আসসালামু আলাইকুম, বন্ধুরা! কেমন আছেন সবাই? আশা করি ভালো। আজ আমরা কথা বলব ইসলামী শরীয়তের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে – ইজমা। ইজমা (Ijma) শব্দটা হয়তো শুনেছেন, কিন্তু এর আসল মানে কী, কেন এটা এত গুরুত্বপূর্ণ, আর আমাদের জীবনেই বা এর প্রভাব কতটা – এসব নিয়েই আজ আমরা আলোচনা করব। তাহলে চলুন, শুরু করা যাক!
ইসলামের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস এই ইজমা। কুরআন এবং হাদিসের পরেই এর স্থান।
ইজমা কী? (What is Ijma?)
“ইজমা” (الإجماع) একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ হচ্ছে কোনো বিষয়ে একমত হওয়া বা ঐকমত্য পোষণ করা। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায়, ইজমা বলতে বোঝায় কোনো একটি নির্দিষ্ট যুগের মুসলিম মুজতাহিদগণের (ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞ) কোনো শরয়ী বিষয়ে একমত হওয়া। সহজ ভাষায় বললে, কুরআন ও হাদিসের আলোকে কোনো নতুন সমস্যার সমাধানে একদল ইসলামিক স্কলার যখন একমত হন, তখন সেটাকে ইজমা বলা হয়।
ইজমার মূল ভিত্তি (The Basis of Ijma):
কুরআন ও হাদিসে ইজমার গুরুত্বের কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা বলেন, “আর যে ব্যক্তি সৎপথ প্রকাশিত হওয়ার পর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং মুমিনদের পথ ছেড়ে অন্য পথ অনুসরণ করে, আমি তাকে সে দিকেই ফিরিয়ে দেব এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব; আর তা কতই না মন্দ আবাস!” (সূরা আন-নিসা: ১১৫)। এই আয়াতে মুমিনদের পথ অনুসরণ করার কথা বলা হয়েছে, যা ইজমার একটি ভিত্তি।
হাদিসে রাসুল (সাঃ) বলেছেন, “আমার উম্মত কখনো ভ্রান্ত বিষয়ে একমত হবে না।” (তিরমিজি: ২১৪৩)। এই হাদিসটি ইজমার বৈধতার অন্যতম প্রমাণ।
ইজমা কেন প্রয়োজন? (Why is Ijma Necessary?)
কুরআন ও হাদিসে জীবনের সব সমস্যার সরাসরি সমাধান নাও থাকতে পারে। সময়ের সাথে সাথে নতুন নতুন সমস্যা দেখা দেয়। এই সমস্যাগুলোর সমাধানে ইজমা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি ইসলামী আইনকে যুগোপযোগী করে এবং মুসলিমদের জীবনকে সহজ করে তোলে।
ইজমার প্রকারভেদ (Types of Ijma)
ইজমাকে সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা হয়:
-
ইজমায়ে কওলী (Explicit Ijma): যখন কোনো বিষয়ে সকল মুজতাহিদ স্পষ্টভাবে একমত হন, তখন তাকে ইজমায়ে কওলী বলা হয়। অর্থাৎ, প্রত্যেক মুজতাহিদ তাদের মতামত স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেন।
-
ইজমায়ে সুকুতি (Tacit Ijma): যখন কিছু মুজতাহিদ কোনো বিষয়ে মতামত দেন এবং বাকিরা নীরব থাকেন, তখন তাকে ইজমায়ে সুকুতি বলা হয়। এক্ষেত্রে ধরে নেয়া হয় যে, যারা নীরব ছিলেন, তারাও ঐ মতের সাথে একমত। কিছু ইসলামিক স্কলার এই প্রকার ইজমাকে দুর্বল মনে করেন।
ইজমার শর্তসমূহ (Conditions of Ijma)
ইজমা বৈধ হওয়ার জন্য কিছু শর্ত রয়েছে। এগুলো হলো:
-
মুজতাহিদ হওয়া: যারা ইজমায় অংশ নেবেন, তাদের অবশ্যই ইসলামী আইন সম্পর্কে গভীর জ্ঞান থাকতে হবে। অর্থাৎ, তাদের মুজতাহিদ হওয়ার যোগ্যতা থাকতে হবে।
-
ঐকমত্য: সকল মুজতাহিদকে একটি বিষয়ে একমত হতে হবে। সামান্য ভিন্নমত থাকলেও সেটা ইজমা হিসেবে গণ্য হবে না।
-
শরয়ী বিষয়: ইজমা হতে হবে শরীয়তের কোনো বিধান নিয়ে। কোনো জাগতিক বা প্রযুক্তিগত বিষয়ে ইজমা গ্রহণযোগ্য নয়।
- যুক্তি ও প্রমাণের ভিত্তিতে: ইজমা হতে হবে কুরআন, হাদিস ও অন্যান্য শরয়ী প্রমাণের ভিত্তিতে। কোনো প্রকার আন্দাজ বা অনুমানের উপর ভিত্তি করে ইজমা হতে পারে না।
ইজমার গুরুত্ব (Importance of Ijma)
ইসলামী শরীয়তে ইজমার গুরুত্ব অপরিসীম। এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক নিচে উল্লেখ করা হলো:
-
শরীয়তের উৎস: কুরআন ও হাদিসের পর ইজমাকে শরীয়তের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে ধরা হয়।
-
সমস্যার সমাধান: নতুন উদ্ভূত সমস্যার সমাধানে ইজমা একটি নির্ভরযোগ্য উপায়।
-
ঐক্য ও সংহতি: ইজমার মাধ্যমে মুসলিম সমাজে ঐক্য ও সংহতি বজায় থাকে।
- যুগোপযোগিতা: ইজমা ইসলামী আইনকে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে সাহায্য করে।
ইজমা নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর (Frequently Asked Questions – FAQs)
ইজমা নিয়ে অনেকের মনে অনেক প্রশ্ন থাকে। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
১. সবাই কি ইজমায় অংশ নিতে পারে? (Can everyone participate in Ijma?)
না, ইজমায় অংশ নেওয়ার জন্য মুজতাহিদ হওয়ার যোগ্যতা থাকতে হয়। অর্থাৎ, ইসলামী আইন ও শরীয়ত সম্পর্কে গভীর জ্ঞান থাকতে হবে। সাধারণ মানুষ ইজমায় সরাসরি অংশ নিতে পারে না, তবে তারা মুজতাহিদদের মতামত জানতে এবং অনুসরণ করতে পারে।
২. ইজমা কি কুরআন ও হাদিসের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ? (Is Ijma more important than Quran and Hadith?)
কখনোই না। কুরআন ও হাদিস হলো শরীয়তের প্রধান উৎস। ইজমা কুরআন ও হাদিসের আলোকে গঠিত হয় এবং এর পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। কুরআন ও হাদিসের বিরোধী কোনো ইজমা গ্রহণযোগ্য নয়।
৩. ইজমার উদাহরণ কী? (What is an example of Ijma?)
ইজমার অনেক উদাহরণ আছে। যেমন, সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-গণ কুরআন সংকলনের বিষয়ে একমত হয়েছিলেন। এটি একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। এছাড়া, আধুনিক যুগে অনেক নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে, যেগুলোর সমাধানে ইসলামিক স্কলাররা ইজমার মাধ্যমে শরয়ী বিধান দিয়েছেন।
৪. ইজমা কিভাবে কাজ করে? (How does Ijma work?)
প্রথমত, কোনো একটি নতুন সমস্যা দেখা দিলে মুজতাহিদগণ (ইসলামিক স্কলার) কুরআন, হাদিস ও অন্যান্য শরয়ী প্রমাণের আলোকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। এরপর তারা ঐকমত্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করেন। যদি তারা সবাই একমত হন, তবে সেটা ইজমা হিসেবে গণ্য হয়।
৫. ইজমা কি পরিবর্তনযোগ্য? (Is Ijma changeable?)
কিছু ইসলামিক স্কলার মনে করেন যে, ইজমা পরিবর্তনযোগ্য নয়। আবার কিছু স্কলার মনে করেন, সময়ের প্রয়োজনে এবং নতুন প্রমাণের ভিত্তিতে ইজমা পরিবর্তন করা যেতে পারে। তবে এই বিষয়ে ইসলামিক স্কলারদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।
৬. বর্তমান যুগে ইজমার প্রয়োজনীয়তা কতটুকু? (How important is Ijma in the modern era?)
বর্তমান যুগে ইজমার প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। কারণ, প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ আসছে। এই সমস্যাগুলোর সমাধানে কুরআন ও হাদিসের মৌলিক শিক্ষার আলোকে যুগোপযোগী সমাধান বের করার জন্য ইজমার বিকল্প নেই।
৭. “কিয়াস” এবং “ইজমা” এর মধ্যে পার্থক্য কী? (What is the difference between “Qiyas” and “Ijma?”)
“কিয়াস” মানে তুলনা করা। যখন কুরআন ও হাদিসে কোনো সমস্যার সরাসরি সমাধান পাওয়া যায় না, তখন একই ধরনের অন্য কোনো সমস্যার সমাধানের সাথে তুলনা করে নতুন সমস্যার সমাধান বের করা হয়। অন্যদিকে, “ইজমা” হলো মুজতাহিদগণের ঐকমত্যের ভিত্তিতে কোনো শরয়ী বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া।
বৈশিষ্ট্য | কিয়াস (Qiyas) | ইজমা (Ijma) |
---|---|---|
সংজ্ঞা | কুরআন ও হাদিসের সাথে তুলনা করে সমাধান বের করা | মুজতাহিদগণের ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ |
ভিত্তি | সাদৃশ্য ও যুক্তির উপর নির্ভরশীল | কুরআন, হাদিস ও মুজতাহিদগণের ঐকমত্যের উপর নির্ভরশীল |
বৈধতা | কুরআন ও হাদিসের আলোকে বৈধ | কুরআন ও হাদিসের আলোকে বৈধ, তবে মুজতাহিদগণের সম্মতির প্রয়োজন |
উদাহরণ | নেশা সৃষ্টিকারী পানীয় হারাম হওয়া (কারণ এটা মদের মতো) | কুরআন সংকলন |
৮. সুন্নি ও শিয়া মতবাদে ইজমার ধারণা কি একই? (Is the concept of Ijma the same in Sunni and Shia doctrines?)
সুন্নি ও শিয়া মতবাদে ইজমার ধারণায় কিছু পার্থক্য রয়েছে। সুন্নি মতবাদে সকল যুগের মুজতাহিদগণের ঐকমত্য প্রয়োজন, তবে শিয়া মতবাদে শুধু নবী (সা.)-এর বংশধর (আহলে বাইত) এবং তাদের অনুসারীদের ঐকমত্যকেই ইজমা হিসেবে গণ্য করা হয়।
আধুনিক জীবনে ইজমার প্রয়োগ (Application of Ijma in Modern Life)
আধুনিক জীবনে ইজমার অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োগ রয়েছে। নিচে কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো:
-
ইসলামিক ব্যাংকিং: ইসলামিক ব্যাংকিংয়ের অনেক নিয়ম-কানুন ইজমার মাধ্যমে নির্ধারিত হয়েছে। সুদবিহীন ব্যাংকিং ব্যবস্থা কিভাবে পরিচালনা করা হবে, তা ইজমার মাধ্যমে ঠিক করা হয়েছে।
-
ডিজিটাল ফিনান্স: ক্রিপ্টোকারেন্সি, ব্লকচেইন এবং অন্যান্ন ডিজিটাল ফিনান্সিয়াল কার্যক্রম শরীয়াহ-সম্মত কিনা, তা ইজমার মাধ্যমে নির্ধারণ করা যায়। বর্তমান সময়ের ইসলামিক স্কলারগণ এই নিয়ে কাজ করছেন।
-
চিকিৎসা বিজ্ঞান: আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে অনেক নতুন পদ্ধতি এসেছে, যেমন ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন (IVF)। এই পদ্ধতি শরীয়াহ-সম্মত কিনা, তা ইজমার মাধ্যমে নির্ধারণ করা যায়।
- পরিবেশ সুরক্ষায়: পরিবেশ সুরক্ষায় ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, তা ইজমার মাধ্যমে নির্ধারণ করা যায়।
ইজমা: একটি বাস্তব উদাহরণ (Ijma: A Real-Life Example)
বর্তমান সময়ের একটি উদাহরণ দেই। কোভিড-১৯ এর সময় যখন ভ্যাকসিন আবিষ্কার হল, তখন ইসলামিক স্কলারগণ ইজমার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, জীবন বাঁচানোর জন্য ভ্যাকসিন গ্রহণ করা জায়েজ। কারণ, ইসলামে জীবনের নিরাপত্তা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
ইজমার সমালোচনা (Criticism of Ijma)
কিছু ইসলামিক স্কলার ইজমার সমালোচনা করেন। তাদের মতে, ইজমায় মতভেদ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে এবং অনেক সময় রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তবে, অধিকাংশ স্কলার ইজমার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেন এবং এর সঠিক প্রয়োগের উপর গুরুত্ব দেন।
উপসংহার (Conclusion)
ইজমা ইসলামী শরীয়তের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। কুরআন ও হাদিসের আলোকে নতুন সমস্যার সমাধানে এর গুরুত্ব অপরিসীম। তবে, ইজমার সঠিক প্রয়োগের জন্য প্রয়োজন গভীর জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও সততা। আশা করি, ইজমা সম্পর্কে আপনারা একটি স্পষ্ট ধারণা পেয়েছেন। ইসলামিক জ্ঞান অর্জনে আপনার পথচলা আরও সুন্দর হোক, সেই কামনাই করি।
যদি এই বিষয়ে আপনার আরও কোনো প্রশ্ন থাকে, তবে নির্দ্বিধায় কমেন্ট করতে পারেন। আর হ্যাঁ, আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না!
আল্লাহ হাফেজ!