আমাদের চারপাশের সবকিছুই তো পরমাণু দিয়ে তৈরি, তাই না? আর এই পরমাণুদের স্বভাব-চরিত্র জানতে পারাটা কিন্তু রসায়নের একটা মজার দিক। আজ আমরা তেমনই একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করব – “ইলেকট্রন আসক্তি”। শুনে কঠিন মনে হলেও, বুঝিয়ে বললে দেখবেন এটা আসলে খুবই সোজা! তাহলে চলুন, দেরি না করে শুরু করা যাক!
ইলেকট্রন আসক্তি কী? (What is Electron Affinity?)
সহজ ভাষায় বলতে গেলে, ইলেকট্রন আসক্তি হলো কোনো গ্যাসীয় পরমাণুর সর্বশেষ কক্ষপথে একটি ইলেকট্রন যোগ করে তাকে ঋণাত্মক আয়নে (anion) পরিণত করার সময় যে পরিমাণ শক্তি নির্গত হয়, সেটাই হলো ঐ পরমাণুর ইলেকট্রন আসক্তি।
বিষয়টা একটু ভেঙে বলি। ধরুন, আপনার একটা বন্ধু আছে, যে চকলেট খেতে খুব ভালোবাসে। আপনি যদি তাকে একটা চকলেট দেন, সে খুশি হবে, মানে তার মধ্যে একটা পরিবর্তন আসবে এবং সেই সাথে সে কিছুটা “এনার্জি” দেবে (যেমন, আপনাকে ধন্যবাদ জানাবে বা হাসবে!)। ইলেকট্রন আসক্তি অনেকটা তেমনই। একটা পরমাণু যখন ইলেকট্রন পায়, তখন সে স্থিতিশীল হওয়ার জন্য শক্তি ছাড়ে। এই নির্গত শক্তিই হলো ইলেকট্রন আসক্তি।
ইলেকট্রন আসক্তির সংজ্ঞা (Definition of Electron Affinity)
আরও একটু স্পষ্ট করে বললে, ইলেকট্রন আসক্তির সংজ্ঞা হলো: “গ্যাসীয় অবস্থায় কোনো এক মোল বিচ্ছিন্ন পরমাণুর প্রত্যেকটিতে একটি করে ইলেকট্রন যোগ করে এক মোল ঋণাত্মক আয়ন (anion) তৈরির সময় যে পরিমাণ তাপ নির্গত হয়, তাকে ঐ মৌলের ইলেকট্রন আসক্তি বলে।”
ইলেকট্রন আসক্তিকে সাধারণত কিলোজুল পার মোল (kJ/mol) এককে প্রকাশ করা হয়। এর মান ধনাত্মক (+) বা ঋণাত্মক (-) হতে পারে। সাধারণত, ইলেকট্রন আসক্তির মান ঋণাত্মক (-) হয়, কারণ ইলেকট্রন যোগ করলে শক্তি নির্গত হয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে, ইলেকট্রন যোগ করার জন্য শক্তি সরবরাহ করতে হয়, তখন এর মান ধনাত্মক (+) হয়।
ইলেকট্রন আসক্তি কেন গুরুত্বপূর্ণ? (Why is Electron Affinity Important?)
ইলেকট্রন আসক্তি রসায়ন এবং পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নিচে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা হলো:
-
রাসায়নিক বন্ধন (Chemical Bonding): ইলেকট্রন আসক্তি থেকে বোঝা যায় কোন পরমাণু কত সহজে ইলেকট্রন গ্রহণ করে ঋণাত্মক আয়নে পরিণত হতে পারে। এর মাধ্যমে আয়নিক বন্ধন (Ionic Bond) এবং সমযোজী বন্ধন (Covalent Bond) গঠনের সম্ভাবনা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
-
তড়িৎ ঋণাত্মকতা (Electronegativity): ইলেকট্রন আসক্তি এবং আয়োনাইজেশন শক্তি (Ionization energy) – এই দুইটি বিষয় তড়িৎ ঋণাত্মকতা নির্ধারণে সাহায্য করে। তড়িৎ ঋণাত্মকতা হলো কোনো পরমাণুর বন্ধনে ইলেকট্রন জোড় আকর্ষণ করার ক্ষমতা।
-
পর্যায় সারণীর বৈশিষ্ট্য (Periodic Table Trends): পর্যায় সারণীতে ইলেকট্রন আসক্তির একটা নির্দিষ্ট ধারা দেখা যায়। এই ধারা মৌলগুলোর রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য বুঝতে সাহায্য করে।
- অর্ধপরিবাহী (Semiconductor) এবং সোলার সেল (Solar Cell) এর গবেষণা: নতুন অর্ধপরিবাহী বা সোলার সেল তৈরির সময় কোন উপাদান ইলেকট্রন গ্রহণ করতে পারবে, তা জানার জন্য ইলেকট্রন আসক্তি গুরুত্বপূর্ণ।
ইলেকট্রন আসক্তিকে প্রভাবিত করার কারণগুলো (Factors Affecting Electron Affinity)
কিছু বিষয় আছে, যেগুলো একটা পরমাণুর ইলেকট্রন আসক্তিকে প্রভাবিত করতে পারে। সেগুলো হলো:
পরমাণুর আকার (Atomic Size)
পরমাণুর আকার যত ছোট হয়, তার নিউক্লিয়াসের আকর্ষণ ক্ষমতা তত বেশি থাকে। এর ফলে নতুন ইলেকট্রন সহজে আকৃষ্ট হয় এবং বেশি শক্তি নির্গত হয়। তাই ছোট আকারের পরমাণুর ইলেকট্রন আসক্তি বেশি হয়।
নিউক্লিয়ার চার্জ (Nuclear Charge)
নিউক্লিয়াসের চার্জ যত বেশি হবে, ইলেকট্রনকে আকর্ষণ করার ক্ষমতাও তত বেশি হবে। ফলে ইলেকট্রন আসক্তির মান বাড়বে।
ইলেকট্রন বিন্যাস (Electronic Configuration)
পরমাণুর ইলেকট্রন বিন্যাস ইলেকট্রন আসক্তিকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। যেসব পরমাণুর স্থিতিশীল ইলেকট্রন বিন্যাস (যেমন: নিষ্ক্রিয় গ্যাস) রয়েছে, তাদের ইলেকট্রন আসক্তির মান খুব কম বা ধনাত্মক হয়ে থাকে। কারণ তারা সহজে ইলেকট্রন গ্রহণ করতে চায় না। অন্যদিকে, যাদের ইলেকট্রন বিন্যাসে একটি ইলেকট্রন যোগ করলে স্থিতিশীলতা আসে, তাদের ইলেকট্রন আসক্তি বেশি হয়।
অর্ধপূর্ণ এবং পরিপূর্ণ কক্ষপথের প্রভাব (Effect of Half-filled and Fully-filled Orbitals)
যেসব পরমাণুর সর্ববহিঃস্থ কক্ষপথে অর্ধপূর্ণ (half-filled) অথবা পরিপূর্ণ (fully-filled) ইলেকট্রন থাকে, তারা সাধারণত নতুন ইলেকট্রন গ্রহণ করতে চায় না। কারণ এই অবস্থায় তারা স্থিতিশীল থাকে। তাই তাদের ইলেকট্রন আসক্তি কম হয়।
পর্যায় সারণীতে ইলেকট্রন আসক্তির ধারা (Trends of Electron Affinity in the Periodic Table)
পর্যায় সারণীতে ইলেকট্রন আসক্তির একটা নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করে। এই নিয়মগুলো জানা থাকলে, মৌলগুলোর ধর্ম সম্পর্কে ধারণা পাওয়া সহজ হয়।
পর্যায় বরাবর পরিবর্তন (Trends Across a Period)
সাধারণত, পর্যায় সারণীর বাম দিক থেকে ডান দিকে গেলে ইলেকট্রন আসক্তি বৃদ্ধি পায়। এর কারণ হলো, একই পর্যায়ে পরমাণুর আকার ছোট হতে থাকে এবং নিউক্লিয়াসের চার্জ বাড়তে থাকে। ফলে ইলেকট্রন গ্রহণের প্রবণতা বাড়ে।
গ্রুপ বরাবর পরিবর্তন (Trends Down a Group)
গ্রুপের উপরের মৌল থেকে নিচের দিকে নামলে ইলেকট্রন আসক্তি সাধারণত কমতে থাকে। কারণ পরমাণুর আকার বৃদ্ধি পায় এবং নিউক্লিয়াসের আকর্ষণ ক্ষমতা হ্রাস পায়। ফলে নতুন ইলেকট্রন যোগ করা কঠিন হয়ে যায়।
তবে, এই ধারায় কিছু ব্যতিক্রম দেখা যায়। যেমন, গ্রুপ 17 (হ্যালোজেন) এর ক্ষেত্রে ক্লোরিনের (Cl) ইলেকট্রন আসক্তি ফ্লোরিনের (F) চেয়ে বেশি। এর কারণ হলো ফ্লোরিনের ছোট আকারের কারণে ইলেকট্রন মেঘের ঘনত্ব বেশি থাকে, যা নতুন ইলেকট্রনকে বিকর্ষণ করে।
ইলেকট্রন আসক্তি এবং আয়োনাইজেশন শক্তির মধ্যে সম্পর্ক (Relationship between Electron Affinity and Ionization Energy)
ইলেকট্রন আসক্তি এবং আয়োনাইজেশন শক্তি – এই দুইটি বিষয় একে অপরের বিপরীত।
-
আয়োনাইজেশন শক্তি (Ionization Energy): গ্যাসীয় অবস্থা থেকে কোনো পরমাণুর সর্বশেষ কক্ষপথ থেকে একটি ইলেকট্রন অপসারণ করতে যে পরিমাণ শক্তি প্রয়োজন হয়, সেটাই হলো আয়োনাইজেশন শক্তি।
-
ইলেকট্রন আসক্তি (Electron Affinity): গ্যাসীয় অবস্থায় কোনো পরমাণুর সর্বশেষ কক্ষপথে একটি ইলেকট্রন যোগ করতে যে পরিমাণ শক্তি নির্গত হয়, সেটাই হলো ইলেকট্রন আসক্তি।
আয়োনাইজেশন শক্তি পরমাণু থেকে ইলেকট্রন বের করতে প্রয়োজনীয় শক্তি, আর ইলেকট্রন আসক্তি হলো পরমাণুতে ইলেকট্রন যোগ করলে নির্গত হওয়া শক্তি।
কিছু সাধারণ মৌলের ইলেকট্রন আসক্তি (Electron Affinity of Some Common Elements)
এখানে কয়েকটি সাধারণ মৌলের ইলেকট্রন আসক্তির মান উল্লেখ করা হলো:
মৌল (Element) | ইলেকট্রন আসক্তি (Electron Affinity) (kJ/mol) |
---|---|
ক্লোরিন (Cl) | -349 |
ফ্লোরিন (F) | -328 |
অক্সিজেন (O) | -141 |
ব্রোমিন (Br) | -325 |
আয়োডিন (I) | -295 |
এই মানগুলো থেকে বোঝা যায়, হ্যালোজেন গ্রুপের মৌলগুলোর ইলেকট্রন আসক্তি বেশি, কারণ তারা সহজেই একটি ইলেকট্রন গ্রহণ করে স্থিতিশীলতা অর্জন করতে পারে।
ইলেকট্রন আসক্তি: কিছু মজার তথ্য (Fun Facts about Electron Affinity)
-
হ্যালোজেন গ্রুপের মৌলগুলোর মধ্যে ক্লোরিনের ইলেকট্রন আসক্তি সবচেয়ে বেশি।
-
নিষ্ক্রিয় গ্যাসগুলোর ইলেকট্রন আসক্তির মান প্রায় শূন্য, কারণ তাদের সর্ববহিঃস্থ কক্ষপথ ইলেকট্রনে পরিপূর্ণ থাকে।
-
ইলেকট্রন আসক্তির মান ধনাত্মক হলে, বুঝতে হবে পরমাণুটিকে ঋণাত্মক আয়নে পরিণত করার জন্য বাইরে থেকে শক্তি দিতে হয়েছে।
ইলেকট্রন আসক্তি নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন ও উত্তর (FAQs about Electron Affinity)
এখানে ইলেকট্রন আসক্তি নিয়ে কিছু সাধারণ প্রশ্ন এবং তার উত্তর দেওয়া হলো:
ইলেকট্রন আসক্তি কি একটি ভৌত ধর্ম? (Is electron affinity a physical property?)
না, ইলেকট্রন আসক্তি একটি রাসায়নিক ধর্ম। এটি কোনো মৌলের ইলেকট্রন গ্রহণের ক্ষমতা এবং ঋণাত্মক আয়নে পরিণত হওয়ার প্রবণতা নির্দেশ করে।
কোন গ্রুপের মৌলগুলোর ইলেকট্রন আসক্তি বেশি? (Which group of elements has the highest electron affinity?)
হ্যালোজেন (Group 17) গ্রুপের মৌলগুলোর ইলেকট্রন আসক্তি সবচেয়ে বেশি। কারণ তারা সহজেই একটি ইলেকট্রন গ্রহণ করে স্থিতিশীলতা অর্জন করতে পারে। “হ্যালোজেন মৌলগুলোর মধ্যে কার ইলেকট্রন আসক্তি সবচেয়ে বেশি?” – এই প্রশ্নের উত্তর হলো ক্লোরিন (Cl)।
ইলেকট্রন আসক্তির মান কীভাবে পরিমাপ করা হয়? (How is electron affinity measured?)
ইলেকট্রন আসক্তির মান সরাসরি পরিমাপ করা কঠিন। এটি সাধারণত পরোক্ষভাবে আয়োনাইজেশন শক্তি এবং অন্যান্য তাপগতীয় ডেটা ব্যবহার করে গণনা করা হয়।
প্রথম ইলেকট্রন আসক্তি এবং দ্বিতীয় ইলেকট্রন আসক্তি বলতে কি বোঝায়?
প্রথম ইলেকট্রন আসক্তি (First Electron Affinity) হলো একটি গ্যাসীয় পরমাণুতে প্রথম ইলেকট্রন যোগ করার সময় নির্গত শক্তি। দ্বিতীয় ইলেকট্রন আসক্তি (Second Electron Affinity) হলো একটি গ্যাসীয় ঋণাত্মক আয়নে (anion) দ্বিতীয় ইলেকট্রন যোগ করার সময় নির্গত বা শোষিত শক্তি। “অক্সিজেনের প্রথম ইলেকট্রন আসক্তি কত?” – অক্সিজেনের প্রথম ইলেকট্রন আসক্তি ঋণাত্মক, কারণ ইলেকট্রন যোগ করলে শক্তি নির্গত হয়। কিন্তু দ্বিতীয় ইলেকট্রন আসক্তি ধনাত্মক, কারণ ঋণাত্মক আয়নে দ্বিতীয় ইলেকট্রন যোগ করতে শক্তি সরবরাহ করতে হয়।
ইলেকট্রন আসক্তি এবং তড়িৎ ঋণাত্মকতার মধ্যে পার্থক্য কী?
“তড়িৎ ঋণাত্মকতা কি?” – কোনো পরমাণু যখন অন্য কোনো পরমাণুর সাথে রাসায়নিক বন্ধন তৈরি করে, তখন বন্ধনের ইলেকট্রন নিজের দিকে টানার ক্ষমতাকে তড়িৎ ঋণাত্মকতা বলে। অন্যদিকে, ইলেকট্রন আসক্তি হলো একটি গ্যাসীয় পরমাণুর একটি ইলেকট্রন গ্রহণ করে ঋণাত্মক আয়নে পরিণত হওয়ার প্রবণতা। “ইলেকট্রন আসক্তি বেশি হলে কি হয়?” – ইলেকট্রন আসক্তি বেশি হলে পরমাণুর ঋণাত্মক আয়ন হওয়ার প্রবণতা বাড়ে।
উপসংহার (Conclusion)
তাহলে, ইলেকট্রন আসক্তি নিয়ে এতক্ষণে নিশ্চয়ই অনেক কিছু জানতে পারলেন। এটা শুধু একটা সংজ্ঞা নয়, বরং পরমাণুদের চরিত্র এবং রাসায়নিক বিক্রিয়া বোঝার একটা গুরুত্বপূর্ণ চাবিকাঠি।
আশা করি, আজকের আলোচনা আপনাদের ভালো লেগেছে। রসায়নের এরকম আরও মজার বিষয় নিয়ে আমরা ভবিষ্যতে আলোচনা করব। কোনো প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট সেকশনে জানাতে পারেন!