এই ব্লগ পোস্টটি হাশর সম্পর্কিত।
আচ্ছা, কখনো কি এমন হয়েছে, গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেছে আর মনে হচ্ছে যেন কেউ ডাকছে? অথবা কোনো পরীক্ষার আগে মনে হচ্ছে সব পড়া যেন মাথা থেকে উড়ে গেছে? এই অনুভূতিগুলো কিন্তু হাশরের দিনের একটা ছোট ঝলক! হাশর, মানে মহাপ্রলয়ের পরের সেই বিচার দিন। চলুন, আজকে আমরা হাশর নিয়ে একটু খোলামেলা আলোচনা করি, যেন বিষয়টা আমাদের কাছে আরও পরিষ্কার হয়ে যায়।
হাশর: শেষ বিচারের দিনের খুঁটিনাটি
হাশর (হাশর কাকে বলে) শব্দটির অর্থ হলো সমবেত হওয়া, একত্রিত হওয়া। ইসলামী পরিভাষায় হাশর বলতে বোঝায় কিয়ামতের পরে আল্লাহ তা’আলার নির্দেশে সকল মৃত মানুষের পুনরুত্থান এবং বিচার দিবসের জন্য একটি নির্দিষ্ট স্থানে সমবেত হওয়া। এই দিনে আল্লাহ সকল মানুষের ভালো-মন্দ কাজের হিসাব নেবেন এবং সেই অনুযায়ী তাদের প্রতিদান দেবেন।
হাশরের দিনের গুরুত্ব অপরিসীম। এটি বিশ্বাস করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অপরিহার্য। কুরআনে এবং হাদিসে এই দিনের অনেক বর্ণনা পাওয়া যায়, যা আমাদের কর্মের প্রতি আরও বেশি সতর্ক করে তোলে।
হাশরের মাঠ কেমন হবে?
হাশরের মাঠের বর্ণনা দিতে গেলে প্রথমে যে কথাটি আসে, তা হলো ভয়াবহতা। এই দিনের ভয়াবহতা এতটাই বেশি হবে যে, আপনজনও একে অপরের থেকে দূরে পালাবে। সূর্যের তেজ মাথার খুব কাছে চলে আসবে, ফলে অসহ্য গরম অনুভূত হবে।
-
জমিনের পরিবর্তন: কোরআনে বলা হয়েছে, “যেদিন পৃথিবী পরিবর্তিত হয়ে অন্য পৃথিবী হবে এবং আকাশও।” (সূরা ইব্রাহীম, আয়াত ৪৮)। অর্থাৎ, হাশরের দিনের পৃথিবী আজকের মতো থাকবে না।
-
সূর্যের তীব্রতা: সূর্য মানুষের মাথার কাছে চলে আসবে। গরমে মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত হবে।
-
আমলের হিসাব: প্রত্যেকের আমলনামা (কর্মের হিসাব) খোলা হবে। যাদের আমলনামা ডান হাতে দেওয়া হবে, তারা সফলকাম হবে, আর যাদের বাম হাতে দেওয়া হবে, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
হাশরের দিন কী ঘটবে?
হাশরের দিন অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটবে। তার মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা নিচে উল্লেখ করা হলো:
-
সিঙ্গায় ফুঁ: হযরত ইসরাফিল (আঃ) সিঙ্গায় ফুঁ দেবেন। প্রথম ফুঁ-তে সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে এবং দ্বিতীয় ফুঁ-তে সবাই জীবিত হয়ে উঠবে।
-
পুনরুত্থান: সকল মৃত মানুষ কবর থেকে জীবিত হয়ে উঠবে।
-
সমাবেশ: সবাই হাশরের মাঠে একত্রিত হবে।
-
বিচার: আল্লাহ তা’আলা মানুষের ভালো ও খারাপ কাজের বিচার করবেন।
-
জান্নাত ও জাহান্নাম: ভালো কাজ করা মানুষরা জান্নাতে যাবে এবং খারাপ কাজ করা মানুষরা জাহান্নামে যাবে।
হাশর সম্পর্কিত কিছু জরুরি প্রশ্ন (Frequently Asked Questions – FAQs)
হাশর নিয়ে আমাদের মনে অনেক প্রশ্ন জাগে। এখানে কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হলো:
হাশরের মাঠে কতক্ষণ দাঁড়াতে হবে?
হাশরের দিনের দৈর্ঘ্য সম্পর্কে বিভিন্ন মত রয়েছে। তবে কুরআনের সূরা মা’আরিজে বলা হয়েছে, “একদিন যা তোমাদের গণনায় পঞ্চাশ হাজার বছরের সমান।” (সূরা মা’আরিজ, আয়াত ৪)। এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, হাশরের দিনের সময়কাল অনেক দীর্ঘ হবে। তবে আল্লাহ মুমিনদের জন্য এই দিনটিকে সহজ করে দেবেন।
হাশরের ময়দানে আল্লাহ্ মানুষকে কিভাবে বিচার করবেন?
আল্লাহ তায়ালা হাশরের ময়দানে মানুষের কাজকর্মের বিস্তারিত হিসাব নেবেন। প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের হিসাব দিতে হবে। কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত আছে যে, আল্লাহ তায়ালা ন্যায়বিচারের সাথে বিচার করবেন এবং কারো উপর কোনো অবিচার করা হবে না।
হাশরের দিন আমলনামা কিভাবে দেওয়া হবে?
আমলনামা বিতরণের সময় মানুষের দুটি অবস্থা হবে। যাদের আমলনামা ডান হাতে দেওয়া হবে, তারা হবে ভাগ্যবান। তারা তাদের কর্মের ফল দেখে খুশি হবে। আর যাদের আমলনামা বাম হাতে দেওয়া হবে, তারা হবে দুর্ভাগা। তারা তাদের খারাপ কাজগুলোর জন্য অনুতপ্ত হবে।
হাশরের দিনের ভয়াবহতা থেকে বাঁচার উপায় কি?
হাশরের দিনের ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে হলে আমাদের কিছু কাজ করতে হবে। নিচে কয়েকটি উপায় আলোচনা করা হলো:
-
আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস: আল্লাহর প্রতি অবিচল বিশ্বাস রাখতে হবে।
-
নামাজ: নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে হবে।
-
দান করা: গরিব ও অসহায়দের দান করতে হবে।
-
ভালো কাজ করা: বেশি বেশি ভালো কাজ করতে হবে এবং খারাপ কাজ থেকে দূরে থাকতে হবে।
-
কুরআন তেলাওয়াত: নিয়মিত কুরআন তেলাওয়াত করতে হবে এবং এর অর্থ বুঝতে চেষ্টা করতে হবে।
হাশর ও কিয়ামতের মধ্যে পার্থক্য কি?
হাশর ও কিয়ামত শব্দ দুটি প্রায়ই একসাথে ব্যবহৃত হয়, তবে এদের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। কিয়ামত হলো সেই মহাপ্রলয়, যার মাধ্যমে এই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। আর হাশর হলো কিয়ামতের পরে মৃতদের পুনরুত্থান এবং বিচার দিবসের জন্য একত্রিত হওয়া। কিয়ামত হলো ধ্বংসের শুরু, আর হাশর হলো পুনর্জন্ম ও বিচারের শুরু।
হাশরের দিনের sign বা নিদর্শন গুলো কি কি?
হাশরের কিছু ছোট ও বড় আলামত হাদীসে বর্ণিত আছে। ছোট আলামতগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো:
- জ্ঞানের অভাব
- অধিকহারে খুন খারাবি
- বেপর্দা হওয়া
- গান বাজনার প্রসার
- সুদ ও ঘুষের বিস্তার
আর বড় আলামতগুলো হলো:
- দাজ্জালের আগমন
- ঈসা (আঃ)-এর পুনরাগমন
- ইয়াজুজ ও মাজুজের আত্মপ্রকাশ
- সূর্য পশ্চিম দিক থেকে ওঠা
হাশরের আজাব থেকে মুক্তির দোয়া কী?
হাশরের আজাব থেকে মুক্তির জন্য নির্দিষ্ট কোনো দোয়া নেই, তবে বেশি বেশি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া এবং সৎ আমল করার মাধ্যমে আল্লাহর রহমত আশা করা যায়। এছাড়াও, কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত দোয়াগুলো পড়া যেতে পারে। যেমন:
رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ
উচ্চারণ: “রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনইয়া হাসানাতাওঁ ওয়াফিল আখিরাতি হাসানাতাওঁ ওয়াকিনা আজাবান্নার।”
অর্থ: “হে আমাদের রব! আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দিন এবং আখেরাতেও কল্যাণ দিন এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করুন।” (সূরা আল-বাকারা, ২০১)
এই দোয়াটি নিয়মিত পাঠ করলে আল্লাহর রহমতে হাশরের আজাব থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে।
হাশর বিষয়ক আয়াত
কুরআনে হাশর সম্পর্কে অনেক আয়াত রয়েছে। এখানে কয়েকটি উল্লেখ করা হলো:
-
“যেদিন পৃথিবী তার কম্পনে প্রকম্পিত হবে।” (সূরা আয-যিলযাল, আয়াত ১)
-
“প্রত্যেক মানুষ সেদিন উপস্থিত হবে, তার সাথে থাকবে একজন চালক ও একজন সাক্ষী।” (সূরা ক্বাফ, আয়াত ২১)
-
“এবং সেদিন তাদের আমলনামা পেশ করা হবে।” (সূরা আল-কাহফ, আয়াত ৪৭)
এই আয়াতগুলো হাশরের দিনের ভয়াবহতা এবং বিচারের গুরুত্ব সম্পর্কে আমাদের ধারণা দেয়।
হাশরের ময়দানে নবী করিম (সাঃ) এর ভূমিকা
হাশরের ময়দানে নবী করিম (সাঃ) এর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সেদিন উম্মতের জন্য সুপারিশ করবেন। আল্লাহ তায়ালা তাকে “শাফায়াতে কুবরা” অর্থাৎ সবচেয়ে বড় সুপারিশের অধিকার দান করবেন। নবীর সুপারিশ ছাড়া কেউ মুক্তি পাবে না।
হাশরের মাঠে ৭ শ্রেণীর মানুষ আরশের নিচে ছায়া পাবে
হাদিসে বর্ণিত আছে, হাশরের ময়দানে সাত শ্রেণির মানুষ আরশের নিচে ছায়া পাবে। তারা হলো:
- ন্যায়পরায়ণ শাসক
- যে যুবক আল্লাহর ইবাদতে জীবন কাটিয়েছে
- যার অন্তর মসজিদের সাথে লেগে থাকে
- যারা আল্লাহর জন্য ভালোবাসে এবং আল্লাহর জন্য ঘৃণা করে
- যাদেরকে কোনো সুন্দরী নারী খারাপ কাজের জন্য ডাকলে বলে, আমি আল্লাহকে ভয় করি
- যে দান করে গোপন রাখে, এমনকি ডান হাত দিয়ে দান করলে বাম হাতও জানতে পারে না
- যে গোপনে আল্লাহকে স্মরণ করে কাঁদে
হাশরের গুরুত্ব
হাশরের দিনের উপর বিশ্বাস রাখা ঈমানের অংশ। এই দিনের কথা স্মরণ করে আমরা নিজেদের জীবনকে সুন্দরভাবে পরিচালনা করতে পারি। সৎ পথে চলতে এবং অসৎ কাজ থেকে দূরে থাকতে পারি।
শেষ কথা
হাশর আমাদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই দিনের কথা মনে রেখে আমরা যেন নিজেদের জীবনকে সুন্দর করতে পারি, সেই চেষ্টাই আমাদের করা উচিত। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে হাশরের দিনের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করুন এবং জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করুন। আমিন।