙ ধারণ করে।
পর্যায় সারণিতে d ব্লক মৌলের অবস্থান
d ব্লক মৌলগুলো পর্যায় সারণির গ্রুপ ৩ থেকে গ্রুপ ১২ পর্যন্ত অবস্থিত। এই ব্লকটি s এবং p ব্লকের মাঝে অবস্থিত। পর্যায় সারণিতে d ব্লক মৌলগুলোকে চারটি সারিতে ভাগ করা হয়েছে, যা পর্যায় ৪, ৫, ৬ এবং ৭ এ অবস্থিত।
- প্রথম সারি (পর্যায় ৪): স্ক্যান্ডিয়াম (Sc), টাইটানিয়াম (Ti), ভ্যানাডিয়াম (V), ক্রোমিয়াম (Cr), ম্যাঙ্গানিজ (Mn), আয়রন (Fe), কোবাল্ট (Co), নিকেল (Ni), কপার (Cu), জিঙ্ক (Zn).
- দ্বিতীয় সারি (পর্যায় ৫): ইট্রিয়াম (Y), জিরকোনিয়াম (Zr), নিওবিয়াম (Nb), মলিবডেনাম (Mo), টেকনেটিয়াম (Tc), রুথেনিয়াম (Ru), রোডিয়াম (Rh), প্যালাডিয়াম (Pd), সিলভার (Ag), ক্যাডমিয়াম (Cd).
- তৃতীয় সারি (পর্যায় ৬): ল্যান্থানাম (La), হাফনিয়াম (Hf), ট্যানটালাম (Ta), টাংস্টেন (W), রেনিয়াম (Re), অসমিয়াম (Os), ইরিডিয়াম (Ir), প্ল্যাটিনাম (Pt), গোল্ড (Au), মার্কারি (Hg).
- চতুর্থ সারি (পর্যায় ৭): অ্যাক্টিনিয়াম (Ac), রুদারফোর্ডিয়াম (Rf), ডাবনিয়াম (Db), সিborgিয়াম (Sg), বোরিয়াম (Bh), হ্যাসিয়াম (Hs), মেইটনারিয়াম (Mt), ডার্মস্টাডিয়াম (Ds), রন্টজেনিয়াম (Rg), কোপারনিসিয়াম (Cn).
আমাদের জীবনে d ব্লক মৌলের ভূমিকা
d ব্লক মৌলগুলোর আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এদের কিছু ব্যবহার নিচে উল্লেখ করা হলো:
শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহার
d ব্লক মৌলগুলো শিল্পক্ষেত্রে বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়। যেমন, টাইটানিয়াম (Ti) এবং এর সংকর ধাতু উড়োজাহাজ এবং মহাকাশযান তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। ভ্যানাডিয়াম (V) ইস্পাতকে শক্তিশালী করতে ব্যবহৃত হয়। নিকেল (Ni) ব্যাটারি এবং অন্যান্য রাসায়নিক শিল্পে ব্যবহৃত হয়।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহার
d ব্লক মৌলগুলো চিকিৎসা ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়। যেমন, প্ল্যাটিনাম (Pt) ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। আয়রন (Fe) রক্তে অক্সিজেন পরিবহনে সাহায্য করে এবং আয়রনের অভাবে অ্যানিমিয়া হতে পারে। জিঙ্ক (Zn) শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।
কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহার
d ব্লক মৌলগুলো কৃষিক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়। যেমন, কপার (Cu) এবং ম্যাঙ্গানিজ (Mn) উদ্ভিদের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এদের অভাবে উদ্ভিদের বিভিন্ন রোগ হতে পারে।
d ব্লক মৌল নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন (FAQ)
d ব্লক মৌল নিয়ে তোমাদের মনে কিছু প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক। নিচে কয়েকটি সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
d ব্লক মৌলগুলো কি সবাই ধাতু?
হ্যাঁ, d ব্লক মৌলগুলো সবাই ধাতু। এদের মধ্যে কিছু ধাতু খুব সক্রিয়, আবার কিছু ধাতু নিষ্ক্রিয়।
d ব্লক মৌলগুলোর গলনাঙ্ক এবং স্ফুটনাঙ্ক বেশি কেন?
d ব্লক মৌলগুলোর মধ্যে শক্তিশালী ধাতব বন্ধন (metallic bond) থাকে। এই কারণে এদের গলনাঙ্ক এবং স্ফুটনাঙ্ক বেশি হয়। এছাড়াও এদের মধ্যে আনপেয়ারড ইলেকট্রন থাকার কারণে এরা শক্তিশালী বন্ধন তৈরি করতে পারে।
d ব্লক মৌলগুলোর মধ্যে কোন মৌলটি সবচেয়ে মূল্যবান?
d ব্লক মৌলগুলোর মধ্যে প্ল্যাটিনাম (Pt), গোল্ড (Au), এবং রোডিয়াম (Rh) সবচেয়ে মূল্যবান। এগুলো অলঙ্কার, ইলেকট্রনিক্স এবং রাসায়নিক শিল্পে ব্যবহৃত হয়।
d ব্লক মৌলগুলোর তেজস্ক্রিয় মৌল আছে কি?
হ্যাঁ, টেকনেটিয়াম (Tc) এবং কিছু অ্যাক্টিনয়েড (actinoid) মৌল তেজস্ক্রিয়।
d ব্লক মৌল কিভাবে আমাদের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করে?
d ব্লক মৌল আমাদের জীবনযাত্রার প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে অবদান রাখে। আমাদের ব্যবহার করা মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, গাড়ি, বাড়ি, সবকিছুতেই d ব্লক মৌলের ব্যবহার আছে। আমাদের খাদ্য, ঔষধ এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষায়ও এদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
d ব্লক মৌলের জটিল যৌগ গঠন প্রক্রিয়া
d ব্লক মৌলগুলোর জটিল যৌগ গঠনের প্রক্রিয়া বেশ মজার। একটি কেন্দ্রীয় ধাতব আয়ন (metal ion) কিভাবে লিগ্যান্ডের (ligand) সাথে যুক্ত হয়ে জটিল যৌগ গঠন করে, তা নিচে আলোচনা করা হলো:
-
কেন্দ্রীয় ধাতব আয়ন: জটিল যৌগের কেন্দ্রে d ব্লক মৌলের একটি আয়ন থাকে। এই আয়নটি সাধারণত ধনাত্মক চার্জযুক্ত হয় এবং লিগ্যান্ড থেকে ইলেকট্রন গ্রহণ করে।
-
লিগ্যান্ড: লিগ্যান্ড হলো সেই অণু বা আয়ন, যা কেন্দ্রীয় ধাতব আয়নের সাথে সন্নিবেশ বন্ধন (coordinate bond) তৈরি করে। লিগ্যান্ডের মধ্যে এক বা একাধিক লোন পেয়ার (lone pair) ইলেকট্রন থাকে, যা তারা ধাতব আয়নকে দান করে।
-
সন্নিবেশ বন্ধন: লিগ্যান্ড তার লোন পেয়ার ইলেকট্রন দিয়ে ধাতব আয়নের সাথে যে বন্ধন তৈরি করে, তাকে সন্নিবেশ বন্ধন বলে। এই বন্ধনে লিগ্যান্ড ইলেকট্রন দান করে এবং ধাতব আয়ন তা গ্রহণ করে।
- জটিল যৌগ গঠন: যখন একাধিক লিগ্যান্ড একটি ধাতব আয়নের সাথে সন্নিবেশ বন্ধন তৈরি করে, তখন একটি জটিল যৌগ গঠিত হয়। জটিল যৌগের গঠন এবং বৈশিষ্ট্য লিগ্যান্ড এবং ধাতব আয়নের প্রকৃতির উপর নির্ভর করে।
d ব্লক মৌলের প্রভাব এবং সতর্কতা
d ব্লক মৌলগুলো আমাদের জীবনে অনেক উপকারী হলেও, এদের কিছু ক্ষতিকর প্রভাবও আছে। নিচে কিছু সতর্কতা আলোচনা করা হলো:
-
d ব্লক মৌলের অনেক যৌগ বিষাক্ত হতে পারে। যেমন, মার্কারি (Hg) এবং ক্যাডমিয়াম (Cd) শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর।
-
d ব্লক মৌলের কিছু যৌগ পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। এদের কারণে মাটি ও পানি দূষিত হতে পারে।
-
d ব্লক মৌলের তেজস্ক্রিয় আইসোটোপগুলো স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর।
d ব্লক মৌলের ভবিষ্যৎ
d ব্লক মৌল নিয়ে গবেষণা ভবিষ্যতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। বিজ্ঞানীরা এদের নতুন ব্যবহার এবং বৈশিষ্ট্য আবিষ্কারের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। ন্যানোটেকনোলজি, নতুন অনুঘটক এবং উন্নত ব্যাটারি তৈরিতে d ব্লক মৌল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়াও পরিবেশ সুরক্ষায় এদের ব্যবহার নিয়ে গবেষণা চলছে।
d ব্লক মৌলগুলো রসায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এদের বৈশিষ্ট্য, পর্যায় সারণিতে এদের অবস্থান এবং আমাদের জীবনে এদের ভূমিকা অনেক ব্যাপক। এই মৌলগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। তাই, রসায়ন সম্পর্কে জানতে হলে d ব্লক মৌল সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরি।
আজ এই পর্যন্তই। আশা করি, d ব্লক মৌল সম্পর্কে তোমাদের ধারণা স্পষ্ট হয়েছে। রসায়ন ক্লাসে বন্ধুদের সাথে এই মজার তথ্যগুলো শেয়ার করতে ভুলো না। আর কোনো প্রশ্ন থাকলে, কমেন্ট বক্সে জানাতে পারো!